ঋতুচক্র ও রজঃশ্রাব
স্তন্যপায়ী প্রাণীর প্রাইমেট বর্গের প্রাণীকূলের প্রাপ্তবয়স্কা স্ত্রী-প্রাণীর একটি নিয়মিত শারীরীক কার্যক্রম। এর সাথে প্রাইমেটদের প্রজনন কার্যক্রম জড়িত রয়েছে। শৈশবদশা পার হওয়ার পর, প্রাইমেটদের স্ত্রীপ্রাণীরা যৌবনদশায় উপনীত হয় এই ঋতুচক্রের মধ্য দিয়ে। একটি সুনির্দিষ্ট সময় পরে এই ঋতুচক্র চিরতরে বন্ধ হয়ে যায়। ঋতুচক্র শুরু এবং চিরতের বন্ধ হয়ে যাওয়ার মধ্যবর্তীকালীন সময়ে, একই প্রজাতি বা প্রায় সমপ্রজাতির পুরুষ জাতীয় প্রাণীর সাথে যৌনমিলন হলে, স্ত্রী-প্রাণীটি গর্ভবতী হয় এবং সুনির্দিষ্ট সময়ের পর শাবক প্রসব করে। প্রজাতিভেদে ঋতুচক্রের সময়, সমগ্রজীবনে ঋতচক্রের ব্যাপ্তী ইত্যাদি ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে।

স্ত্রী-প্রাণীর একটি সুনির্দিষ্ট সময়ে ডিম্বাশয়ে ডিম্বস্ফোটন হয়। এই ডিম ফ্যালোপিয়ন টিউব দিয়ে জরায়ুতে চলে আসে এবং ৩-৪ দিন অবস্থান করে। এ সময় যদি পুরুষের সঙ্গে যৌনমিলনের মাধ্যমে নারীর ডিম্ব যদি শুক্র দ্বারা নিষিক্ত না হয়, তবে তা নষ্ট হয়ে যায়। এই সময় জরায়ুগাত্রের অভ্যন্তরতম সরস স্তর (এন্ডমেট্রিয়াম) ভেঙ্গে পড়ে। এই ভগ্ন ঝিল্লি, সঙ্গের শ্লেষ্মা ও এর রক্ত বাহ থেকে উৎপাদিত রক্তপাত সব মিশে তৈরি তরল বর্জ হিসাবে নারীর যোনি পথ দিয়ে কয়েকদিন বের হতে থাকে। যোনি  পথে বেরিয়ে আসা তরল বর্জকে রজঃশ্রাব (Menstruation) বলা হয়।

যদি নারী জরায়ুতে অবমুক্ত ডিম্বটি পুরুষের স্খলিত শুক্র দ্বারা নিষিক্ত হযলে, এণ্ডোমেট্রিয়ামে প্রোথিত (ইম্প্ল্যান্টেশন) হয় এবং আর রজঃস্রাব হয় না। তাই মাসিক রজঃস্রাব বন্ধ হয়ে যাওয়া নারীর গর্ভধারণের প্রাথমিক লক্ষণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। অবশ্য শারীরীক সমস্যার কারণে নারীর নিয়মিত রজঃস্রাব নাও হতে পারে।

ঋতুচক্রের দশা : প্রতি মাসে সংঘটিত ঋতুচক্রের অবস্থাগত প্রকৃতিতকে ৩টি দশায় ভাগ করা হয়। এই ভাগগুলো হলো
  • ১ম দশা:  চারদিন স্থায়ী হয় (৪-৭ দিন) এবং একে ঋতুচক্রের প্রাথমিক দশা বলা হয়। এই দশা চলাকালীন সময়ে নারীর যোনিপথ দিয়ে রজঃস্রাব হতে থাকে। ৪-৭ দিন স্থায়ী এই রক্তপাতে ভেঙ্গে যাওয়া রক্তকণিকা ছাড়াও এর সাথে শ্বেত কণিকা, জরায়ুমুখের মিউকাস, জরায়ুর নিঃসৃত আবরণী, ব্যাকটেরিয়া, প্লাজমিন, প্রস্টাগ্লানডিন এবং অনিষিক্ত ডিম্বাণু বের হতে থাকে। ইস্ট্রোজেন এবং প্রজেস্টেরন হরমোনের যৌথ ক্রিয়ার এই পর্বটি ঘটে।
     
  • ২য় দশা ১০দিন (৮-১০ দিন): একে প্রলিফারেটিভ দশা।  শুধু ইস্ট্রোজেন হরমোনের প্রভাবে এটি হয়। এই সময় জরায়ু নিষিক্ত ডিম্বানুকে গ্রহণ করার জন্য প্রস্ততি নেয়। যদি এই সময়ের ভিতর ডিম্বাণু নিষিক্ত না হয়, তাহলে নারীর গর্ভবতী হওয়ার জন্য পরবর্তী ঋতুচক্রের অপেক্ষা করতে হয়।
  • ৩য় দশা : ১৪ দিন (১০-১৪ দিন): সেক্রেটরি দশা। এই দশাটা সবচেয়ে দীর্ঘ।  প্রায় ১০ থেকে ১৪ দিন এই দশা থাকে। এটিও ইস্ট্রোজেন ও প্রজেস্টেরন উভয় হরমোনের যৌথ কারণে হয়। এই সময় নিষিক্ত ডিম্বানুর বৃদ্ধির জন্য জরায়ু সর্বোচ্চ প্রস্ততি নিয়ে থাকে।

মাসিক ঋতুচক্রের মাঝামাঝি (অর্থাৎ ১৪ দিনের মাথায়) লুটিনাইজিং হরমোন (LH) ক্ষরণের ৩৬-৩৮ ঘন্টার মধ্যে ডিম্বকোষ নির্গত হয়। এই বেরুনর পর ডিম্বকোষ যদি ৩৬ ঘন্টার মধ্যে উপযুক্ত সংখ্যক শুক্রকোষ পায় তবে তার একটির সাথে মিলিত হয়ে সন্তান দিতে পারে। তবে ডিম্বকোষটি জীবিত থাকে আরো প্রায় ৩৬ ঘন্টা অর্থাৎ ডিম্বকোষের আয়ু সর্বমোট ৭২ ঘন্টা বা তিনদিন। অন্যদিকে যৌনমিলনের পর জরায়ু তথা ডিম্বনালীতে প্রবেশের পর শুক্রকোষও জীবিত থাকতে পারে সর্বাধিক ৭২ ঘন্টা। তাই ২৮ দিনের মাসিক ঋতুচক্রের মাঝামাঝি মোট প্রায় ১২০ ঘন্টা (৫দিন) হচ্ছে উর্বর সময়,–এই সময় যৌনমিলন হলে সন্তানের জন্ম হতে পারে। মোটামুটি মাসিকের ১৪ দিনের মাথায় ডিম্বকোষ হচ্ছে ধরে নিয়ে তার ২-৩ দিন আগে ও ২-৩ দিন পরে হচ্ছে এই উর্বর সময়।

তবে যারা সন্তান নিতে চান না, তাদের এটিও জেনে রাখা দরকার যে, এই ডিম্বকোষের নির্গমনের (ovalution) দিনটি পরিবর্তিত হয়। তাই এর সঙ্গে আগে ও পরে আরো দু’একদিন যোগ করা ভাল। মাসিক ঋতুচক্রের ৯ম দিনের আগের ও ২০শ দিনের পরেকার সময়কে মোটামুটি নিরাপদ সময় বলে ধরা যায়। এই সময় যৌনমিলন ঘটলে তার থেকে সন্তান ধারণের তথা গর্ভবতী হওয়ার সম্বাবনা থাকে না, কারণ এই সময় ডিম্বকোষ বেরোয়ই না। সাধারণভাবে ৯ম দিনের আগে ও ২০শ দিনের পরের সময়টি নিরাপদ সময় এবং ৯ম-২০শ দিনের মধ্যকার সময়টিকে উর্বর সময় হিসাবে ধরা যায়, আর এর মধ্যেও দ্বাদশ থেকে ষোড়শ (মতান্তরে ১৩ম থেকে ১৭ম) দিনটি উর্বরতম সময়।

রজঃশ্রাবের অনিয়ম
প্রাপ্তবয়স্কা নারীর রজঃস্রাব হওয়াটা একটি স্বাভাবিক রীতি।  আটাশ দিন পর পর নারী তাঁর ঋতু দর্শন করে থাকে। এই রীতিতে বিশেষ বিশেষ কারণে অনিয়মিত হতে পারে। এই অনিয়মকে দুটি ভাগে ভাগ করা হয়। এই ভাগ দুটি হলোস্বাভাবিক অনিয়ম ও অস্বাভাবিক অনিয়ম।

  • স্বাভাবিক অনিয়ম : প্রাকৃতিক নিয়ম অনুসরণেই নারীর রজঃস্রাব অনিয়মিত হতে পারে। এক্ষেত্রে যে কারণগুলো দৃষ্ট হয়, তা হলো
    ১. গর্ভবতী নারীর রজঃস্রাব প্রাকৃতিক কারণে বন্ধ হয়ে যায়।
    ২. ৪০ বা তদূর্ধ্ব বয়সে উপনীত হওয়ার পর, নারীর ঋতুচক্র অনিয়মিত হতে থাকে। এরপর একসময় প্রাকৃতিক নিয়মেই চিরকালের জন্য রজঃস্রাব বন্ধ হয়ে যায়। একে বলা হয় রজঃক্ষান্তি
    (Menopause)।
     
  • অস্বাভাবিক অনিয়ম : একটি নির্দিষ্ট বয়সে এসে নারী প্রথম আদ্যঋতু দর্শন করে। এরপর থেকে গর্ভবতী না হলে বা বয়সের কারণ রজঃস্রাব বন্ধ না হয়ে গেলে, স্বাভাবিকভাবে নির্দিষ্ট সময় পর পর নারী আত্মঋতু দর্শন করে থাকে। এই দুটি কারণ ছাড়া নারীর ঋতুচক্রে ব্যাঘাত ঘটলে, অস্বাভাবিক নিয়ম হিসাবেই বিবেচনা করা হয়। মূলত অনিয়মিত ঋতুচক্র হলো একটি মেয়েলি রোগ। যথাযথ হরমোন ক্ষরণের অভাবে বা কোনো রোগের কারণে ঋতুচক্র অনিয়মিতভাবে সম্পন্ন হতে পারে।