প্রোটো-অস্ট্রালয়েড
ইংরেজি :
Proto-Australoid

নিগ্রোইড মহাজাতি সত্তার একটি আদিম জনগোষ্ঠী। আফ্রিকা বেরিয়ে আসা নৃগোষ্ঠীসমূহের ভিতরে এদেরকে দ্বিতীয় দল হিসেবে উল্লেখ করা হয়। উল্লেখ্য এদের প্রথম বা আদি দল হিসেবে চিহ্নিত করা হয় নেগ্রিটোদেরকে। ১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দে এই নামটি প্রথম ব্যবহার করেছিলেন মার্কিন নৃবিজ্ঞানী Roland Burrage Dixon, তাঁর Racial History of Man গ্রন্থে।

আদিতে প্রোটো-অস্ট্রেলয়েড-রা
ছিল অরণ্যচারী এবং মূলত শিকারী। তারা কৃষি কাজ জানতো না, জীবিকার জন্য নির্ভর করতো বনের ফলমূল আর বন্যপ্রাণী। এদের গায়ের রঙ কালো। মাথার চুল ঘন ও কোঁকড়ানো। এদের মাথার গড়ন ছিল লম্বাটে এবং নাক ছিল চ্যাপ্টা। চিবুক বেশ ছোটো


নৃবিজ্ঞানী এবং ভাষাবিজ্ঞানীদের মতে
প্রায় ২ লক্ষ বৎসর আগে, নর-বানর থেকে আধুনিক মানুষ তথা Homo sapiens (হোমো স্যাপিয়েন্স) নামক প্রজাতিটির আবির্ভাব ঘটেছিল আফ্রিকার ইথিওপিয়া অঞ্চলে। এদের প্রথম দলটিকে সাধারণভাবে নেগ্রিটো নামে অভিহিত করা হয়।  ক্রমে ক্রমে এদের জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকলে, প্রায় ১ লক্ষ ২৫ হাজার খ্রিষ্ট-পূর্বাব্দের দিকে এরা ইথিওপিয়া সংলগ্ন ইরিত্রিয়া, সুদান এবং মিশরের দিকে ছড়িয়ে পড়া শুরু করে।

 

এরপর খ্রিষ্টপূর্ব ৬৫ হাজার অব্দের ভিতরে, আফ্রিকা থেকে অপর একটি দল পৃথিবীর অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। বিজ্ঞানীরা এই দ্বিতীয় দলটিকে প্রোটো-অস্ট্রালয়েড নামে অভিহিত করে থাকেন। প্রায় ৫০-৬০ হাজার খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে এরা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে পড়েছিল। প্রায় ৪০ হাজার খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে এরা সাগর পাড়ি দিয়ে অষ্ট্রেলিয়া মহাদেশে প্রবেশ করেছিল। এরাই হলো অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসী। এদেরকে সাধারণভাবে প্রোটো-অস্ট্রালয়েড বলা হয়।

 

ভারতের প্রোটো-অস্ট্রালয়েড কিশোরী।

এদের অপর একটি দল ইউরোপে প্রবেশ করেছিল খ্রিষ্টপূর্ব ৪৩ হাজার বৎসরে মধ্যে। এই ইউরোপে আগে থেকেই হোমো নিয়ানডার্থালেনসিস নামক প্রাক্ নরগোষ্ঠী বসবাস করতো। সাধারণভাবে এদেরকে বলা হয় নিয়ানডার্থাল বলা হয়।  হোমো স্যাপিয়েন্স প্রজাতির শাখা হিসেবে প্রোটো-অস্ট্রালয়েড ইউরোপে প্রবেশ করার পর নিয়ানডার্থাল-দের সাথে সংঘাতের সৃষ্টি হয় এবং শেষ পর্যন্ত এরা জয়ী হয়ে ইউরোপে বংশ বিস্তার করে। ২৫ হাজার বৎসর পর্যন্ত পশিচম ইউরোপ ও মধ্য-এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাস অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হলেও, এরা অন্যান্য জাতিসত্তার দ্বারা বিতারিত হয় বা বিলুপ্ত হয়ে যায়।

 

হোমো স্যাপিয়েন্স-দের একটি দল সাগর-উপকূল অনুসরণ করে বেরিং প্রণালীতে পৌঁছেছিল। এরপর এই প্রণালী পার হয়ে আমেরিকা মহাদেশে পৌঁছেছিল প্রায় ৩০ হাজার বৎসর আগে।

ধারণা করা ভারতে প্রোটো-অস্ট্রালয়েডদের অনুপ্রবেশ ঘটেছিল খ্রিষ্টপূর্ব ২০-৬ হাজার বৎসর পূর্বে। এদের আগমনের ফলে আদি  নেগ্রিটো-রা অপ্রধান হয়ে পড়ে। হয়তো নেগ্রিটোরা আত্মরক্ষায় অপারগ হয়ে ক্রমে ক্রমে উত্তর ভারতে বিলীন হয়ে গিয়েছিল। কিম্বা এরা দক্ষিণের দিকে সরে গিয়েছিল। কিম্বা এদের সাথে প্রোটো-অস্ট্রালয়েডদের সংমিশ্রণের ফলে নিজেদের জাতিগত স্বতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্য হারিয়েছিল।

 

পুরো ভারতবর্ষ, মায়ানমার এবং তৎসংলগ্ন অঞ্চলে এরা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল। অনেকে মনে করেন সিন্ধু-সভ্যতার আদ্যদশার পত্তন ঘটেছিল এদেরই দ্বারা। পরে তা দ্রাবিড়দের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়। ভারতীয় প্রোটো-অস্ট্রালয়েডরা খাদ্য শস্য এবং শাকসব্জির উৎপাদন করা শিখেছিল।

আদিবাসী হিসেবে ভারতে
নেগ্রিটো-কে সবার আগে স্থান দিলেও মূলত প্রোটো-অস্ট্রালয়েডরাই ভারতরে মূল জনসংখ্যায় পরিণত হয়েছিল। এদের মূল ধারা হিসেবে ভারতবর্ষে রয়েছে কোল, সাঁওতাল, মুণ্ডা (মুণ্ডারি) ইত্যাদি।

এরা যে ভাষায় কথা বলতো, ভাষাবিজ্ঞানীরা তার গোষ্ঠীবদ্ধ নাম দিয়েছেন অষ্ট্রিক। এরা বঙ্গোপসাগরের জাভা বর্ণিও থেকে পশ্চিমে এডেন পর্যন্ত বসতি গড়ে তুলেছিল। এরা অন্যান্য অঞ্চলের মতো বঙ্গদেশেও এরা বসতি গড়ে তুলেছিল। কৃষিজীবি জাতি হিসেবে তারা বঙ্গদেশে ৩০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ থেকেই স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে।

এদের প্রশাসনিক কোনো কাঠামো বঙ্গদেশে গড়ে উঠে নি। ফলে রাষ্ট্রীয় পরিমণ্ডলে স্থায়ীভাবে রাজতন্ত্র গড়ে উঠে নি। এদের কোনো স্থাপত্য নিদর্শন ভারতবর্ষে পাওয়া যায় না। এমন কি এমন কোনো স্থায়ী স্থাপত্য নিদর্শন ছিল কিনা তাও জানা যায় না। এদের সমাজ ছিল দলনেতা ভিত্তিক গোষ্ঠীশাসনতন্ত্র। বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে এদের ছিল অসংখ্য ছোটো ছোটো এরূপ ছোটো ছোটো গোষ্ঠী শাসন ব্যবস্থা। তারপরেও এদের ভিতর সাধারণ সংস্কৃতি প্রায় একই ছিল।


তথ্য সূত্র :
World History- The Human Experience. Mounir Farah, Andrea Berens Karls. MGraw-Hill, 1985
http://www.cristoraul.com/ENGLISH/readinghall/UniversalHistory/INDIA/Cambridge/I/CHAPTER_II.html