গ্রহাণুপুঞ্জ
সৌরজগতের
মঙ্গল ও
বৃহস্পতি গ্রহের
মধ্যবর্তী স্থানে গ্রহের চেয়ে ছোটো ছোটো মহাকাশীয় উপাদান, যা সূর্যকে আবর্তন করে চলেছে। এই
উপাদানগুলোকে বলা হয় গ্রহাণু। আর সকল গ্রহাণুর সমষ্টিগত নাম
গ্রহাণুপুঞ্জ। এই গ্রহাণুপুঞ্জগুলো যে কক্ষপথ ধরে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করছে, তার
মঙ্গল ও
বৃহস্পতি গ্রহের
মধ্যবর্তী অঞ্চলে বলয়াকার সৃষ্টি করেছে। এই অঞ্চলকে বলা হয় গ্রহাণুপুঞ্জ-বলয় (asteroid belt)।
গ্রহাণুতে এখন পর্যন্ত কোনো ধরনের প্রাণের সন্ধান পাওয়া যায় নাই।
আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানে গ্রহাণুগুলোকে ক্ষুদ্র গ্রহ (Minor planet বা Planetoid) বলা হয়। এদের আকার চাঁদের চেয়ে ছোটো। ধারণা করা হয়, দূর-অতীতে কোনো গ্রহ ভেঙে এই গ্রহাণুগুলোর সৃষ্টি হয়েছিল। অনেকে আবার এটাও মনে করেন যে, সৌরজগৎ সৃষ্টির শুরুর দিকে, কিছু বস্তু মঙ্গল ও বৃহস্পতির সাথে মিলিত হতে পারে নি। ফলে সৌরজগত সৃষ্টির পর থেকে এরা স্বাধীনভাবে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করা শুরু করে চলেছে। এই কারণে ধারণা করা হয়, এদের সৃষ্টি হয়েছিল প্রায় ৪৬০ কোটি বৎসর আগে। এরা উপবৃত্তাকার পথে সূর্যকে আবর্তন করে। সকল গ্রহাণুর সূর্য-প্রদক্ষিণ সময় একরকম হয় না। আবার এদের নিজ অক্ষের উপর ঘূর্ণনগতিও সমান নয়। এদের কোনো বায়ুমণ্ডল নাই। প্রায় ১৫০টি গ্রহাণুর উপগ্রহ আছে। কোনো কোনোটির দুটি উপগ্রহ আছে। ১৯৯৩ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম উপগ্রহযুক্ত আইডা (Ida) আবিষ্কৃত হয়। এর উপগ্রহের নাম ডাক্টিল (Dactyl)। আবার চারিক্লো (Chariklo) নামক গ্রহাণুর রয়েছে ঘন এবং সরু বলয়।
অনেক সময় বৃহস্পতি বা মঙ্গলগ্রহের টানে গ্রহাণু কক্ষচ্যূত হয়ে, প্রলয়ঙ্করী কাণ্ড ঘটিয়ে থাকে। ধারণা করা হয়, দূর অতীতে পৃথিবীতে গ্রহাণু আঘাত করেছিল।
গ্রহাণু ভেস্টা |
১৮০১ খ্রিষ্টাব্দে ইতালির বিজ্ঞানী
Giuseppe Piazzi,
গ্রহাণুর সন্ধান পান। এই গ্রহাণুটির নামকরণ করা
হয়েছে সিরেস (Ceres)।
অবশ্য বর্তমানে একে অনেকে ক্ষুদ্রাকার গ্রহ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এর ব্যাস প্রায়
৯৫০ কিলোমিটার। এরপর এই বৎসরেই আবিষ্কৃত হয় প্যালাস (Pallas)
নামক একটি বৃহদাকার গ্রহাণু। এরপর বিভিন্ন সময়ে বহু গ্রহাণু আবিষ্কৃত হয়েছে।
গ্রহাণুগুলোর প্রকৃতি জানার জন্য বেশ কিছু মহাকাশ অভিযান চালানো হয়েছে। ১৯৯১
খ্রিষ্টাব্দে গ্যালিলিও নভোযান গ্যাসপ্রা এবং ১৯৯৩ খ্রিষ্টাব্দে আইডাকে নিকট থেকে
পর্যবেক্ষণ করে। ২০০৭ খ্রিষ্টাব্দে নাসা ভেস্টার উদ্দেশ্যে নভোযান পাঠায়। এটি এই
গ্রহাণু পরীক্ষা শেষে ২০১২ খ্রিষ্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে সেরেস গ্রহাণুর দিকে রওনা
দিয়েছে। এই নভোযান ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দে সেরাস গ্রহাণুতে পৌঁছাবে। এবং ২০০৮ এবং ২০১০
খ্রিষ্টাব্দে নাসা অভিযান চালিয়েছিল। ২০০৫ খ্রিষ্টাব্দে জাপানি নভোযান
Hayabusa নামক নভোযান
আইটোকাওয়া (Itokawa)-তে
অবতরণ করে। এবং এই গ্রহাণুর উপরিতল থেকে পরীক্ষার জন্য উপাদান সংগ্রহ করে।
গ্রহাণুগুলোর গঠন প্রকৃতির বিচারে মোটা দাগে তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়। এই ভাগ তিনটি হলো–
সি প্রকরণ (C-type): অধিকাংশ গ্রহাণু এই শ্রেণির অন্তর্গত। এদের দেহ কাদা এবং সিলিকেট পাথর দ্বারা গঠিত। এদের কালো দেখায়। এগুলোকে সৌরজগতের প্রাচীন গ্রহাণু হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
এস প্রকরণ (S-type): এই শ্রেণির গ্রহাণুগুলো সিলিকেট-ভিত্তিক পাথর এবং নিকেল-লৌহের আকরিক ধরনের পদার্থ দ্বারা তৈরি।
এম প্রকরণ (M-type): এই শ্রেণির গ্রহাণুগুলোকে বলা হয় ধাতব গ্রহাণু। এদের দেহের অধিকাংশ স্থান জুড়ে রয়েছে নিকেল-লৌহের মিশ্র পদার্থ। তবে সকল অংশে এই দুটি পদার্থের মিশ্রণ সমান নয়। ভেস্টা (Vesta) এই জাতীয় গ্রহাণুগুলোর একটি।
গ্রহাণুবলয়ে গ্রহাণুর অবস্থানানুসারে তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়। এই ভাগগুলো হলো–
প্রধান গ্রহাণু বলয় (Main
asteroid belt): অধিকাংশ
গ্রহাণুগুলোর কক্ষপথ
মঙ্গল ও
বৃহস্পতি গ্রহের মধ্যভাগে। এই বলয়টি খুব একটা
প্রশস্ত নয়। এই বলয়ে রয়েছে প্রায় ১০-২০ লক্ষ গ্রহাণু। এদের ভিতর রয়েছে ব্যাস এক
কিলোমিটারের চেয়ে একটু বেশি মাপের গ্রহাণু। আবার বহু ক্ষুদ্রাকার গ্রহাণুও আছে।
ট্রোজান্স (Trojans):
এই জাতীয় গ্রহাণুগুলো নিকটবর্তী কোনো বড় গ্রহের আকর্ষণকে ব্যবহার করে
গ্রহাণুবলয়ে টিকে রয়েছে। একটি বিশেষস্থানে অবস্থানের কারণে সূর্যের আকর্ষণ এবং
গ্রহের আকর্ষণের ভারসাম্যের ভিত্তিতে এরা নিজস্ব কক্ষপথ খুঁজে পেয়েছে। এই
বিশেষ বলয় স্থানকে বলা হয়
Lagrangian points।
এই অঞ্চলটি দুটি ভাগে বিভক্ত। এদের
নাম L4
এবং
L5।
যে গ্রহের আকর্ষণকে কাজে লাগিয়ে গ্রহাণু নিজের কক্ষপথকে ঠিক রাখে, তার
নামানুসারে ট্রোজান্স-এর নাম হয়। এই বিচারে ট্রোজান্স হতে পারে, বৃহস্পতি
ট্রোজান্স, নেপচুন ট্রোজান্স, মঙ্গল ট্রোজান্স। ২০১১ খ্রিষ্টাব্দে নাসার
বিজ্ঞানীরা পৃথিবী ট্রোজান্সে সন্ধান পেয়েছে।
নিকট-পৃথিবীর গ্রহাণুপুঞ্জ (Near-Earth
asteroids): বেশ কিছু
গ্রহাণু রয়েছে, যেগুলোর কক্ষপথ পৃথিবীর খুব কাছে। এদের কিছু কিছু আবার পৃথিবীর
কক্ষপথের ভিতরে ঢুকে পড়ে। এদেরকে বলা হয় পৃথিবী-ভেদী (Earth-crossers)
গ্রহাণু। ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দে এই জাতীয় গ্রহাণুর সন্ধান পাওয়া গেছে প্রায়
১০,০০৩টি। এদের ব্যাস প্রায় এক কিলোমিটার। এদের ভিতর ১৪০৯টিকে পৃথিবীর জন্য
বিপজ্জনক হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। এরা অদূর ভবিষ্যতে পৃথিবীর বুকে আছড়ে পড়তে
পারে।
নিচে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি গ্রহাণুর আবিষ্কারের কালানুক্রমে উল্লেখ করা হলো।
উল্লেখযোগ্য গ্রহাণুর তালিকা
Ceres (1801)
Pallas (1801)
Juno (1804)
Vesta (1807)
Astraea (1847)
Iris (1847)
Flora (1847)
Metis (1848)
Hygiea (1849)
Parthenope (1850)
Victoria (1850)
Egeria (1850)
Irene (1851)
Eunomia (1851)
Psyche (1852)
Thetis (1852)
Melpomene (1852)
Fortuna (1852)
Proserpina (1853)
Bellona (1854)
Amphitrite (1854)
Leukothea (1855)
Fides (1855)
Ida (1993)
তথ্যসূত্র
https://solarsystem.nasa.gov/planets/profile.cfm?Object=Asteroids&Display=OverviewLong