নারীদেহের হাজারও সমস্যার মধ্যে অন্যতম একটি সমস্যা হচ্ছে
জরায়ু
নেমে আসা। গর্ভধারণকালে
নারীর তলপেটের
ভিতরে অবস্থিত জরায়ুর ভিতরে ভ্রূণ বৃদ্ধি পেতে থাকে। এই সময় কিছু মাংসপেশী এবং রগ
(লিগামেন্ট এক ধরনের বন্ধনী যা শরীরের বিভিন্ন অঙ্গকে যথাস্থানে আটকে রাখতে সাহায্য
করে) জরায়ুকে ধরে রাখে। কোনো কারণে এই পেশী ও রগগুলো ছিঁড়ে যায়, ঢিলা হয়ে যায় অথবা
দুর্বল হয়ে পড়ে, তখন জরায়ু যথাযথ স্থানে আর থাকতে পারে না এবং ক্রমান্বয়ে যোনিপথ
দিয়ে বাইরে বের হয়ে আসে।
সম্ভাব্য যে কারণগুলির জন্য
জরায়ু নেমে আসে তা হচ্ছে:
১. অল্প বয়সে গর্ভধারণ করলে জরায়ু ও এর ধারক রগগুলো পূর্ণতা পায় না তাই এগুলি সহজে
দুর্বল হয়ে পড়ে।
২.বার বার গর্ভধারণ করলে জরায়ু ও রগগুলোর উপর ক্রমাগত চাপ পড়তে থাকে, ফলে এদের
স্থিতিস্থাপকতা নষ্ট হয়ে এগুলি ঢিলা হয়ে যায়।
৩. মাসিক বন্ধ হবার পর (মেনোপজ) যখন জরায়ুর ধারক পেশী ও রগগুলো শুকিয়ে যায় তখন
জরায়ু বের হযে আসার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
৪. বাধাগ্রস্ত প্রসবের ক্ষেত্রে আনাড়ি দাই দ্বারা বাচ্চা প্রসব করালে জোরে বাচ্চা
টেনে বের করার সময় রগগুলো ছিঁড়ে যায়, তখন জরায়ু বের হয়ে আসে।
৫. দীর্ঘস্থায়ী প্রসব বেদনার ক্ষেত্রে জরায়ু ও রগগুলো শক্তিহীন হয়ে পড়ে। পরবর্তীতে
জরায়ু নেমে আসার (বিশেষ করে মাসিক বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর) সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
৬. এ ছাড়াও দুর্বল জরায়ুর উপর দীর্ঘদিন যাবৎ কোন চাপ অনুভূত হলে (যেমন দীর্ঘস্থায়ী
কাশি, পেটে বা জরায়ুতে টিউমার, ক্রমাগত ভারি কাজ করা) আস্তে আস্তে জরায়ু বের হয়ে
আসে।
৭. গর্ভবস্থায় ও প্রসবের পর ভারী কাজ করলে, পুষ্টিকর খাবার না খেলে, বিশ্রাম ও
শরীরচর্চা না করলে জরায়ুর আর পূর্বাবস্থায় ফিরে আসা সম্ভব হয় না। ফলে পরবর্তীতে
জরায়ু বের হয়ে আসতে পারে।
জরায়ুর নেমে আসার লক্ষণ
যদিও কখনো কখনো শুরুতেই সম্পূর্ণ জরায়ু যোনিপথে বের হয়ে আসে, তবে বেশিরভাগ
ক্ষেত্রে এটি একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। অর্থাৎ একটু খেয়াল করলে মেয়েদের অনেকেই
অনুভব করতে পারবেন। তাদের কাছে মনে হবে―
যোনিপথে কি যেন বের হয়ে আসছে। বসলে বা কাশি দিলে এই অনুভূত বেশি হয়। এটি জরায়ু নেমে
আসার প্রাথমিক পর্যায়। এই সময়ে জরায়ু যোনিপথে অবস্থান করে। এক্ষেত্রে প্রস্রাব ও
পায়খানায় অসুবিধা হয়। জরায়ু নেমে আসার সময় এর সাথে মূত্রথলি ও মলাশয়ের কিছু অংশ
নেমে আসে যা থলির মতো ঝুলতে থাকে, এই থলিতে কিছু প্রস্রাব ও পায়খানা আটকে থাকে।
হাঁচি বা কাশি দিলে এই আটকে থাকা প্রস্রাব ও পায়খানা হঠাৎ বের হয়ে আসে, তাই
প্রস্রাব ও পায়খানা সম্পূর্ণ করতে এই সময়ে আঙ্গুল দিয়ে জরায়ুকে আবার ভিতরে ঢুকিয়ে
দিতে হয়।
জরায়ু সমস্যার প্রাথমিক এই পর্যায়ে তেমন কোন চিকিৎসা নেই। তবে পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ, শরীরচর্চা এবং শরীরিক ও মানসিক স্বাচ্ছন্দ্য এ অবস্থাকে কিছুটা উন্নত করতে পারে অথবা অবস্থা অপরিবর্তিত রাখতে পারে। কিন্তু এ অবস্থায় আবার গর্ভধারণ করলে, আনাড়ি ধাত্রী দ্বারা প্রসব করালে, ভারী জিনিস উঠালে অথবা দীর্ঘস্থায়ী কাশি হলে এবং অনেকের ক্ষেত্রে মাসিক বন্ধ হওয়ার পর জরায়ু সম্পূর্ণ বের হয়ে আসে।
কোন নারীর জরায়ু যখন যোনিপথ দিয়ে অসম্পূর্ণ বের হয়ে দু’পায়ের মাঝখানে ডিম বা বলের আকারে ঝুলতে থাকে তখন প্রস্রাব ও পায়খানার সমস্যা ছাড়াও তার স্বাভাবিক জীবনধারায় বিঘ্ন ঘটে। তখন তিনি স্বাভাবিকভাবে বসতে পারেন না, হাঁটা-চলায় সমস্যা বোধ করেন ও সহবাসে তার সমস্যা হয়। পরবর্তীতে সেখানে ঘাঁ বা ক্ষতের সৃষ্টি হয় এবং নানা জটিলতা দেখা দেয়।
সাধারণত অস্ত্রোপচার-এর মাধ্যমে তখন জরায়ু অপসারণ করা হয়। তবে অস্ত্রোপচারটি বেশ জটিল, দীর্ঘ ও ঝুঁকিপূর্ণ। জেলা হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এ ব্যবস্থা আছে।
জরায়ু নেমে আসা প্রতিরোধে
আমাদের করণীয়:
১. নিজের সমস্যা নিজেকেই চিহ্নিত করতে হবে এবং সমস্যার শুরুতেই চিকিৎসকের পরামর্শ
নিতে হবে
২. অল্প বয়সে বিয়ে করা ও বিয়ে দেয়া থেকে বিরত থাকতে হবে
৩. ঘন ঘন বাচ্চা না নেয়া- এজন্য প্রথম বাচ্চা হবার পর থেকেই জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি
ব্যবহার করা বাঞ্ছনীয় এবং দ্বিতীয় বাচ্চা নেয়ার আগে অন্তত তিন বছরের বিরতি
স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী
৪. বেশী বাচ্চা না নেয়া- এজন্য দু’টি বাচ্চা হবার পর দীর্ঘস্থায়ী বা স্থায়ী
জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে
৫. গর্ভকালীন ও প্রসব পরবর্তী সময়ে ভারী কাজকর্ম করা থেকে বিরত থাকতে হবে। পুষ্টিকর
খাদ্য গ্রহণ, শরীরচর্চা ও নিয়মিত জরায়ুর ধারক মাংসপেশী, রগ ও অঙ্গগুলোর ব্যায়াম
(পেরিনিয়াল এক্সারসাইজ) করতে হবে
৬. চিকিৎসক, নার্স বা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ধাত্রীর সাহায্যে সন্তান প্রসব করাতে হবে
৭. প্রসব বিলম্বিত হলে প্রসূতিকে অবশ্যই হাসপাতালে নিতে হবে।
চিকিৎসকদের প্রতি আবেদন:
১. দুটি বাচ্চা হবার পর স্থায়ী জন্মনিয়ন্ত্রণে নারী ও তার স্বামীকে উৎসাহী করুন
২. প্রথম বাচ্চা হবার পর থেকেই নারীদের জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার করতে উৎসাহিত
করুন
৩. জরায়ুর সমস্যা নিয়ে কোন নারী এলে সাধ্যমত চিকিৎসা ও পরামর্শ দিন, চিকিৎসার
সুযোগ-সুবিধা না থাকলে উন্নত স্বাস্থ্য কেন্দ্রে প্রেরণ করুন।
সূত্র : http://www.naripokkho.org.bd/