স্বর্ণ
[ স্বর্ণ (অভিধান)]

প্রতীক Au
পারমাণবিক ওজন ১৯৭.০
পারমণবিক সংখ্যা ৭৯
ইলেক্ট্রোন সংখ্যা ৭৯
প্রোটোন ৭৯
ইলেক্টোন কক্ষ: ২ ৮ ১৮ ৩২ ১৮ ১
ইলেক্ট্রোন শক্তিবিন্যাস :
4f14 5d106s1
গলনাঙ্ক :  ১০৬৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
স্ফুটনাঙ্ক : ২৮৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
আপেক্ষিক গুরুত্ব: ১৯.৩২ গ্রাম/ঘন সেমি

অত্যন্ত মূল্যবান ধাতু মৌলিক পদার্থ এর রঙ দ্যুতিময় হলুদ। তাই এই ধাতুর রঙ অনুসারে রঙের নাম ধরা হয় সোনালি বা স্বর্ণালী। ল্যাটিন নাম aurum । এই নাম থেকে সোনার Au প্রতীক গ্রহণ করা হয়েছে।

এটি অত্যন্ত নমনীয়। সহজেই এই ধাতুকে পাতলা পাতে পরিণত করা যায়। স্বরণ তাপ ও বিদ্যুৎ পরিবাহী। 

এর একটি মাত্র সুস্থির আইসোটোপ রয়েছে এই আইসোটোপটি হলো
১৯৭ Au । অন্যান্য  আইসোটোপগুলোর ভিতর ১৯৫Au-এর আয়ুষ্কাল ১৮৬.১০ দিন। অন্যান্য আইসোটোপগুলো হলো ১৯৬Au-এর আয়ুষ্কাল ৬.১৮৩ দিন, ১৯৮Au-এর আয়ুষ্কাল ২.৬৯৫১৭ দিন, ১৯৯Au-এর আয়ুষ্কাল ৩.১৬৯ দিন।

জাপানের তোই যাদুঘরে রক্ষিত ২৫০ কেজি ওজনের স্বর্ণদণ্ড

স্বর্ণ রক্ষণ ও পরিমাপ
খনি থেকে বা প্রাকৃতিকভাবে অন্য কোনো সূত্রে প্রাপ্ত স্বর্ণ রাষ্ট্রীয় সম্পদ হিসাবে বিবেচনা করা হয়। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় ব্যাংকের কাছে স্বর্ণ রক্ষিত হয়। সাধারণতঃ বিশুদ্ধ সোনাকে দণ্ডাকারে বা ব্লকাকারে রক্ষা করা হয়।

ক্যারেট
গ্রিক
kerátion (κεράτιον) ক্ষুদ্র শিঙ। আরবি قيراط> ইতালি carato> মধ্য ফ্রান্স carat> ইংরেজি ১৫শ শতাব্দী carat ভিন্ন বানান Karat> বাংলা ক্যারেট।

সাধারণভাবে স্বর্ণকে অন্যান্য ধাতুর মতো সিজিএস পদ্ধতিতে গ্রাম অনুসারে পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু বিশুদ্ধতার বিচারে স্বর্ণের মান নির্ধারণ করা হয় ক্যারেট (Carat) হিসাবে। মূলত স্বর্ণ বা প্লাটিনাম প্রধান সঙ্কর ধাতুর জন্য এই মান ব্যবহার করা হয়। এর প্রতীক  K বা Kt

কোনো সঙ্কর ধাতুতে সোনা বা প্লাটিনামের ভর এবং মোট সঙ্কর ধাতুর অনুপাতের সাথে গুণগতমানের গুণিতক মান হলো ক্যারেট। এই গুণিতক মানের সর্বোচ্চ ধাপ হলো ২৪। এই বিচারে ২৪ ক্যারেট স্বর্ণ বা প্লাটিনামের সূত্রটি হবে
           

এখানে

X =ক্যারেট
24= গুণগত মান
Mg= ধাতব খণ্ডে বিশুদ্ধ স্বর্ণ বা প্লাটিনামের ভর
Mm= ধাতব খণ্ডের ভর

এই বিচারে
    ২৪ ক্যারেট স্বর্ণখণ্ডে স্বর্ণের পরিমাণ থাকে ৯৯.৯ ভাগ।
    ১৮ ক্যারেট স্বর্ণখণ্ডে স্বর্ণের পরিমাণ থাকে ১৮ ভাগ, বাকি  ৬ ভাগ থাকে অন্য দ্রব্য।
    ১২ ক্যারেট  স্বর্ণখণ্ডে স্বর্ণের পরিমাণ থাকে ১২ ভাগ, বাকি ১২ ভাগ থাকে অন্য দ্রব্য।

সোনার ইতিহাস :
প্রখ্যাত জার্মান সমাজতত্ত্ববিদ কার্ল মার্ক্স তাঁর
'A contribution to the critique of Political economy" গ্রন্থে সোনাকে মানুষের আবিষ্কৃত প্রথম ধাতু হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। দুষ্প্রাপ্য এবং অপরিবর্তনশীল ধাতু হিসাবে সোনার ব্যবহার শুরু হয়েছিল মানব সভ্যতার প্রাচীন কাল থেকেই।  বিশেষ করে এর রঙ এবং নমনীয়তার গুণে সোনার মহার্ঘ ধাতুতে পরিণত হয়েছিল অলঙ্কার শিল্পে। চীন, ভারত, মেসেপোটিয়াম, মিশর ইত্যাদি সকল প্রাচীন সভ্যতায় সোনার ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়।

মানুষ খনি থেকে সোনা উত্তোলনের আগে, বিভিন্ন নদীর স্রোতে বা পাহাড়ি এলাকায় সোনা পেতো টুকরো হিসাবে। বিভিন্ন অপদ্রব্য থেকে সোনাকে পৃথক করার পদ্ধতি প্রাচীন কালের মানুষ জানতো, কিন্তু বিশুদ্ধ সোনা তারা ব্যবহার করতো না। সে সময় সোনা-রুপার সঙ্কর ধাতু তৈরি করা হতো। এই ধাতুর নাম ছিল অ্যাজেম নামে পরিচিত ছিল। প্রকৃতি থেকে প্রাপ্ত সোনা-রুপার সঙ্কর ধাতুকে বলা হতো ইলেকট্রুম।

মিশরীয় ফারাও সম্রাটদের নির্মিত পিরামিডগুলোতে সোনার অলঙ্কার ও জিনিসপত্র  পাওয়া যায়। খনি থেকে প্রাপ্ত সোনাতে সেকালে মিশরের মানুষের মন ভরে নি। তাই কিছু সোনা তৈরির জন্য অবিরাম চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছিল। এদেরকে বলা হয়- আলকিমিয়া। তামার খনিতে লোহা পড়ে থাকলে, লোহার উপরে তামার আস্তরণ পড়ে। সে সময়ের মানুষ মনে করতো যে, লোহাই তামায় রূপান্তরিত হয়। এই বিশ্বাস থেকে তারা ধারণা করেছিল যে, অন্য ধাতুকে সোনায় পরিণত করা সম্ভব। এর ফলে বহু গবেষক অন্য ধাতুকে সোনায় পরিণত করার জন্য গবেষণা শুরু করেছিল। আরেকদল মানুষ মনে করতো, কোনো বিশেষ ধরনের পদার্থ তৈরি করা সম্ভব, যা দিয়ে অন্য ধাতুকে স্পর্শ করলেই তা সোনা হয়ে যাবে। এই কাল্পনিক পদার্থকে তারা নাম দিয়েছিল পরশ পাথর। যদিও এই গবেষণার সূত্রে অন্য ধাতুকে সোনায় পরিণত করা সম্ভব হয় নি, কিন্তু এই গবেষণার সূত্রে রসায়ন বিদ্যার অভাবনীয় বিকাশ ঘটেছিল।

খ্রিষ্টপূর্ব অষ্টম-সপ্তম শতাব্দীতে গ্রিসে সোনার মুদ্রার প্রচলন ছিল। এছাড়া মধ্য এশিয়াতেই স্বর্ণমুদ্রার প্রচলন করেছিলেন বিভিন্ন সম্রাটরা। দক্ষিণ ও মধ্য আমেরিকা স্পেনীয়রা নাবিকরা অভিযান পরিচালনার সময়, পেরুর প্রাচীন ইন্‌কা সভ্যতায় সোনার সন্ধান পেয়েছিল। ইন্‌কা সভ্যতায় সোনা গুপ্ত ধাতু তথা সূর্য দেবতার ধাতু হিসাবে বিবেচনা করা হতো। দেবতার সম্পত্তি হিসাবে তাঁরা তাঁদের মন্দিরগুলোতে বিপুল পরিমাণ সোনা বিশেষ মর্যাদায় রক্ষা করতেন। ইন্‌কাদের নেতা আটাহুয়ালপাকে যখন স্পেনীয়রা বন্দী করেছিল। তাঁর মুক্তির জন্য ইন্‌কারা, মুক্তিপণ হিসেবে ৬০ ঘনমিটার সোনা দেয়ার প্রতিশ্রুতি করেছিল। এবং প্রতিশ্রুতি মতে প্রায় ১১০০ পুরোহিত ও কর্মী বহন করে রওনা দিয়েছিল। কিন্তু স্পেনীয় সেনানায়ক ফ্রান্সিস্‌কো পিজারো আটাহুয়ালপাকে মুক্তি দেওয়ার পরিবর্তে হত্যা করেছিল। ইন্‌করা এই হত্যার সংবাদ জানার পর তারা সোনাগুলো অ্যাজানগারের পর্বতে লুকিয়ে রাখে। পরে স্প্যনিশ যোদ্ধারা পেরুর সমৃদ্ধতম নগরগুলো ধ্বংস এবং সোনাসহ অন্যান্য দ্রব্য  লুট করেছিল।

স্বর্ণ খনি
এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত সর্ববৃহৎ স্বর্ণখনিটি হলো - দক্ষিণ আফ্রিকার জোহান্সবার্গের স্বর্ণখনি। অন্যান্য উল্লেখযোগ্য স্বর্ণখনি রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, অষ্ট্রেলিয়া, পেরুতে। এছাড়া চিলি ও আর্জেন্টিনার সীমান্ত বরাবর আটাকামা মরুভূমিতে, চীন ও ভারতে স্বর্ণ খনি রয়েছে।


সূত্র :
রাসায়নিক মৌল। দ,ন, ত্রিফোনভ, ভ.দ. ত্রিফোনভ। মির প্রকাশন, ১৯৮৮।
বাংলা একাডেমী বিজ্ঞান বিশ্বকোষ। দ্বিতীয় খণ্ড। কার্তিক ১৪০৬/নভেম্বর ১৯৯৯।