আখতারুজ্জামান
মোহাম্মদ ইলিয়াস
কথা সাহিত্যিক
১৯৪৩ খ্রিষ্টাব্দের ১২ ফেব্রুয়ারি গাইবান্ধা
জেলার সাঘাটা থানার গোটিয়া গ্রামে, মাতামহের বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর ডাকনাম
ছিলমঞ্জু। পিতার নাম বিএম ইলিয়াস। মায়ের নাম মরিয়ম। তিনি ছিলেন পিতামাতার
প্রথম সন্তান। তাঁর ছোট তিন ভাইয়ের নাম শহীদুজ্জামান ইলিয়াস, নূরুজ্জামান ইলিয়াস ও
খালেকুজ্জামান ইলিয়াস।
উল্লেখ্য, তাঁর পিতা বগুড়া জেলার সারিয়াকান্দি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক
ছিলেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি রাজনীতি করতেন। ইলিয়াসের জন্মের সময় তিনি ছিলেন
পূর্ববাংলা মুসলিম লিগের বগুড়া জেলার সেক্রেটারি।
ইলিয়াসের পূর্বপুরুষদের বাড়ি ছিল বগুড়ার সারিয়াকান্দি থানার চন্দনবাইশা গ্রামে।
সেখান থেকে এসে ইলিয়াসের দাদা বাড়ি করেন বগুড়া শহরের উপকণ্ঠে করতোয়া নদীর তীরবর্তী
নারুলি গ্রামে। এই নারুলি গ্রামেই ইলিয়াসের শৈশবের প্রথম চার বছর কাটে। ১৯৪৬
খ্রিষ্টাব্দের নির্বাচনে ইলিয়াসের বাবা বঙ্গীয় প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত
হন। পাকভারত বিভাজনের পর, ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দে তিনি প্রাদেশিক আইন পরিষদের
পার্লামেন্টারি সেক্রেটারি নিযুক্ত হন। এ সময় ইলিয়াসের বাবা সপরিবারে ঢাকায় চলে
আসেন।
১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস এবং শহীদুজ্জামান ইলিয়াসকে ঢাকার
সেন্ট ফ্র্যান্সিস জেভিয়ার্স স্কুলে স্কুলে ভর্তি করানো হয়। ১৯৫০
খ্রিষ্টাব্দে তিনি এ স্কুল ছেড়ে ঢাকার কেএল জুবিলি স্কুলে দ্বিতীয় শ্রেণীতে ভর্তি
হন। তৃতীয় শ্রেণির পাঠ শেষ না করেই, ১৯৫১ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে
চতুর্থ শ্রেণিতে ভর্তি হন।
১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর বাবা-মা ঢাকা থেকে বগুড়াতে চলে যান। এই সময় তিনি বগুড়া জেলা স্কুলে ভর্তি হন। স্কুলে পড়ার সময় তাঁর লেখালেখির হাতেখড়ি হয়। এসময় কলকাতা থেকে প্রকাশিত 'সত্যযুগ' ও 'আজাদ' পত্রিকায় ছোটদের পাতায় তাঁর কিছু রচনা ছাপা হয়। দশম শ্রেণীতে পড়ার সময় 'সওগাত'-এ তাঁর প্রথম ছোটগল্প ছাপা হয়।
১৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দে বগুড়া জিলা স্কুল থেকে
মাধ্যমিক পাস করেন এবং ঢাকা কলেজে ভর্তি হন। তিনি থাকতেন ঢাকা কলেজের নর্থ
ছাত্রাবাসে। এই সময় তিনি প্রচুর গল্প লেখেন। অবশ্য সে সময় তাঁর খুব সামান্য অংশই
পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল।
১৯৬০ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন তিনি। এরপর পর তিনি ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে ভর্তি হন। এই সময় তিনি ফজলুল হক মুসলিম ছাত্রাবাসে
থাকতেন।
১৯৬১ খ্রিষ্টাব্দে তিনি চিকেন পক্সে আক্রান্ত হয়ে বেশ কিছুদিন মিটফোর্ড হাসপাতালে
ছিলেন। হাসপাতালের অভিজ্ঞতা নিয়ে পরে 'অতন্দ্র' নামের একটি গল্প লেখেন।
১৯৬৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ইলিয়াস ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে এম এ পাস করেন। এই বৎসরে তিনি সাহিত্য বিষয়ক পত্রিকা 'স্বাক্ষর'-এর সঙ্গে জড়িত হন। এ বছরই আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ সম্পাদিত 'সাম্প্রতিক ধারার গল্প' নামক একটি গ্রন্থে ইলিয়াসের 'স্বগত মৃত্যুর পটভূমি' নামে একটি গল্প অন্তর্ভুক্ত হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করে, তিনি করটিয়া সা'দত কলেজে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। কিন্তু কর্তৃপক্ষের সঙ্গে মতের মিল না হওয়ায় দু-তিন দিন পর চাকরিটি ছেড়ে দেন তিনি। এরপর ১৯৬৫ খ্রিষ্টাব্দের আগস্ট মাসে ঢাকার জগন্নাথ কলেজে তিনি প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন।
১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসে লিটল
ম্যাগাজিন 'আসন্ন'-তে 'চিলেকোঠায়' নামে তাঁর একটি গল্প প্রকাশিত হয়।
১৯৬৮ খ্রিষ্টাব্দের গণআন্দোলনের সময় তিনি প্রায় প্রতিটি রাজনৈতিক সভায় যোগদান
করতেন। বিশেষ করে মওলানা ভাসানীর প্রায় প্রতিটি সভায় তিনি উপস্থিত থাকতেন এবং
মিছিলে অংশগ্রহণ করতেন। সেই সময় চীনের তৎকালীন সাংস্কৃতিক বিপ্লব এবং পরে ভারতের
নকশাল বাড়ি আন্দোলনের ঘটনাপ্রবাহ সমর্থন করেছেন।
১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে মুক্তিযুদ্ধে ইলিয়াস গ্রামের বাড়িতে চলে যান। সে সময় তাঁর বাড়িতে
মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দেন।
১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দে সিরাজগঞ্জের মহিলা কলেজের শিক্ষিকা সুরাইয়া (ডাকনাম
তুতুল)-র সাথে তাঁর বিবাহ হয়। বিয়ের পর তুতুল সিরাজগঞ্জের মহিলা কলেজ থেকে
চাকরি ছেড়ে ইলিয়াসের কাছে ঢাকায় চলে আসেন।
১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দে জন্ম নেয় তাঁদের প্রথম সন্তান আন্দালিব।
১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দে 'চিলেকোঠায়' নামে তাঁর
প্রথম উপন্যাস 'দৈনিক সংবাদ'-এর সাহিত্য পাতায় ধারাবাহিকভাবে ছাপা শুরু হয়। কিন্তু
ওই সময় সরকার পরিবর্তন হওয়ায় 'সংবাদ' কর্তৃপক্ষ উপন্যাসটি প্রকাশ বন্ধ করে দেয়।
১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয় ইলিয়াসের প্রথম গল্পগ্রন্থ 'অন্য ঘরে অন্য স্বর'।
১৯৭৭ খ্রিষ্টাব্দে তিনি হুমায়ুন কবির স্মৃতি পুরস্কারে ভূষিত হন।
১৯৮১ খ্রিষ্টাব্দে জানুয়ারিতে সাপ্তাহিক
'রোববার' পত্রিকায় তাঁর প্রথম উপন্যাস 'চিলেকোঠার সেপাই' ধারাবাহিকভাবে ছাপা শুরু
হয়।
১৯৮২ খ্রিষ্টাব্দের সেপ্টেম্বরে রাজশাহীর 'তরঙ্গ প্রকাশনী' হতে তার গল্পগ্রন্থ
'খোঁয়ারি' প্রকাশিত হয়।
১৯৮৩ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারিতে সাপ্তাহিক 'রোববার'-এ 'চিলেকোঠার সেপাই' ছাপা শেষ
হয়। এই বৎসরে তিনি বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন।
১৯৮৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি জগন্নাথ কলেজে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতি পান। এই
বৎসরে তিনি 'বাংলাদেশ লেখক শিবিরে' যোগ দেন এবং লেখক শিল্পীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা
আন্দোলনে আমৃত্যু সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন।
১৯৮৫ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর 'দুধ ভাতে উৎপাত' শিরোনামে তাঁর আরেকটি গল্পগ্রন্থ
প্রকাশিত হয়।
১৯৮৬ খ্রিষ্টাব্দে অক্টোবরে 'ঢাকা ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড' হতে বই আকারে
প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম উপন্যাস 'চিলেকোঠার সেপাই'।
১৯৮৭ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারি মাসে ইলিয়াস
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের উপপরিচালক হিসেবে যোগ দেন এবং ডিসেম্বরে সরকারি সঙ্গীত
মহাবিদ্যালয়ের উপাধ্যক্ষ নিযুক্ত হন। এই বৎসরে তিনি আলাওল সাহিত্য পুরস্কার অর্জন
করেন।
১৯৮৮ খ্রিষ্টাব্দের ভয়াবহ বন্যায় তিনি সরাসরি ত্রাণ কাজে অংশগ্রহণ করেন।
১৯৮৯ খ্রিষ্টাব্দে গল্পগ্রন্থ 'দোজখের ওম' প্রকাশিত হয়।
১৯৯০ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশ লেখক শিবিরের উদ্যোগে আয়োজন করা হয় তিন দিনব্যাপী
'জাতীয় সাহিত্য সম্মেলন'। এ সম্মেলনেও মূখ্যভূমিকা পালন করেন তিনি।
১৯৯২ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর রচনা নিয়ে চট্টগ্রাম থেকে এজাজ ইউসুফ সম্পাদিত 'লিরিক'
সাহিত্য পত্রিকার একটি বিশেষ সংখ্যা বের হয়।
১৯৯৩ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারি মাসে ইলিয়াসের পঞ্চাশ বছরপূর্তি উপলক্ষে কলকাতার
'একুশে প্রকাশনী' প্রকাশ করে তাঁর একটি গল্পগ্রন্থ। এপ্রিল মাসে কলকাতার বাংলাদেশ
মিশন কর্তৃক আয়োজিত গ্রন্থমেলায় অনুষ্ঠিত একটি সেমিনারে অংশগ্রহণের জন্য বাংলাদেশ
প্রতিনিধিদলের সদস্য হিসেবে তিনি কলকাতা সফরে যান। এ বছর জুন মাসে কলকাতার প্রতিভাস
প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয় 'চিলেকোঠার সেপাই' উপন্যাসটি।
১৯৯৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ঢাকা কলেজের অধ্যাপক হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এই বৎসরে 'দৈনিক জনকণ্ঠ'-এর সাহিত্যপাতায় তাঁর 'খোয়াবনামা' নামক উপন্যাস ধারাবাহিকভাবে ছাপা হতে শুরু হয়। পুরো উপন্যাস প্রকাশিত হওয়ার আগে 'জনকণ্ঠ' কর্তৃপক্ষ রাজনৈতিক কারণে 'খোয়াবনামা' ছাপা বন্ধ করে দেয়। এই বৎসরের জুলাই মাসে লেখক- শিল্পীদের উপর ধর্মীয় ফ্যাসিবাদীদের আক্রমণ ও 'ব্লাসফেমি আইন' প্রণয়নের চক্রান্তের বিরুদ্ধে তিনি রুখে দাঁড়ান, নেতৃত্ব দেন 'বাংলাদেশ লেখক শিবিরের'।
১৯৯৫ খ্রিষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে স্ত্রীর
চিকিৎসার জন্য সস্ত্রীক কলকাতায় যান এবং শান্তিনিকেতন ভ্রমণ করেন। অক্টোবর মাসে
তাঁর মায়ের মৃত্যু হয়। এরপর থেকে তিনি পায়ে ব্যথা অনুভব করতে থাকেন। প্রথম দিকে
চিকিৎসকরা বাতের ব্যথা হিসেবে চিকিৎসা শুরু করেন। কিন্তু পরে তাঁর পায়ের হাড়ে
ক্যান্সার ধরা পড়ে ।
১৯৯৬ খ্রিষ্টাব্দের ২০শে মার্চ তাঁর ডান পা সম্পূর্ণ কেটে ফেলা হয়। এই বৎসরের
এপ্রিল মাসে 'খোয়াবনামা'র জন্য পান প্রফুল্ল কুমার সরকার স্মৃতি আনন্দ পুরস্কার এবং
সাদাত আলী আকন্দ পুরস্কার। এবছর কাজী মাহবুবউল্লাহ স্বর্ণপদক নামে আরেকটি পুরস্কার
পান তিনি।
১৯৯৭ খ্রিষ্টাব্দের ৪ জানুয়ারি তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
একনজরের তাঁর পুরস্কার
১৯৭৭ খ্রিষ্টাব্দ। হুমায়ুন কবির স্মৃতি পুরস্কারে ভূষিত হন। বাংলাদেশ লেখক শিবির
সংঘ তাঁকে এই পুরস্কারে ভূষিত করেন।
১৯৮৩ খ্রিষ্টাব্দ। ইলিয়াস বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন।
১৯৮৭ খ্রিষ্টাব্দ। আলাওল সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন।
১৯৯৬ খ্রিষ্টাব্দ। এপ্রিলে মাসে 'খোয়াবনামা'র জন্য পান প্রফুল্ল কুমার সরকার স্মৃতি
আনন্দ পুরস্কার এবং সাদাত আলী আকন্দ পুরস্কার। এবছর কাজী মাহবুবউল্লাহ স্বর্ণপদক
নামে আরেকটি পুরস্কার পান তিনি।
১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দ।
একুশে পদক
(মরণোত্তর)
প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ:
অন্য ঘরে অন্য স্বর (১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দ)
খোঁয়ারি (১৯৮২ খ্রিষ্টাব্দ)
দুধভাতে উৎপাত (১৯৮৫ খ্রিষ্টাব্দ)
দোজখের ওম (১৯৮৯ খ্রিষ্টাব্দ)
জাল স্বপ্ন স্বপ্নের জাল (১৯৯৭ খ্রিষ্টাব্দ)
প্রবন্ধের বই:
সংস্কৃতির ভাঙা সেতু
উপন্যাস:
চিলেকোঠার সেপাই (১৯৮৭
খ্রিষ্টাব্দ)
খোয়াবনামা (১৯৯৬
খ্রিষ্টাব্দ)
তথ্যসূত্র:
আখতারুজ্জামান ইলিয়াস সমগ্র, দ্বিতীয় খণ্ড, মওলা ব্রাদার্স
আখতারুজ্জামান ইলিয়াস স্মারকগ্রন্থ
ফিরে দেখা সারাজীবন, দ্বিতীয় খণ্ড ( সম্পাদক-মুজিবুল কবীর ও মাহবুব কামরান) ও
খালেকুজ্জামান ইলিয়াস।