আমেরিগো ভেচপুচি
Amerigo Vespucci
১৪৫৪-১৫১২ খ্রিষ্টাব্দ
ইতালির প্রখ্যাত নৌঅভিযাত্রী এবং দক্ষিণ আমেরিকার প্রথম সন্ধান দাতা।

১৪৫৪ খ্রিষ্টাব্দের ৯ই মার্চ, তৎকালীন ইতালি উপদ্বীপের ফ্লোরেন্স রিপাব্লিকে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম সার্ নাস্তাগিও (আনাস্তাসিও) ভেসুপুচি (Ser Nastagio (Anastasio) Vespucci) , মায়ের নাম লিবসবাটা মিনিরে (Lisabetta Mini) । তিনি ছিলেন পিতামাতার তৃতীয় পুত্র।

শৈশবে তিনি প্রতিপালিত হয়েছিলেন তাঁর চাচা ফোর জর্জজি অ্যান্টোনিও ভেসপুচি'র কাছে। ১৪৭৯ খ্রিষ্টাব্দে ফ্রান্সের মেসিসি শহরের জনৈক আত্মীয়ের সুবাদে তাঁর পিতা ফ্রান্সের সম্রাটের অনুগ্রহ লাভ করেন। এই কারণে তাঁর পিতা ইতালি থেকে ফ্রান্সে চলে আসেন। পিতার সাথে ফ্রান্সে থাকার সময় তিনি উচ্চ শিক্ষা লাভ করেন। এরপর তিনি ইতালির মেডিসি হাউস নাম বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে কেরানি হিসেবে কাজ শুরু করেন। এই প্রতিষ্ঠানের কর্ণধর লোরেঞ্জো ডি পিয়েরফ্রাসেস্কো ডি মেডিসি, তাঁকে খুব পছন্দ করতেন। মাত্র ১৮ বৎসর বয়সে মেডিস'র গুরুত্বপূর্ণ এজেন্ট হিসেবে স্পেনের কাডিজ-এ অফিস ম্যানেজারে দায়িত্ব পান।

১৪৯৫ খ্রিষ্টাব্দের এপ্রিল মাসে, বিশপ জুয়ান রদ্রিগেজ ডি ফোন্সেসের প্ররোচনায়, স্পেন সরকার ওয়েস্ট ইন্ডিজ অভিযানে
ক্রিস্টোফার কলম্বাসের একচেটিয়া অধিকার চুক্তি বাতিল করেন। এই সময় সরকার বিভিন্ন নৌ অভিযাত্রীদের ওয়েস্ট ইণ্ডিজে যাওয়ার লাইসেন্স দিতে থাকে। এই বৎসরেই তিনি গিয়ান্নোটো বেরাডি নামক জনৈক ব্যবসায়ীর সাথে যুক্ত হন। এই প্রতিষ্ঠানের মূল ব্যবসা ছিল সামুদ্রিক জাহাজ তৈরি এবং জাহাজের খাদ্য ও অন্যান্য সরঞ্জাম সরবরাহ করা। উল্লেখ্য ক্রিস্টোফার কলম্বাস যখন ১৪৯২ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম সমুদ্র অভিযানে যান, তখন তাঁর জাহাজের সকল সামগ্রী সরবরাহ করেছিল বেরাডির কোম্পানি।

১৯৪৫ খ্রিষ্টাব্দেই গিয়ান্নোটো বেরাডি মৃত্যুবরণ করলে, আমেরিগো ভেসপুচি বেরাডি কোম্পানির সর্বময় ক্ষমতা লাভ করেন। পর্তুগালের রাজা ম্যানুয়েল প্রথম এর আমন্ত্রণে ভেসপুচি দক্ষিণ আমেরিকা অভিযানের যাবতীয় অভিযাত্রীদের তত্ত্বাবধায়কের দায়িত্ব পালন করেন।  ১৪৯৭ খ্রিষ্টাব্দে তিনি প্রথম সমুদ্রযাত্রায় অংশ গ্রহণ করেন। অবশ্য এই ভ্রমণ নিয়ে কেউ কেউ সন্দেহ প্রকাশ করেন।

১৪৯৯ খ্রিষ্টাব্দের মে মাসে, দ্বিতীয়বার একটি স্প্যানিশ জাহাজে সমুদ্র-অভিযানে অংশগ্রহণ করেন। এই জাহাজের ক্যাপ্টেন ছিলেন এ্যালোঞ্জো ডে ওজেদা। এই যাত্রায় তিনি ইকুয়েডর এবং বর্তমান গায়নার উপকূল ধরে ভ্রমণ করেন। এরপর ভেচপুচি ওজেদাকার সঙ্গ ত্যাগ করে ব্রাজিলের উপকূলের দিকে চলে যান। এই সময় তিনি আমাজান নদীর সন্ধান পান। এছাড়া বর্তমান সেন্ট অগাস্টিন অন্তরীপ দেখতে পান। এখান থেকে ফেরার পথে তিনি ত্রিনিনাদে যান এবং ওরিনোকো নদীর মোহনা দেখতে পান। এরপর তিনি আরও দক্ষিণে অগ্রসর হয়ে হাইতির সন্ধান পান। এরপর তিনি স্পেনে ফিরে আসেন।

১৫০১ খ্রিষ্টাব্দে ১৩ই মে, তিনি তৃতীয়বার ট্র্যান্স-আট্লান্টিক অভিযানে বের হন। এই সময় তাঁর পৃষ্ঠপোষক ছিলেন পরতুগিজের রাজা ম্যানুয়েল প্রথম। এবারে তাঁর লক্ষ্য ছিল কেপ ভার্দে। ভেচুপুচি এবার দক্ষিণ আমেরিকার উপকুল বরাবর নিজস্ব জাহাজ নিয়ে অগ্রসর হন। এই যাত্রায় তিনি ব্র্তমান রিও ডি জানেরিও এবং রিও ডি লা প্লাটা অঞ্চলের সন্ধান পান। এরপর উপকূল ধরে অগ্রসর হয়ে, আর্জেন্টিনা উপকূল দেখতে পান। এবার তিনি প্রথম বুঝতে পারেন যে, তিনি একটি মহাদেশের সন্ধান পেয়েছেন। তিনি সেকালের দক্ষিণ আমেরিকার নামকরণ করেছিলেন নতুন বিশ্ব
(New World)। এই যাত্রা শেষে তিনি ফিরে এসেছিলেন ১৫০২ খ্রিষ্টাব্দের ২২ জুলাই।

১৫০৩ খ্রিষ্টাব্দে তিনি চতুর্থবার পর্তুগিজ জাহাজে আমেরিকা মহাদেশের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। এই অভিযানে নতুন কিছুর সন্ধান পান নি। ১৫০৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি পর্তুগালে ফিরে আসেন।

১৫০৫ খ্রিষ্টাব্দে স্পেন সরকার তাঁকে সমুদ্র বিষয়ক উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দান করে। একই সাথে তিনি 'কমার্শিয়াল হাউস ফর দ্যা ওয়েস্ট ইন্ডিজ' কোম্পানির প্রধান হিসাবে যুক্ত হন।

কোনো কোনো গবেষক এই দাবি করেন যে, তিনি আমেরিকা মহাদেশে পঞ্চম এবং ষষ্ঠ অভিযানে গিয়েছিলন। তাঁদের মতে এই অভিযান করেছিলেন ১৫০৫-১৫০৭ খ্রিষ্টাব্দের ভিতরে।

১৯০৭ খ্রিষ্টাব্দের দিকে বেশ কিছু গবেষক এবং গ্রন্থ লেখক এই সময়ের আমেরিকা মহাদেশের মানচিত্র-সহ বিবরণ লিপিবদ্ধ করেন। এর ভিতরে জার্মান লেখক মার্টিন ওয়াল্ডসিমুলার একটি গ্রন্থে ভেসপুচির 'নতুন বিশ্ব-এর নামকরণ করেছিলেন 'আমেরিকা'। উল্লেখ্য, এই শব্দটি ছিল আমেরিগো ভেসপুচির 'আমেরোগো' শব্দের স্ত্রীবাচক শব্দ।

 ১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দে তিনি তাঁর কোম্পানির প্রধান নাবিক হিসেবে স্বীকৃতি দান করে। এছাড়া তাঁর জীবদ্দশায় স্পেন এবং পর্তুগালে সম্মানিত নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি পান।

১৫১২ খ্রিষ্টাব্দের ২২ ফেব্রুয়ারি ৫৮ বৎসর বয়সে স্পেনে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

 

সূত্র: