অনন্ত সিংহ
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের একজন সক্রিয় কর্মী।  চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার আক্রমণের অন্যতম নায়ক। এঁর পুরো নাম অনন্তলাল সিংহ।

১৯০৩ খ্রিষ্টাব্দের ১লা ডিসেম্বর তারিখে চট্টগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। উল্লেখ্য এঁদের পূর্ব-পুরুষ ভারতের আগ্রা অঞ্চলের অধিবাসী ছিলেন। অনন্ত সিং-এর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা খুব বেশি ছিল না। ইনি ছোটবেলা থেকেই খেলাধুলা ও শরীরচর্চা করতেন। মাষ্টার দা সূর্যসেন তাঁর অসাধারণ সাহস, সাংগঠনিক দক্ষতা, বুদ্ধিমত্তা, কর্মোদ্যোগ ও অসাধারণ সাহস দেখে মুগ্ধ হন। অচিরেই তিনি সূর্য সেনের একজন ঘনিষ্ঠ ও বিশ্বাসভাজন সহকর্মী হয়ে ওঠেন।

১৯২১ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর ‌উদ্যেগে তাঁর স্কুলের ছেলেরা কংগ্রেসের অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেয়। পরে এই আন্দোলন প্রত্যাহার করা হলে, তিনি বিপ্লবী আন্দোলনকে জোরদার করার জন্য সচেষ্ট হন।

১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ই ডিসেম্বর (শুক্রবার ২৮ অগ্রহায়ণ ১৩৩০) চট্টগ্রাম শহরের বাটালি পাহাড় এলাকায় সরকারি রেলের টাকা লুণ্ঠন করেন। এই লুণ্ঠনে তাঁর সহযোগীদের মধ্যে ছিলেন দেবেন দে ও নির্মল সেন।  সে সময় সুলুকবাহার এলাকায় ছিল বিপ্লবীদের সদর দপ্তর।

২৪শে ডিসেম্বর (সোমাবার ৮ পৌষ ১৩৩০) সুলুকবাহার দফতরে পুলিশ হানা দেয়। এখান থেকে তাঁরা পালিয়ে যাওয়ার সময় পুলিশের সাথে সংঘর্ষ হয়। তবে এঁরা অক্ষত অবস্থায় পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। এঁরা প্রথমে নগরকানা পাহাড়ে আশ্রয় নেন। পুলিশের হাতে ধরা পড়া প্রায় নিশ্চিত হয়ে গেলে  মাস্টারদা, অম্বিকা চক্রবর্তী ও রাজেন দাস তাঁদের পকেটে রাখা পটাশিয়াম সায়ানাইড খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা চালান। অন্যান্যরা পালিয়ে যেতে সক্ষম হলেই মৃতপ্রায় মাস্টারদা ও অম্বিকা চক্রবর্তী পুলিশের হাতে ধরা পড়েন। পরে তিনি ১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দে বিপ্লবী কাজকর্মের জন‌্য গ্রেপ্তার হয়ে চার বছর কারাগারে থাকেন।

সূর্যসেনের  পরিকল্পনা অনুসারে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের জন্য পরিকল্পনা করা হয় ১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দে। এই পরিকল্পনা চূড়ান্ত রূপ লাভ করে ১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ই এপ্রিলে। মোট ৬৫ জন যোদ্ধা নিয়ে প্রায় রাত দশটার দিকে আক্রমণ করে চট্টগ্রাম পুলিশ লাইনে অবস্থিত অস্ত্রাগার দখল করেন। এই আক্রমণে অনন্ত সিং একটি ছোটো দলের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। ঐ সময় চট্টগ্রাম শহর চারদিনের জন্য ব্রিটিশ শাসনমুক্ত ছিল। এই আক্রমণের সময় রাত্রের অন্ধকারে অনন্ত সিং, গণেশ ঘোষ, আনন্দগুপ্ত, জীবন ঘোষাল মূল দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলেন। তাই মূল দলটি ১৯শে এপ্রিল এঁরা সুলুকবহর পাহাড়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন। আর এঁরা আত্মগোপন করার চেষ্টা করেন। চট্টগ্রাম থেকে আট মাইল দূরে পুটিয়ারি রেলস্টেশনে আসেন। এই সময় স্টেশন মাষ্টার এদের দেখে সন্দেহ করেন এবং টেলিগ্রাম করে দূরবর্তী স্টেশনগুলোতে জানিয়ে দেন। ফেনীতে রেলগাড়ি প্রবেশ করলে, অনন্ত সিং এবং গণেষ ঘোষ প্রকৃতির তাগিতে স্টেশনে নামে। এরপর পুলিশ রেলগাড়িতে উঠে যাত্রীদের তল্লাসি শুরু করে। এই সময় জীবন ঘোষাল ও অনন্তগুপ্ত রিভলবার বের করে গুলি করা শুরু করে। কিছুক্ষণ পর গণেষ ঘোষও বাইরে থেকে গুলিও করা শুরু করে। এই সময় অনন্ত সিং আবার বিচ্ছিন্ন হয়ে যান। এরপর বাকি তিনজনের সাথে মিলিত হন চন্দন নগরে।

১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দের ২৮ জুন তিনি স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণ করেন। ইনি এই আত্মসমর্পণ সম্পর্কে গোয়েন্দা কর্মকর্তা লোম্যানকে এক চিঠিতে এই আত্ম সমর্পণের কথা জানিয়ে চিঠি লেখেন।

  'প্রিয় মিঃ লোম্যান,
১৯৩০ সালের ২৮শে জুন আমি তোমার সঙ্গে দেখা করব। আমি নিশ্চিন্ত যে, আমাকে গ্রেপ্তার করার সে সুযোগ তুমি হারাবে না। আমি তার জন্য প্রস্তুত। মনে কর না যে, আমি আত্মসমর্পণ করছি। লোকে কখন আত্মসমর্পণ করে? যখন সে একান্ত অসহায় বা আত্মরক্ষার কোন পথ পায় না, তখনই সে নত হয়।

আমি কি এখন অসাহয়? না, কখনোই না। আমার আত্মরক্ষার অস্ত্র আছে, খরচ করার মতো প্রচুর অর্থ আছে, সহায়তা করার মতো লোকও আছে। বাংলা, বাংলার বাইরে বা ভারতের বাইরে থাকবার মতো আশ্রয়ও আছে। তবুও যে ধরা দিচ্ছি, তার কারণ কি? তুমি কি ভেবেছ আমার কাজের জন্য আমি অনুতপ্ত? না. কখনোই না। আমি একবিন্দু দুঃখিত নই। তবে কি উপর থেকে আমার ওপর  কোন আদেশ এসেছে? না, এটা আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার এবং সম্পূর্ণ গোপনীয়।

বিদ্রোহী অনন্তলাল সিংহ

চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের মামলার বিচারে অনন্ত সিং ও অন্য নয়জনের দ্বীপান্তর হয়। ১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দে আন্দামান সেলুলার জেলে অনশন ধর্মঘট শুরু হলে রবীন্দ্রনাথ, গান্ধীজী প্রমুখের চেষ্টায় বন্দীদের আন্দামান থেকে স্বদেশে ফিরিয়ে আনা হয়। ১৯৪৬ খ্রিষ্টাব্দে তিনি মুক্তিলাভ করেন।

জেলে থাকাকালীন সময়ে তিনি মার্ক্সীয় দর্শনে আকৃষ্ট হন এবং জেলের বাইরে এসে ইনি কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগদান করেন। কিছুদিন তিনি চলচ্চিত্র ও মোটর গাড়ির ব্যবসা করে রাজনীতি থেকে কিছুটা দূরে থাকেন। বিপ্লবী আন্দোলনের সময়কৃত ব্যাংক ডাকাতির অভিযোগে স্বাধীন ভারতে তাঁকে আট বছর (১৯৬৯ - ১৯৭৭) জেলে থাকতে হয়।

১৯৭৯ খ্রিষ্টাব্দের ২৫শে জানুয়ারিতে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যবরণ করেন।

তাঁর রচিত গ্রন্থ :
চট্টগ্রাম যুববিদ্রোহ (দুই খণ্ড)
অগ্নিগর্ভ চট্টগ্রাম
মাস্টারদা
স্বপ্ন ও সাধনা
আমি সেই মেয়ে
কেউ বলে ডাকাত কেউ বলে বিপ্লবী


সূত্র :
http://www.banglapedia.org/
বাংলাদেশ প্রতিদিন। শনিবার ২২ মে ২০১০, ০৮ জ্যৈষ্ঠ ১৪১৭, ০৭ জমাদিউস সানী ১৪৩১।