১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দের
৫ই সেপ্টেম্বর (মঙ্গলবার ২০ ভাদ্র ১৩৩১) চট্টগ্রামের নোয়াপাড়ায় একটি অস্ত্রলুটের ঘটনা ঘটে। এই ঘটনায় মাস্টারদার নাম শোনা যায়। এই কারণে ১ নং বেঙ্গল অর্ডিনেন্স ঘোষণা করে সারা বাংলায় বিপ্লবীদের ব্যাপকহারে গ্রেফতার করা হয়। শুধু এক ২৫ অক্টোবর তারিখেই বাংলার বিভিন্ন জেলা থেকে প্রায় ২০০ বিপ্লবী কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়। এই সময় গ্রেফতার হন নেতাজী সুভাষ, অনিলবরণ রায় প্রমুখ নেতারাও। চট্টগ্রামের বিপ্লবীরা পুলিশের চোখ ফাঁকি দিতে মাষ্টারদা কলকাতা শোভাবাজার আশ্রয় নেন। ওই সময় তাঁরা কলকাতার দক্ষিণেশ্বরে বোমা তৈরির প্রশিক্ষণ নিতেন। ১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দের ১০ই নভেম্বর সেখানে পুলিশ হানা দেয়। সূর্যসেন গায়ের জামা খুলে খালি গায়ে একটা অপরিষ্কার ময়লা গামছা কাঁধে ফেলে চায়ের কেতলি হাতে ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে আসেন। পুলিশ তাঁকে দাঁড় করিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করলে তিনি সাদাসিদাভাবে বলেন, বাবুলোকদের জন্য চা আনতে যাচ্ছেন। পুলিশের দারোগা কিছুক্ষণ জেরা করার পর সন্দেহ করার মতো কোনো কিছু না পেয়ে তাঁকে ছেড়ে দেন। এর প্রায় একবছর পর ১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দের ৮ অক্টোবর কলকাতার আমহার্স্ট স্ট্রিটের এক মেস থেকে পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করে। তাঁদের বিরুদ্ধে দায়ের করা হয় 'মুরারিপুকুর ষড়যন্ত্র মামলা'। এ মামলায় ১৯২৮ সাল পর্যন্ত দুইবছর তাঁকে মেদিনীপুর প্রেসিডেন্সি জেল, পুনার রায়েরোড়া জেল ও বম্বের রত্নগিরি জেলে কারাবাস করতে হয়।
১৯২৮ সালের শেষের দিকে তাঁর স্ত্রী
পুষ্পকুন্তলার অসুস্থতার খবর পেয়ে সূর্যসেন তাকে দেখতে আসার অনুমতি প্রার্থনা করেন।
এই আবেদন মঞ্জুর করা হলে তিনি জেল থেকে তিনি ছাড়া পান। কিন্তু তাঁকে নজরবন্দি রাখা
হয়। বাড়ি পৌঁছার দিনে তাঁর স্ত্রী পুষ্পকুন্তলা মৃত্যুবরণ করেন। এরপর তিনি টাইফয়েডে
আক্রান্ত হলেন। তিন মাস শয্যাশায়ী থাকলেন। এই সময় একজব ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেট রাজনীতি
থেকে সরে দাঁড়ানোর জন্য পরামর্শ দেন এবং এর বিনিময়ে সংসারের খরচ ব্রিটিশ সরকার
চালাবে বলে জানানো হয়। সূর্যসেন এর কোনো উত্তর দেন নি। সূর্যসেনের দাদা চন্দ্রনাথ
সেন বিষয়টি বিবেচনা করার জন্য ম্যাজিস্ট্রেটের কাছ থেকে সময় চেয়ে নেন। এরপর একদিন
পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে যান এবং কিছুদিন আত্মগোপন করে থাকেন।
১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দে চট্টগ্রামে ফিরে আসেন। এই সময় পুর্ণেন্দু দস্তিদারের মাধ্যমে
প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারকে
ও কল্পনা দত্ত
নামক দুজন নারী বিপ্লবীর সাথে পরিচিত হন। প্রথম দিকে দলে নারী সদস্য নেওয়ার পক্ষে
তিনি ছিলেন না। পরে পুর্ণেন্দু দস্তিদারের বিশেষ অনুরোধে এঁদেরকে সদস্য হিসেবে
গ্রহণ করেন।
এরপর তিনি চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের জন্য পরিকল্পনা করতে থাকেন। এর চূড়ান্ত
রূপ লাভ করে ১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ই এপ্রিলে। মোট ৬৫ জন যোদ্ধা নিয়ে প্রায় রাত
দশটার দিকে আক্রমণ করে চট্টগ্রাম পুলিশ লাইনে অবস্থিত অস্ত্রাগার দখল করেন। এই সময়
তাঁদের পরনে ছিল সেনাবাহিনীর পোশাক। তাঁরা ব্যবহার করেছিলেন কয়েকটি রিভলবার এবং
সাধারণ বন্দুক। অস্ত্রাগার ভেঙে তাঁরা মাস্কেট্রি রাইফেল, রিভলবার এবং কার্তুজ লাভ
করেন। এই আক্রমণের শুরুতেই তাঁরা টেলিফোন লাইন কেটে দিয়েছিলেন। ফলে আক্রমণের সময়,
ব্রিটিশ পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা শহরের অন্যপ্রান্তের সৈন্যদের কাছে এই
আক্রমণের যথার্থ সংবাদ পাঠতে ব্যর্থ হয়। এইউ সময় বিপ্লবীরা এত দ্রুত আক্রমণ করে দখল
করে নেয় যে, সার্জেন্ট ব্লেকবার্ন, কলোন, সার্জেন্ট মেজর ফেরেল-সহ অনেক অফিসার
প্রতিরোধ করার আগেই মৃত্যুবরণ করেন।
হরিগোপাল বল (টেগরা) ও মতি কানুনগো |
জিতেন দাস, মধু দত্ত ও পুলিনবিকাশ ঘোষ |
নরেশ রায়, ত্রিপুরা সেন ও বিধু ভট্টাচ |
প্রভাশ বল, শশাঙ্ক দত্ত ও নির্মল লালা |
যুদ্ধের উপযোগী প্রচুর রাইফেল এবং সে সময়ের
বিখ্যাত স্বয়ংক্রিয় ম্যাশিন গান (লুইস গান) দখল করলেও তার গুলি থেকে বঞ্চিত হলো।
কারণ, বিপ্লবীরা জানতো না, অস্ত্র এবং তার গুলি একস্থানে রাখা হয় না। ফলে এই আক্রমণ
সফলতার প্রান্তে এসে সফল হলো না। বিপ্লবীরা অস্ত্রাগার থেকে যথাসম্ভব নিজেদের জন্য
অস্ত্র সংগ্রহ করলো এবং পরে অস্ত্রাগারগুলোতে আগুন ধরিয়ে দিল। এই সময় শহরের অপর
প্রান্ত থেকে কিছু ব্রিটিশ সৈন্য বিভ্রান্তি অবস্থার মধ্য থেকেও ডবল মুরিং জেটিতে
রক্ষিত একমাত্র লুইস থেকে গুলি বর্ষণ শুরু করেছিল। বিপ্লবীরা জানতো লুইসগানের
বিরুদ্ধে তাঁরা যুদ্ধে পারবেন না। এই আক্রমণের সময় রাত্রের অন্ধকারে অনন্ত সিং,
গণেশ ঘোষ, আনন্দগুপ্ত, জীবন ঘোষাল মূল দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলেন। বাকি
সদস্যদের নিয়ে সূর্যসেন সুলুক পাহাড়ে আশ্রয়
নিল।
১৯শে এপ্রিল সারাদিন এই পাহাড়ে কাটিয়ে পরে ফতেয়াবাদে আশ্রয় নেয়। সেখান থেকে
সূর্যসেন সবাইকে নিয়ে জালালাবাদ পাহাড়ে আশ্রয় নেন।
২২ শে এপ্রিল বিকালে ট্রেনযোগে আগত বৃটিশ বাহিনীর জালালাবাদ পাহাড়ে অভিযান শুরু
করে। ব্রিটিশ সৈন্যরা জালালবাদ পাহাড়ের দিকে অগ্রসর হতে থাকলে, সূর্যসেন তাঁর দলবল
নিয়ে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিলেন এবং এই যুদ্ধের অধিনায়ক হিসাবে লোকনাথকে নিয়োগ দেন।
সৈন্যরা পাহাড় বেয়ে উঠ আসার সময় বিপ্লবীরা আক্রমণ চালায়।
এই আক্রমণে ব্রিটিশ সৈন্যরা পিছিয়ে যায়। পরে
পূব দিকের একটি পাহাড়ে ব্রিটিশ সৈন্যরা ভাইকার ম্যাশিনগান স্থাপন করতে সক্ষম হয়।
জালাবাদ যুদ্ধে প্রথম শহীদ হন ১৪ বৎসর বয়সী টেগরা বল। এরপর আগে পরে একে একে
বিপ্লবীরা যুদ্ধে প্রাণ হারাতে থাকেন। জালালাবাদের যুদ্ধে শহীদ হন মোট ১১জন
বিপ্লবী। এঁরা হলেন। টেগরা বল, নরেশ রায়, ত্রিপুরা সেন, বিধু ভট্টাচার্য, মতি
কানুনগো, প্রভাশ বল, শশাঙ্ক দত্ত, নির্মল লালা, জিতেন দাস, মধু দত্ত জো পুলিন ঘোষ।
এই দিনের যুদ্ধে ব্রিটিশ বাহিনী জালালাবাদ পাহাড় দখল করতে পারে নি। তবে অবশিষ্ট
বিপ্লবীদের নিয়ে সূর্যসেন রাতের অন্ধকারে জালালাবাদ পাহাড় ত্যাগ করেন। এই সময় আহত
বিনোদবিহারী চৌধুরী ও বিনোদ দত্তকে বহন করে অজ্ঞাত পথে পা বাড়ান। এই যুদ্ধের পরে অবশিষ্ট বিদ্রোহীরা চারিদিক
ছড়িয়ে পড়েছিল। পাহাড় থেকে নামার পর অগ্রগামী দলে থাকা লোকনাথ বল ও তাঁর সঙ্গীরা
অন্ধকারে হারিয়ে যান। ফলে অগ্রগামী দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে, সূর্যসেন কোয়েপাড়ার বিনয় সেনের বাড়িতে আশ্রয় নেন।
এই সময় তাঁর সাথে ছিল অপর বিপ্লবী নির্মল সেন।
মে মাসের প্রথম দিকে ইউরোপীয়ান ক্লাব আক্রমণের
পরিকল্পনা করেন দলের সদস্যরা। সূর্যসেন প্রথমে এই আক্রমণ করা থেকে সবাইকে বিরত
থাকতে বলেন। কিন্তু দলের অত্যুৎসাহী সদস্যদের চাপে তিনি অনুমতি দেন। অবশেষ ৫ই মে
সূর্যসেনের অনুমতি নিয়ে আক্রমণের উদ্দেশ্যে একদল বিপ্লবী যান। কিন্তু চারিদকে
সশস্ত্র সৈন্যের আধিক্য দেখে পরে তার আর আক্রমণ করেন নি।
কল্পনা দত্ত |
১৯৩১ সালের এপ্রিল মাসে এক বিশেষ আদালতে রাজদ্রোহ মামলায় অভিযুক্ত ৩২ জন বন্দির বিচার আরম্ভ হয় । সূর্যসেন মাইন ব্যবহার করে জেলের প্রাচীর উড়িয়ে দিয়ে বন্দীদের মুক্ত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। একই সাথে তিনি আদালত ভবন ধ্বংস করারও উদ্যোগ নেন। এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন কল্পনা দত্ত। হামলার দিন ধার্য করা হয়েছিল ৩রা জুন। শেষ মুহূর্তে সর্বশেষ মাইনটি বসানোর সময় পুলিশের নজরে পড়ে যাওয়ায় গোটা পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়ে যায়।
নির্মল সেন |
সূর্যসেনের দলের অনেকেই গ্রেফতার হয়েছিলেন। কিন্তু সূর্যসেন
ধরা ছোঁয়ার বাইরেই থেকে গেলেন। এই সময় তাঁর গ্রেফতারের জন্য পুরস্কার ঘোষণাও করা
হয়েছিল। এরই ভিতরে ১৩ জুন পটিয়ার ধলঘাটে সাবিত্রী দেবীর বাড়িতে বিপ্লবীরা মিলিত হন।
এই বাড়িতে তখন ছিলেন সূর্যসেন, নির্মল সেন, প্রীতিলতা এবং অপূর্ব সেন। সেখানে
আচম্বিতে গুর্খা সৈন্য নিয়ে হানা দেয় ক্যাপ্টেন ক্যামেরন। এখানকার যুদ্ধে
ক্যাপ্টেন ক্যামেরন নিহত হয়। বিপ্লবীদের পক্ষে শহিদ হয়েছিলেন নির্মল সেন। পরে
পালিয়ে যাওয়ার সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে শহিদ হন অপূর্ব সেন
(ভোলা)।
প্রীতিলতা ওয়ার্দার-এর ডায়রি থেকে জানা যায়, এই সময় অপূর্ব সেন জ্বরে কাতর ছিলেন।
দোতলার একটি ঘরে প্রীতিলতা, অপূর্ব সেন ও নির্মল সেন ছিলেন। সৈনদের আগমনের কথা
সূর্যসেন এসে সবাইকে জানান। সূর্যসেন প্রীতিলতাকে নিচের তলার মেয়েদের ভিতর পাঠিয়ে
দেন। আক্রমণের শুরুতেই ক্যামেরন নির্মল সেনের গুলিতে নিহত হয়। এরপর আরও
কিছুক্ষণ উভয় পক্ষের ভিতর গুলি চলে। এক পর্যায়ে নির্মল সেন মৃত্যুবরণ করেন। পরে
প্রীতিলতা ও অপূর্ব সেনকে নিয়ে সূর্যসেন সন্তর্পণে এই বাড়ি ত্যাগ করেন। এই সময়
সৈন্যদের গুলিতে অপূর্ব সেন মৃত্যবরণ করেন।
জুন মাসে সরকার সূর্যসেনকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য দশ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে।
ঘোষণাটি বঙ্গদেশীয় পুলিশ বিভাগের ইন্সপেক্টর-জেনারেল মহোদয়ের
অনুমতিক্রমে প্রচারিত হয়েছিল। [দেখুন:
বিজ্ঞাপন]
প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার |
এরপর সূর্যসেন চট্টগ্রামের পাহাড়তলীতে অবস্থিত ইউরোপীয়ান ক্লাব আক্রমণের পরিকল্পনা করলেন। এ অভিযানের দায়িত্ব দেওয়া হল প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারকে। ১৯৩২ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর রাতে আক্রমণ করা হল ইউরোপীয়ান ক্লাব। সফল আক্রমণ শেষে ফেরার পথে এক ইংরেজ অফিসারের গুলিতে প্রীতিলতা আহত হলেন। ধরা না দেবার প্রত্যয়ে সঙ্গে রাখা সায়ানাইড বিষ পান করে তিনি আত্মাহুতি দিলেন। ভারতের মুক্তিসংগ্রামের প্রথম নারী শহীদের নাম প্রীতিলতা।
১৯৩৩ খ্রিষ্টাব্দের ২রা ফেব্রুয়ারি গৈরালা
গ্রামে আশ্রয় নিয়েছিলেন। এই সময় ইংরেজ সরকার তাঁর মাথার দাম ধার্য করেছিল দশ হাজার
টাকা। এখানে ব্রজেন সেন মাস্টারদাক আশ্রয় দেওয়ার জন্য নিয়ে আসেন। এই গ্রামের
বিশ্বাস-বাড়ির গৃহবধু ক্ষিরোদাপ্রভা বিশ্বাসের ঘরে ছিলেন। ব্রজেন সেনের বাসা থেকে
কার জন্য খাবার নিয়ে ক্ষিরোদাপ্রভা বিশ্বাসের ঘরে যাচ্ছে, তা জানার জন্য ব্রজেন
সেনের ভাই নেত্র সেন বিশেষ আগ্রহী হয়ে ওঠে। পরে সূর্যসেনের অবস্থানের কথা জানতে
পরে, পুলিশকে খবর দেয়। তারপর রাতের বেলা আলোর সংকেত দেখিয়ে নেত্র সেন সৈন্যদের পথ
দেখায়। বিষয়টি ব্রজেন সেন বুঝতে পেরে শেষ মুহূর্তে চেষ্টা করেও সূর্যসেনকে রক্ষা
করতে পারেন নি। ক্যাপ্টেন ওয়ামস্লীর নেতৃত্বে একদল গুর্খা সৈন্য সূর্যসেনকে
গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়।
১৯৩৪ খ্রিষ্টাব্দের ১২ জানুয়ারিতে তাঁর ফাঁসি হয়।
মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টা আগে তিনি সহকর্মীদের উদ্দেশ্যে একটি চিঠি পাঠিয়েছিলেন। মূল
লেখাটি ছিল ইংরেজিতে। নিচের বাংলা তুলে ধরা হলো।
আমার শেষ বাণী
–আদর্শ
ও একতা। ফাঁসির রজ্জু আমার মাথার উপর ঝুলছে। মৃত্যু আমার দরজায় করাঘাত
করছে। মন আমার অসীমের পানে ছুটে চলছে। এই তো আমার সাধনার সময়। এই তো আমার
বন্ধুরূপে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার সময়, হারানো দিনগুলোকে নতুন করে স্মরণ
করার এই তো সময়। কত মধুর তোমাদের সকলের স্মৃতি। তোমরা আমরা ভাই-বোনেরা তোমাদের মধুর স্মৃতি বৈচিত্রহীন আমার এই জীবনের একঘেঁয়েমিকে ভেঙে দেয়। উৎসাহ দেয় আমাকে। এই সুন্দর পরম মুহূর্তে আমি তোমাদের জন্য দিয়ে গেলাম স্বাধীন ভারতের স্বপ্ন। আমার জীবনের এক শুভ মুহূর্তে এই স্বপ্ন আমাকে অনুপ্রাণিত করেছিল। জীবনভর উৎসাহভরে ও অক্লান্তভাবে পাগলের মতো সেই স্বপ্নের পেছনে আমি ছুটেছি। জানি না কোথায় আজ আমাকে থেমে যেতে হচ্ছে। লক্ষ্যে পৌঁছানোর আগে মৃত্যুর হিমশীতল হাত আমার মতো তোমাদের স্পর্শ করলে তোমরাও তোমাদের অনুগামীদের হাতে এই ভার তুলে দেবে, আজ যেমন আমি তোমাদের হাতে তুলে দিয়ে যাচ্ছি। আমরা বন্ধুরা – এগিয়ে চল, এগিয়ে চল – কখনো পিছিয়ে যেও না। পরাধীনতার অন্ধকার দূরে সরে যাচ্ছে। ঐ দেখা যাচ্ছে স্বাধীনতার নবারুণ। কখনো হতাশ হয়ো না। সাফল্য আমাদের হবেই। ভগবান তোমাদের আশীর্বাদ করুন। ১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ই এপ্রিলের চট্টগ্রাম ইস্টার বিদ্রোহের কথা কোনো দিনই ভুলে যেও না। জালালাবাদ, জুলখা, চন্দননগর ও ধলঘাটের সংগ্রামের কথা সব সময় মনে রেখো। ভারতের স্বাধীনতার বেদীমূলে যেসব দেশপ্রেমিক জীবন উৎসর্গ করেছেন, তাঁদের নাম রক্তাক্ষরে অন্তরের অন্তরতম প্রদেশে লিখে রেখো। আমাদের সংগঠনে বিভেদ না আসে– এই আমার একান্ত আবেদন। যারা কারাগারের ভেতরে ও বাইরে রয়েছে, তাদের সকলকে জানাই আমার আশীর্বাদ। বিদায় নিলাম তোমাদের কাছ থেকে। চট্টগ্রাম কারাগার বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক ১১ই জানুয়ারি, ১৯৩৪ বন্দেমাতরম সকাল ৭টা। |
সূত্র :
চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন : চারুবিকাশ দত্ত, কলকাতা
আমি সুভাষ বলছি। প্রথম খণ্ড । শৈলেশ দে। বিশ্ববাণী প্রকাশনী। কলকাতা-৯। অগ্রহায়ণ, ১৩৭৫।
বিপ্লবীরা সফলভাবে টেলিফোন ও টেলিগ্রাফ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করতে সক্ষম হন এবং রেল চলাচল বন্ধ করে দেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী গণেশ ঘোষের নেতৃত্বে একদল বিপ্লবী পুলিশ অস্ত্রাগারের এবং লোকনাথ বাউলের নেতৃত্বে দশজনের একটি দল সাহায্যকারী বাহিনীর অস্ত্রাগারের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেন। এই দুঃসাহসী কাজের পরিকল্পনা ও নেতৃত্বে ছিলেন বিপ্লবের স্বপ্নপুরুষ মাস্টারদা সূর্য সেন। এতে ব্রিটিশ শাসনের প্রায় দেড়শ বছরের গৌরব ধুলোয় মিশে যায়। বিপ্লবীদের কাছে ব্রিটিশ আর্মি পরাজিত হয় এবং পিছু হটে। সফল অভিযানের পর বিপ্লবী দলটি পুলিশ অস্ত্রাগারে সমবেত হয়ে মাস্টারদা সূর্য সেনকে মিলিটারি স্যালুট প্রদান করে। আর এ সময় সূর্য সেন জাতীয় পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে অস্থায়ী বিপ্লবী সরকার ঘোষণা করেন।
সশস্ত্র যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার পর ইংরেজ সরকার সূর্য সেনকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য
পুরস্কার ঘোষণা করে। ১৯৩৩ সালে এক বাড়িতে গোপনে অবস্থানের সময় প্রতিবেশী নেত্র সেন
এর বিশ্বাসঘাতকতায় পুলিশের হাতে ধরা পড়েন তিনি। পরবর্তীতে মাস্টারদা কে ধরিয়ে
দেয়ার পুরস্কারের টাকা দিয়ে বিশাল আকৃতির মাছ কিনে বাড়িতে রান্না করে খাওয়ার সময়ে
সেই মাছের মাথার পাশেই নেত্র সেনের খণ্ডিত মস্তক পড়ে। মাস্টারদা কে ধরিয়ে দেবার
দন্ড এভাবেই ভোগ করতে হয় বিশ্বাসঘাতক নেত্র সেনকে।
১৯৩৩ সালের মার্চে বিপ্লবীরা জেল থেকে সূর্য সেনকে মুক্ত করার জন্য কয়েকবার চেষ্টা
চালায়। প্রতিবারই ফাঁস হয়ে যায় তাদের গোপন পরিকল্পনা।
সূর্য সেন, তারকেশ্বর দস্তিদার এবং কল্পনা দত্তকে বিচারের জন্য ইন্ডিয়ান পেনাল
কোডের ১২১/১২১এ ধারা অনুযায়ী স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। ১৪ আগস্ট ১৯৩৩ সালে
সূর্য সেন ও তাঁর সহযোগীদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলার রায় ঘোষণা করা হয়।
ট্রাইব্যুনাল সূর্য সেনকে ১২১ ধারা অনুসারে দোষী সাব্যস্ত করে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত
করে। ওই একই ধারায় তারকেশ্বর দস্তিদারেরও প্রাণদণ্ডের আদেশ হয়। কুমারী কল্পনা
দত্তকে ভারতীয় দণ্ডবিধির ১২১ ধারায় দোষী সাব্যস্ত করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়।
সূর্য সেনকে কনডেম সেলে কড়া পাহারায় নির্জন কুঠুরিতে রাখা হত। মৃত্যুর আগে জেলে আটক
বিপ্লবী কালীকিঙ্কর দে’র কাছে সূর্য সেন পেন্সিলে লেখা একটি বার্তা পাঠান। ধরে
নেওয়া হয় এটি জীবদ্দশায় মাস্টারদার শেষ চিঠি। সে বার্তায় তিনি লেখেন “আমার শেষ
বাণী-আদর্শ ও একতা”।
তার ভাষায় “ভারতের স্বাধীনতার বেদীমূলে যে সব দেশপ্রেমিক জীবন উৎসর্গ করেছেন, তাদের
নাম রক্তাক্ষরে অন্তরের অন্তরতম প্রদেশে লিখে রেখো’।
সূর্য সেন ও তারকেশ্বর দস্তিদারের লাশ তাদের আত্মীয় স্বজনদের হাতে হস্তান্তর করা
হয়নি এবং ধর্মীয় নিয়ম অনুযায়ী পোড়ানোও হয়নি। ফাঁসির পর লাশদুটো জেলখানা থেকে ট্রাকে
করে তৎকালীন ৪ নম্বর স্টিমার ঘাটে নিয়ে যাওয়া হয়। তারপর মৃতদেহের বুকে লোহার টুকরা
বেঁধে বঙ্গোপসাগর আর ভারত মহাসাগরের সংলগ্ন কোনো এক স্থানে ফেলে দেওয়া হয়।
অস্ত্রাগার লুণ্ঠন মামলায় ইন্ডিয়ান পেনাল কোড ১২১/১২১এ ধারা অনুযায়ী স্পেশাল
ট্রাইব্যুনাল ১৪ আগষ্ট ১৯৩৩ সালে মামলার রায় ঘোষনা করে। এবং ১৯৩৪ খ্রিষ্টাব্দের ১২
জানুয়ারিতে তাঁর ফাঁসি কার্যকর করা হয়।
এ মামলায় ইন্ডিয়ান পেনাল কোড ১২১/১২১এ ধারা অনুযায়ী স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল ১৪
আগস্ট ১৯৩৩ সালে মামলার রায় ঘোষণা করে। ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দের ১২ জানুয়ারি তাঁর ফাঁসি
কার্যকর করা হয়। অস্তমিত হয় বীরত্বের মহান সূর্য! যিনি রচনা করে গেছেন এমন ইতিহাস
যা চিরদিন বাঙালির শৌর্য আর গৌরবের প্রমাণ হয়ে জ্বলজ্বল করবে বিশ্ববাসীর কাছে,
নিপীড়িত মানুষের অন্তরে!!
মাস্টার দা সূর্যসেন চিরজীবী হোন।
মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টা আগে তিনি সহযোদ্ধাদের উদ্দেশ্যে একটি চিঠি পাঠিয়েছিলেন।
আমার শেষ বাণী – আদর্শ ও একতা। ফাঁসির রজ্জু আমার মাথার উপর ঝুলছে। মৃত্যু আমার
দরজায় করাঘাত করছে। মন আমার অসীমের পানে ছুটে চলছে। এই তো আমার সাধনার সময়। এই তো
আমার বন্ধু রূপে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার সময়, হারানো দিনগুলোকে নতুন করে স্মরণ করার
এই তো সময়।
কত মধুর তোমাদের স্মৃতি। তোমরা আমরা ভাই-বোনেরা তোমাদের মধুর স্মৃতি বৈচিত্র্যহীন
আমার এই জীবনের একঘেয়েমি ভেঙে দেয়। উৎসাহ দেয় আমাকে। এই সুন্দর পরম মুহূর্তে আমি
তোমাদের জন্য দিয়ে গেলাম স্বাধীন ভারতের স্বপ্ন। আমার জীবনের এক শুভ মুহূর্তে এই
স্বপ্ন আমাকে অনুপ্রাণিত করেছিল। জীবনভর উৎসাহভরে ও অক্লান্তভাবে পাগলের মতো সেই
স্বপ্নের পেছনে আমি ছুটেছি। জানি না কোথায় আজ আমাকে থেমে যেতে হচ্ছে। লক্ষ্যে
পৌঁছানোর আগে মৃত্যুর হিমশীতল হাত আমার মতো তোমাদের স্পর্শ করলে তোমরাও তোমাদের
অনুগামীদের হাতে এই ভার তুলে দেবে, আজ যেমন আমি তোমাদের হাতে তুলে দিয়ে যাচ্ছি।
আমরা বন্ধুরা – এগিয়ে চল, এগিয়ে চল – কখনো পিছিয়ে যেও না। পরাধীনতার অন্ধকার দূরে
সরে যাচ্ছে। ওই দেখা যাচ্ছে স্বাধীনতার নবারুণ। কখনো হতাশ হয়ো না। সাফল্য আমাদের
হবেই। ভগবান তোমাদের আশীর্বাদ করুন।
১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের ১৮ এপ্রিলের চট্টগ্রাম ইস্টার বিদ্রোহের কথা কোনো দিনই ভুলে যেও
না। জালালাবাদ, জুলধা, চন্দননগর ও ধলঘাটের সংগ্রামের কথা সব সময় মনে রেখো। ভারতের
স্বাধীনতার বেদিমূলে যেসব দেশপ্রেমিক জীবন উৎসর্গ করেছেন, তাঁদের নাম রক্তাক্ষরে
অন্তরের অন্তরতম প্রদেশে লিখে রেখো।
আমাদের সংগঠনে বিভেদ না আসে– এই আমার একান্ত আবেদন। যারা কারাগারের ভেতরে ও বাইরে
রয়েছে, তাদের সকলকে জানাই আমার আশীর্বাদ। বিদায় নিলাম তোমাদের কাছ থেকে।
বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক বন্দেমাতরম্।
চট্টগ্রাম কারাগার, ১১ জানুয়ারি ১৯৩৪ সকাল ৭টা
পরিশেষে বলতে হয়, মাস্টার`দা, আপনার স্বপ্নের অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ আজ
`সংখ্যালঘু-সংখ্যাগুরু` প্রশ্নে সন্ত্রাস আর হত্যায় রক্তাক্ত! তবু আমরা বিশ্বাস
করি, স্বাধীনতার পতাকা হাতে সাম্য আর পরাধীনতার শৃঙ্খলমুক্তির জন্য আপনার
বীরত্বপূর্ণ লড়াই নতুন প্রজন্মের চেতনায় অগ্নিমশাল জ্বালাবেই। মাস্টারদা সূর্যসেন
অমর, চিরজীবী। মাস্টারদা, আপনার আত্মোৎসর্গের এদিনে জানাই প্রণতি আর শ্রদ্ধাঞ্জলি।
প্রত্যাশা করি আমাদের নতুন প্রজন্ম আপনার আদর্শে দীক্ষা নেবে- আপনার দীক্ষা আপনার
আত্মদান ব্যর্থ হত পারে না! শত প্রণাম তোমার চরণে মাস্টার`দা সূর্য সেন!`
মাস্টারদা সূর্যসেন কে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের অভিযোগে ১৯৩৪ সালের ১২
জানুয়ারি চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করে তৎকালীন ব্রিটিশ
সরকার।