 প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার 
(বা ওয়াদ্দাদার)
প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার 
(বা ওয়াদ্দাদার)
ব্রিটিশভারতে স্বাধীনতা সংগ্রামী। ডাক নাম রাণী। ছদ্মনাম ফুলতার
১৯১১ খ্রিষ্টাব্দের ৫ই মে চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার ধলঘাট গ্রামে মামার বাড়িতে 
জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা জগৎবন্ধু ওয়াদ্দেদার ছিলেন চট্টগ্রাম পৌরসভার হেড 
ক্লার্ক। মায়ের নাম প্রতিভাদেবী। তাঁর অন্যান্য ভাইবোনদের নাম ছিল- মধুসূদন, 
কনকলতা, শান্তিলতা, আশালতা ও সন্তোষ। উল্লেখ্য, এঁদের আদি পদবী ছিল দাশগুপ্ত। 
পরিবারের কোন এক পূর্বপুরুষ নবাবী আমলে 'ওয়াহেদেদার' উপাধি পেয়েছিলেন। কালক্রমে 
এই পদবি এসেছিল ওয়াদ্দেদার। অনেকসময় ওয়াদ্দাদারও বলা হতো।
শৈশবে পিতার মৃত্যুর পর জগৎবন্ধু ওয়াদ্দেদার তাঁর পৈতৃক বাড়ি ডেঙ্গাপাড়া 
সপরিবারে ত্যাগ করেন। পরবর্তীকালে ওয়াদ্দেদার পরিবার চট্টগ্রাম শহরের আসকার খানের 
দীঘির দক্ষিণ-পশ্চিম পাড়ে একটা দোতলা বাড়িতে স্থায়ীভাবে থাকতেন।
১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দে ডাঃ খাস্তগীর উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে লেখাপড়া শুরু করেন। ১৯২৪ 
খ্রিষ্টাব্দে বেঙ্গল অর্ডিনান্স নামে এক জরুরি আইনে বিপ্লবীদের বিনাবিচারে আটক করা 
শুরু হয়। এই সময় চট্টগ্রামের বিপ্লবীদলের বহু নেতা-কর্মী এই আইনে আটক হয়েছিল। 
সে সময় প্রীতিলতার নিকট-আত্মীয় পূর্ণেন্দু দস্তিদার বিপ্লবী দলের কর্মী ছিলেন। 
তিনি সরকার কর্তৃক বাজেয়াপ্ত কিছু গোপন বই প্রীতিলতার কাছে রাখেন। এই সূত্রে  
'দেশের কথা', 'বাঘা যতীন', 'ক্ষুদিরাম' আর 'কানাইলাল' ইত্যাদি রচনা পাঠ করার সুযোগ 
পান। মূলত এই সমস্ত বই পড়ের তিনি বিপ্লবের আদর্শে অনুপ্রাণিত হন। 
এই স্কুল থেকে থেকে ১৯২৮ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাশ করেন। এরপর তিনি  ঢাকা ইডেন মহিলা কলেজে ভর্তি হন। ১৯২৯ 
খ্রিষ্টাব্দের মে মাসে চট্টগ্রামে
সূর্যসেন ও তাঁর সহযোগীরা চট্টগ্রাম জেলা 
কংগ্রেসের জেলা সম্মেলন, ছাত্র সম্মেলন, যুব সম্মেলন ইত্যাদি আয়োজনের পরিকল্পনা 
গ্রহণ করেন। এই পরিকল্পনায় নারী সম্মেলন ছিলো না। কিন্তু পূর্ণেন্দু দস্তিদারের 
বিপুল উৎসাহের জন্যই সূর্য সেন নারী সম্মেলন আয়োজনের সম্মতি দেন। মহিলা কংগ্রেস 
নেত্রী লতিকা বোসের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই সম্মেলনে প্রীতিলতা ঢাকা থেকে এবং তাঁর 
বন্ধু ও সহযোদ্ধা কল্পনা দত্ত কলকাতা থেকে এসে যোগদান করেন। তাঁদের দুজনের আপ্রাণ 
চেষ্টা ছিল সূর্যসেনের অধীনে চট্টগ্রামের বিপ্লবী দলে যুক্ত হওয়া। কিন্তু 
শেষপর্যন্ত ব্যর্থ 
হয়ে তাঁদের ফিরে যেতে হয়। পরে পূর্ণেন্দু দস্তিদারের চেষ্টায় সূর্যসেন
কল্পনা দত্ত ও তাঁকে 
দলভুক্ত করেন।
১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ই এপ্রিল, মোট ৬৫ জন যোদ্ধা নিয়ে
সূর্যসেন রাত দশটার 
চট্টগ্রাম পুলিশ লাইনে আক্রমণ করে। আক্রমণ শেষে
১৯শে এপ্রিল এরা সারাদিন সুলুক পাহাড়ে আশ্রয় নেন। এরপর ফতেয়াবাদে কিছুটা সময় 
কাটিয়ে, সূর্যসেন সবাইকে নিয়ে জালালাবাদ পাহাড়ে আশ্রয় নেন। ঠিক এই দিনই প্রীতিলতা আই এ পরীক্ষা 
দিয়ে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম ফিরে আসেন । প্রীতিলতার একটি লেখা থেকে জানা যায়-
'পরীক্ষার পর ঐ বছরেরই ১৯শে এপ্রিল সকালে বাড়ি ফিরে আমি আগের রাতে চট্টগ্রামের বীর যোদ্ধাদের মহান কার্যকলাপের সংবাদ পাই। ঐ সব বীরদের জন্য আমার হৃদয় গভীর শ্রদ্ধায় আপ্লুত হল। কিন্তু ঐ বীরত্বপুর্ণ সংগ্রামে অংশগ্রহণ করতে না পেরে এবং নাম শোনার পর থেকেই যে মাষ্টারদাকে গভীর শ্রদ্ধা করেছি তাঁকে একটু দেখতে না পেয়ে আমি বেদনাহত হলাম'।
১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় ঢাকা বোর্ডে মেয়েদের ভিতর প্রথম এবং সম্মিলিত মেধা তালিকায় পঞ্চম স্থান অধিকার করেন। এরপর তিনি কলকাতার বেথুন কলেজ ভর্তি হন এবং ১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দে এই কলেজ থেকে দর্শনশাস্ত্রে ডিস্টিংশনসহ গ্রাজুয়েশন করেন। কিন্তু, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে সম্পৃক্ত থাকায় কৃতিত্বের সাথে স্নাতক পাস করলেও তিনি এবং তাঁর সঙ্গী বীণা দাসগুপ্তের পরীক্ষার ফল স্থগিত রাখা হয়।
১৩৩২ খ্রিষ্টাব্দের ১৩ই জুন পটিয়ার ধলঘাটে সাবিত্রী দেবীর বাড়িতে গোপন বৈঠকের 
জন্য সূর্যসেন, নির্মল 
সেন, প্রীতিলতা ও অপূর্ব সেন মিলিত হন। সেখানে 
হঠাৎ গুর্খা সৈন্য নিয়ে হানা দেয় ক্যাপ্টেন ক্যামেরন। এখানকার যুদ্ধে 
ক্যাপ্টেন ক্যামেরন নিহত হয়। বিপ্লবীদের পক্ষে শহিদ হয়েছিলেন  নির্মল সেন। পরে 
পালিয়ে যাওয়ার সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে শহিদ হন অপূর্ব সেন 
(ভোলা)।
প্রীতিলতা ওয়ার্দার-এর ডায়রি থেকে জানা যায়, এই সময় অপূর্ব সেন জ্বরে কাতর ছিলেন। 
দোতলার একটি ঘরে প্রীতিলতা, অপূর্ব সেন ও নির্মল সেন ছিলেন। সৈন্যদের আগমনের কথা 
সূর্যসেন এসে সবাইকে জানান। সূর্যসেন প্রীতিলতাকে নিচের তলার মেয়েদের ভিতর পাঠিয়ে 
দেন।  আক্রমণের শুরুতেই ক্যামেরন নির্মল সেনের গুলিতে নিহত হয়। এরপর আরও 
কিছুক্ষণ উভয় পক্ষের ভিতর গুলি চলে। এক পর্যায়ে নির্মল সেন মৃত্যুবরণ করেন। পরে 
প্রীতিলতা ও অপূর্ব সেনকে নিয়ে সূর্যসেন সন্তর্পণে এই বাড়ি ত্যাগ করেন। পালানোর সময় 
সৈন্যদের গুলিতে অপূর্ব সেন মৃত্যবরণ করেন।   
জুলাই মাসে সরকার সূর্যসেনকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য দশ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে। 
তৎকালীন আনন্দবাজার পত্রিকায় এই বিষয়ে একটি খবর প্রকাশিত হয়। এর দশ দিন পর অর্থাৎ 
আনন্দবাজার পত্রিকায় 'চট্টগ্রামের পলাতকা' নামে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়।
চট্টগ্রামের পলাতকা
'চট্টগ্রাম জিলার পটিয়া থানার ধলগ্রামের শ্রীমতী প্রীতিলতা ওয়াদ্দাদার গত ৫ই জুলাই, মঙ্গলবার চট্টগ্রাম শহর হইতে অন্তর্ধান করিয়াছেন। তাঁহার বয়স ১৯ বৎসর। পুলিশ তাঁহার সন্ধানের জন্য ব্যস্ত। [আনন্দবাজার ১৩-৭-১৯৩২]
এই সময় সূর্যসেন তাঁকে এবং কল্পনা দত্ত নামক অপর বিপ্লবীকে আত্মগোপনের নির্দেশ দেন। পলাতক অবস্থায় তিনি সূর্যসেনের নির্দেশে ১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দের ২৪শে সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামের পাহাড়তলীতে অবস্থিত ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণ করেন। এই দলে তিনি ছাড়া সবাই পুরুষ বিপ্লবী ছিলেন। এঁদের ভিতর যাঁদের নাম গিয়েছে, তাঁরা হলেন- মহেন্দ্র চৌধুরী, সুশীল দে, শান্তি চক্রবর্তী, কালী দে, পান্না সেন, বীরেশ্বর রায়, প্রফুল্ল দাস। রাত ১১টার দিকে এই দলটি আক্রমণ করে। আক্রমণে একজন ইউরোপিয়ান বৃদ্ধা নিহত হন এবং ৮জন ইয়োরোপীয়ান আহত হন। আনন্দবাজার পত্রিকার ২৫শে সেপ্টেম্বর সংখ্যয় এই সংবাদটি যেভাবে প্রকাশিত হয়েছিল, তা হলো-
'গতকল্য রাত্রি ১১টার সময় বিপ্লবী বলিয়া বর্ণিত একদল লোক পাহাড়তলী ইনষ্টিটিউট নামক আসাম বেঙ্গল রেলওয়ে ইয়োরোপীয়ান ক্লাবে অতিশয় দুঃসাহসিক ভাবে ইয়োরোপীয়ানদের উপর আক্রমণ করে। আক্রমণকারীর দলে পুরুষের বেশে সজ্জিতা একজন নারীও ছিল।
আক্রমণকারীরা ঘরের মধ্যে বোমা নিক্ষেপ করিয়াছিল। ইহার ফলে একজন বৃদ্ধা ইয়োরোপীয়ান মহিলা নিহত এবং ইন্সপেক্টর ম্যাকডোন্যাল্ড, সার্জেন্ট উইলিস এবং অপর ছয়জন ইয়োরোপীয়ান আহত হন।
একজন স্ত্রীলোক ব্যতীত আক্রমণকারী দলের আর সকলেই পলাইয়া গিয়াছে। পুরুষের পোশাকে সজ্জিতা ২০ বৎসর বয়স্কা এই নারীকে মৃত অবস্থায় পাওয়া গিয়াছে। তাহার মৃতদেহ ক্লাব ঘর হইতে কিছু দূরে পড়িয়াছিল।...
প্রকাশ যে, এই স্ত্রীলোকটিকে কুমারী প্রীতিলতা ওয়াদ্দার বিএ বলিয়া সনাক্ত করা হইয়াছে। সে নাকি চট্টগ্রাম শহরের শ্রীযুক্ত জগৎবন্ধু ওয়াদ্দাদারের কন্যা। তাহার পকেটে রিভলবার ও রাইফেলের কতকগুলি কার্তুজ পাওয়া গিয়েছে।' [আনন্দবাজার ২৫-৯-১৯৩২]
২৪শে সেপ্টেম্বর রাতের এই আক্রমণের পর প্রীতিলতা পটাসিয়াম সায়ানাইড খেয়ে মৃত্যবরণ করেছিলেন। ময়নাতদন্ত শেষে, তাঁর মৃতদেহ পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছিল।