চট্টগ্রাম বিভাগ
Chittagong Division

বাংলাদেশের একটি বিভাগের নাম। এর সদর দফতর চট্টগ্রাম শহর। এই বিভাগে রয়েছে বাংলাদেশের প্রধান বন্দর নগরী।  

এর উত্তরে সিলেট বিভাগ, ভারত-এর ত্রিপুরা , আসাম মেঘালয় রাজ্য, দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর, পূর্বে ভারতের মেঘালয় , ত্রিপুরা ও মায়ানমার এবং পশ্চিমে ঢাকা ও বরিশাল বিভাগ এবং বঙ্গোপসাগর

আয়তন: ৩৩,৭৭১.১৩ বর্গকিলোমিটার।
এই বিভাগটি মোট ১১টি জেলা নিয়ে গঠিত। এগুলো হলো চট্টগ্রাম সদর জেলা, রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, কক্সবাজার, ফেণী, লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালী, চাঁদপুর, কুমিল্লা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া। এই বিভাগের বৃহত্তম জেলার নাম— রাঙ্গামাটি। এর আয়তন ৬১১৬ বর্গকিলোমিটার। আর ক্ষুদ্রতম জেলার নাম — ফেণী। এর আয়তন ৯২৮ বর্গকিলোমিটার।

উপজেলাঃ ৯৯টি।
ইউনিয়নঃ ৯২৩টি।
গ্রামঃ ১৪৯৬৭টি।
ওয়ার্ডঃ ৮৩০৭টি।
সিটি কর্পোরেশনঃ ১টি। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন।

লোকসংখ্যাঃ ২০০১ সালের আদশ শুমারি অনুযায়ী এ বিভাগের মোট লোক সংখ্যা ২,৫১,৮৭,৩১৩ জন।  জনসংখ্যার ঘনত্ব—
 
চট্টগ্রামের ইতিহাস
সীতাকুণ্ডু এলাকায় প্রাপ্ত প্রস্তরীভূত অস্ত্র ও যন্ত্রপাতি থেকে ধারণা করা হয় যে, এ অঞ্চলে নব্যপ্রস্তর যুগে অস্ট্রো-এশিয়াটিক জনগোষ্ঠীর বসবাস ছিল। এরপর পূর্ব-প্রান্ত থেকে আগত মঙ্গোলীয় জনগোষ্ঠী এই এলাকায় আসে। এই অঞ্চল সম্পর্কে প্রথম লিখিত ধারণা পাওয়া যায় গ্রিক ভূগোলবেত্তা প্লিনির পেরিপ্লাস নামক রচনা থেকে। এই রচনায় ক্রিস নামক যে স্থানের বর্ণনা পাওয়া যায়—ঐতিহাসিক নলিনীকান্ত ভট্টশালীর মতে সেটি বর্তমানের সন্দীপ। ঐতিহাসিক ল্যাসেনের মতে,  পেন্টাপোলিশ আসলে চট্টগ্রামেরই আদিনাম। পূর্ব নোয়াখালির শিলুয়াতে মৌর্য যুগের ব্রাহ্মী লিপিযুক্ত একটি মূর্তির সূত্রে ধারণা করা যায়, মৌর্য যুগে এই অঞ্চলের সাথে যোগাযোগ ছিল।

ধারণা করা হয়, চট্টগ্রাম এবং তৎসংলগ্ন অঞ্চল প্রাচীন বাংলার অন্যতম জনপদ হরিকেল-এর অন্তর্ভুক্ত ছিল। তিব্বতের বৌদ্ধ ঐতিহাসিক লামা তারানাথের একটি গ্রন্থ ও  আরাকানের সিথাং মন্দিরের শিলালিপি অনুসারে  জানা যায় চন্দ্রবংশের শাসনামলে  রাজধানী ছিল চট্টগ্রাম। সে সময় আরবীয় বণিকরা 'সমুন্দর' নামের একটি বন্দরকে উল্লেখ করেছেন। ধারণা করা হয়, এই বন্দর বলতে তাঁরা চট্টগ্রাম বন্দরকে বুঝাতেন। উল্লেখ্য এই সময় পালবংশের রাজা ছিলেন ধর্মপাল। পাল বংশের পর এ অঞ্চলে একাধিক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল।

৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দে আরাকানের চন্দ্রবংশীয় রাজা সু-লা‌-তাইং-সন্দয়া চট্টগ্রাম একটি সামরিক অভিযান পরিচালিত করেন।  কিন্তু তিনি এই সময়ে বেশি দূর অগ্রসর না হয়ে একটি স্তম্ভ তৈরি করেন। এই স্তম্ভের গায়ে খোদিত আছে, 'চেৎ-ত-গৌঙ্গ'  (যুদ্ধ করা অনুচিৎ)। সে থেকে স্থানীয় লোকজন এলাকাটিকে চৈত্তগৌং বলতেন। ধারণা করা হয়, চৈত্তগৌং থেকে কালক্রমে চাটিগ্রাম, চাটগাঁ, চট্টগ্রাম, চিটাগাং ইত্যাদি নামে অভিহিত হতে থাকে। ১২৪০ খ্রিষ্টাব্দে ত্রিপুরার রাজা এই অঞ্চল দখল করে নেয়।

ঐতিহাসিক শিহাবুদ্দিন তালিশের মতে ১৩৩৮ খ্রিষ্টাব্দে সুলতান ফকরুদ্দিন মোবারক শাহ‌-এর চট্টগ্রাম বিজয়ের পূর্বকাল পর্যন্ত, চট্টগ্রামের ইতিহাস সুষ্পষ্টভাবে জানা যায় না। ১৩৪০ খ্রিষ্টাব্দে সুলতান ফখরুদ্দীন মোবারক শাহ চট্টগ্রাম অধিকার করেন এবং স্বাধীন সোনারগাঁও রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেন।

১৩৪৬ খ্রিষ্টাব্দের দিকে পরিব্রাজক ইবনে বতুতা এই অঞ্চলে আসেন। তিনি যে শহরে আমরা প্রবেশ করেছিলেন, তার নাম উল্লেখ করেছেন হল সোদকাওয়াঙ (চট্টগ্রাম)। তিনি চট্টগ্রাম শহরকে মহাসমূদ্রের তীরে অবস্থিত একটি বিরাট শহর হিসাবে উল্লেখ করেছেন।

১৩৫২‌-৫৩ খ্রিষ্টাব্দে ফকরুদ্দীন মোবারক শাহ-এর পুত্র ইখতিয়ার উদ্দিন গাজী শাহকে হত্যা করে সুলতান ইলিয়াস শাহ বাংলার মসনদ দখল করেন। এই সময় চট্টগ্রামও তার রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। তাঁর সময়ে চট্টগ্রাম বাংলার প্রধান বন্দর হিসাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এরপর রাজা গণেশ ও তাঁর বংশধররা চট্টগ্রাম শাসন করা শুরু হয়। এরপরে বাংলায় হাবসি বংশ প্রতিষ্ঠা হয়।

১৪৩৫ খ্রিষ্টাব্দের দিকে আরাকানরা চট্রগ্রাম অভিমুখে যুদ্ধাভিযান শুরু করে। ১৪৩৭ খ্রিষ্টাব্দ রামু এবং ১৪৫৯ খ্রিষ্টাব্দে চট্টগ্রাম দখল করে নেন।

১৪৯২ খ্রিষ্টাব্দে হোসেন শাহ বাংলার সুলতান হোন। তিনি চট্টগ্রামের অধিকার নিতে গেলে ত্রিপুরার রাজা ধনমানিক্যের সাথে সংঘাত সৃষ্টি হয়। ১৫১৩-১৫১৭ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত উভয় রাজার ভিতর যুদ্ধ সংঘটিত হয়। রাজা ধনমানিক্যের মৃত্যুর পর হোসেন শাহ‌ চট্টগ্রাম তাঁর দখলে আনেন এবং উত্তর আরাকান পর্যন্ত তাঁর রাজ্য বিস্তার করতে সক্ষম হন।

১৫১৭ খ্রিষ্টাব্দের দিকে পোর্তুগিজরা চট্টগ্রামে আসা শুরু করে। এরা প্রথমাস্থায় বাণিজ্য করতে এলেও, পরে তারা জলদস্যু হয়ে যায়। সুলতান এদের দমন করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। কিন্তু এ সময় আফগান শাসক শের শাহ বাংলা আক্রমণ করতে পারে, এই আশঙ্কায় তিনি পোর্তুগিজদের সহায়তা কামনা করেন।

১৫৩২ খ্রিষ্টাব্দে নসরৎ শাহ আততায়ীর হাতে নিহত হন।  এরপর সিংহাসনে বসেন তাঁর পুত্র আলাউদ্দিন ফিরোজ। ফিরোজ শাসনকার্যে অনুপযুক্ত ছিলেন। তাঁর কুশাসনের বিরুদ্ধে আমিররা বিদ্রোহ করেন। বাংলার এই দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে আরাকান- এর ১৩তম রাজা মিন বিন, ১৫৩২ খ্রিষ্টাব্দের ৭ই অক্টোবর, চট্টগ্রাম দখল করে নেন। এরপর ডিসেম্বর মাসের ১ তারিখে,  আরাকান- এর সৈন্যরা ঢাকা অভিমুখে যাত্রা করে। সুলতানের সৈন্যরা আরাকানিদের বিরুদ্ধে যথাসাধ্য প্রতিরোধ গড়ে তোলে এবং প্রায় ১০দিন আরাকানিদের ঠেকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সুলতানের সৈন্যরা পরাজিত হয় এবং ১১ই ডিসেম্বর এরা আরাকানি সৈন্যরা ঢাকা প্রবেশ করে। এরা ঢাকা এবং এর আশপাশের অঞ্চলে ব্যাপক লুটতরাজ ও হত্যাকাণ্ড চালাতে থাকে। ফলে ১৫৩৩ খ্রিষ্টাব্দের ৮ ফেব্রুয়ারি তরুণ সুলতান আলাউদ্দিন ফিরোজের পক্ষে রানি রাজা মিন বিন-কে কর প্রদান করে। এরপর ১৩ই এপ্রিল মিন বিন- ঢাকা ত্যাগ করে। ১৪ই মে তিনি অধিকৃত অঞ্চলের জন্য একজন্য গভর্নর নিয়োগ করেন। ফলে চট্টগ্রাম আরাকানিদের
অধিকারেই থেকে যায়।

তখন সামরিক সহায়তার বিনিময়ে ১৫৩৭ খ্রিষ্টাব্দে পোর্তুগিজরা চট্টগ্রামে বাণিজ্য কুঠি নির্মাণ করে। এই সময় তারা বন্দর এলাকার শুল্ক আদায়ের অধিকার লাভ করে। এতকিছুর পরেও ১৫৩৮ খ্রিষ্টাব্দে শের শাহ‌-র সেনাপতি চট্টগ্রাম দখল করেন। কিন্তু শের শাহ‌-এর এই সেনপাতি চট্টগ্রামের উপর পূর্ণ কর্তৃত্ব লাভ করতে পারেন নি। ১৫৮০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত আফগানদের ত্রিপুরা আর আরাকানীদের সঙ্গে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হয়েছে।

চট্টগ্রাম অঞ্চলে পোর্তুগিজরা দস্যুতা বৃদ্ধি পেলে আরাকান রাজা ১৬০৩ খ্রিষ্টাব্দে পোর্তুগিজদের বিরুদ্ধে অভিযান চালায়। এই অভিযানের ফলে পোর্তুগিজদের সম্পূর্ণরূপে পরাজিত করা সম্ভব হয় নি। বিশেষ করে সন্দীপ অঞ্চল পোর্তুগিজ জলদস্যু গঞ্জালেস দখলে রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন।

১৬৬৫ খ্রিষ্টাব্দের মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেব বাংলার সুবেদার শায়েস্তা খানকে চট্টগ্রাম দখলের নির্দেশ দেন। শায়েস্তা খান ১৬৬৫ খিষ্টাব্দের ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে চট্টগ্রাম অভিযান শুরু করেন। তাঁর পুত্র বুজুর্গ উমেদ খানকে সার্বিক নেতৃত্ব দেওয়া হয় এবং নৌ-সেনাপতি ইবনে হোসেনকে নৌ-বাহিনীর নেতৃত্ব প্রদান করা হয়। অন্যদিকে শায়েস্তা খান নিজে রসদ সরবরাহের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। সেনাবাহিনী ও নৌ-বাহিনী একই সময়ে একে অপরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রেখে স্থল ও সমুদ্রপথে যাত্রা করে। স্থল বাহিনীকে জঙ্গল কেটে রাস্তা তৈরি করে অগ্রসর হতে হয়েছিল। সমুদ্রে এবং পরে কর্ণফুলী নদীতে একটি বড় যুদ্ধে পর্তুগিজদের সাহায্য নিয়ে মোগলরা প্রথম জয় পায়। এই সময় টমাস প্রাট নামে এক ইংরেজ আরাকানীদের সঙ্গে যোগ দিয়ে মোঘলদের পরাজিত করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়।  ১৬৬৬ খ্রিষ্টাব্দের ২৬শে জানুয়ারিতে এরা আরাকানদের চট্টগ্রাম দুর্গ অবরোধ করে। এই যুদ্ধে জয়লাভের পর ২৭শে জানুয়ারি বুজুর্গ উমেদ খান দুর্গে প্রবেশ করেন এবং চট্টগ্রামকে মুগল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেন। সম্রাটের অনুমতি সাপেক্ষে শায়েস্তা খান চট্টগ্রামের নাম পরিবর্তন করে ইসলামাবাদ করেন।

১৬৮৬ খ্রিষ্টাব্দে  জব চার্নক এবং ১৬৮৮ খ্রিষ্টাব্দে কাপ্তেন হিথের চট্টগ্রাম দখল করতে ব্যর্থ হয়। ১৬৭০ ও ১৭১০ খ্রিষ্টাব্দে আরাকানীরা চট্টগ্রাম দখলের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। ১৭২৫ আরাকানরা বিশাল এক সেনাবাহিনী নিয়ে চট্টগ্রাম দখল করতে সক্ষম হয়। এই সময় প্রায় ৩০ হাজার মগ সৈন্য চট্টগ্রামে ঢুকে পড়ে এবং লুঠতরাজ ও ধর্ষণ করে। কিন্তু অল্পদিনের মধ্যেই মোগলরা আরাকানদের বিতারিত করে।

১৭৫৭ খ্রিষ্টাব্দের ২৩শে জুন ভাগীরথী নদীর তীরে পলাশীর প্রান্তরের যুদ্ধ নবাব সিরাজদৌল্লা পরাজিত হলে, ইংরেজরা বাংলার সিংহাসনে মীরজাফরকে অধিষ্ঠিত করেন। এই সময় ইংরেজরা চট্টগ্রাম বন্দরের অধিকার লাভের জন্য নবাব মীরজাফরের ওপর চাপ সৃষ্টি করে। কিন্তু মীরজাফর ইংরেজদের কাছে চট্টগ্রাম বন্দরের কর্তৃত্ব দিতে তুলে দেন নি। ইংরেজদের স্বার্থ রক্ষা না হওয়ার কারণে,  মীরকাশিমের সাথে এক গোপন চুক্তি করে, মীরজাফরের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ তুলে মীরাজফরকে ক্ষমতাচ্যুত করে, ১৭৬০ খ্রিষ্টাব্দে মীরকাশিমকে সিংহাসনে বসায়। অবশ্য এজন্য মীরকাশিম ইংরেজদেরকে দুই লক্ষ পাউন্ড উৎকোচ প্রদান করে এবং এই সময়  ইংরেজরা বর্ধমান, মেদেনীপুর ও চট্টগ্রামের অধিকার লাভ করে। চট্টগ্রামের শেষ ফৌজদার রেজা খাঁ সরকারিভাবে চট্টগ্রামের শাসন প্রথম ইংরেজ চিফ ভেরেলস্ট-এর হাতে সমর্পন করেন। এর মাধ্যমে চট্টগ্রামে হয় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন।

কোম্পানির শাসনামলে চট্টগ্রামবাসীর ওপর করারোপ দিনে দিনে বাড়তে থাকে। মীরকাশিমের সাথে ইংরেজদের বৈরী সম্পর্ক তৈরি হলে, ইংরেজরা মীরজাফরকে পুনরায় সিংহসনে বসায়।
 
১৭৭৬ খ্রিষ্টাব্দে হরিষপুরের সন্দীপের জমিদার আবু তোরাপ কৃষকদের সংগঠিত করে ইংরেজদের প্রতিরোধ করেন। এরপরে ইংরেজদের সাথে যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে তিনি পরাজিত ও নিহত হলে সন্দীপের প্রতিরোধ ভেঙ্গে পড়ে। এই সময় ১৭৭৬ থেকে ১৭৮৯ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত চাকমারা ইংরেজদের বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তোলে। পাহাড়ি এলাকায় চাকমাদের পরাস্ত করতে না পেরে ইংরেজরা তাদের বিরুদ্ধে কঠিন অর্থনৈতিক অবরোধ করে। শেষ পযর্ন্ত চাকমা বিদ্রোহও থেমে যায়।

ইংরেজরা আন্দরকিল্লা জামে মসজিদকে গোলাবারুদের গুদামে পরিণত করলে চট্টগ্রামবাসী ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। মসজিদের জন্য নবাবী আমলে প্রদত্ত লাখেরাজ জমি ১৮৩৮ খ্রিষ্টাব্দে জরিপের সময় বাজেয়াপ্ত করা হয়। পরে খান বাহাদুর হামিদুল্লাহ খান কলিকাতায় গিয়ে গভর্নরের কাছ থেকে এটি উদ্ধার করেন।

১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দে সিপাহি বিপ্লবের সময় ৩৪তম বেঙ্গল পদাতিক রেজিমেন্টের ২য়, ৩য় ও ৪র্থ কোম্পানীগুলি চট্টগ্রামে মোতায়েন ছিল। ১৮ নভেম্বর রাতে উল্লিখিত তিনটি কোম্পানী বিদ্রোহ করে এবং জেল থেকে সকল বন্দী মুক্ত করে। এই বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেন হাবিলদার রজব আলী ও সিপাহী জামাল খান। সিপাহিরা ৩টি সরকারি হাতি, গোলাবারুদ ও ধনসম্পদ নিয়ে চট্টগ্রাম ত্যাগ করে। তারা পার্বত্য ত্রিপুরার সীমান্ত পথ ধরে এগিয়ে সিলেট ও কাছাড়ে পৌঁছে। ইংরেজ কোম্পানির অনুরোধে ত্রিপুরা রাজ তাদের বাধা দেন। এভাবে বিভিন্ন স্থানে লড়াই সংগ্রাম এবং রসদের অভাবে বিদ্রোহীরা অনেকখানি কাবু হয়ে পড়ে।

১৮৫৮ খ্রিষ্টাব্দের ৯ জানুয়ারি সিলেটের মনিপুরে ইংরেজ বাহিনীর সঙ্গে এক লড়াই-এ চট্টগ্রাম সেনা বিদ্রোহের অবসান হয়।  

১৮৯২, ১৮৯৬ ও ১৯০১ খ্রিষ্টাব্দে চট্টগ্রামকে বাংলা থেকে পৃথক করে আসামের সঙ্গে জুড়ে দেওয়ার উদ্যোগ নেয়। এই প্রচেষ্ঠার প্রতিরোধে চট্টগ্রামে দুইটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে। একটি ১৮৯৫-৯৬ সালে ব্রিটিশ পণ্য বর্জন জোরদার ও ১৯০২ সালে চট্টগ্রাম বিভাগীয় সম্মিলন নামে একটি রাজনৈতিক সংস্থার প্রতিষ্ঠা। ১৯০২ সালের ২৯ ও ৩০ মার্চ প্যারেড ময়দান-এ সংস্থার প্রথম বার্ষিক সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন যাত্রা মোহন সেন।
ইংরেজ আমলে চট্টগ্রামে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন তীব্রতর হয়ে উঠেছিল। ১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ই এপ্রিলে বিপ্লবী সূর্যসেন  মোট ৬৫ জন যোদ্ধা নিয়ে প্রায় রাত দশটার দিকে আক্রমণ করে চট্টগ্রাম পুলিশ লাইনে অবস্থিত অস্ত্রাগার দখল করেন। কয়েকদিন পরেই ইংরেজরা এই শহরকে পুনরুদ্ধার করে।

১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দের ২৪ সেপ্টেম্বর রাতে প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার ইউরোপীয়ান ক্লাব আক্রমণ করে। সফল আক্রমণ শেষে ফেরার পথে এক ইংরেজ অফিসারের গুলিতে প্রীতিলতা আহত হোন। ধরা না দিয়ে তিনি সায়ানাইড বিষ পান করে তিনি আত্মাহুতি দেন।

১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে পাকভারত বিভাজনের সূত্রে চট্টগ্রাম তদানীন্তন পূর্ব-পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৯৫১ সালের ১৬-১৯ মার্চ চট্টগ্রামের হরিখোলার মাঠে ৪ দিনব্যাপী সংস্কৃতি সম্মেলনে আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ সভাপতির যে ভাষণটি প্রদান করেন সেটি পূর্ব বাংলার স্বাধিকার চিন্তা ও জাতির সাংস্কৃতিক ধারাকে বেগবান করে তোলে। ঐ ভাষণে তিনি বলেন, ‘মানুষে মানুষে বিভেদ আছে সত্য। এই বিভেদকে জয় করাই শক্তি। সংস্কৃতি ঐক্যের বাহন, বিভেদের চামুণ্ডা নয়।’

১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দের ভাষা আন্দোলনের চূড়ান্ত আন্দোলন-সংগ্রামের তুঙ্গপর্বে চট্টগ্রামের এই সাংস্কৃতিক আন্দোলন দেশব্যাপী লেখক-বুদ্ধিজীবী ও সংস্কৃতিকর্মীদের ব্যাপক অনুপ্রেরণা দেয়। এই সম্মেলনের প্রভাবে চট্টগ্রামে গণতান্ত্রিক ও শ্রমজীবী মানুষের আন্দোলনও জোরদার হয় এবং পাকিস্তানের শাসক শোষকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ প্রবল হয়ে ওঠে। ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দের ২৭ জানুয়ারি মাসে খাজা নাজিমউদ্দিন ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’-এ ঘোষণা দিলে সারা পূর্ব বাংলায় বিক্ষোভ শুরু হয়। এই সূত্রে চট্টগ্রামে ৪ ফেব্রুয়ারি ধর্মঘট ও হরতাল পালিত হয়। আন্দরকিল্লায় আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। তরুণ সাহিত্যিক মাহবুব-উল-আলম চৌধুরীকে আহ্বায়ক, আওয়ামী মুসলিম লিগ চট্টগ্রাম জেলার সাধারণ সম্পাদক এম এ আজিজ ও রেল শ্রমিক নেতা চৌধুরী হারুনর রশিদকে যুগ্ম আহ্বায়ক করা হয়। কমিটিতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, ক্লাব, যুব সম্প্রদায়, সাংস্কৃতিক সংগঠন ও শ্রমজীবী সংগঠনের প্রতিনিধিরা অন্তর্ভুক্ত হন। চট্টগ্রামে ছাত্র-ছাত্রীদের ভূমিকাও ছিলো উল্লেখযোগ্য, ৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম দিকে ভাষা আন্দোলনকে বেগবান করতে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। আবদুল্লাহ আল হারুনকে আহ্বায়ক, মোহাম্মদ আলী ও ফরিদ উদ্দিন আহমদকে যুগ্ম আহ্বায়ক করা হয়। চট্টগ্রামের ছাত্র-ছাত্রীরা আন্দোলনে ব্যাপক ভূমিকা রাখেন। ভাষা আন্দোলনের ডাক চট্টগ্রামের গ্রামে-গঞ্জে ছড়িয়ে দেওয়ার কাজে রাজনৈতিক ও ছাত্র নেতৃত্বের পাশাপাশি রাজনীতিসচেতন শিল্পী, সংস্কৃতিকর্মী ও তরুণ লেখকরা বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখেন। তারা চট্টগ্রাম শহর ও গ্রামাঞ্চলে গণসংগীত, কবিগান ও নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ভাষা আন্দোলনের মর্মবাণী ও পূর্ব বাংলার মানুষের জাতীয়তাবাদী ও স্বাধিকার চেতনা ছড়িয়ে দেন।

১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে ২৫ মার্চ দিবাগত রাত্রে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী যে অপারেশন সার্চ লাইট- শুরু করেছিল, তার পূর্ব-প্রস্তুতি হিসেবে সমুদ্র পথে অস্ত্র আনে। ২৩ ও ২৪ মার্চ সোয়াত জাহাজ থেকে পাকিস্তানিরা অস্ত্র নামানোর বিরুদ্ধে শ্রমিক জনতার রক্তক্ষয়ী প্রতিরোধ গড়ে তোলে। ‘সোয়াত’ জাহাজ থেকে অস্ত্র লুট করে চট্টগ্রামের খালাসিরা বিরাট অবদান রাখেন।

১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ২৬ মার্চ স্বাধীন বাংলা বেতারের সূচনা হয় চট্টগ্রামের কালুরঘাটে ট্রান্সমিশন ভবনে । ২৬ মার্চ-এর প্রথম প্রহরে (২৫ মার্চ দিবাগত রাত ১২টার পর, পাকিস্তানি সেনা বাহিনি ঢাকাতে নিরস্ত্র জনগণ, পুলিশ এবং ইপিআর এর উপর আক্রমণ শুরু করে। এই আক্রমণকে পাকিস্তানি বাহিনী নাম দিয়েছিল‒ অপারেশন সার্চ লাইট। ২৫ মার্চ দিবাগত রাত ১২টা ২০ মিনিটে টিএনটির মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু'র স্বাধীনতা ঘোষণার প্রচারপত্র প্রচারিত হয়। ভোর হওয়ার আগেই বার্তাটির সাইক্লোষ্টাইল মেশিনের সাহায্যে শত শত কপি তৈরি করে চট্টগ্রামের বিভিন্ন জায়গায় বিতরণ কর হয়। চট্টগ্রামের অনেক জায়গায় মধ্য রাত থেকেই মাইকেও বার্তাটি প্রচার করা হয়।

         [বিস্তারিত: স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র]


সূত্র :
http://www.banglapedia.org/HTB/101486.htm
http://www.chittagong.gov.bd/