মীরজাফর
ইষ্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি'র বাংলার তাবেদার নবাব। বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলা'র সাথে  ইষ্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি'র লর্ড ক্লাইভের সাথে যুদ্ধের সময়, সিরাজউদ্দৌলা'র সাথে বিশ্বাস ঘাতকতা করেন। এই সূত্রে যে কোন বিশ্বাস ঘাতককে বাংলা ভাষায় 'মীরজাফর' হিসেবে অভিহিত করা হয়।

এঁর পুরো নাম মীর জাফর আলী খান। ১৬৯১ খ্রিষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন।

মীরজাফর নবাব সিরাজউদ্দৌলা'র একজন মন্ত্রী এবং প্রধান সেনাপতি ছিলেন। সিরাজউদ্দৌলা বাংলার নবাব হওয়ায় তিনি সন্তুষ্ট হতে পারেন নি। তাই তিনি প্রধান সেনাপতি হয়েও সিরাজউদ্দৌলার বিপক্ষেই কাজ করেছেন।

১৭৫৭ খ্রিষ্টাব্দে সিরাজউদ্দৌলা'র আদেশ লঙ্ঘন করে ইংরেজরা চন্দননগররের ফরাসি কুঠি আক্রমণ করে। এই সময় আহম্মদশাহ আবাদলী দিল্লি আক্রমণ করে লুটতরাজ করে। এতে শঙ্কিত হয়ে সিরাজউদ্দৌলা ইংরেজদের সাথে নতুন যুদ্ধে যেতে সাহসী হন নি। ফলে সহজেই ইংরেজরা ফরাসী কুঠি দখল করে নেয়। পলাতক ফরাসিরা মুর্শিদাবাদে আশ্রয় নেয়। এছাড়া  সিরাজউদ্দৌলা ইংরেজদের শায়েস্তা করার জন্য দাক্ষিণাত্যের  বুসীর সাথে পত্রালাপ করেন। ইংরেজরা তাদের রাজত্ব কায়েম রাখার জন্য সিরাজকে অপসারণের জন্য দেশীয় ক্ষমতালোভীদের সাথে ষড়যন্ত্র শুরু করে। এই দলে জগৎশেঠ, মীরজাফর, রাজবল্লভ, রায়দুর্লভ, উমিচাঁদ যোগ দেয়। তারা সিরাজের পরিবর্তে মীরজাফরকে নবাব বানানোর ষড়যন্ত্র শুরু করে।

এই সময় মীরজাফর ছিলেন নবাবের প্রধান সেনাপতি। সিরাজ কর্তৃক ক্রমাগত অপমানের কারণে সে সিরাজের বিপক্ষে চলে যায়। ক্লাইভের কাছে এদের এই ষড়যন্ত্রের কথা প্রকাশ পেলে, ক্লাইভ এদের সাহায্য দানে অঙ্গীকার করেন। ১৭৫৭ খ্রিষ্টাব্দের জুন মাসে কুচক্রীদের সাথে ইংরেজদের দুটি চুক্তি হয়। এই চুক্তির একটি ছিল আসল, অপরটি জাল। আসল চুক্তিতে ছিল, মীরজাফর নবাব হলে সিরাজ-প্রদত্ত সকল বাণিজ্যিক সুবিধা ইংরেজদের দেওয়া হবে। বাংলাদেশ থেকে ফরাসীদের বিতারিত করবে। সিরাজের কলকাতা আক্রমণের ফলে কলকাতাবাসীর যে আর্থিক ক্ষতি হয়েছে, তা প্রদান করা হবে। এই চুক্তির সময় উমিচাঁদের স্বার্থের ব্যাপারটি বাদ দেওয়া হয়। উমিচাঁদ উপযুক্ত পুরস্কার না পেলে, এই ষড়যন্ত্রের কথা সিরাজ জানিয়ে দেবে এই হুমকি দিলে, আর একটি জাল পত্র তৈরি করা হয়। এই পত্রে উমিচাঁদের উপযুক্ত পুরস্কারের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়।

এই চুক্তি সম্পন্ন হওয়ার পর, ক্লাইভ সামান্য অজুহাতে  সিরাজউদ্দৌলা'র বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। ২৩শে জুন ভাগীরথী নদীর তীরে পলাশীর প্রান্তরের যুদ্ধ শুরু হয়। নবাবের পক্ষে সৈন্য ছিল প্রায় ৫০,০০০। পক্ষান্তরে ইংরেজদের পক্ষে সৈন্য ছিল মাত্র ৩,০০০। কিন্তু মীরজাফর, রায়দুর্লভ এই যুদ্ধে নিরপেক্ষ থেকে দর্শকের ভূমিকায় থাকেন। নবাবের পক্ষে যুদ্ধ করেন মীরমদন, মোহনলাল এবং সিনফ্রে নামক ফরাসি সেনাপতি। যুদ্ধের প্রথমাবস্থায় নবাব বাহিনী জয়লাভ করে। এই সময় মীরজাফরের পরামর্শে নবাব যুদ্ধবিরতির আদেশ দেন। যুদ্ধ বিরতির সময়, ইংরেজরা আকস্মিক আক্রমণ করলে, নবাবের সেনাবাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে পালিয়ে যায়।  সিরাজউদ্দৌলা কোনোক্রমে রাজধানীতে ফিরে এসে অর্থ বিতরণ করে সৈন্য সংগ্রহের উদ্যোগ নেন। এরা অর্থগ্রহণ করে নবাবের সাহায্যের পরিবর্তে আত্মগোপন করে। পরে নিরুপায় হয়ে  সিরাজউদ্দৌলা স্ত্রীকন্যাকে সাথে নিয়ে রাজধানী ত্যাগ করেন। রাজমহলের কাছে সিরাজ সপরিবারের ধরা পড়েন। এরপর মীরাজাফরের  পুত্র মীরনের নির্দেশে সিরাজকে হত্যা করা হয়।

যুদ্ধের শেষে ইংরেজরা মীরজাফরকে বাংলার নবাব হিসেবে বরণ করে নেয়। কিন্তু মেদেনীপুরের শাসনকর্তা রামরাম সিংহ, বিহারের শাসনকর্তা রাজা রামনারায়ণ এবং পূর্ণিয়ার শাসনকর্তা হাজির আলি মীরজাফরের সিংহাসন লাভকে অবৈধ ঘোষণা করে। এই বিদ্রোহের সাথে রায়দুর্লভ যুক্ত আছে এই সন্দেহে মীরজাফর তাকে শাস্তি দিতে উদ্যত হন। পরে লর্ড ক্লাইভের মধ্যস্থতায় তা মিটে যায়। এরপর মীরজাফর অন্যান্য বিদ্রোহীদের শাস্তি দেওয়ার উদ্যোগ নিলে, ক্লাইভের মধ্যস্থতায় সে সকল দ্বন্দ্বের অবসান হয়। এরপর মীরজাফর প্রথমেই বিভিন্ন খাতে ইংরেজদেরকে দেড় কোটি টাকা প্রদান করেন। এছাড়া ক্লাইভকে তিনি ২১ লক্ষ টাকা পুরস্কার হিসেবে দেন।

১৭৫৯ খ্রিষ্টাব্দে আলি গোহর (সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলি) বাংলা ও বিহার দখলের উদ্দেশ্যে পাটনা আক্রমণ করেন।  মীরজাফর ক্লাইভের সহযোগিতায় এই আক্রমণ প্রতিহত করতে সক্ষম হন। এর পুরস্কার স্বরূপ মীরজাফর ক্লাইভকে বাৎসরিক ৩০ হাজার পাউন্ড আয়ের একটি জায়গির প্রদান করেন। এর বাইরে কোম্পানির সেনাবাহিনীর জন্য অতিরিক্ত ২৫ লক্ষ টাকা ইংরেজদেরকে প্রদান করা হয়। মীরজাফরের অসহায়ত্বের সুযোগে ইংরেজরা ক্রমাগত তার উপর অর্থের দাবি করতে থাকে। ইংরেজদের সে সকল দাবি পূরণ করার পরও, বর্ধমান, নদীয়া, হুগলি প্রভৃতি পরগণার রাজস্ব ইংরেজদের প্রদান করতে বাধ্য হয়। ইংরেজদের এ সকল আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে, তিনি ওলন্দাজদের সাথে মিত্রতা স্থাপন করেন। ওলন্দাজরা মনে করেছিল যে, নবাব তাদের পক্ষে যুদ্ধ করবে। তাই তারা মীরজাফরের সাথে কোনো আলোচনা না করেই, ১৭৫৯ খ্রিষ্টাব্দে ইংরেজদের আক্রমণ করে বসে।  বিদরের যুদ্ধে ওলন্দাজরা ইংরেজ বাহিনীর হাতে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। ইংরেজরা এই যুদ্ধের জন্য মীরজাফরকে দায়ী করলেও কোনো প্রমাণ হাজির করতে ব্যর্থ হয়।

ইতিমধ্যে মীরজাফরের পুত্র মীরণের মৃত্যু হয়। এই কারণে তাঁর মনোবল ভেঙে পড়ে। ইংরেজেদের অর্থ প্রদান করতে গিয়ে রাজকোষ শূন্য হয়ে পড়ে। এই সময় ইংরেজ গরভর্নর ভ্যান্সিটার্ট এবং ইংরেজ রাজকর্মচারীদের অর্থলোলুপতায় মীরজাফর প্রায় নিঃস্ব হয়ে যান। এই সময় ভ্যান্সিটার্ট মীরকাশিমের সাথে এক গোপন চুক্তি করে, মীরজাফরের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ তুলে মীরাজফরকে ক্ষমতাচ্যুত করে, ১৭৬০ খ্রিষ্টাব্দে মীরকাশিমকে সিংহাসনে বসায়। অবশ্য এজন্য মীরকাশিম ইংরেজদেরকে দুই লক্ষ পাউন্ড উৎকোচ প্রদান করে।

মীরকাশিমের সাথে ইংরেজদের স্বার্থ-সংক্রান্ত দ্বন্দ্বের সূত্রে উভয় বাহিনীর ভিতর যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে উঠে। ১৭৬৩ খ্রিষ্টাব্দে মীরকাশিমের অধিকার খর্ব করার জন্য, ইংরেজরা মীরজাফরকে পুনরায় সিংহাসনে বসায়। এবারেও মীরজাফর ইংরেজদেরকে ৬৫ লক্ষ টাকা ঘুষ দিয়েছিলেন। ১৭৬৫ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ই জানুয়ারি তাঁর মৃত্যু হলে, তাঁর পুত্র নাজিম-উদ-দৌলা সিংহাসন লাভ করেন।


সূত্র :
ভারতের ইতিহাস । অতুলচন্দ্র রায়, প্রণবকুমার চট্টোপাধ্যায়।