মীরকাশিম
বাংলা বিহার উড়িষ্যার নবাব। ১৭৫৭
খ্রিষ্টাব্দের ২৩শে জুনে সংঘটিত পলাশীর যুদ্ধে, নবাব
সিরাজউদ্দৌলা'র সাথে
যাঁরা বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন, মীরকাশিম তাঁদের একজন ছিলেন।
পলাশীর যুদ্ধে জয়লাভের পর, ইংরেজরা মীরজাফরকে সিংহাসনে বসান। ইংরেজদের তোষামদ ও অর্থ প্রদানের ভিতর দিয়ে ১৭৬০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত কোনোমতে টিকে ছিল। একসময় ইংরেজ গরভর্নর ভ্যান্সিটার্ট এবং ইংরেজ রাজকর্মচারীদের অর্থলোলুপতায় মীরজাফর প্রায় নিঃস্ব হয়ে যান। এই সময় ভ্যান্সিটার্ট মীরকাশিমের সাথে এক গোপন চুক্তি করে, মীরজাফরের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ তুলে তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করে, মীরকাশিমকে সিংহাসনে বসায়। অবশ্য এজন্য মীরকাশিম ইংরেজদেরকে দুই লক্ষ পাউন্ড উৎকোচ প্রদান করেছিলেন। ১৭৬০ খ্রিষ্টাব্দে ইংরেজরা মীর কাশিমকে সিংহাসনে বসান।
পূর্বে মীরজাফর-এর সাথে কোম্পানীর চুক্তি অনুসারে, মীরকাশিম ইংরেজদেরকে অন্যতম ৪টি দাবি মেনে তা কার্যকর করেন। এগুলো ছিল-
১. বর্ধমান, মেদেনীপুর ও চট্টগ্রামের রাজস্ব আদায়ের জন্য পরওয়ানা প্রদান করেন।
২. কোম্পানীর সেনাবাহিনীর ব্যয় নির্বাহের জন্য ১০ লক্ষ টাকা প্রদান করেন।
৩. শ্রীহট্টের চুন-ব্যবসায়ীদের জন্য পরওয়ানা প্রদান করেন।
৪. কোম্পানীকে নিজস্ব মুদ্রা প্রচলনের অধিকার প্রদান করেন।
এই বিপুল পরিমাণ অর্থ প্রদানের পর রাজকোষের ঘাটতি পূরণের জন্য, মীরকাশিম মীরজাফর-এর আমলের উচ্চ পদস্থ কর্মচারীদের আয়-ব্যয়-এর হিসাব নিয়ে, সরকারী প্রাপ্য অর্থ জোরপূর্বক আদায় করেন। এই সময় সরকারী সম্পত্তি আত্মসাৎ করার অভিযোগে জরিমানা এবং সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করেন। আলীবর্দী খান-এর বংশধর এবং মীরজাফর-এর আত্মীয় স্বজনদের উপর অতিরিক্ত কর আরোপ করেন। এ ছাড়া জগৎশেঠের পরিবারের কাছ থেকে প্রায় জোর করে ঋণ গ্রহণ করেন। তবে তাঁর সকল পদক্ষেপের ভিতর প্রশংসনীয় ছিল, সরকারী ব্যয় সংকোচন প্রক্রিয়া। এরপর তিনি ধীরে ধীরে নিজেকে ইংরেজদের কবল থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করতে থাকেন। বাৎসরিক ২৬ লক্ষ টাকা রাজস্ব প্রদানের চুক্তি করে, তিনি দিল্লীর শাহ আলমের সমর্থন লাভ করেন। এরপর তিনি ইংরেজদের মিত্রভাবাপন্ন রাজকর্মচারী ও রাজাদের কঠোরভাবে দমন করেন। ইংরেজদের সংশ্রব এড়ানোর জন্য তিনি মুর্শিদাবাদ থেকে মুঙ্গেরর রাজধানী স্থানান্তরিত করেন এবং সেখানে তিনি একটি দুর্গ নির্মাণ করেন।
ইংরেজদের মোকাবিলার উপযোগী করে তিনি সেনাবহিনীকে নতুন করে সাজানোর চেষ্টা করেন। তিনি তাতার, আফগান, পারশ্যের লোকদের সেনাবহিনীতে নিয়োগ দেন। সেই সাথে সেনাবাহিনীকে প্রশিক্ষত করার জন্য মারকৎ, সমরু এবং জেন্টাল নামক তিনজন ইউরোপীয় সেনাপতিকে নিয়োগ দেন। এছাড়া তিনি মুঙ্গেরে তিনি অস্ত্র তৈরির কারখানা স্থাপন করেন।
ইতিমধ্যে ইংরেজদের সাথে
মীরকাশিমের প্রধান দ্বন্দ্বের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল বাণিজ্যের অধিকার। ইংরেজরা পলাশীর যুদ্ধের
পর, ক্রমে ক্রমে রীতি-নীত বর্জিত বণিক শ্রেণিতে পরিণত হয়। এদের অনেকেই বিনাশুল্কে
বে-আইনী ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ে। বিভিন্ন কারণে, মীরকাসেম রাজস্ব ঘাটতির কবলে পড়ে।
কোম্পানির কর্মচারীদের অবৈধ ব্যবসা বন্ধ করার জন্য, মীরকাশিম দেশীয় বণিকদের উপর
শুল্ক উঠিয়ে দেন। ফলে ইংরেজ বণিকরা প্রতিযোগিতামূলক বাজারে অসুবিধায় পড়ে। এই
অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য পাটনা কুঠির ইংরেজ কর্মচারী এলিস পাটনা শহর দখল করার
উদ্যোগ নেন। নবাবের সেনবাহিনীর তৎপরতায় ইংরেজ বাহিনী পরাজিত হয়ে পলায়ন করে। এর
প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য, মেজর এ্যাডামস দশ হাজার ইউরোপীয় সৈন্য ও চারশত দেশীয় সৈন্য
নিয়ে মীরকাশিমের বিরুদ্ধে যুদ্ধ যাত্রা করে। মীরকাশিমের অধীনে পনেরো থেকে কুড়ি হাজর
সৈন্য ছিল। কিন্তু এদের অধিকাংশই ছিল অদক্ষ। ফলে ১৭৬৩ খ্রিষ্টাব্দে কাটোয়া, গিরিয়া
এবং উদয়নালার যুদ্ধে মীরকাশিমের সৈন্য পরাজিত হয়। এরপর উভয় বাহিনীর মধ্যে চূড়ান্ত
যুদ্ধ হয় ১৭৬৪ খ্রিষ্টাব্দের ২৩শে অক্টোবর বক্সারে। ইংরেজ বাহিনীর সাথে শাহ্ আলমের বাহিনী যুক্ত
হয়। এই যুদ্ধে মীরকাশিমের বাহিনী চূড়ান্তভাবে পরাজিত হয়। মীরকাশিম যুদ্ধক্ষেত্র
থেকে পালিয়ে যান।
তিনি রহিলাখণ্ড, আল্লাহাবাদ, গোহাদ এবং সোধপুরে কিছু দিন পালিয়ে বেড়ান। সবশেষে
তিনি দিল্লীর কোতোয়াল এলাকায় অবস্থান নেন। ১৭৭৭ খ্রিষ্টাব্দের ৮ই মে তিনি পলাতক অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন।