নবাব সিরাজ-উদ্-দৌলা
ভিন্ন বানান : সিরাজদ্দৌলা।
পূর্ণনাম : মিরজা মুহাম্মাদ সিরাজ-উদ-দৌলা
বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার শেষ স্বাধীন নবাব।
১৭৩২ খ্রিষ্টাব্দ জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম জৈনুদ্দিন আহমেদ খান। মায়ের নাম আমেনা বেগম। স্ত্রীর নাম বেগম লুৎফুন্নেসা। একমাত্র কন্যা উম্মে জোহরা।
তিনি নবাব আলীবর্দী খান -এর অত্যন্ত প্রিয়পাত্র ছিলেন। ১৭৪৬ খ্রিষ্টাব্দে মারাঠাদের বিরুদ্ধে আলীবর্দী খান -এর যুদ্ধের সময় কিশোর সিরাজদ্দৌলা তার সাথি হন। আলীবর্দী সিরাজদ্দৌলাকে বালক বয়সেই পাটনার শাসনকর্তা নিযুক্ত করেছিলেন। সে সময় তাঁর হয়ে রাজা জানকীরাম রাজপ্রতিনিধিত্ব করতেন। কিন্তু বিষয়টি সিরাজদ্দৌলাকে সন্তুষ্ট করতে পারে নি। তাই তিনি একদিন গোপনে কয়েকজন বিশ্বস্ত অনুচরকে নিয়ে ভ্রমণের নাম করে স্ত্রী লুৎফুন্নেসাকে সঙ্গে নিয়ে মুর্শিদাবাদ থেকে বের হয়ে পাটনা উপস্থিত হন এবং জানকীরামকে তাঁর শাসনভার ছেড়ে দেওয়ার আদেশ দেন। কিন্তু নবাবের বিনা অনুমতিতে জানকীরাম তাঁর শাসনভার ছেড়ে দিতে অস্বীকৃতি জানান। পরে দুর্গের দ্বার বন্ধ করে বৃদ্ধ নবাবের কাছে বিস্তারিত তথ্য জানিয়ে দূত পাঠান। অন্যদিকে জানকীরামের আচরণে ভীষণ ক্ষুদ্ধ হয়ে সিরাজদ্দৌলা দুর্গ আক্রমণ করেন। উভয়পক্ষে লড়াই শুরু হয়ে গেলে হতাহতের ঘটনাও ঘটে। ঘটনার সংবাদ পেয়ে আলীবর্দী খাঁ দ্রুত ঘটনাস্থলে এসে পৌঁছান এবং পরিস্থিতি স্বাভাবিক করেন। সেদিনই আলীবর্দী খাঁ দুর্গের অভ্যন্তরস্থ দরবারে স্নেহভাজন দৌহিত্রকে পাশে বসিয়ে ঘোষণা দেন, সিংহাসনের উত্তরাধিকারী হিসেবে সিরাজদৌল্লার নাম ঘোষণা করেন।
১৭৫২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি হুগলী ভ্রমণ করেন। এ সময় ইংরেজ, ওলন্দাজ ও ফরাসি কোম্পানির প্রেসিডেন্টরা তাঁকে সম্মান প্রদর্শন করেন।
১৭৫৬ খ্রিষ্টাব্দের ২৯শে এপ্রিল নবাব আলীবর্দী খান মুর্শিদাবাদে মৃত্যবরণ করেন। এবং আলীবর্দী খান-এর পূর্ব ঘোষণা অনুসারে সিরাজদৌল্লা সিংহাসন লাভ করেন। সিংহাসন লাভের পর, তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করেন তাঁর খালা ঘষেটি বেগম। সে সময় পুর্নিয়ার শাসনকর্তা ছিলেন শওকত জঙ্গ। সিংহাসন লাভের পর সিরাজদৌল্লা ঘষেটি বেগমের সকল সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করেন। এরপর তিনি শওকত জঙ্গের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করেন। কিন্তু নবাবের আদেশ উপেক্ষা করে, কলকাতায় ইংরেজরা দুর্গ নির্মাণ করেছে, এই সংবাদ পেয়ে তিনি এই যুদ্ধযাত্রা বন্ধ করে ফিরে আসেন। ১৭৫৬ খ্রিষ্টাব্দ সিরাজদ্দৌলা প্রায় ৩০ হাজার সৈন্যের একটি বিশাল বাহিনী নিয়ে ইংরেজেদের শায়েস্তা করার জন্য অগ্রসর হন। এই অভিযানে প্রথমে তিনি ১৭ই মে কাশিমবাজার কুঠি দখল করেন। নবাবের বাহিনী ১৬ জুন ইংরেজদের ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ অবরোধ করে। দুই দিন যুদ্ধের পর, ১৯ জুনে ইংরেজ সেনাপতি এবং গভর্নর ড্রেক ইংরেজদের একটি বড় অংশকে সাথে নিয়ে পালিয়ে যান। শেষ পর্যন্ত প্রায় ১৭০ জন সৈন্য দুর্গে থেকে যায়। এই ক্ষুদ্র বাহিনী নিয়ে হলওয়েল দুর্গের ভিতর থেকে প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। কিন্তু নবাবের বন্দুকধারী সৈন্যদের আক্রমণের মুখে অধিকাংশ ওলন্দাজ সৈন্য পালিয়ে যায় এবং নবাবের বাহিনীতে যোগদান করে। ২০ জুন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ২০ জন ইংরেজ সৈন্য নিহত এবং ৭০ জন আহত হয়। সন্ধ্যায় নবাবের সৈন্যরা দুর্গের দেওয়ালে সরাসরি কামানের গোলা নিক্ষেপ করতে সক্ষম হয়। এই সময় জনৈক ওলন্দাজ সৈন্য নদী মুখের দুর্গ তোড়ন খুলে দেয়। এই পথে নবাবের সৈন্যরা দুর্গে প্রবেশ করে। উপায়ন্তর না দেখে হলওয়েল আত্মসমর্পণ করে।
বন্দীদের সাথে নবাবের সৈন্যরা দুর্গের সম্পদ লুণ্ঠন করে, তবে বন্দীদের সাথে ভালো ব্যবহারও করে। হলওয়েল নবাবের কাছ থেকে নিরাপত্তার আশ্বাসও লাভ করেন। কিন্তু রাতে ইংরেজ সৈন্যরা মাতলামি শুরু করে এবং নবাবের বাহিনীর প্রহরীদের আক্রমণ করে। এই পরিপ্রেক্ষিতে নবাব ইংরেজ সৈন্যদের বন্দী করে রাখার নির্দেশ দেন। হলওয়েলের মতে ১৮ ফুট দৈর্ঘ্য এবং ১৪ ফুট ১০ ইঞ্চি প্রস্থবিশিষ্ট একটি কক্ষে ১৪৬ জন ইংরেজকে রাখা হয়। এই ঘরে একটি মাত্র জানালা ছিল। সকালবেলায় দেখা যায়, ঘরের ১২৩ জন মৃত্যুবরণ করে। হলওয়েল কর্তৃক প্রচারিত এই ঘটনাকে অন্ধকূপ হত্যা নামে অভিহিত করা হয়।
সিরাজদ্দৌল্লা মানিকচাঁদের হাতে কলকাতার শাসনভার অর্পণ করে ১২ই জুলাই তিনি মুর্শিদাবাদে ফিরে আসেন। এরপর ইংরেজ কাউন্সিল এ্যাডমিরাল ওয়াটসন ও রবার্ট ক্লাইভকে একটি নৌবহর কলকাতা পুনরুদ্ধারের জন্য প্রেরণ করেন। এই সময় নবাবের কোনো বড় সেনাবাহিনী কলকাতায় ছিল না। ফলে ক্লাইভ প্রায় বিনাযুদ্ধে কলকাতা জয় করেন। এই সংবাদ পাওয়ার পর, সিরাজদ্দৌল্লা ১৭৫৭ খ্রিষ্টাব্দে দ্বিতীয় বারের মতো কলকাতা আক্রমণ করেন। কয়েকদিন যুদ্ধের পর, উভয় পক্ষ শান্তি আলোচনায় সম্মত হন। ৪ঠা ফেব্রুয়ারি উভয়ে পক্ষের ভিতর সন্ধিপত্র স্বাক্ষরিত হয়। একে আলীনগর সন্ধি নামে অভিহিত করা হয়। এই সন্ধির শর্তানুসারে, নবাব দিল্লির সম্রাটের দেওয়া সকল বাণিজ্যিক সুবিধা ইংরেজদের দেন। কলকাতায় দুর্গ নির্মাণে অনুমতি দেন। এবং কোম্পানি নিজের নামে মুদ্রা প্রচলনের অধিকার লাভ করে। কিন্তু ইংরেজরা এই সন্ধিপত্র মানা প্রয়োজন মনে করে নাই। ১৭৫৭ খ্রিষ্টাব্দে নবাবের আদেশ লঙ্ঘন করে ইংরেজরা চন্দননগররের ফরাসি কুঠি আক্রমণ করে। এই সময় আহম্মদশাহ আবাদলী দিল্লি আক্রমণ করে লুটতরাজ করে। এতে শঙ্কিত হয়ে সিরাজদ্দৌল্লা ইংরেজদের সাথে নতুন যুদ্ধে যেতে সাহসী হন নি। ফলে সহজেই ইংরেজরা ফরাসী কুঠি দখল করে নেয়। পলাতক ফরাসিরা মুর্শিদাবাদে আশ্রয় নেয়। এছাড়া সিরাজ ইংরেজদের শায়েস্তা করার জন্য দাক্ষিণাত্যের বুসির সাথে পত্রালাপ করেন। ইংরেজরা তাদের রাজত্ব কায়েম রাখার জন্য সিরাজকে অপসারণের জন্য দেশীয় ক্ষমতালোভীদের সাথে ষড়যন্ত্র শুরু করে। এই দলে জগৎশেঠ, মীরজাফর, রাজবল্লভ, রায়দুর্লভ, উমিচাঁদ যোগ দেয়। তারা সিরাজের পরিবর্তে মীরজাফরকে নবাব বানানোর ষড়যন্ত্র শুরু করে। এই সময় মীরজাফর ছিলেন বাংলার প্রধান সেনাপতি। সিরাজ কর্তৃক ক্রমাগত অপমানের কারণে সে সিরাজের বিপক্ষে চলে যায়। ক্লাইভের কাছে এদের এই ষড়যন্ত্রের কথা প্রকাশ পেলে, ক্লাইভ এদের সাহায্যদানে অঙ্গীকার করেন। ১৭৫৭ খ্রিষ্টাব্দের জুন মাসে কুচক্রীদের সাথে ইংরেজদের দুটি চুক্তি হয়। এই চুক্তির একটি ছিল আসল, অপরটি জাল।
আসল চুক্তিতে ছিল, মীরজাফর নবাব হলে সিরাজ-প্রদত্ত সকল বাণিজ্যিক সুবিধা ইংরেজদের দেওয়া হবে। বাংলাদেশ থেকে ফরাসীদের বিতারিত করবে। সিরাজের কলকাতা আক্রমণের ফলে কলকাতাবাসীর যে আর্থিক ক্ষতি হয়েছে, তা প্রদান করা হবে। এই চুক্তির সময় উমিচাঁদের স্বার্থের ব্যাপারটি বাদ দেওয়া হয়। উমিচাঁদ উপযুক্ত পুরস্কার না পেলে, এই ষড়যন্ত্রের কথা সিরাজ জানিয়ে দেবে এই হুমকি দিলে, আর একটি জাল পত্র তৈরি করা হয়। এই পত্রে উমিচাঁদের উপযুক্ত পুরস্কারের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়।
শিরোনাম: Plassey 1757
শিল্পী: Osprey
এই চুক্তি সম্পন্ন হওয়ার পর, ক্লাইভ সামান্য অজুহাতে সিরাজের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। সিরাজ এই যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত ছিলেন। ২৩শে জুন ভাগীরথী নদীর তীরে পলাশীর প্রান্তরের যুদ্ধ শুরু হয়। নবাবের পক্ষে সৈন্য ছিল প্রায় ৫০,০০০। নবাবের মূল বাহিনীতে ছিল ৫০টি কামান। ফরাসি সেনাপতি সিনফ্রে-এর অধীনে ছিল ৪টি কামান।
পক্ষান্তরে ইংরেজদের পক্ষে সৈন্য ছিল মাত্র ৩,০০০। কামান ছিল ৮টি। কিন্তু মীরজাফর, রায়দুর্লভ এই যুদ্ধে নিরপেক্ষ থেকে দর্শকের ভূমিকায় থাকেন। নবাবের পক্ষে যুদ্ধ করেন মীরমদন, মোহনলাল এবং সিনফ্রে নামক ফরাসি সেনাপতি। যুদ্ধের প্রথমাবস্থায় নবাব বাহিনী জয়লাভ করে। এই সময় মীরজাফরের পরামর্শে নবাব যুদ্ধবিরতির আদেশ দেন। যুদ্ধ বিরতির সময়, ইংরেজরা আকস্মিক আক্রমণ করলে, নবাবের সেনাবাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে পালিয়ে যায়। সিরাজ কোনোক্রমে রাজধানীতে ফিরে এসে অর্থ বিতরণ করে সৈন্য সংগ্রহের উদ্যোগ নেন। এরা অর্থগ্রহণ করে নবাবের সাহায্যের পরিবর্তে আত্মগোপন করে। পরে নিরুপায় হয়ে সিরাজৌদ্দালা স্ত্রীকন্যাকে সাথে নিয়ে রাজধানী ত্যাগ করেন। রাজমহলের কাছে সিরাজ সপরিবারের ধরা পড়েন। এরপর মীরাজাফরের পুত্র মীরনের নির্দেশে সিরাজকে হত্যা করা হয়। এরপর ইংরেজরা বাংলার সিংহাসনে মীরজাফরকে অধিষ্ঠিত করেন।
পলাশীর যুদ্ধে ব্যবহৃত কতিপয় যুদ্ধ সরঞ্জাম
সূত্র :
ভারতের ইতিহাস । অতুলচন্দ্র রায়, প্রণবকুমার চট্টোপাধ্যায়।
The story of Liord Clive/ edited
John Lang [ইন্টারনেট
সংস্করণ]