রবার্ট ক্লাইভ, লর্ড
ভারতবর্ষে ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠার অন্যতম সেনানায়ক।

১৭২৫ খ্রিষ্টাব্দের ২৫শে সেপ্টেম্বর, ইংল্যান্ডের ওয়েস্ট মিডল্যান্ডের শ্রোপশ্যায়র (Shropshire) কাউন্টির উত্তরাংশের মার্কেট ড্রাইটোন (Market Drayton) নামক শহরের ক্লাইভ পরিবারে রবার্ট জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার নাম ছিল রিচার্ড ক্লাইভ এবং মায়ের নাম রেবেকা গ্যাসকেল ক্লাইভ। রবার্ট ক্লাইভ ছিলেন তাঁর পিতামাতার ১৩টি সন্তানের মধ্যে (৭ কন্যা ও ৬ পুত্র) বড়। শৈশবে তিনি তাঁর খালার কাছে প্রতিপালিত হন। রবার্টের ৯ বৎসর বয়সে তাঁর এই খালার মৃত্যু হয়।

সম্রাট হেনরি চতুর্থ-এর আমলে ক্লাইভ পরিবারের একটি ছোট জমিদারি ছিল।   তাঁর বাবা তাঁকে প্রথমে
Market Drayton Grammar School -এর ভর্তি হন। কিন্তু উচ্ছৃঙ্খল আচরণের জন্য ওই স্কুল কর্তৃপক্ষ অভিযোগ তোলে, পরে তাঁর বাবা তাঁকে লণ্ডনের Merchant Taylors' School-এ ভর্তি করে দেন। এখানেও উচ্ছৃঙ্খল আচরণের জন্য বহিস্কৃত হলে, তাঁকে হার্টফোর্ডশায়ারের একটি স্কুলে ভর্তি করে দেওয়া হয়। এই স্কুল থেকে তিনি প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করতে সক্ষম হন। স্কলারশিপ না পাওয়ায় তাঁর পরবর্তী শিক্ষাকার্যক্রম ব্যাহত হয়। এই সময় তিনি নিজের মতো করে লেখাপড়া করতে থাকেন।

রবার্টের বাবা ইষ্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি-তে তাঁর জন্য একটি লেখকের চাকরির ব্যবস্থা করে দেন। এই সূত্রে ১৭৪৩ খ্রিষ্টাব্দের শুরুর দিকে তিনি জাহাজে করে ভারতে রওনা দেন। কিন্তু ওই জাহাজের মেরামতির জন্য ব্রাজিলের রিও দি জেনেরিও বন্দরে প্রায় নয় মাস অবস্থান করে। এই সময় তিনি কিছুটা পর্তুগিজ ভাষা রপ্ত করতে সক্ষম হন। উল্লেখ্য সেকালের ভারতে পর্তুগিজ ভাষা বিদেশী বণিকরা অল্পবিস্তর ব্যবহার করতো। ভারতে তাঁর এই ভাষা বিশেষ কাজে লেগেছিল। জাহাজ মেরামত হওয়ার পর, উত্তমাশা অন্তরীপে তাঁদের জাহাজ কিছুদিন থাকে। অবশেষে তাঁদের জাহাজ যখন মাদ্রাজ উপকূলে পৌঁছায়, তখন তাঁর কাছে খরচ করার মতো কোনো অর্থ ছিল না। ফলে জাহাজের ক্যাপ্টেনের কাছ থেকে তিনি চড়া সুদে ঋণ নেন। ভারতে পৌঁছে তিনি প্রথমেই তেমন কাজ জোগার করতে পারেন নি। কথিত আছে এই সময় তিনি দুই বার আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেছিলেন।

সে সময়ে বর্তমান চেন্নাই-এর কাছে মাদ্রাজপত্তম নামক ছোট্ট গ্রামে কোম্পানির সেন্ট জর্জ নামক একটি দুর্গ ছিল।
১৭৪৪ খ্রিষ্টাব্দের জুন মাসে এই দুর্গে পৌঁছান। তিনি কোম্পানিতে লেখালেখির পাশাপাশি নানা ধরণের কাজে দুই বৎসর কাটান। 

ভারতে বাণিজ্যিক আধিপত্য বিস্তার নিয়ে ফ্রেন্স ইস্ট ইন্ডিয়ান কোম্পানী এবং ব্রিটিশ ইষ্ট ইন্ডিয়ার মধ্যে দীর্ঘ দিন ধরে দ্বন্দ্ব ছিল। তারই জের ধরে, ১৭৪৫ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশ নৌসেনারা ফরাসি নৌবহরের উপর আক্রমণ চালায়। এই অবস্থায় ফরাসি নৌসেনারা ফরাসি গভর্নর জেনারেল ডুপ্লেইক্স (Governor-General Dupleix)-এর কাছে অতিরিক্ত সৈন্যের জন্য আবেদন করে। এরপর ১৭৪৬ খ্রিষ্টাব্দের ৪ঠা সেপ্টেম্বর লা বুরদনাইস  (La Bourdonnais) -এর নেতৃত্বে ফরাসি বাহিনী সেন্ট জর্জ দুর্গ আক্রমণ করে। কয়েকদিনের যুদ্ধের পর ব্রিটিশ বাহিনী আত্মসমর্পণ করে। ফরাসিরা বন্দী ইংরেজদের পণ্ডিচেরীতে স্থানান্তরিত করে। এই সময় ক্লাইভও ফরাসিদের হাতে বন্দী হয়। লা বুরদনাইস ক্ষতিপূরণ নিয়ে মাদ্রাজ ইংরেজদের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব করে। মাদ্রাজ আক্রমণের আগে, ডুপ্লেইক্স  কর্ণাটকের নবাব আন্‌ওয়ার উদ্দিনক প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে, দখলকৃত মাদ্রাজ তাঁর কাছে হস্তান্তর করবে। যুদ্ধ জয়ের পর, এ নিয়ে কালক্ষেপণ করতে থাকলে, নবাব ফরাসি বাহিনীর বিরুদ্ধে ১০ হাজার সৈন্য পাঠান। যুদ্ধের প্রথমাবস্থায় ফরাসিরা পরাজিত হয়। শেষ পর্যন্ত ফরাসি বাহিনী জয়লাভ করতে সক্ষম হয়। ফলে ইংরেজ ও নবাবের সৈন্যদের বিরুদ্ধে জয়লাভের সূত্রে ডুপ্লেইক্স ভারতে উপনিবেশ স্থাপনের স্বপ্ন দেখতে থাকে। ৯ই নভেম্বর ডুপ্লেইক্স-এর অধীনস্থ সেনাদল মাদ্রাজে প্রবেশ করে। সে সময়ে পণ্ডিচেরীতে বন্দী ইংরেজদের প্যারোলে মুক্তি দেওয়া হয়। সেই সাথে মাদ্রাজ থেকে সকল ইংরেজদের বহিস্কার করা হয়। অন্যান্য ইংরেজরা ফরাসিদের আনুগত্য মেনে নিলেও ক্লাইভ এবং কতিপয় ইংরেজ কর্মকর্তা তা মেনে নিতে পারেন নি। ফরাসিদের কাছে পরাজয়ের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য তিনি ছদ্মবেশে পণ্ডিচেরী থেকে পালিয়ে ইংরেজদের ফোর্ট ডেভিড-এ চলে যান।  এই সময় এই দুর্গের অধিপতি ছিলেন মেজর স্ট্রিঙ্গার লরেন্স (Major Stringer Lawrence)। ক্লাইভের যুদ্ধপরায়ণ মনোবৃত্তিতে মেজর লরেন্স মুগ্ধ হন। ১৭৪৮-১৭৫১ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত দক্ষিণ ভারত এবং হায়দ্রাবাদে স্থানীয় নবাব, ফরাসি এবং ইংরেজ বাহিনীর ভিতর ক্ষমতা দখলের যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়, তার অনেক ঘটনার সাথেই ক্লাইভ জড়িত ছিলেন না। এই সময় তিনি মানসিকভাবে কিছুটা বিপর্যস্ত ছিলেন। এই কারণে তাঁক বঙ্গদেশে পাঠানো হয়েছিল।

১৭৪৮ থেকে ১৭৫১ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত দাক্ষিণাত্য ও হায়দ্রাবাদের দ্বন্দ্ব
১৭৪৮ খ্রিষ্টাব্দে আয়-লা-স্যাপল চুক্তির মাধ্যমে অষ্ট্রিয়ার উত্তরাধিকার যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটে। এই চুক্তির সূত্রে ফরাসিরা মাদ্রাজকে ইংরেজদের ফিরিয়ে দেয়। এর বিনিময়ে ফরাসিরা আমেরিকা মহাদেশের লুইবার্গ-এর অধিকার লাভ করে। ডুপ্লেইক্স অনিচ্ছা সত্ত্বেও এই সন্ধি মেনে নিয়ে, মাদ্রাজ থেকে তাদের সৈন্য ফিরিয়ে নেয়। কিন্তু অন্য একটি কারণে ডুপ্লেইক্স ভারতে আধিপত্য বজায় রাখার ব্যাপারে উৎসাহী হয়ে উঠেন। ১৭৪৮ খ্রিষ্টাব্দে হায়দ্রাবাদের নিজাম আসফজার মৃত্যুর পর তাঁর দ্বিতীয় পুত্র নাসির জং এবং দৌহিত্র মুজফ্‌ফর জং-এর (বিজাপুরের শাসক) ভিতর বিরোধের সঞ্চার হয়। অন্যদিকে কর্ণাটকের নবাব দোস্ত আলির মৃত্যুর, নিজাম আসফজার প্রতিনিধি আন্‌ওয়ার উদ্দিন ও দোস্ত আলির জামাতা চাঁদ সাহেবের মধ্যে বিবাদ শুরু হয়। চাঁদ সাহেব মারাঠাদের হাতে বন্দী ছিলেন। ১৭৪৮ খ্রিষ্টাব্দে মুক্তি লাভ করে, কর্ণাটক-এর সিংহাসনের দাবি করেন। দক্ষিণ ভারতের ভারতে দেশীয় শাসকদের এই বিবাদে ডুপ্লেইক্স কর্ণাটকে চাঁদ সাহেব এবং হায়দ্রাবাদে মুজফ্‌ফর জং-এর পক্ষ নেন। তিনি এই দুই সিংহাসনের দাবিদারের সাথে গোপন চুক্তি করেন। ১৭৪৯ খ্রিষ্টাব্দের আগষ্ট মাসে চাঁদ সাহেব, মুজফ্‌ফর জং এবং ফারসি বাহিনী কর্ণাটকের নবাব আন্‌ওয়ার উদ্দিন-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। অম্বুরের যুদ্ধে এই তিন বাহিনীর কাছে আন্‌ওয়ার উদ্দিন  পরাজিত ও নিহত হন। ফলে কর্ণাটকের সিংহাসনে চাঁদ সাহেব বসেন। এর মাধ্যমে ফরাসিরা ওই কর্ণাটকে শক্তিশালী হয়ে উঠে। এই সময়  আন্‌ওয়ার উদ্দিন-এর পুত্র মোহম্মদ আলী ত্রিচিনপল্লীতে আশ্রয় নেন। এই সময় ফরাসিদের প্রতিপক্ষ হিসেবে ইংরেজরা মোহম্মদ আলি এবং হায়দ্রাবাদের নাসির জং-এর পক্ষ নেন। ইংরেজদের সাহায্যে নাসির জং পণ্ডীচেরী আক্রমণ করেন এবং চাঁদ সাহেবকে পরাজিত করেন। এই সময় তিনি মুজফ্‌ফর জংকেও বন্দী করা হয়। এই সময় কুদাপ্পার নবাব বিদ্রোহ ঘোষণা করে নাসির জংকে হত্যা করে। ফলে মুজফ্‌ফর জং মুক্তি পায় এবং ফরাসিরা তাঁকে দাক্ষিণ্যত্যের সুবেদার হিসেবে স্বীকৃতি দান করে। ফরাসি সেনাপতি বুসি এবং মুজফ্‌ফর জং -এর বাহিনী যুদ্ধাভিযানে বের হলে ১৯৫১ খ্রিষ্টাব্দে মুজফ‌ফর জং নিহত হন। এই সময় ফরাসি সেনাপতি বুসি, মুজফ‌ফর জং -এর পুত্র নিজাম-উল-মুলক-এর তৃতীয় পুত্র সালাবৎ জংকে সিংহাসনে বসান। এই সময় হায়দ্রাবাদে ফরাসি সৈন্য নিরাপত্তার জন্য অবস্থান করতে থাকে। ১৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত হায়দ্রাবাদ নিরাপদে থাকে।

১৭৫১ খ্রিষ্টাব্দের দিকে ক্লাইভ আবার দাক্ষিণাত্যে আসেন।  আন্‌ওয়ার উদ্দিন-এর পুত্র মোহম্মদ আলী ত্রিচিনপল্লীতে অবস্থান নিলে, কর্ণাটকের শাসক চাঁদ সাহেব ত্রিচিনপল্লী আক্রমণ করেন। ফরাসি বাহিনী এবং চাঁদ সাহেবের বাহিনী ত্রিচিনপল্লী জয় করতে সক্ষম না হলেও, মোহম্মদ আলী সেখানে অবরুদ্ধ হয়ে থাকেন। ইংরেজ সেনাবাহিনীও এই অবরোধ ভেঙে মোহ্ম্মদ আলীকে উদ্ধার করতে ব্যর্থ হন। এই অবস্থায় মোহম্মদ আলী, মাদ্রাজের ইংরেজ গভর্নর স্যান্ডার্সকে  চাঁদ সাহেবের রাজধানী আর্কট আক্রমণের অনুরোধ করেন। ইংরেজরা আর্কট আক্রমণে প্রথমে সুবিধা করতে না পারলে, মেজর স্ট্রিন‌জার এই আক্রমণের দায়িত্ব দেন ক্লাইভকে। ক্লাইভ এক আকস্মিক আক্রমণে আর্কট দখল করতে সক্ষম হন। এরপর আর্কট উদ্ধারে ফরাসি এবং চাঁদ সাহেবের বাহিনী আক্রমণ শুরু করলে, ক্লাইভ প্রায় দুই মাস এই আক্রমণ প্রতিহত করতে সক্ষম হন। ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে ফরাসি সেনাপতি জেকি-ল আত্মসমর্পণ করেন। প্রায় একই সময় চাঁদ সাহেব তাঞ্জোরের রাজার কাছে আত্মসমর্পণ করেন। পরে চাঁদ সাহেবকে হত্যা করে, কর্ণাটকের সিংহাসনে মোহম্মদ আলীকে বসানো হয়। এর কিছুদিন পরে লরেন্স ক্লাইভকে কমিশনারের দায়িত্বে নিয়োগ করেন। ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তাকে তখনকার সময়ে ৭০০ পাউন্ড মুল্যের তলোয়ার প্রদান করে সম্মান জানান।

১৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দে দেশে ফিরে যান এবং বন্ধু নেভিলের ছোট বোন মারগারেট মেইস্কিলিনকে বিয়ে করেন। ১৭৫৫ খ্রিষ্টাব্দের জুলাই মাসে ডেপুটি গভর্নর হিসাবে মাদ্রজে ফিরে আসেন। ফিরতি পথে তাঁরর জাহাজ বিধ্বস্থ হলে, তিনি তাঁর ৩৩ হাজার পাঊন্ড মুল্যের গোল্ড কয়েনের বাক্স হারিয়ে ফেলেন। ফিরে আসার কিছুদিনের মধ্যেই রবার্ট ক্লাইভ প্রমোশন পেয়ে লেফন্যান্ট কর্নেল হন।

১৭৫৬ খ্রিষ্টাব্দের ২৯শে এপ্রিল নবাব আলীবর্দী খান মুর্শিদাবাদে মৃত্যবরণ করেন। এবং আলীবর্দী খান-এর পূর্ব ঘোষণা অনুসারে সিরাজদৌল্লা সিংহাসন লাভ করেন। সিংহাসন লাভের পর, তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করেন তাঁর খালা ঘষেটি বেগম। সে সময় পুর্নিয়ার শাসনকর্তা ছিলেন শওকত জঙ্গ। সিংহাসন লাভের পর সিরাজদৌল্লা ঘষেটি বেগমের সকল সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করেন। এরপর তিনি শওকত জঙ্গের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করেন। কিন্তু নবাবের আদেশ উপেক্ষা করে, কলকাতায় ইংরেজরা দুর্গ নির্মাণ করেছে, এই সংবাদ পেয়ে তিনি এই যুদ্ধযাত্রা বন্ধ করে ফিরে আসেন। ১৭৫৬ খ্রিষ্টাব্দ সিরাজদ্দৌলা প্রায় ৩০ হাজার সৈন্যের একটি বিশাল বাহিনী নিয়ে ইংরেজেদের শায়েস্তা করার জন্য অগ্রসর হন। এই অভিযানে প্রথমে তিনি ১৭ই মে কাশিমবাজার কুঠি দখল করেন। নবাবের বাহিনী ১৬ই জুন ইংরেজদের ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ অবরোধ করে। এই যুদ্ধে একসময় ইংরেজরা আত্মসমর্পণ করে। বন্দীদের সাথে নবাবের সৈন্যরা দুর্গের সম্পদ লুণ্ঠন করে, তবে বন্দীদের সাথে ভালো ব্যবহারও করে। হলওয়েল নবাবের কাছ থেকে নিরাপত্তার আশ্বাসও লাভ করেন। কিন্তু রাতে ইংরেজ সৈন্যরা মাতলামি শুরু করে এবং নবাবের বাহিনীর প্রহরীদের আক্রমণ করে। এই পরিপ্রেক্ষিতে নবাব ইংরেজ সৈন্যদের বন্দী করে রাখার নির্দেশ দেন। হলওয়েলের মতে ১৮ ফুট দৈর্ঘ্য এবং ১৪ ফুট ১০ ইঞ্চি প্রস্থবিশিষ্ট একটি কক্ষে ১৪৬ জন ইংরেজকে রাখা হয়। এই ঘরে একটি মাত্র জানালা ছিল। সকালবেলায় দেখা যায়, ঘরের ১২৩ জন মৃত্যুবরণ করে। হলওয়েল কর্তৃক প্রচারিত এই ঘটনাকে অন্ধকূপ হত্যা নামে অভিহিত করা হয়।

সিরাজদৌল্লা মানিকচাঁদের হাতে কলকাতার শাসনভার অর্পণ করে ১২ই জুলাই তিনি মুর্শিদাবাদে ফিরে আসেন। এরপর ইংরেজ কাউন্সিল এ্যাডমিরাল ওয়াটসন ও রবার্ট ক্লাইভকে একটি নৌবহর কলকাতা পুনরুদ্ধারের জন্য প্রেরণ করেন। এই সময় নবাবের কোনো বড় সেনাবাহিনী কলকাতায় ছিল না। ফলে ক্লাইভ প্রায় বিনাযুদ্ধে কলকাতা জয় করেন। এই সংবাদ পাওয়ার পর, সিরাজদৌল্লা ১৭৫৭ খ্রিষ্টাব্দে দ্বিতীয় বারের মতো কলকাতা আক্রমণ করেন। কয়েকদিন যুদ্ধের পর, উভয় পক্ষ শান্তি আলোচনায় সম্মত হন। ৪ঠা ফেব্রুয়ারি উভয়ে পক্ষের ভিতর সন্ধিপত্র স্বাক্ষরিত হয়। একে আলীনগর সন্ধি নামে অভিহিত করা হয়। এই সন্ধির শর্তানুসারে, নবাব দিল্লির সম্রাটের দেওয়া সকল বাণিজ্যিক সুবিধা ইংরেজদের দেন। একই সাথে নবাব কলকাতায় ইংরেজদের দুর্গ নির্মাণে অনুমতি দেন। এই সময় নবাবের অনুমতিক্রমে কোম্পানি নিজের নামে মুদ্রা প্রচলনের অধিকার লাভ করে।

কিন্তু শেষ পর্যন্ত ইংরেজরা এই সন্ধিপত্র মানা প্রয়োজন মনে করে নাই। ১৭৫৭ খ্রিষ্টাব্দে নবাবের আদেশ লঙ্ঘন করে ইংরেজরা চন্দননগররের ফরাসি কুঠি আক্রমণ করে। এই সময় আহম্মদশাহ আবদলী দিল্লি আক্রমণ করে লুটতরাজ করে। এতে শঙ্কিত হয়ে সিরাজদৌল্লা ইংরেজদের সাথে নতুন করে যুদ্ধে যেতে সাহসী হন নি। ফলে সহজেই ইংরেজরা ফরাসী কুঠি দখল করে নেয়। পলাতক ফরাসিরা মুর্শিদাবাদে আশ্রয় নেয়। এছাড়া সিরাজ ইংরেজদের শায়েস্তা করার জন্য দাক্ষিণাত্যের বুসীর সাথে পত্রালাপ করেন। ইংরেজরা তাদের রাজত্ব কায়েম রাখার জন্য সিরাজকে অপসারণের জন্য দেশীয় ক্ষমতালোভীদের সাথে ষড়যন্ত্র শুরু করে। এই দলে জগৎশেঠ, মীরজাফর, রাজবল্লভ, রায়দুর্লভ, উমিচাঁদ যোগ দেয়। তারা সিরাজের পরিবর্তে মীরজাফরকে নবাব বানানোর ষড়যন্ত্র শুরু করে। এই সময় মীরজাফর ছিলেন বাংলার প্রধান সেনাপতি। সিরাজ কর্তৃক ক্রমাগত অপমান এবং উচ্চাশার কারণে সে সিরাজের বিপক্ষে চলে যায়। ক্লাইভের কাছে এদের এই ষড়যন্ত্রের কথা প্রকাশ পেলে, ক্লাইভ এদের সাহায্যদানে অঙ্গীকার করেন। ১৭৫৭ খ্রিষ্টাব্দের জুন মাসে কুচক্রীদের সাথে ইংরেজদের দুটি চুক্তি হয়। এই চুক্তির একটি ছিল আসল, অপরটি জাল।

এই চুক্তি সম্পন্ন হওয়ার পর, ক্লাইভ সামান্য অজুহাতে সিরাজের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। সিরাজ এই যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত ছিলেন। ২৩শে জুন ভাগীরথী নদীর তীরে পলাশীর প্রান্তরের যুদ্ধ শুরু হয়। নবাবের পক্ষে সৈন্য ছিল প্রায় ৫০,০০০। পক্ষান্তরে ইংরেজদের পক্ষে সৈন্য ছিল মাত্র ৩,০০০। কিন্তু মীরজাফর, রায়দুর্লভ এই যুদ্ধে নিরপেক্ষ থেকে দর্শকের ভূমিকায় থাকেন। নবাবের পক্ষে যুদ্ধ করেন মীরমদন, মোহনলাল এবং সিনফ্রে নামক ফরাসি সেনাপতি। যুদ্ধের প্রথমাবস্থায় নবাব বাহিনী জয়লাভ করে। এই সময় মীরজাফরের পরামর্শে নবাব যুদ্ধবিরতির আদেশ দেন। যুদ্ধ বিরতির সময়, ইংরেজরা আকস্মিক আক্রমণ করলে, নবাবের সেনাবাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে পালিয়ে যায়। সিরাজ কোনোক্রমে রাজধানীতে ফিরে এসে অর্থ বিতরণ করে সৈন্য সংগ্রহের উদ্যোগ নেন। এরা অর্থগ্রহণ করে নবাবের সাহায্যের পরিবর্তে আত্মগোপন করে। পরে নিরুপায় হয়ে সিরাজৌদ্দালা স্ত্রীকন্যাকে সাথে নিয়ে রাজধানী ত্যাগ করেন। রাজমহলের কাছে সিরাজ সপরিবারের ধরা পড়েন। এরপর মীরজাফরের  পুত্র মীরনের নির্দেশে সিরাজকে হত্যা করা হয়। এরপর ইংরেজরা বাংলার সিংহাসনে মীরজাফরকে অধিষ্ঠিত করেন।

যুদ্ধের শেষে ক্লাইভের নেতৃত্বে ইংরেজরা মীরজাফরকে বাংলার নবাব হিসেবে বরণ করে নেয়। কিন্তু মেদেনীপুরের শাসনকর্তা রামরাম সিংহ, বিহারের শাসনকর্তা রাজা রামনারায়ণ এবং পূর্ণিয়ার শাসনকর্তা হাজির আলি মীরজাফরের সিংহাসন লাভকে অবৈধ ঘোষণা করে। এই বিদ্রোহের সাথে রায়দুর্লভ যুক্ত আছে এই সন্দেহে মীরজাফর তাকে শাস্তি দিতে উদ্যত হন। পরে ক্লাইভের মধ্যস্থতায় তা মিটে যায়। এরপর মীরজাফর অন্যান্য বিদ্রোহীদের শাস্তি দেওয়ার উদ্যোগ নিলে, ক্লাইভের মধ্যস্থতায় সে সকল দ্বন্দ্বের অবসান হয়। এরপর  মীরজাফর প্রথমেই বিভিন্ন খাতে ইংরেজদেরকে দেড় কোটি টাকা প্রদান করে। ক্লাইভকে তিনি ২১  লক্ষ টাকা পুরস্কার হিসেবে দেন। ১৭৫৮ খ্রিষ্টাব্দে ক্লাইভ বাংলার গভর্নর পদে উন্নীত হন।

মীরজাফরের অসহায়ত্বের সুযোগে ইংরেজরা ক্রমাগত তার উপর অর্থের দাবি করতে থাকে। ইংরেজদের সে সকল দাবি পূরণ করার পরও, বর্ধমান, নদীয়া, হুগলি প্রভৃতি পরগণার রাজস্ব ইংরেজদের প্রদান করতে বাধ্য হয়। ইংরেজদের এ সকল আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে, তিনি ওলন্দাজদের সাথে মিত্রতা স্থাপন করেন। ওলন্দাজরা মনে করেছিল যে, নবাব তাদের পক্ষে যুদ্ধ করবে। তাই তারা মীরজাফরের সাথে কোনো আলোচনা না করেই, ১৭৫৯ খ্রিষ্টাব্দের শেষের দিকে ইংরেজদের আক্রমণ করে বসে।  বিদরের যুদ্ধে ওলন্দাজরা, ক্লাইভের নেতৃত্বাধীন ইংরেজ বাহিনীর হাতে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। ইংরেজরা এই যুদ্ধের জন্য মীরজাফরকে দায়ী করলেও কোনো প্রমাণ হাজির করতে ব্যর্থ হয়।

১৭৬০ খ্রিষ্টাব্দে আলি গোহর (সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলি) বাংলা ও বিহার দখলের উদ্দেশ্যে পাটনা আক্রমণ করেন।  মীরজাফর ক্লাইভের সহযোগিতায় এই আক্রমণ প্রতিহত করতে সক্ষম হন। এর পুরস্কার স্বরূপ মীরজাফর ক্লাইভকে বাৎসরিক ৩০ হাজার পাউন্ড আয়ের একটি জায়গির প্রদান করেন।

১৭৬০ খ্রিষ্টাব্দে ক্লাইভ ইংল্যান্ডে ফিরে যান। তাঁর জায়গায় বাংলার গভর্নর হন ভ্যান্সিটার্ট (
Henry Vansittart)।  ১৭৬৫ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ক্লাইভ  ইংল্যান্ডে অবস্থান করেন এবং নিজেকে রাজনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠা করার কার্যক্রম চালিয়ে যান। এই বৎসরে নন-গ্র্যাডুয়েট ক্লাইভকে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ডিসিএল ডিগ্রি প্রদান করেন। ১৭৬৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি Knight of the Bath উপাধি পান।

ইতিমধ্যে ভারতে মীরজাফরের পুত্র মীরণের মৃত্যু হয়। এই কারণে তাঁর মনোবল ভেঙে পড়ে। ইংরেজেদের অর্থ প্রদান করতে গিয়ে রাজকোষ শূন্য হয়ে পড়ে। এই সময় ইংরেজ গরভর্নর ভ্যান্সিটার্ট এবং ইংরেজ রাজকর্মচারীদের অর্থলোলুপতায় মীরজাফর প্রায় নিঃস্ব হয়ে যান। এই সময় ভ্যান্সিটার্ট মীরকাশিমের সাথে এক গোপন চুক্তি করে, মীরজাফরের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ তুলে মীরাজাফরকে ক্ষমতাচ্যুত করে, ১৭৬০ খ্রিষ্টাব্দে মীরকাশিমকে সিংহাসনে বসায়। মীরকাশিমের সাথে ইংরেজদের স্বার্থ-সংক্রান্ত দ্বন্দ্বের সূত্রে উভয় বাহিনীর ভিতর যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে উঠে। ১৭৬৩ খ্রিষ্টাব্দে মীরকাশিমের অধিকার খর্ব করার জন্য, ইংরেজরা মীরজাফরকে পুনরায় সিংহাসনে বসায়।  খ্রিষ্টাব্দের ১৭ই জানুয়ারি তাঁর মৃত্যু হলে, তাঁর পুত্র নাজিম-উদ-দৌলা সিংহাসন লাভ করেন।

এই সময় সার্বিকভাবে বাংলার অবস্থা অরাজকতায় পৌঁছায়। একদিকে বাংলার সিংহাসনের পালাবদলে জনজীবনে নানা ধরনের বিপত্তি নেমে এসেছিল। অন্যদিকে ভ্যান্সিটার্ট-এর দুর্নীতি পরায়ণ কর্মচারীদের দৌরাত্মে কোম্পানি আর্থিকভাবে ক্ষতির সম্মুখিন হয়। ফলে ক্লাইভ দ্বিতীয়বারের মতো বাংলার গভর্নর হয়ে আসেন ১৭৬৫ খ্রিষ্টাব্দে। ক্লাইভ কলকাতায় পৌঁছান ৩রা মে। তিনি এসে জানলেন ১৭ই জানুয়ারি  মীরজাফর মারা গেছেন।

বক্সারের যুদ্ধের পর, অযোধ্যার নবাব এবং মোগল সম্রাট শাহ্ আলম পরাজিত হলে, উভয় রাজশক্তি কোম্পানির কর্তৃত্বাধীন হয়ে পড়েছিল। সে সময় ক্লাইভ ইচ্ছা করলেই অযোধ্যা এবং দিল্লী অধিকার করতে পারতেন। কিন্তু দূরদেশে কর্তৃত্ব বজায় রাখা অসম্ভব মনে করে, ক্লাইভ বাংলা বিহার এবং উড়িষ্যা শাসন কোম্পানির অধিকারে রাখাটা যুক্তি সঙ্গত মনে করেন। তাই তিনি অযোধ্যার নবাবের সাথে সন্ধি করেন। এই সন্ধির ফলে অযোধ্যার নবাব কোম্পানিকে ৫০ লক্ষ টাকা যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ বাবদ প্রদান করেন। এছাড়া এলাহাবাদ এবং কারা এলাকার কর প্রদানে রাজি হন। নবাব কোম্পানির সাথে মিত্রতামূলক সন্ধি করেন। কারণ, তিনি মনে করেছিলেন যে, আফগান আক্রমণ হলে তিনি কোম্পানির সহায়তা পাবেন।

১৭৬৫ খ্রিষ্টাব্দের ১২ই আগষ্ট দিল্লীর সম্রাট শাহ আলম কোম্পানির সাথে সন্ধি চুক্তি করে। এই চুক্তি অনুসারে কোম্পানি অযোধ্যার কাছ থেকে প্রাপ্ত কর এবং এলাহাবাদ সম্রাটকে উপহার হিসেবে দেয়। এছাড়া বাৎসরিক ২৬ লক্ষ টাকা কর প্রদানের বিনিময়ে, কোম্পানি বাংলা বিহার উড়িষ্যার রাজস্ব আদায়ের ক্ষমতা তথা দেওয়ানি লাভ করে।

এরপর কোম্পানি বাৎসরিক ৫৩ লক্ষ টাকা বাৎসরিক বৃত্তি প্রদানের বিনিময়ে, বাংলার নবাব নাজিম্-উদ্-দৌলাকে রাজস্ব আদায়ের কর্তৃত্ব থেকে অব্যাহতি দেন। তিনি পুলিশ ও বেসামরিক শাসনভার নবাবের হাতে অর্পণ করেন কিন্তু সামরিক শাসনভার কোম্পানির কাছে রাখেন। এতে বাংলার নবাব আসলে ক্ষমতাহীন হয়ে পড়েন। আর এই সুযোগে কোম্পানির লোকেরা খাজনা আদায়ের নামে অবাধ লুণ্ঠন ও অত্যাচার শুরু করে দেয়। ক্লাইভের এই ব্যবস্থাকে ইতিহাসে দ্বৈতশাসন বলা হয়। 

১৭৬৭ খ্রিষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে ক্লাইভ ইংল্যান্ডে ফিরে যান। ১৭৬৮ খ্রিষ্টাব্দে কিছুদিনের জন্য তিনি প্যারিসে কাটান। এরপর তিনি ইংল্যান্ডে ফিরে আসেন। ১৭৬৮ খ্রিষ্টাব্দের রয়্যাল সোসাইটির ফেলো নির্বাচিত হন। ১৭৬৯ খ্রিষ্টাব্দে তিনি একটি বাগান এবং বাড়ি ক্রয় করেন। ১৭৭২ খ্রিষ্টাব্দে ভারতে কোম্পানির কার্যকলাপ নিয়ে পার্লামেন্টে তদন্ত করার বিষয় উত্থাপিত হয়। ভারতে ক্লাইভ কিভাবে এত অর্থ উপার্জন করেন সে বিষয়ে আলোচনা হয়। কিন্তু পার্লামেন্টের ভোটে তাঁর বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগ খারিজ হয়ে যায়। এই বৎসরেই তিনি Order of the Bath-এ অর্থ লগ্নি করেন এবং শ্রোপশ্যায়ারে লর্ড লেফট্যান্ট হিসেবে নিয়োগ পান।

১৭৭০ খ্রিষ্টাব্দে (বাংলা ১১৭৬) বাংলাদেশে অনাবৃষ্টি হয়। ফলে বাংলাদেশে খাদ্যাভাব দেখা দেয়। ইতিহাসে একে বলা হয় ছিয়াত্তরের মন্বন্তর। এই মন্বন্তরে ১৭৭৩ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত বঙ্গদেশে বিপুল পরিমাণ লোক মৃত্যুবরণ করে। ফলে ক্লাইভ এবং কোম্পানির কার্যকলাপ নিয়ে পার্লামেন্ট আবার উত্তপ্ত হয়ে উঠে। এর ফলে ভারতে কোম্পানির কার্যলাপকে নতুন আইনের অধীনের ঢেলে সাজানোর বিষয় উঠে আসে।

১৭৭৪ খ্রিষ্টাব্দের ২২ নভেম্বর তিনি গলায় ক্ষুর চালিয়ে আত্মহত্যা করেন।


সূত্র :