১৯৭১ এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ
মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে গণ-প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র


১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ২৬ মার্চ স্বাধীন বাংলা বেতারের সূচনা হয় চট্টগ্রামের কালুরঘাটে ট্রান্সমিশন ভবনে ।
২৬ মার্চ-এর প্রথম প্রহরে (২৫ মার্চ দিবাগত রাত ১২টার পর, পাকিস্তানি সেনা বাহিনি ঢাকাতে নিরস্ত্র জনগণ, পুলিশ এবং ইপিআর এর উপর আক্রমণ শুরু করে। এই আক্রমণকে পাকিস্তানি বাহিনী নাম দিয়েছিল অপারেশন সার্চ লাইট২৫ মার্চ দিবাগত রাত ১২টা ২০ মিনিটে টিএনটির মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু'র স্বাধীনতা ঘোষণার প্রচারপত্র প্রচারিত হয়। ভোর হওয়ার আগেই বার্তাটির সাইক্লোষ্টাইল মেশিনের সাহায্যে শত শত কপি তৈরি করে চট্টগ্রামের বিভিন্ন জায়গায় বিতরণ কর হয়। চট্টগ্রামের অনেক জায়গায় মধ্য রাত থেকেই মাইকেও বার্তাটি প্রচার করা হয়।

২৬ মার্চ দুপুর বেলা চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগ নেতা এম এ হান্নান, চট্টগ্রামের কালুরঘাট ট্রান্সমিশান কেন্দ্র হতে প্রথমবারের মত স্বাধীনতার ঘোষণা হিসেবে বঙ্গবন্ধুর ঐ বার্তা পাঠ করেন। এর ভিতর দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ বেতারের জন্ম হয়। এই সময় তৎকালীন চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রের কয়েকজন বেতারকর্মী, বেলাল মোহাম্মদ এবং আবুল কাশেম সন্দীপসহ সিদ্ধান্ত নেন যে, বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে জনগণকে সচেতন ও উদ্বুদ্ধ করার জন্য তাঁরা বেতার মাধ্যমে ব্যবহার করবেন। এ সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে তাঁরা প্রথমে আগ্রাবাদ বাণিজ্যিক এলাকায় অবস্থিত চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রকে কাজে লাগানোর চিন্তা করেন। এই সময় তাঁরা এই বেতার কেন্দ্রের নাম 'স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র' রাখার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু নিরাপত্তার কারণে তাঁরা এই বেতারকেন্দ্রকে কাজে না-লাগিয়ে শহর থেকে কিছু দূরে কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রে চলে যান। ২৬ মার্চ সন্ধ্যা ৭টা ৪০ মিনিটে আবুল কাশেম সন্দীপ প্রথম প্রচারে বলেন 'স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র' থেকে বলছি। এ ছাড়া তিনিই প্রথম বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা সংবাদাকারে পাঠ করেন। সে সময়েই এম এ হান্নান বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণাটি আবার পাঠ করেন। প্রায় ১ ঘণ্টা অনুষ্ঠান করার পর তারা পরদিন সকাল ৭টায় পরবর্তী অনুষ্ঠান প্রচারের ঘোষণা দিয়ে সেদিনের পর্ব শেষ করেন।

এরপর তাঁরা ২৭ মার্চ সকালে বেতার কেন্দ্রের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য পটিয়ায় অবস্থানরত মেজর জিয়ার কাছে এ ব্যাপারে সাহায্য চাইতে যান। সেখান থেকে তারা
জিয়াউর রহমানকে সাথে করে কালুরঘাট ফেরত আসেন। সেদিন অর্থাৎ ২৭ মার্চ রাত ৮টায় এক নতুন লিখিত ও সম্প্রসারিত বক্তব্যের মাধ্যমে হঠাৎ এক সিদ্ধান্তে মেজর জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুর পক্ষ থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন।

"“I Major Zia, on behalf of our great national leader Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman, do hereby declare [the] independence of Bangladesh”."

২৮ মার্চ মেজর জিয়ার অনুরোধে 'স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র' এই নাম হতে বিপ্লবী অংশটি বাদ দেয়া হয় এবং নতুন নামকরণ করা হয় 'স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র'। ২৮ মার্চ প্রথম অধিবেশনে বিমান হামলায় করণীয় সম্পর্কে নির্দেশমালা প্রচারিত হয় এবং দ্বিতীয় অধিবেশনে প্রথম একটি কথিকা পাঠ করা হয়।

৩০ মার্চ প্রভাতী অধিবেশনে প্রথম বারের মত 'জয় বাংলা, বাংলার জয়' গানটি প্রচারিত হয়। ৩০ মার্চ দুপুরের অধিবেশন শেষ হবার পর প্রায় ২টা ১০ মিনিটের দিকে বেতার কেন্দ্রে পাকিস্তানি সেনাবাহিনি বিমান হামলা করে। এর ফলে এ বেতার কেন্দ্রটির কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। এ বিমান হামলায় কেউ হতাহত না হলেও বেতার কেন্দ্র এবং সম্প্রচার যন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর ফলে সেখান থেকে সম্প্রচার চালানো অসম্ভব হয়ে পড়ে। এরপর এই বেতারকেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা দশজন সদস্য দুটি দলে বিভক্ত হয়ে আগরতলা ও ত্রিপুরার বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়েন।

৩১ মার্চ সকালে কয়েকজন বেতারকর্মী বেতার কেন্দ্রে অবস্থিত একটি এক কিলোওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ছোট সম্প্রচার যন্ত্র উদ্ধার করেন। এই সম্প্রচার যন্ত্র সাথে করে নিয়ে তাঁরা ঐদিনই পটিয়ার উদ্দেশ্যে রওনা দেন এবং ১ এপ্রিল পটিয়ায় পৌঁছেন। এরপর মূল দলটি ৩ এপ্রিল সম্প্রচার যন্ত্রটি পটিয়ায় রেখে রামগড়ের দিকে রওনা হন। রামগড়ে পৌঁছে তাঁরা ভারতের বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স তত্ত্বাবধানে ভারতীয় সীমান্তে অবস্থিত ভারত প্রদত্ত একটি শর্ট ওয়েভ (২০০ ওয়াট শর্টওয়েভ) ট্রান্সমিটার থেকে আবার অনুষ্ঠান সম্প্রচার করেন।

৪ এপ্রিল তাদের একটি দল এক কিলোওয়াট সম্প্রচার যন্ত্রটি আনার জন্য পটিয়ার উদ্দেশ্যে রওনা দেন এবং অপর দল বাগফায় চলে যান। তাঁরা বাগফা হতে ৪-৮ এপ্রিল পর্যন্ত একটি ৪০০ ওয়াট সম্প্রচার যন্ত্র দিয়ে সম্প্রচার চালাতে থাকেন। এরপর ৮ এপ্রিল আবার তারা আগরতলার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন এবং বিভিন্ন স্থান হয়ে ১১ এপ্রিল আগরতলায় পৌঁছান। অন্যদিকে দ্বিতীয় দলটি তখন ১ কিলোওয়াট ট্রান্সমিটারটি নিয়ে ১০ এপ্রিলে বাগফা-বেলোনিয়া সড়কের পাশে বাংলাদেশ সীমান্ত হতে ১০ মাইল দূরে স্থাপন করেন এবং ১২ এপ্রিল তারা সেখান থেকে অনুষ্ঠানও সম্প্রচার করেছিলেন। এ সময় অনুষ্ঠান রেকর্ড করে সম্প্রচার কেন্দ্র থেকে শর্ট ওয়েভে প্রচার করা হতো।

১০ এপ্রিল অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয় এবং প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ১১ এপ্রিল অল ইন্ডিয়া রেডিও'র শিলিগুড়ি কেন্দ্রকে "স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র" হিসাবে উল্লেখ করে সেখান থেকে ভাষণ প্রদান করেন। এরপর থেকে বেশ কিছুদিন ঐ কেন্দ্র থেকে বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ভাষণসহ আরো নানা প্রকার অনুষ্ঠান প্রচারিত হয়। ১৬ এপ্রিল জনগণের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক নির্দেশিত ঘোষণা ও আদেশপত্র পাঠ করা হয়। এরপর সেখানে কয়েকদিন অনিয়মিতভাবে সম্প্রচার চলে।

মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে বাংলাদেশ সরকার ও বেতারকেন্দ্রের কর্মীদের আবেদনের প্রেক্ষিতে ভারত সরকার বাংলাদেশ সরকারকে একটি শক্তিশালী ট্রান্সমিটার (৫০ কিলোওয়াট মিডিয়াম ওয়েভ) প্রদান করে। এই নতুন বেতারের প্রথম অধিবেশনের দিন ধার্য করা হয় কবি নজরুল ইসলামের জন্মবার্ষিকী ১১ জ্যৈষ্ঠ তথা ২৫ মে তারিখ। কলকাতার বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের ৫৭/৮নং দোতলা বাড়িটিতে রাষ্ট্রপতি ও অন্যান্য মন্ত্রীদের আবাসের কক্ষের সাথের একটি কক্ষে উক্ত ট্রান্সমিটার দিয়ে সম্প্রচার শুরু হয়েছিল। রাষ্ট্রপতি ও মন্ত্রীরা অন্য বাড়িতে উঠে যাওয়ার পর সেই ৫৭/৮ নম্বর বাড়িটিই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের স্থায়ী কার্যালয়রূপে গড়ে ওঠে। এরপর থেকে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান নিয়মিতভাবে সম্প্রচারিত হতে থাকে। উল্লেখ্য এই কেন্দ্র দুটি ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে পরিচালিত হতো।

মুক্তিযুদ্ধ সময়কালে যুদ্ধরত মুক্তিযোদ্ধাদের এবং অবরুদ্ধ এলাকার জনগণের মনোবল অক্ষুন্ন রাখার ক্ষেত্রে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মধ্যদিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে বাংলাদেশ সরকারের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিপরিষদ সদস্যদের নীতি নির্ধারণী ভাষণসহ জনগণের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন নির্দেশাবলী প্রচারিত হয়। প্রতিদিনের সংবাদসহ যে সমস্ত অনুষ্ঠান জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল তার মধ্যে চরমপত্র ও জল্লাদের দরবার অন্যতম।

নিয়মিত সম্প্রচারসমূহ :

 


সূত্র : বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের দলিলপত্র