অপারেশন সার্চলাইট
Operation Searchlight
১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের
২৫ মার্চ দিবাগত রাত ১২টার পর থেকে ১০ এপ্রিল।
১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে ২৫ মার্চ
(বৃহস্পতিবার, ১১ চৈত্র, ১৩৭৭) দিবাগত রাত্রি
১২টার পর থেকে
―
পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক তদানীন্তন পূর্ব-পাকিস্তানে সামরিক অভিযানের
সাংকেতিক নাম। এই
অভিযানের মূল লক্ষ্য ছিল, হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের ভিতর দিয়ে- বাঙালি জাতীয়তাবাদ আন্দোলনকে
সমূলে ধ্বংস করা এবং পূর্ব-বাংলার বাঙালি জনগোষ্ঠীকে দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ করা।
এই অপারেশন আনুষ্ঠানিকভাবে শেষ হয়ে এপ্রিল
মাসের ১০ তারিখে (শনিবার, ২৭ চৈত্র ১৩৭৭ )। এরপর এই অভিযানের অধিনায়ক
টিক্কা
খান তাঁর ক্ষমতা
আমির আব্দুল্লাহ খান
নিয়াজির কাছে হস্তান্তর
করেন। এর ফলে 'অপারেশন সার্চালাইট' কার্যত বাতিল হয়ে যায়। এরপর শুরু হয়-
নিয়াজি নবতর পদ্ধতির বাঙালি জাতিসত্ত্বা নিধনের কার্যক্রম।
অভিযান পরিকল্পনা
১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ২২ ফেব্রুয়ারি
(সোমবার, ৯ ফাল্গুন ১৩৭৭) পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর উচ্চস্তরের কর্মকর্তাদের ভিতরে এই অভিযানের প্রাথমিক আলোচনা হয়।
এই অভিযানের উদ্দেশ্য ছিল-
-
১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ২৬শে
মার্চের (শুক্রবার, ১২ চৈত্র ১৩৭৭) মধ্যে পূর্ব-পাকিস্তানের বড় বড় শহরগুলোকে সামরিক নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আনা
- এরপর এক মাসের মধ্যে সকল বিরোধী রাজনৈতিক দল অথবা সামরিক শক্তি নির্মূল করে ফেলা।
এই সময় পূর্ব পাকিস্তানের
জিওসি লেফট্যান্ট জেনারেল
সাহেবজাদা ইয়াকুব খান এবং পূর্ব পাকিস্তানের
ভাইস
এডমিরাল সৈয়দ মোহাম্মদ আহসান,
পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ জনগণের উপর সামরিক হামলার বিরোধিতা করেন। এই বিরোধিতার
কারণে উভয়কে তাঁদের পদ থেকে অপসারণ করা হয়। ৭ই মার্চ
(রবিবার, ২২ ফাল্গুন ১৩৭৭)
সাহেবজাদা ইয়াকুব খানকে তদানীন্তন
পূর্ব-পাকিস্তানের গভর্নর পদ থেকে অপসারিত করে,
টিক্কা
খাননকে গভর্নর করা হয়। একই সাথে
টিক্কা
খান ইস্টার্ন কমান্ডের কমান্ডার এবং সামরিক আইন
প্রশাসকের দায়িত্ব পান।
১৭ই মার্চ (বুধবার, ৩ চৈত্র ১৩৭৭),
পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর চিফ অফ স্টাফ
জেনারেল আব্দুল হামিদ খান টেলিফোন করে ১৪ ডিভিশনের অফিসার জেনারেল
খাদিম হুসেন রাজা
অপারেশনের পরিকল্পনা করার দায়িত্ব প্রদান করেন।
১৮ই মার্চ (বৃহস্পতিবার, ৪ চৈত্র ১৩৭৭) সকালে ঢাকা সেনানিবাসের
জিওসি কার্যালয়ে বসে জেনারেল>
খাদিম হুসেন রাজা এবং মেজর জেনারেল
রাও ফরমান আলী এই অভিযানের
পরিকল্পনা লিপিবদ্ধ করেন। পরিকল্পনাটি
রাও ফরমান আলী নিজ হাতে হালকা নীল রঙের একটি
অফিস প্যাডের ৫ পাতা জুড়ে (১৬টি প্যারাগ্রাফে) লিড পেন্সিল দিয়ে লিখে নেন।
জেনারেল
রাও ফরমান আলী
এই অভিযানের সিদ্ধান্ত এবং সাফল্যের শর্তাদির সীমা তৈরি
করে দেন। এই সিদ্ধান্ত অনুসারে জেনারেল
খাদিম হুসেন রাজা সেনাদলের স্থান বিতরণ, বিভিন্ন
ব্রিগেড ও ইউনিটের উপর সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব বণ্টন ইত্যাদি কাজ তদারকি করেন। এই
সামরিক কর্মকর্তাদ্বয় ধারণা করেছিলেন যে, বাঙালি সেনারা অভিযানের শুরু থেকেই
বিদ্রোহ করবে। তাই পরিকল্পনাকারীরা প্রেসিডেন্ট
ইয়াহিয়া খান সাথে আলাপকালে বাঙালি
সৈন্যদের নিরস্ত্র করার এবং বাঙালি রাজনৈতিক নেতাদের গ্রেফতারের প্রস্তাব দেন।
পরিকল্পনাটি ২০ মার্চে জেনারেল
আব্দুল হামিদ খানএবং লে জেনারেল
টিক্কা
খান
ঢাকাস্থ স্টাফ অফিসে গভীরভাবে পর্যালোচনা করেন। প্রাথমিকভাবে
আব্দুল হামিদ খান
তাৎক্ষণিকভাবে বাঙালি
ইপিআর, আর্মড পুলিশ ও আধা-সামরিক বাহিনীদের নিরস্ত্র করার অনুমতি দেন। তবে
পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হিসেবে
ইয়াহিয়া খান,
এই সিদ্ধান্তের রদবদল করে-
আওয়ামী লীগ
নেতাদের গণহারে গ্রেফতারের পরিকল্পনাকে বাতিল করে দেন।
পরিকল্পনায় ঢাকা ছাড়া অন্যান্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্থান নিয়ন্ত্রণে রাখার
সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছিল। এই স্থানগুলো হলো
―
ঢাকা,
খুলনা,
রাজশাহী, কুমিল্লা, যশোর, রাজশাহী, রংপুর, সৈয়দপুর এবং সিলেট।
উল্লেখ্য এসব স্থানে আগে থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্য ছিল। এছাড়া পূর্ব
পাকিস্তানের অন্যান্য স্থানে অবস্থিত পাকিস্তানি সৈন্যদল এবং প্যারা মিলিটারি
বাহিনীদের নিজ নিজ এলাকা নিয়ন্ত্রণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। অভিযান শুরু হওয়ার পর
প্রথমে ঢাকা সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আনা হবে। এরপর পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থানরত ৯ম এবং
১৬তম ডিভিশনের সৈন্যরা শক্তিবৃদ্ধির জন্য বিমান যোগে ঢাকা চলে আসবে। যেসব শহরে
বিমানঘাঁটি আছে (সে সময়ে চট্টগ্রাম, সিলেট, যশোর, রংপুর, কুমিল্লাতে বিমানঘাঁটি
ছিল) সেসব শহরে সরাসরি ঢাকা থেকে সি-১৩০ (C-130)
বিমান অথবা হেলিকপ্টার ট্রুপস এর মাধ্যমে শক্তি বৃদ্ধি করা হবে।
অভিযানে পাকিস্তানি সেনাশক্তি
এই অভিযান পরিচালনার জন্য
পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় ইউনিটের জিওস লে.জেনারেল
টিক্কা
খানের
অধীনে ছিল ১৪তম পদাতিক ডিভিশন। এই ব্রিগেডগুলো ছিলো
―
- ১৪তম পদাতিক ডিভিশন:
পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় ইউনিটের জিওস মার্চে লে.জেনারেল
টিক্কা
খানের অধীনে ছিল ১৪তম পদাতিক ডিভিশন।
এই ডিভিশনের জিওসি ছিলেন মেজর জেনারেল খাদিম রেজা। সেনাবাহিনীর সাধারণ নিয়ম
অনুযায়ী এক ডিভিশন (১০ হাজার থেকে ৩০ হাজার সৈন্যের পদাতিক দল) তিনটি
ব্রিগেড থাকার কথা, সেখানে এই ডিভিশনে চারটি পদাতিক ব্রিগেড ছিল। এগুলো হলো-
-
৫৭তম পদাতিক ব্রিগেড:
পশ্চিম পাকিস্তানি ব্রিগেডিয়ার জাহানবাজ আরবাব-এর অধীনস্থ দল। এই ব্রিগেডের সদর
দফতর ছিল ঢাকা।
-
৫৩তম পদাতিক ব্রিগেড:
পশ্চিম পাকিস্তানি ব্রিগেডিয়ার ইকবাল শফি-র অধীনস্থ দল। এই ব্রিগেডের সদর
দফতর ছিল কুমিল্লায়।
-
২৩তম পদাতিক ব্রিগেড
পশ্চিম পাকিস্তানি ব্রিগেডিয়ার আবদুল্লাহ খান মালিক-এর
অধীনস্থ দল। এই ব্রিগেডের সদর
দফতর ছিল রংপুর।
-
১০৭তম পদাতিক ব্রিগেড
পশ্চিম পাকিস্তানি ব্রিগেডিয়ার এআর দুররানি-র
অধীনস্থ দল। এই ব্রিগেডের সদর দফতর ছিল যশোর।
এছাড়া ব্রিগেডিয়ার এম এইচ মজুমদার নামের এক বাঙালি ব্রিগেডিয়ার ছিলেন চট্টগ্রামের কমান্ডে।
এই চারটি ব্রিগেডে মোট ১২টি পদাতিক ব্যাটেলিয়ন ছিল (প্রতি রেজিমেন্টে সাধারণত ৯১৫ জন
সৈন্য থাকে) যেগুলোর সবগুলোতে ছিল শুধুমাত্র পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যরা। মূলত
পাঞ্জাব, বালুচ, পাঠান এবং সিন্ধি সৈন্যরা এই দলে ছিল। এই ডিভিশনের আরো ছিল ৫টি ফিল্ড আর্টিলারী
রেজিমেন্ট, একটি হালকা বিমান বিধ্বংসী রেজিমেন্ট, দুটি মর্টার ব্যাটারি। রংপুরে অবস্থানরত
২৯তম অশ্বারোহী রেজিমেন্টই ছিল পুর্ব পাকিস্তানে অবস্থানরত একমাত্র বাঙালি সৈন্যসহ
সশস্ত্র
মিশ্র রেজিমেন্ট। ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস (ইপিআর) এর সদস্য সংখ্যা ছিল ১৬ হাজার। এর
প্রায় ২০% সৈন্য ছিল পশ্চিম পাকিস্তানি। কিন্তু বেশিরভাগ ইউনিটের ইউনিট
কমান্ডার এবং উচ্চপদস্থ সেনা কর্মকর্তাগণ ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানি।
ঢাকা বিমান ঘাঁটিতে পাকিস্তানি বিমান বাহিনীর ২০টি এফ-৮৬ সাবের জেট এবং ৩টি টি-৩৩
প্রশিক্ষণ বিমান ছিল। সশস্ত্র বাহিনীর এক স্কোয়াড্রন ৪টি এমআই-৮ এবং ৪টি এলট-III
হেলিকপ্টার ছিল। সি-১৩০ হারকিউলিস বিমানকে পশ্চিম
পাকিস্তান থেকে অপারেশনের জন্য ঢাকায় স্থানান্তর করা হয়েছিল ২৫শে মার্চের আগে। চট্টগ্রাম, কুমিল্লা,
রংপুরের কাছাকাছি লালমনিরহাটে, সিলেটের কাছাকাছি সালুটি করে, যশোরে এবং ঠাকুরগাঁয়ের
কাছে বিমানঘাঁটিগুলো স্থাপন করা হয়।
পাকিস্তান নৌবাহিনীর চারটি গানবোট ছিল রাজশাহী, যশোর , কুমিল্লা এবং
সিলেটে। একটি পেট্রোল বোট ছিল বালাঘাটে এবং পিএনএস জাহাঙ্গির নামে একটি
ডেস্ট্রয়ার ছিল। পাকিস্তানি নৌবাহিনীর পিএনএস বাবুর নামের পতাকাবাহী জাহাজ
অপারেশন শুরুর পর পূর্ব পাকিস্তানে আসবে এমন পরিকল্পনা ছিল। উল্লেখ্য পূর্ব
পাকিস্তানের বেশির ভাগ নৌঘাঁটিই ছিল ঢাকা,
চট্টগ্রাম ও মংলায়।
এই
অভিযান কার্যকরী হওয়ার আগে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং আওয়ামী লীগের অন্যান্য
নেতাদের ভিতরে মনে ভুল ধারণা সৃষ্টি করার জন্য, রাখার জন্য ইয়াহিয়া খান আলোচনা
চালিয়ে যাওয়ার অভিনয় করবেন
―
এটাও এই অভিযান পরিকল্পনার অংশ ছিল। এক্ষেত্রে জুলফিকার আলী ভুট্টো যদি আওয়ামী
লীগের প্রস্থাবে রাজি হয়ে আলোচনা চালিয়ে যেতে অনিচ্ছা প্রকাশ করেন, তবুও ইয়াহিয়া
খান আলোচনা চালিয়ে যাবেন।
ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে (ইবিআর) বাঙালি সৈন্য পূর্ব পাকিস্তানে তখন ৬টি নিয়মিত বাঙালি পদাতিক বাহিনী
(ইবিআর) ছিল। এই বাহিনীগুলো হলো-
- ১ম ইবিআর: যশোরে ১০৭তম ব্রিগেডের সাথে যুক্ত ছিল।
- ২য় ইবিআর: ঢাকার দক্ষিণে জয়দেবপুরে ৫৭তম ব্রিগেডের সাথে যুক্ত ছিল।
- ৩য় ইবিআর: সৈয়দপুরে ২৩তম ব্রিগেডের সাথে যুক্ত
ছিল।
- ৪র্থ ইবিআর: ৫৩তম ব্রিগেডের সাথে কুমিল্লায় ছিল।
- ৮ম ইবিআর: পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নির্দেশে পশ্চিম পাকিস্তানে যাবার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল এবং
এদের প্রায় ৭৫%
সৈন্য ছিল চট্টগ্রামে।
- ৯ম ইবিআর: চট্টগ্রামের ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারে ২০০০ বাঙালি
সৈন্য অবস্থান করছিল, যাদের মধ্যে নতুনভাবে তৈরি করা ৯ম ইবিআর-এর অন্তর্ভুক্ত ছিল।
- ১০ম ইবিআর: এটি ছিল একটি প্রশিক্ষণ ইউনিট, এটি ঢাকায় ১৪তম ডিভিশনের সাথে সংযুক্ত ছিল।
এই সকল বাঙালি সৈন্যদের অফিসারদের ভিতরে বাঙালি অফিসার ছিল ১ম, ২য় এবং ১০ম ইবিআর এর নেতৃত্বে। বাদবাকিগুলোর দায়িত্বে
ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানি অফিসাররা।
পূর্ব পাকিস্তানের পুলিশ বাহিনীর কিছু পশ্চিম পাকিস্তানি অফিসার ছাড়া অধিকাংশই ছিল
বাঙালি। এছাড়া ছিল ১৫০০০ সৈন্যের প্যারামিলিটারি বাহিনী (যার মধ্যে ৮০% বাঙালি),
ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস (ইপিআর): এরা সীমান্তবর্তী ৭টি সেক্টরে মোতায়েন ছিল। এগুলোর সদর দফতর ছিল, যথাক্রমে ঢাকা,
ময়মনসিংহ, যশোর, রাজশাহী, দিনাজপুর, সিলেট এবং চট্টগ্রামে। এই দলটি
১৭টি অপারেশনাল উইঙে বিভক্ত ছিল (প্রতি উইঙে ১৫০ জনের ৩-৬টি কোম্পানি থাকতো)। ইপিআর কোম্পানীদের প্রায়শই ছোট ছোট সেকশন(১৫-২০জন
সৈন্য) এবং প্লাটুনে(২০-৩৫জন সৈন্য) বিভক্ত করে সীমান্তের নিকটবর্তী ক্যম্পে অথবা
সীমান্ত ফাঁড়িতে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছিল। এই দলগুলোর দায়িত্বে সাধারণ
সেনাবাহিনীর একজন ক্যাপ্টেন ও মেজর থাকতেন। ইপিআর উইংদের ভারি অস্ত্র হিসাবে ছিল
হালকা ট্যঙ্ক বিধ্বংসী অস্ত্র ও মর্টার।
সারা দেশ জুড়ে অভিযানের প্রস্তুতি
পাকিস্তানি সেনাকর্মকর্তারা পূর্ব পরিকল্পনা অনুসারে পূর্ব-পাকিস্তানের বিভিন্ন
স্থানে সৈন্যদের প্রস্তুত রাখেন। মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহে মেজর জেনারেল কামার আলি
মির্জা এবং ব্রিগেডিয়ার হ্যারিসন পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানে আসেন
রসদপত্র ব্যবস্থাপনা নিশ্চয়তার জন্য। সে সময়
বঙ্গবন্ধু'র নির্দেশে পূর্ব-পাকিস্তানে
অসহযোগিতার আন্দোলন চলছিল। ফলে সেনানিবাসগুলোতে খাদ্য সরবরাহ বাঁধাগ্রস্ত হচ্ছিল।
ইতিমধ্যে ১৩ এফএফ এবং ২২ বালুচ রেজিমেন্টের সৈন্যরা বিমানের সাধারণ যাত্রী হিসাবে
ঢাকায় পৌঁছায়। ব্রিগেডিয়ার হ্যারিসন রসদপত্র ব্যবস্থাপনার জন্য ঢাকায় থেকে যান।
কিন্তু গিয়েছিলেন জেনারেল মির্জা পশ্চিম পাকিস্তানে ফিরে গিয়েছিলেন।
এরপর
পাকিস্তানি সৈন্যার বাঙালি সেনকর্মাকর্তাদের পরিকল্পনা অনুসারে নতুনভাবে বিন্যস্ত
করেন।
- ২২ মার্চ (সোমবার, ৮ চৈত্র ১৩৭৭), ঢাকায় অবস্থানরত ৫৭তম ব্রিগেড
এর ব্রিগেড মেজর খালেদ মোশাররফ-কে বদলি করে কুমিল্লায় পাঠামো হয় ৪র্থ ইবিআর এর
২আইসি হিসেবে।
- ২৩ মার্চ (মঙ্গলবার, ৯
চৈত্র ১৩৭৭), ২য় ইবিআর এর কমান্ডিং অফিসার লে. কর্নেল মাসুদুল
হাসানকে তার পদ থেকে অব্যাহতি দেয়া হয় এবং ২৫ মার্চ তার দায়িত্ব গ্রহণ করেন লে.
কর্নেল রকিবউদ্দিন।
- ২৪ মার্চ (বুধবার, ১০ চৈত্র ১৩৭৭): সে
সময়ে পাকিস্তানি বাহিনীর অস্ত্রের মূল ভাণ্ডার ছিল ঢাকার অদূরে
অবস্থিত রাজেন্দ্রপুরে। এছাড়া ৯০০০ টন অস্ত্র ও গোলাবারুদ চট্টগ্রামে এমভি সোয়াত নামের
একটি জাহাজে খালাসের অপেক্ষায় ছিল। কিন্তু বাঙালিদের অসহযোগিতার কারণে অস্ত্র
খালাসে বিঘ্ন সৃষ্টি হয়েছিল। জেনারেল খাদিম আন্দোলনরত বাঙালি শ্রমিকদের উপর গুলি
চালানোর নির্দেশ দেন ব্রিগেডিয়ার মজুমদারকে। কিন্তু ব্রিগেডিয়ার মজুমদার এই আদেশ
অমান্য করলে, ২৪ মার্চ জেনারেল খাদিম তাঁকে অপসারিত করেন এবং জয়দেবপুরে ২য় ইবিআর এর
কাছে রিপোর্ট করতে বলেন। ব্রিগেডিয়ার মজুমদারের বদলে ব্রিগেডিয়ার এম এইচ আনসারিকে
চট্টগ্রামের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
উল্লেখ্য, ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারিতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনি ছুটির দরখাস্ত বাতিল করে
দিয়েছিল। কিন্তু মার্চে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাঙালি অফিসারদেরকে ছুটি নিতে
উদ্বুদ্ধ করেন, অন্যদিকে পাকিস্তানি কর্মকর্তাদেরকে কোন ছুটি না নিয়ে সদা সতর্ক
থাকতে বলা হয়। পশ্চিম পাকিস্তানি
কর্মকর্তা ও সৈন্যদের পরিবারের সদস্যদেরকে পূর্ব পাকিস্তান থেকে সরিয়ে নেয়া হয় এবং
তার বদলে সুযোগ সুবিধা মত কিছু পশ্চিম পাকিস্তানি বেসামরিক কর্মকর্তাদের পরিবারের
সদস্যদের পূর্ব পাকিস্তানে এনে রাখা হয়।
এরপর
বিভিন্ন সামরিক ঘাঁটিগুলোতে সশরীরে গিয়ে নির্দেশনা দেন। এই কার্যক্রমের অধীনে ২৪
মার্চ (বুধবার, ১০ চৈত্র ১৩৭৭) পাকিস্তানি
জেনারেলদের একটি দল হেলিকপ্টারে করে প্রধান প্রধান গ্যারিসনগুলো পরিদর্শন শুরু করেন।
- ২৫শে মার্চ (বৃহস্পতিবার, ১১ চৈত্র ১৩৭৭) পাকিস্তানি জেনারেলদের
হেলিকপ্টারে করে প্রধান প্রধান গ্যারিসনগুলো পরিদর্শন পরিদর্শন কার্যক্রম চলেছিল। এই সময়
গ্যারিসন কমান্ডার ও অপারেশনের অন্যান্য সিনিয়র পাকিস্তানি কর্মকর্তাদের বিভিন্ন নির্দেশনা দেওয়া হয়। এই
দলের সাথে ছিলেন জেনারেল হামিদ,
মিঠা, (মেজর জেনারেল), কোয়ার্টার-মাস্টার জেনারেল এবং
প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার কর্নেল সাদউল্লাহ। জেনারেল
রাও ফরমান আলীকে যশোরে পাঠানো হয়,
জেনারেল
খাদিম হুসেন রাজা নিজে কুমিল্লা ও চট্টগ্রামের গ্যারিসন কমান্ডারদের নির্দেশ দেন এবং
ব্রিগেডিয়ার এল-ইদ্রিস ও কর্নেল সাদউল্লাহ রংপুর সফর করেন।
২৫ মার্চের পূর্বে বাঙালি ইউনিটগুলোর সৈন্যদের একসাথে নিরস্ত্র করার অনুমতি দেননি জেনারেল হামিদ, ফলে
পাকিস্তানি নেতৃত্ব অন্যান্য উপায় বাঙালি ইউনিটগুলোর সম্ভাব্য হুমকি নিয়ন্ত্রণের
ব্যবস্থা করে। কিন্তু বাঙালি ইউনিটগুলোকে ছোট ছোট ভাগে বিভক্ত করে ফেলা
হয়, তাদেরকে সেনানিবাসের বাইরে বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন কাজ দেখিয়ে পাঠানো হয়। এর
ফলে ২৫শে মার্চের আগে বাঙালি সৈন্যরা কার্যত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। এমনকি বাঙালি
সৈন্যদের কাছ থেকে ওয়ারলেস যোগাযোগাকে ব্যবস্থা থেকে দূরে রাখার ব্যবস্থা করা
হয়েছিল। কৌশলে কিছু কিছু জায়গায় পশ্চিম পাকিস্তানি কর্মকর্তাদেরকে বাঙালি ইউনিট
পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়।
এছাড়া প্রথম ইবিআর-কে শীতকালীন প্রশিক্ষণের জন্য সীমান্তবর্তী চৌগাছায় পাঠানো হয়, ২৯ মার্চ
(সোমবার, ১৫ চৈত্র ১৩৭৭)পর্যন্ত তারা এখানেই
ছিল। দ্বিতীয় ইবিআর এর কোম্পানিগুলোকে ঢাকার আশপাশের এলাকায় ছড়িয়ে দেয়া হয় এবং
তাদের যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ অকেজো রাখা হয়। ৩য় ইবিআর এর কোম্পানিগুলোকে
ছড়িয়ে দেয়া হয় সৈয়দপুর সেনানিবাসের বাইরে গোড়াঘাট ও পার্বতীপুর এলাকার আশেপাশে।
৪র্থ ইবিআর ছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও শমসেরনগর এর মাঝামাঝি এলাকায়। একমাত্র
চট্টগ্রামেই নিয়মিত বাঙালি ইউনিটগুলোকে তাদের স্বাভাবিক এলাকা থেকে সরিয়ে নেয়া
হয় নি।
পশ্চিম পাকিস্তানের ইপিআর বাহিনীর কোম্পানিগুলোকে শহরগুলোতে মোতায়েন করে, বাঙালি
ইপিআর বাহিনীকে পাঠানো হয়েছিল
সীমান্তবর্তী এলাকায়। অধিকাংশ ইপিআর ইউনিট তাদের মূল অ্যাকশন এর অঞ্চল থেকে অনেক
দূরে ছিল এবং নিজ অবস্থান থেকে বড় শহরগুলোতে পৌঁছতে তাদের অন্তত ১ দিন লাগতো। ২৪
অথবা ২৫ মার্চ রাতে ইপিআর এর বেতার যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়া হয়।
অভিযানের প্রাথমিক লক্ষ্য
১. সারা পূর্ব-পাকিস্তানে
একযোগে অভিযান শুরু করতে হবে।
২. সর্বোচ্চ সংখ্যক রাজনৈতিক ও ছাত্র সংগঠনের নেতা, সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত
ব্যক্তিবর্গ এবং শিক্ষকদের গ্রেফতার করতে হবে।
৩. ঢাকায় অপারেশন ১০০% সফল হতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দখল এবং তল্লাশী করতে হবে।
৪. সেনানিবাসকে সুরক্ষিত রাখার প্রয়োজনে যতো অস্ত্র দরকার ব্যবহার করা হবে।
৫. টেলিফোন, টেলিভিশন, রেডিও ও টেলিগ্রাফ সহ সকল অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক যোগাযোগ
ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করে দিতে হবে।
৬. সকল পূর্বপাকিস্তানি (বাঙালি) সৈন্যদলকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ কেড়ে নিয়ে নিষ্ক্রিয়
করে দিতে হবে।
ঢাকার জন্য অভিযানের বিশেষ প্রস্তুতি
২৫ মার্চের (বৃহস্পতিবার, ১১
চৈত্র ১৩৭৭) আগে পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ড সদর দফতরের সাথে যুক্ত হয়েচিল ১৪তম ডিভিশন। এই
সময় ৫৭তম ব্রিগেড ঢাকা সেনানিবাসে অবস্থান করছিল। যেসকল নিয়মিত সেনা
ইউনিটগুলো উপস্থিত ছিল সেগুলো হলো
-
- ৫৭তম ব্রিগেড :
- ১৮ এবং ৩২তম
পাঞ্জাব (সি.ও লে.কর্নেল তাজ) রেজিমেন্ট
- ১৩তম সীমান্তবর্তী রেজিমেন্ট ২২তম বালুচ
রেজিমেন্ট
- ৬০৪তম ইন্টেলিজেন্স (গোয়েন্দা/গুপ্ত) ইউনিট
- ৩১তম ভূ-গোলন্দাজ বাহিনী
(সি.ও লে.কর্নেল জাহিদ হাসান)।
- ১৪তম ডিভিশন সদর দফতরের সাথে নিম্নলিখিত ইউনিট গুলো যুক্ত ছিল-
- ৪৩তম হালকা বিমানবিধ্বংসী
রেজিমেন্ট (সি.ও লে.কর্নেল সাফফাত আলি)
- ৩য় কমান্ডো ব্যটেলিয়নের উপকরন
(সি.ও লে.কর্নেল জেড.এ খান)
- ১৯তম সংকেত প্রদানকারী রেজিমেন্ট
(সি.ও লে.কর্নেল ইফতেখার হুসাইন)
- ১৪৯তম পদাতিক বাহিনী।
PAF
(পাকিস্তানি বিমান বাহিনী) এর সব কিছু তেজগাঁও বিমানবন্দরে জড়ো করা হয়।
২৯তম অশ্বারোহী রেজিমেন্ট থেকে এক স্কোয়াড্রনের কমপক্ষে ১৪টি
M24
শ্যাফি ট্যাঙ্ক
ঢাকায় জড়ো করা হয়। এইসকল ইউনিটের সংযুক্তি হিসাবে ৫৭তম ব্রিগেড, ১৪তম ডিভিশন এবং
পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ড সদর দফতর থেকে অন্যান্য সাহায্যকারী (ইঞ্জিনিয়ারিং,
সরবরাহকারী, এবং চিকিৎসা ইউনিট) দল ঢাকায় অবস্থান নেয়।
ঢাকা অভিযান সুসম্পন্ন করার জন্য মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী একটি পরিকল্পনা
করেছিলেন। তাঁর পরিকল্পনা ছিল নিম্নরূপ
―
- ১৩তম সীমান্তবর্তী সৈন্যদল সেনানিবাসে সংরক্ষিত শক্তি হিসাবে থাকবে এবং নিরাপত্তা
প্রদান করবে।
- ৪৩তম হালকা বিমানবিধ্বংসী বাহিনী তেজগাঁও বিমানবন্দরের নিরাপত্তার দায়িত্বে
থাকবে।
- ২২তম বালুচ রেজিমেন্ট ইপিআর বাহিনীকে নিরস্ত্র করবে এবং ইপিআর সদর দফতরের
ওয়্যারলেস ব্যবস্থা দখলে নেবে।
- ৩২তম পাঞ্জাব রেজিমেন্ট রাজারবাগ পুলিশ লাইনকে নিস্ক্রিয় করবে।
- ১৮তম পাঞ্জাব রেজিমেন্টের দায়িত্ব ছিল পুরান ঢাকা এবং নবাবপুরের নিরাপত্তা
নিশ্চিত করা।
- ৩১তম ফিল্ড রেজিমেন্ট মোহাম্মদপুর এবং মিরপুরের নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিল।
3 SSG
এর একটি প্লাটুন
শেখ
মুজিবকে গ্রেফতার
করবে।
২২তম বালুচ এবং ৩২তম পাঞ্জাব রেজিমেন্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদ্রোহীদের
নিস্ক্রিয় করবে।
২২তম বালুচ রেজিমেন্ট এরপর পিলখানার শক্তি বৃদ্ধি করবে।
২৫ মার্চ সকালে ২২তম বালুচ রেজিমেন্ট পিলখানার নিরাপত্তার দায়িত্ব নেয়। এই
সময় বাঙালি ইপিআর অফিসারদের পাকিস্তানি অফিসাররা পিলখানায় ব্যস্ত রেখেছিল। এই সময়
বাঙালি সৈন্যদের প্রায় সবাইকে কাজ বন্ধ রেখে বিশ্রামে পাঠানো হয়।
বাঙালি সশস্ত্রদল
২৫ মার্চে (বৃহস্পতিবার, ১১ চৈত্র ১৩৭৭) পশ্চিম পাকিস্তানি ব্রিগেডিয়ার নিসার আহমেদ খান ছিলেন পুরো ইপিআর
বাহিনীর প্রধান এবং পশ্চিম পাকিস্তানি লে.কর্নেল আনোয়ার হোসাইন শাহ ইপিআর এর ঢাকা
সেক্টরের সৈন্যদের কমান্ডার। এঁদের অধীনস্থ ২৫০০ ইপিআর-এর ১৩তম, ১৫তম এবং ১৬তম উইং,
সাথে ইপিআর সদর দফতর উইং এবং সংকেত প্রদানকারী উইং পিলখানায় ইপিআর সদর দফতরে
অবস্থান করছিল। প্রতিটি ইপিআর উইঙে ছিল ৩টি কোম্পানী। এই
সৈন্যদের বেশিরভাগ
পিলখানায় অবস্থান করছিল। এদের ভিতর মধ্যে দুটি কোম্পানীকে মিরপুরে, দুটি কোম্পানীকে
রাষ্ট্রপতি ভবনে এবং একটি কে গভর্নর হাউসে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। এই সময় ১০ম ইবিআর
(সি.ও লে.কর্নেল মহিউদ্দিন-বাঙালি) ঢাকা সেনানিবাসে অবস্থানরত ছিল।
রাজারবাগ পুলিশ লাইনে প্রায় ২০০০ সশস্ত্র পুলিশ ছিল। এছাড়া ছিল ঢাকার থানায়
কর্তব্যরত এবং টহলরত সশস্ত্র পুলিশ। এদের প্রায় সবাই ছিল বাঙালি।
অভিযান শুরুর প্রাক্কালে ঢাকার জনজীবন
২৫ মার্চ, সামরিক অভিযান শুরু কয়েক ঘণ্টা আগে, ঢাকায় অবস্থানকালে প্রেসিডেন্ট
ইয়াহিয়া খান
জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বাতিল করে দেন। প্রেসিডেন্টের পক্ষ থেকে বলা
হয় যে, অবিলম্বে প্রেসিডেন্ট জাতির উদ্দেশ্য ভাষণ দেবেন। উল্লেখ্য তিনি এই ভাষণে
শেখ মুজিবর রহমান ও
জুলফিকার আলী ভুট্টো'র
সাথে আলোচনার অজুহাতে ১৫ মার্চ ঢাকা এসেছিলেন।
ইয়াহিয়া খানের
ঢাকা ত্যাগের সংবাদ ঢাকা শহরে ছড়িয়ে
পড়েছিল। ফলে
আওয়ামী লীগের
স্বেচ্ছাসেবকরা রাস্তায় বিক্ষোভ করে এবং রাস্তায় হালকা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে
পাকিস্তানি সৈন্যদের চলাচলে বাধার সৃষ্টি করে। এই সময় সর্বত্র পরবর্তী কি করণী কি
কাজ হবে তা নিয়ে জনসাধারণের ভিতর সরব আলোচনা চলছিল। সেই সাথে চাপা ভয়ও ছিল সাধারণ
মানুষের ভিতরে। এই ভয় ঠিক গণহত্যার ঘটনার কথা ভেবে নয়। সাধারণ মানুষ ভেবেছিল হয়তো
সৈন্যরা গুলি বা প্রহারের মতো ঘটনা ঘটাবে।
অপারেশন শুরু
এই অভিযান শুরু হয়, পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদরশিক রাজধানী ঢাকা থেকে। ২৫ মার্চ
(বৃহস্পতিবার, ১১ চৈত্র ১৩৭৭) রাত
১২টার কিছু আগে, সকল গ্যারিসনকে ফোনের মাধ্যমে অভিযান শুরুর নির্দেশ দিয়ে প্রস্তুত
রাখা হয়। এই সময় ঢাকার সৈন্যদের কমান্ডে ছিলেন
রাও ফরমান আল
এবং অন্যান্য স্থানের
সৈন্যদের কমান্ডে ছিলেন জেনারেল
খাদিম হুসেন রাজা। জেনারেল
টিক্কা
খান এবং তার কর্মকর্তারা। ৩১তম
কমান্ড সেন্টারের সব কিছু তদারক করার দায়িত্ব নিয়েছিলেন এঁরাই। এই সময় এই দলটি ১৪তম ডিভিশনের কর্মকর্তাদের
সহযোগিতা করার উদ্দেশ্যে উপস্থিত থাকেন।
রাত ১১টায় পাকিস্তানি বাহিনী কারফিউ জারি করে। একই সাথে টেলিফোন/টেলিগ্রাফ/রেডিও স্টেশন এবং সকল প্রকার
পত্রিকা প্রকাশনা বন্ধ করে দেয়া।
ঢাকা শহরের সড়ক, রেল ও নৌ-পথের দখল নিয়ে সারা শহর বিচ্ছিন্ন করে ফেলা এবং নদীতে
টহল জারি করা।
সেই সাথে পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনী আক্রমণ শুরু করার আগেই দ্রুততার
সাথে ঢাকা শহরের সাথে অন্যান্য এলাকার যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করে দেয়।
পাকিস্তানি সৈন্যরা ১১.৩০ মিনিটে ঢাকা সেনানিবাস থেকে বের হয়। পাকিস্তানি বাহিনীর
লক্ষ্য অর্জনের জন্য ৬ ঘণ্টা সময় বেঁধে দেয়া হয়েছিল। রাস্তায় তখনো কিছু আওয়ামী লীগ
ও ছাত্র লীগের কর্মী প্রতিবন্ধকগুলোর কাছে সমবেত ছিল। সেনা নিবাস থেকে বেড়িয়ে আসা
পাকিস্তানি সৈন্যদের দ্বারা এরাই প্রথম আক্রান্ত হয়েছিল।
পাকিস্তানি সৈন্যরা
১০ম বাঙালি রেজিমেন্টকে সেনানিবাসে সহজেই নিরস্ত্র করে হত্যা করে।
৩১তম ফিল্ড রেজিমেন্টকে ঢাকার দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ এলাকা এবং শহরের উত্তরাংশের
নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্বে ছিল। এবং তারা বেশ দ্রুত এই কাজগুলো সম্পন্ন করে।
অভিযানের
শুরুতেই
মেজর বেলাল এবং লে.কর্নেল জেড এ খানের সাথে নিযুক্ত কমান্ডো বাহিনী
বঙ্গবন্ধু শেখ
মুজিবুর রহমান-কে
গ্রেফতার করে। বঙ্গবন্ধু
কে গ্রেপ্তারের অপারেশনটির নাম ছিল 'অপারেশন বিগ বার্ড' ।
বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা
পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এই অভিযান শুরু অল্প
কিছুক্ষণ আগে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানিদের আক্রমণ সম্পর্কে অবহিত হন। এবং দ্রুত একটি
বার্তা লিখে তাঁর অনুগত একজনকে দিয়ে টিএন্ডটি'র মাধ্যমে প্রচারের নির্দেশ দেন। এই
নির্দেশটি ২৫ মার্চ দিবাগত রাত ১২টা ২০ মিনিটে টিএনটির মাধ্যমে প্রচারিত হয়। এই
বার্তাটি ছিল নিম্নরূপ-
|
“ This may be my last message,
from today Bangladesh is independent. I call upon the people of
Bangladesh wherever you might be and with whatever
you have, to resist the army of occupation to the last. Your fight must
go on until the last soldier of the pakistan occupation army is expelled
from the soil of Bangladesh. Final victory is ours.” |
|
|
|
[অনুবাদ : ‘সম্ভবতঃ এটাই আমার শেষ
বার্তা, আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। আমি বাংলাদেশের জনসাধারণকে আহ্বান
জানাচ্ছি তোমরা যে যেখানেই আছ এবং যাই তোমাদের হাতে আছে তার দ্বারাই শেষ
মুহূর্ত পর্যন্ত দখলদার সৈন্যবাহিনীকে প্রতিরোধ করতে হবে। যতক্ষণ না
পাকিস্তান দখলদার বাহিনীর শেষ ব্যক্তি বাংলাদেশের মাটি থেকে বিতাড়িত হবে
এবং যতক্ষণ পর্যন্ত না চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হবে, তোমাদের যুদ্ধ চালিয়ে যেতে
হবে।’] |
এই ঘোষণা বাংলাদেশের সর্বত্র ট্রান্সমিটারে
প্রেরিত হয়। এর সঙ্গে সঙ্গেই তিনি বাংলায় নিম্নলিখিত ঘোষণাটি পাঠান-
|
'পাকিস্তান সেনাবাহিনী অতর্কিতভাবে
পিলখানা ইপিআর ঘাঁটি, রাজারবাগ পুলিশ লাইন আক্রমণ করেছে এবং শহরের রাস্তায়
রাস্তায় যুদ্ধ চলছে, আমি বিশ্বের জাতিসমূহের কাছে সাহায্যের আবেদন করছি।
আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা বীরত্বের সঙ্গে মাতৃভূমি মুক্ত করার জন্য শত্রুদের
সঙ্গে যুদ্ধ করছে। সর্বশক্তিমান আল্লাহ'র নামে আপনাদের কাছে আমার আবেদন ও
আদেশ দেশকে স্বাধীন করার জন্য শেষ রক্তবিন্দু থাকা পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে
যান। আপনাদের পাশে এসে যুদ্ধ করার জন্য পুলিশ, ইপিআর, বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও
আনসারদের সাহায্য চান। কোন আপোষ নাই। জয় আমাদের হবেই। পবিত্র মাতৃভূমি থেকে
শেষ শত্রুকে বিতাড়িত করুন। সকল আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী এবং অন্যান্য
দেশপ্রেমিক প্রিয় লোকদের কাছে এ সংবাদ পৌঁছে দিন। আল্লাহ্ আপনাদের মঙ্গল
করুন। জয় বাংলা।' |
বঙ্গবন্ধুর এই আহ্বান বেতার যন্ত্র মারফত
তাৎক্ষণিকভাবে বিশেষ ব্যবস্থায় সারাদেশে পাঠানো হয়। রাতেই এই বার্তা পেয়ে
চট্টগ্রাম, কুমিল্লা ও যশোর সেনানিবাসে বাঙালি জওয়ান ও অফিসাররা প্রতিরোধ গড়ে
তোলেন। চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর ঘোষণা প্রচার করা হয় গভীর রাতে।
তৎকালীন বেঙ্গল রেজিমেন্টের মেজর
জিয়াউর রহমান এই নির্দেশ পেয়েছিলেন কর্নেল অলি আহমেদ-এর কাছ
থেকে।
[http://www.kalerkantho.com/index.php,
অনুলিপি]
এর কিছুক্ষণ পর পাকিস্তানি বাহিনী
বঙ্গবন্ধুর বাসা ঘিরে ফেলে এবং
তাঁকে গ্রেফতার করে ক্যান্টমেন্টে নিয়ে যাওয়া হয়।
২২তম বালুচ রেজিমেন্ট ইপিআর সদর দফতরে অবস্থিত বেশিরভাগ নিরস্ত্র এবং অসংগঠিত ইপিআর
সৈন্যদের আক্রমণ করে এবং সারারাত যুদ্ধ করার এই সদর দফতর অধিকারে আনতে সক্ষম হয়। এই
সময় ইপিআর-এর অধিকাংশ সদস্য পালিয়ে যেতে সক্ষম হন এবং অবশিষ্ট সৈন্যরা নিহন হন।
পাকিস্তানি বাহিনী কোন বাধা ছাড়াই সহজে মিরপুরে অবস্থানরত ইপিআর বাহিনীকে গ্রেফতার
করে হত্যা করে। একই সাথে রাষ্ট্রপতি ভবন ও গভর্নর হাউস দখল করে নিতে সক্ষম হয়। এই
সময় কিছু লোক পালিয়ে সক্ষম হলেও বাকি সবাইকে পাকিস্তানি সৈন্যরা হত্যা করে।
পাকিস্তানি ১৮তম ও ৩২তম পাঞ্জাব রেজিমেন্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়
আক্রমণ চালায়। এই সময় ছাত্রলীগের কিছু কর্মী বাধা প্রদানের চেষ্টা করে। পরিস্থিতি
বুঝে এই সময় অনেকেই পালিয়ে যান।
ইকবাল হল (বর্তমান
সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) এবং জগন্নাথ হলে হত্যা করা হয় কয়েকশ নিরীহ ছাত্রকে এবং বড়
বড় গর্ত করে পুঁতে ফেলা হয় ওইসব লাশ। ওই রাতেই হত্যা করা হয়, আন্তর্জাতিক
খ্যাতিসম্পন্ন দার্শনিক অধ্যাপক ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব, ড. জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরদা,
ড. ফজলুর রহমান খান, অধ্যাপক এম মনিরুজ্জামান, অধ্যাপক এম এ মুক্তাদির, অধ্যাপক এম
আর খাদেম, ড. মোহাম্মদ সাদেক প্রমুখ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককে। রোকেয়া হলের মেয়েদের
ধরে নিয়ে যাওয়া হলো ক্যান্টনমেন্টে। বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন বস্তি এলাকাতে গণ হত্যা
করে। এছাড়া ঢাকার রাজপথের রিকশাওয়ালা, ভিখারি, শিশু, ফুটপাতবাসী সবাইকে হত্যা করে
এবং রাতারাতি ঢাকা পরিণত হল মৃত মানুষের শহরে পরিণত হয়ৈছিল।
২৬ মার্চ সকালের দিকে ঢাকার হিন্দু অধ্যুষিত আক্রমণের উদ্যোগ নেয়। এই সময় রাজারবাগে
অবস্থানরত পুলিশ এবং আওয়ামী লীগের
স্বেচ্ছাসেবকদের সহায়তায় সাময়িকভাবে প্রতিরোধ সৃষ্টি করে।
পিলখানার সাথে সাথে রাজারবাগ, ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয়, শাঁখারী বাজারসহ সমগ্র ঢাকাতেই শুরু হয় প্রচণ্ড আক্রমণ। রাজারবাগে
পুলিশের বাঙালি সদস্যরা প্রতিরোধ গড়ে তোলেন তাদের সামান্য অস্ত্রশস্ত্র দিয়েই। তবে
ট্যাংক আর ভারী মেশিনগানের মুখে এ প্রতিরোধ বেশিক্ষণ টেকেনি। গ্যাসোলিন ছিটিয়ে
জ্বালিয়ে দেয়া হয় পুরো সদর দফতর।
শেষ পর্যন্ত
প্রতিরোধকারীরা পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। পাকিস্তানি সেনারা এরপর ব্যাপকভাবে সাধারণ
মানুষ হত্যা করে। ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় কামান এবং সাঁজোয়া যান ব্যবহার করে। ভোরের
কিছু পরে পাকিস্তানি সৈন্যরা ঢাকা শহরের পূর্ণ অধিকার গ্রহণ করে এবং সারা শহরে কারফিউ
করে। বেঁচে যাওয়া পুলিশ, ইপিআর সেনা, রাজনৈতিক কর্মীরা শহর ছেড়ে
পালিয়ে যায়। বহু সাধারণ মানুষ কেউ কেউ বুড়িগঙ্গা নদী পার হয়ে জিঞ্জিরায় জমায়েত হয়।
২৬ মার্চ
থেকে ৫ এপ্রিল পর্যন্ত পাকিস্তানি বাহিনী ঢাকার বিভিন্ন অঞ্চলের হত্যাকাণ্ড ও
ধ্বংসলীলা চালায়। এই দিন তারা শহীদ মিনার, দৈনিক ইত্তেফাক কার্যালয়, ডেইলি পিপল
কার্যালয় এবং রমনার কালী মন্দির ধ্বংস করে দেয়। উল্লেখ্য সামরিক আক্রমণের ক্ষেত্রে
এ সব প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করার প্রয়োজন না থাকলে, বাঙালি জাতিসত্ত্বার সকল নিদর্শন এবং
ঐতিহ্য ধ্বংস করার জন্য পাকিস্তানি বাহিনী এই অপকর্ম করেছিল।
২৬ মার্চ, পাকিস্তানি সৈন্যরা রাজেন্দ্রপুর অস্ত্র কারখানার দখল নিয়ে নেয় এবং গুদাম
থেকে তাদের গোলাবারুদের সরবরাহ নিশ্চিত করে।
২৭ মার্চ,
পাকিস্তানি সেনারা ২ ঘণ্টার জন্য কারফিউ তুলে নেয়। সময় ঢাকা থেকে বিপুল সংখ্যক
মানুষ গ্রামাঞ্চলের নিরাপদ স্থানে পালিয়ে যায়। এরপর পাকিস্তানি সৈন্যরা শহরের বাইরের দিকে
হত্যাযজ্ঞের জন্য হানা দেয়। প্রথমে এরা পূর্বে ডেমরা, উত্তরে টঙ্গী এবং দক্ষিণে
নারায়ণগঞ্জের দিকে অবস্থান নিয়ে শহরে প্রবেশের রাস্তা বন্ধ করে দেয়। এপ্রিলের ১০
তারিখের মধ্যেই পাকিস্তানি সেনারা দক্ষিণে পদ্মা নদী পর্যন্ত এবং উত্তরে
টঙ্গী-নরসিংদী পর্যন্ত এলাকা দখল করে নিতে সক্ষম হয়।
২৬ মার্চ থেকে ৬ এপ্রিল পর্যন্ত একটি অপারেশন যার নাম দেয়া হয় "
GREAT
FLY-IN>"
। এর মধ্যে দিয়ে
পাকিস্তানি বেসামরিক বিমান-বাহিনীর বোয়িং এবং
C-130
পরিবহন বিমানের মাধ্যমে, ৯ম ও১৬তম ডিভিশনকে ঢাকায় আনা হয়।
এই অভিযানের নৃশংসতা নিয়ে পাকিস্তানি ও আন্তর্জাতিক মাধ্যমগুলোর মতামত
এই অভিযানে ঠিক কতো মানুষ হত্যা করা হয়েছিল তার যথার্থ জানা যায় না। জেনারেল একে.
নিয়াজি 'দ্য বিট্রেয়াল অব ইষ্ট পাকিস্তান' গ্রন্থে এই অভিযান সম্পর্কে
লিখেছেন- '... একটি শান্তিপূর্ণ রাত পরিণত হয় দুঃস্বপ্নে। চারিদেক আর্তনাদ ও
অগ্নিসংযোগ। জেনারেল টিক্কা তার সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন যেন তিনি তার নিজের
বিপথগামী লোকের সঙ্গে নয়; একটি শত্রুর সঙ্গে লড়াই করছেন। ২৫ মার্চের সেই সামরিক
অভিযানের হিংস্রতা ও নৃশংসতা বুখারায় চেঙ্গিস খান, বাগদাদে হালাকু খান এবং
জালিয়ানওয়ালাবাগের ব্রিটিশ জেনারেল ডায়ারের নিষ্ঠুরতাকে ছাড়িয়ে যায়।
অজানা সংখ্যক মহিলারা
ধর্ষণের স্বীকার হন। অপারেশন-সার্চলাইটে প্রথম রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হল এবং কিছু বাসা বাড়ী
থেকে ৫৬৩ যুবতী নারীদের ক্যান্টনমেন্টে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়।
দেখুন :
সাইমন
ড্রিং-এর প্রতিবেদন
সূত্র :
১. লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে। মেজর রফিকুল ইসলাম।
২. মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। মেজর(অবঃ) রফিকুল ইসলাম পিএসসি।
৩. মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ব্যক্তির অবস্থান। এ.এস.এম. সামছুল আরেফিন।
৪. দ্য বিট্রেয়াল অব ইষ্ট পাকিস্তান। লে.জে.: এ.এ.কে.নিয়াজী। ভাষান্তর সাহাদত হোসেন
খান।
৫. বাংলাদেশের
স্বাধীনতাযুদ্ধের দলিলপত্র তৃতীয় খণ্ড, প্রকাশকাল: নভেম্বর ১৯৮২
৬.
Witness to Surrender Salik, Siddiq