জিয়াউর রহমান, লেফ্‌ট্যান্ট জেনারেল
বাংলাদেশের সপ্তম রাষ্ট্রপতি, সেনাপ্রধান, বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা (বীর উত্তম)।

১৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৯ জানুয়ারি, বাংলাদেশের বগুড়া জেলার বাগবাড়ী গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মনসুর রহমান এবং মাতার নাম জাহানারা খাতুন ওরফে রানী। পাঁচ ভাইদের মধ্যে জিয়াউর রহমান ছিলেন দ্বিতীয়। তাঁর পিতা কলকাতা শহরে এক সরকারি দপ্তরে রসায়নবিদ হিসেবে কর্মরত ছিলেন।

শৈশবের কিছুকাল বাগবাড়ী গ্রামে থাকার পর লেখাপড়ার জন্য তিনি কলকাতায় আসেন। এই সময় তিনি কলকাতার হেয়ার স্কুলে ভর্তি হন। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে ভারতবর্ষ বিভাজনের পর তিনি তাঁর পরিবারের সাথে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসেন। এরপর তিনি তাঁর পিতা-মাতার সাথে পশ্চিম পাকিস্তানের করাচিতে চলে যান এবং করাচি একাডেমী স্কুলে ভর্তি হন। ঐ স্কুল থেকে তিনি ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে মাধ্যমিক শিক্ষা সমাপ্ত করেন। এরপর তিনি ১৯৫৩ সালে করাচির ডি.জে. কলেজে ভর্তি হন। একই বছর তিনি পাকিস্তানী সেনাবহিনীতে যোগাদানের চেষ্টা করে সফল হন এবং কাকুল মিলিটারি একাডেমীতে অফিসার ক্যাডেট হিসেবে যোগদান করেন।

১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হিসেবে কমিশন প্রাপ্ত হন। এরপর তিনি ১৯৫৭ খ্রিষ্টাব্দে ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে বদলি হয়ে আসেন। তিনি ১৯৫৯ থেকে ১৯৬৪ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা বিভাগে কাজ করেন। ১৯৬০ খ্রিষ্টাব্দে  খালেদা খানমের সঙ্গে জিয়াউর রহমান বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন।

১৯৬৫ খ্রিষ্টাব্দে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে একটি কোম্পানির কমান্ডার হিসেবে খেমকারান সেক্টরে তিনি যুদ্ধ করেন। যুদ্ধে দুর্ধর্ষ সাহসিকতা প্রদর্শনের জন্য যেসব তার কোম্পানি পুরস্কৃত হয়, তার ভিতরে তার কোম্পানিটিও ছিল। পাকিস্তান সরকার তাঁকে 'হিলাল-ই-জুরাত' খেতাবে ভূষিত করে। এছাড়াও তাঁর সেনাদল বীরত্বের জন্য দুটি 'সিতারা-ই-জুরাত' এবং নয়টি 'তামঘা-ই-জুরাত' পুরস্কার লাভ করে।

১৯৬৬ খ্রিষ্টাব্দে তিনি পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমিতে পেশাদার ইনস্ট্রাক্টর হিসাবে যোগাদান করেন। সে বছরই তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের কোয়েটার স্টাফ কলেজে কমান্ড কোর্সে যোগ দেন। ১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দে তিনি মেজর পদে উন্নীত হয়ে জয়দেবপুরে সেকেন্ড ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড পদের দায়িত্ব লাভ করেন। এরপর উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য তিনি পশ্চিম জার্মানিতে যান। ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দে দেশে ফিরে আসেন এবং চট্টগ্রামে অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড হিসাবে দায়িত্ব লাভ করেন।

১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ২৫শে মার্চ দিবাগত রাতে পশ্চিম পাকিস্তানী সেনাবাহিনী, পূর্ব পাকিস্তানের নিরস্ত্র বাঙালীদের ওপর বর্বরের মতো ঘৃণ্য আক্রমণ চালায়। এই আক্রমণের প্রধান লক্ষ্য ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, পিলখানা রাইফেল সদর দফতর ও রাজারবাগ পুলিশ হেড কোয়ার্টার। এই পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু ২৫ মার্চ রাত ১২টা ২০ মিনিটে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন :

  "This may be my last message, from today Bangladesh is independent. I call upon the people of Bangladesh wherever you might be and with whatever you have, to resist the army of occupation to the last. Your fight must go on until the last soldier of the pakistan occupation army is expelled from the soil of Bangladesh. Final victory is ours."

[অনুবাদ : "সম্ভবতঃ এটাই আমার শেষ বার্তা, আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। আমি বাংলাদেশের জনসাধারণকে আহ্বান জানাচ্ছি তোমরা যে যেখানেই আছ এবং যাই তোমাদের হাতে আছে তার দ্বারাই শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত দখলদার সৈন্যবাহিনীকে প্রতিরোধ করতে হবে। যতক্ষণ না পাকিস্তান দখলদার বাহিনীর শেষ ব্যক্তি বাংলাদেশের মাটি থেকে বিতাড়িত হবে এবং যতক্ষণ পর্যন্ত না চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হবে, তোমাদের যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে।"]
 
এই ঘোষণা বাংলাদেশের সর্বত্র ট্রান্সমিটারে প্রেরিত হয়। এর সঙ্গে সঙ্গেই তিনি বাংলায় নিম্নলিখিত ঘোষণাটি পাঠান
 
'পাকিস্তান সেনাবাহিনী অতর্কিতভাবে পিলখানা ইপিআর ঘাঁটি, রাজারবাগ পুলিশ লাইন আক্রমণ করেছে এবং শহরের রাস্তায় রাস্তায় যুদ্ধ চলছে, আমি বিশ্বের জাতিসমূহের কাছে সাহায্যের আবেদন করছি। আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা বীরত্বের সঙ্গে মাতৃভূমি মুক্ত করার জন্য শত্রুদের সঙ্গে যুদ্ধ করছে। সর্বশক্তিমান আল্লাহ'র নামে আপনাদের কাছে আমার আবেদন ও আদেশ দেশকে স্বাধীন করার জন্য শেষ রক্তবিন্দু থাকা পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যান। আপনাদের পাশে এসে যুদ্ধ করার জন্য পুলিশ, ইপিআর, বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও আনসারদের সাহায্য চান। কোন আপোষ নাই। জয় আমাদের হবেই। পবিত্র মাতৃভূমি থেকে শেষ শত্রুকে বিতাড়িত করুন। সকল আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী এবং অন্যান্য দেশপ্রেমিক প্রিয় লোকদের কাছে এ সংবাদ পৌঁছে দিন। আল্লাহ্ আপনাদের মঙ্গল করুন। জয় বাংলা।'

বঙ্গবন্ধুর এই আহ্বান বেতার যন্ত্র মারফত তাৎক্ষণিকভাবে বিশেষ ব্যবস্থায় সারাদেশে পাঠানো হয়। রাতেই এই বার্তা পেয়ে চট্টগ্রাম, কুমিল্লা ও যশোর সেনানিবাসে বাঙালি জওয়ান ও অফিসাররা প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর ঘোষণা প্রচার করা হয় গভীর রাতে। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান এই নির্দেশ পেয়েছিলেন কর্নেল অলি আহমেদ-এর কাছ থেকে।
সূত্র : কালের কণ্ঠ অনুলিপি]

এই সময় জিয়াউর রহমান চট্টগ্রামে তাঁর রেজিমেন্টের সাথে ছিলেন। ২৭শে মার্চ তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষ থেকে চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা পত্র পাঠ করেন।

  "“I Major Zia, on behalf of our great national leader Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman, do hereby declare [the] independence of Bangladesh”."

জিয়াউর রহমান কয়েকদিন চট্টগ্রাম ও নোয়াখালী অঞ্চল নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হলেও, পরবর্তীতে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর অভিযানের মুখে কৌশলগত কারণে তাঁরা সীমান্ত অতিক্রম করেন। ১৭ই এপ্রিল মুজিবনগর সরকার গঠিত হলে, তিনি ১ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার নিযুক্ত হন। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের জুন পর্যন্ত ১ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার ও তারপর জেড-ফোর্সের প্রধান হিসেবে তিনি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। স্বাধীনতা যুদ্ধে বীরত্বের জন্য তাকে 'বীর উত্তম' উপাধিতে ভূষিত করা হয়।

স্বাধীনতার পর জিয়াউর রহমানকে কুমিল্লায় সেনাবাহিনীর ব্রিগেড কমান্ডার নিয়োগ করা হয় এবং ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের জুন মাসে তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ;ডেপুটি চিফ-অফ-স্টাফ' পদে উন্নীত হন। ১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দের মাঝামাঝি সময়ে তিনি ব্রিগেডিয়ার পদে এবং বছরের শেষের দিকে মেজর জেনারেল পদে পদোন্নতি পান।

১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ই আগষ্টে একটি সামরিক অভ্যুত্থানে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবর রহমান নিহত হন। এই সময় এই হত্যাকাণ্ডের অন্যতম সংগঠক খন্দকার মোশতাক আহমেদ রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ২৫শে আগষ্ট জিয়াউর রহমান 'চীফ অফ আর্মি স্টাফ' হিসাবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। ৩রা নভেম্বর বীর বিক্রম শাফায়াত জামিলের নেতৃত্বাধীন ঢাকা ব্রিগেডের সহায়তায় বীর উত্তম মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফ এক ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থান ঘটান। এর ফলে ৬ই নভেম্বর খন্দকার মোশতাক আহমেদ পদত্যাগ করতে বাধ্য হন এবং আবু সাদাত সায়েম বাংলাদেশের নতুন রাষ্ট্রপতি হন। এর পর জিয়াউর রহমানকে চীফ-অফ-আর্মি স্টাফ হিসেবে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয় এবং তাঁকে গৃহবন্দী করে রাখা হয়। বীর উত্তম কর্নেল (অবঃ) আবু তাহের সে সময় চট্টগ্রামে অবস্থান করছিলেন।

কর্নেল তাহের ছিলেন জিয়াউর রহমানের একজন বিশেষ শুভাকাঙ্ক্ষী। তিনি জিয়াউর রহমানকে নিজের আদর্শের মানুষ হিসাবেই মনে করতেন। সাধারণ সিপাহীদের ভিতর কর্নেল তাহেরের জনপ্রিয়তা ছিল। এই জনপ্রিয়তার সুযোগ নিয়ে তিনি জিয়াউর রহমানকে বন্দী দশা থেকে মুক্ত করেন। প্রথমে কর্ণেল তাহের চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা আসেন এবং তাঁর দল জাসদের কর্মীদের উজ্জীবিত করেন। ৭ই নভেম্বর তিনি যে অভ্যুত্থানটি পরিচালনা করেন, তাকে 'সিপাহী-জনতার অভ্যুত্থান' নামে অভিহিত করা হয়। কর্নেল তাহেরের এই পাল্টা অভ্যুত্থান সফল হয় এবং জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করে নিয়ে আসেন। ঐ দিনই ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্যরা জেনারেল খালেদ মোশাররফকে হত্যা করে। এরপর জেনারেল জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় উঠে আসেন। ৭ই নভেম্বর তিনি প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। সামরিক শাসনের অধীনে তিনি দেশের সর্বময় ক্ষমতার অধিকার লাভ করেন।

উল্লেখ্য বঙ্গবন্ধুর হত্যায় জিয়াউর রহমানের পরোক্ষ সমর্থন ছিল। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত কর্নেল ফারুক এবং কর্নেল রশিদ, ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশ আইটিভি টেলিভিশন চ্যানেলে এন্থনি মাসকারেনিহাসের সাথে
দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন- বঙ্গবন্ধু হত্যা পরিকল্পনাকালে তারা সে সময়ের উপ-সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানের কাছে গিয়ে হত্যা পরিকল্পনার কথা ব্যক্ত করলে জিয়া তাঁদের এগিয়ে যেতে বলেন এবং তাঁদের উৎসাহিত করে বলেন, তাঁরা সফল হলে জিয়া তাদের সঙ্গে থাকবেন। এ সাক্ষাৎকার অনুষ্ঠানটি যুক্তরাজ্য এবং বাইরে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়। এই বছরেই ম্যাসকালরেনহাসের সাথে জিয়াউর রহমান একটি সাক্ষাৎকারের সময়, ফারুকের দেওয়া উদধৃতি দিয়ে বঙ্গবন্ধুর হত্যার সাথে জিয়ার জড়িত থাকার বিষয়টি উত্থাপন করেন।  জিয়া স্বীকার বা অস্বীকার না করে চুপ করে থাকেন। 
    সূত্র:
[Anthony Mascarenhas, Bangladesh– A Legacy of Blood, Hodder and Stroughton, London, 1986)]

জিয়া বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের আত্মরক্ষায় সহায়তা করেন।  বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারবর্গ হত্যাকাণ্ডের পর খন্দকার মোশতাক আহমেদ রাষ্ট্রপতি হন এবং তিনি এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের আইনি ব্যবস্থা থেকে অনাক্রম্যতা বা শাস্তি এড়াবার ব্যবস্থা প্রদানের জন্য, ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দের ২৬শে সেপ্টেম্বর খন্দকার মোশতাক আহমেদ ইনডেমনিটি (দায়মুক্তি) অধ্যাদেশ জারি করেন।  ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দে এর নাম ছিল  অধ্যাদেশ নং ৫০। ১৯৭৯ খ্রিষ্টাব্দের জিয়াউর রহমানের শাসনামলে সংসদ কর্তৃক এটি অনুমোদিত হয়।যার ফলে এটি একটি আনুষ্ঠানিক আইন হিসেবে অনুমোদন পায়। ১৯৭৯ সালের ৯ জুলাই বাংলাদেশ সংবিধানের ৫ম সংশোধনীর পর সংশোধিত আইনে এ আইনটি বাংলাদেশ সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

বঙ্গবন্ধুর হত্যা এবং ধারাবাহিক
ঘটনার সূত্র ধরে, জিয়া ক্ষমতায় আসেন এবং  সেনাবাহিনীর ভিতর শুদ্ধি অভিযান চালান। এই সময় তিনি বহু সৈনিককে হত্যা করেন। বিশেষ করে তাঁর বিরোধিতা করেছে বা করতে পারে এমন বহু সৈন্যকে সামরিক আইনের অধীনে এনে হত্যা করেছেন। এই শুদ্ধ অভিযান চলাকালীন সময়ে, তিনি তাঁর ত্রাণকর্তা এবং প্রাণরক্ষাকারী কর্নেল (অবঃ) আবু তাহেরের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহীতার অভিযোগ আনেন এবং ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দের ২১শে জুলাই কর্নেল তাহেরকে ফাঁসি দেন। অনেকে মনে করেন, ৭ই নভেম্বরে অভ্যুত্থানের সময় সাধারণ মানুষ এবং সৈন্যদের ভিতর কর্নেল তাহেরের জনপ্রিয়তা দেখে জিয়াউর রহমান শঙ্কিত হয়ে পড়েছিলেন। এবং তাঁর ক্ষমতা নিষ্কণ্টক রাখার জন্যই তাহেরের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহীতার অভিযোগ এনে ফাঁসি দেওয়া হয়।

সার্বিকভাবে তিনি তাঁর ক্ষমতাকে ক্যান্টনমেন্টে সুসংহত করার পাশাপাশি, সামরিক বাহিনীর নেতৃত্বে দেশের আইন শৃঙ্খলাকে উন্নতি করেন এবং একই সাথে তিনি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যোগাযোগ বৃদ্ধির দিকে নজর দেন। ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দে ৮ই মার্চ মহিলা পুলিশ গঠন করেন। এই বৎসরেই তিনি কলম্বোতে জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন সম্মেলনে যোগদান করেন এবং বাংলাদেশ ৭ জাতি গ্রুপের চেয়ারম্যান পদে পদোন্নতি লাভ করেন। এই বৎসরেই তিনি উলশি যদুনাথপুর থেকে স্বেচ্ছাশ্রমে খাল খনন উদ্বোধন করেন। ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দের ২৯শে নভেম্বর তিনি প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্বে অধিষ্ঠিত হন। একই বৎসরে ১৯৭৬ সালে 'গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী' গঠন করেন।।

১৯৭৭ সালের ২০শে ফেব্রুয়ারি একুশের পদক প্রবর্তন করেন এবং রাষ্ট্রপতি আবু সাদাত সায়েমকে কৌশলে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে ফেলার পর ২১শে এপ্রিল বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসাবে শপথ গ্রহণ করেন। রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন সময়ে তিনি দেশে আবার গণতন্ত্রায়ণের উদ্যোগ নেন। তিনি বহুদলীয় গণতন্ত্র চালুর সিদ্ধান্ত নেন। দেশের রাজনীতিতে প্রতিযোগিতা সৃষ্টির আভাস দিয়ে তিনি বলেন "I will make politics difficult for the politicians."।

জিয়াউর রহমানের বহুদলীয় গণতন্ত্র চালুর সিদ্ধান্ত ছিল- প্রথাগত সামরিক শাসন থেকে গণতন্ত্রে উত্তোরণের একটি সাধারণ বিধির অনুসরণ। সাধারণত সামরিক শাসক ক্ষমতা দখলের পর, কৈফিয়ত হিসেবে ঘোষণা করেন যে, স্বৈরশাসন থেকে দেশকে উদ্ধার এবং অরাজকতা  থেকে দেশকে রক্ষার জন্য তিনি ক্ষমতায় এসেছেন। দেশে শান্তি ফিরে আসার পর, অবাধ ও সুষ্ঠ নির্বাচনের মাধ্যমে তিনি দেশে গণতন্ত্রের পুনপ্রতিষ্ঠা করবেন। কিছুদিন পর তিনি নিজেই একটি দলের কর্ণধার হন। সেই সাথে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেন। এই অবসরে তিনি নিজের দলকে শক্তিশালী করেন এবং যখন নিশ্চিত হন যে, তাঁর দল জয় লাভ করবে, তখন নির্বাচন দেন। বলাইও বাহুল্য এক্ষেত্রে সামরিক শাসকের দল জয়লাভ করে এবং যতদিন না অন্য অভ্যুত্থানের দ্বারা তিনি ক্ষমতাচ্যুত হন, তিনি এবং তাঁর দল ক্ষমতায় থাকেন।

জি্য়াউর রহমান এই পথ অনুসরণ করে, ধীরে ধীরে কিছু বিষয় পরিবর্তন ঘটান। এর ভিতরে উল্লেখযোগ্য ছিল- এছাড়া রাষ্ট্রপ্রধানের পদ অধিকারের পর- এক সরকারি ঘোষণায় সংবিধান পরিবর্তন করেন। এই নতুন সংবিধানের মুখবন্ধে 'বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম' সংযোজন করেন। সংবিধানের ৮(১) ও ৮(১ক) অনুচ্ছেদে 'সর্বশক্তিমান আল্লাহর ওপর পরিপূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস; কথাটি যুক্ত করেন। ৮(১) অনুচ্ছেদের সমাজতন্ত্রকে 'অর্থনৈতিক ও সামাজিক ন্যায়বিচার' বাক্য দ্বারা প্রতিষ্থাপিত করেন। এই সংবিধানের ২৫ (২) অনুচ্ছেদে যুক্ত করেন
'রাষ্ট্র ইসলামী সংহিতার ভিত্তিতে মুসলিম দেশসমূহের মধ্যে ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন, সংরক্ষণ ও জোরদার করার প্রয়াস চালাবে'।

১৯৭৭ খ্রিষ্টাব্দের ৩রা জুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জিয়াউর রহমান জয়লাভ করেন। এরপর তিনি এই বৎসরের মে মাসে ১৯ দফা কর্মসূচি ঘোষণা এবং আস্থা যাচাইয়ের জন্য ৩০শে মে গণভোট অনুষ্ঠান ও হাঁ-সূচক ভোটে বিপুল জনসমর্থন লাভ করেন।

বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের পর, কতিপয় ভারতীয় সাংবাদিক বুদ্ধিজীবী বাংলাদেশের জাতীয়তা 'বাংলাদেশী' করার জন্য প্রচারণা চালাতে থাকে। এরই সূত্র ১৯৭৭ সালে জিয়াউর রহমান হ্যাঁ/না ভোটের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর এই নূতন জাতীয়তাবাদের বিষয়টি সংবিধানে যুক্ত করেন। যদিও ১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ তারিখের দৈনিক বাংলা পত্রিকায় জিয়াউর রহমান বাঙালী জাতীয়তাবাদকে স্বীকার করে নিয়েছিলেন। উক্ত পত্রিকার 'একটি জাতির জন্ম নামক' প্রবন্ধের শুরুতেই লিখেছিলেন 'পাকিস্তান সৃষ্টির পর পরই ঐতিহাসিক ঢাকা নগরীতে মিঃ জিন্না যে দিন ঘোষণা করলেন উর্দু এবং উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা আমার মতে ঠিক সেদিনই বাঙালী হৃদয়ে অঙ্কুরিত হয়েছিল বাঙালী জাতীয়তাবাদ।'  কালক্রমে প্রচারণার মাধ্যমে, বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের জনক হিসাবে জিয়াউর রহমান জনপ্রিয় হয়ে উঠেন।
                   দেখুন :  বাংলাদেশের জাতীয়তা

এরপর তিনি 'বহুদলীয় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা' চালুর লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলগুলো উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেন। একই সাথে এই নতুন ব্যবস্থায় নিজেও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে নতুন দল তৈরির উদ্যোগ নেন। এই সূত্রে ১৯৭৮ খ্রিষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি তাঁর সামরিক সরকারের উপরাষ্ট্রপতি বিচারপতি আব্দুস সাত্তারকে প্রধান করে জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দল (জাগদল) প্রতিষ্ঠা করেন। ছয়টি রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে গঠিত জাতীয় ফ্রন্টের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। এই নির্বাচনে তিনি ৭৬.৬৭% ভোট পেয়ে বিজয়ী হন এবং রাষ্ট্রপতির পদে অধিষ্ঠিত হন

১৯৭৮ খ্রিষ্টাব্দের ১লা সেপ্টেম্বর তিনি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) প্রতিষ্ঠা করেন। এই দলের সমন্বয়ক ছিলেন তিনি নিজে এবং এই দলের প্রথম চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। আর অধ্যাপক এ. কিউ. এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী এই দলের প্রথম মহাসচিব ছিলেন। ১৯৭৮ খ্রিষ্টাব্দের ২৮শে আগস্ট পূর্বগঠিত জাগদলের বর্ধিত সভায় ওই দলটি বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয় এবং জাগদলের সকল সদস্যদের বিএনপির অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এই বৎসরে ২২শে নভেম্বর তিনি যুগোশ্লাভিয়া যান এবং সে দেশের সর্ব্বোচ্চ বেসামরিক খেতাব 'বিগ স্টার' উপাধি লাভ করেন। একই সাথে তিনি সে দেশের নাগরিকত্ব লাভ করেন।

১৯৭৯ খ্রিষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে সামরিক আইনের অধীনেই জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনে বিএনপি ৩০০টি আসনের ভিতরে ২০৭টি আসন লাভ করে। এই বৎসরের ১লা এপ্রিলে সামরিক শাসনের ভিতরেই প্রথম সংসদ অধিবেশন বসে। এরপর সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর বিধি অনুসারে, ১৯৭৯ খ্রিষ্টাব্দের ৯ এপ্রিল দেশ থেকে সামরিক আইন প্রত্যহার করা হয়।

১৯৮১ খ্রিষ্টাব্দের ৩০শে মে-তে সংঘটিত একটি সামরিক অভ্যুত্থানে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে তিনি নিহত হন। এরপর তাঁকে ঢাকার শেরে-বাংলা নগরে সমাহিত করা হয়।


সূত্র :
শিশু-বিশ্বকোষ। দ্বিতীয় খণ্ড। বাংলাদেশ শিশু একাডেমী। জুলাই ১৯৯৬।
বাংলাপেডিয়া:
http://www.banglapedia.org/httpdocs/HTB/101797.htm
http://en.wikipedia.org/wiki/Ziaur_Rahman