বাংলাদেশের নাগরিকত্ব ও জাতীয়তা
নাগরিকত্ব : বাংলাদেশী। জাতিসত্তা : অধিকাংশ বাঙলি। ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর ভাষা ও সংস্কৃতির বিচারে রয়েছে বেশ কিছু জাতি সত্তা। যেমন- চাকমা, গারো, মুরং ইত্যাদি। দেখুন : বাংলাদেশের জাতীয়তা। |
নৃতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ
অনুসারে বাংলাদেশের অধিবাসীরা বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠির সংমিশ্রণে সৃষ্ট একটি মিশ্র
জাতি হিসাবে বিবেচিত হয়ে থাকে। এই নরগোষ্ঠীর তালিকা রয়েছে–
আর্য ,
দ্রাবিড়,
মোঙ্গলীয়,
নেগ্রিটো ইত্যাদি।
ভাষাভিত্তিক জাতীয়তার দিক থেকে বাংলাদেশের অধিবাসীরা প্রধানত বাঙালি। এছাড়া চাকমা,
গারো, মুরং, মার্মা ইত্যাদি ভাষাগোষ্ঠীগুলোর অস্তিত্ব রয়েছে। বাংলাদেশের
স্বাধীনতা আন্দোলনের মূলধারা সূচিত হয়েছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদের সূত্রে। মূলত
তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানীদের সাথে পূর্ব-পাকিস্তানের এই বিরোধের সূত্রপাত ঘটেছিল,
বাংলা ভাষা রাষ্ট্রীয় ভাষার মর্যাদা পাবে কি না, এই দ্বন্দ্বে। এই দ্বন্দ্ব থেকে
সৃষ্টি হয়েছিল ভাষা-ভিত্তিক আন্দোলন। পরবর্তী সময়ে এই ভাষা-ভিত্তিক আন্দোলনের সাথে
যুক্ত হয়েছিল, বাঙালি জাতিগোষ্ঠীর
আর্থ-সামজিক স্বার্থের বিষয়। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশের
স্বাধীনতা আন্দোলনের সংঘটিত হয়েছিল। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে পাকিস্তানীদের আক্রমণের মূল
লক্ষ্য ছিলো– বাঙালী জাতিগোষ্ঠীকে পদানত রাখা এবং সেই সাথে বাঙালি সংস্কৃতিকে
ধ্বংস করা। তাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন ছিল মূলত বাঙালি জাতি গোষ্ঠীর বিজয়।
বাঙালিদের এই আবেগ থেকে সেসময় নূতন স্বাধীনতা
প্রাপ্ত এই দেশটির জাতীয়তা বাঙালি হিসাবেই গৃহীত হয়েছিল। যদিও অন্যান্য ক্ষুদ্র
জাতিগোষ্ঠীগুলোর পৃথক পৃথক জাতি সত্ত্বা বর্তমান ছিল। কিন্তু দেশের সংখ্যা গরিষ্ঠ
মানুষের জাতীয়তাকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়েছিল এক্ষেত্রে। যেমনটি প্রাধান্য দেওয়া হয়েছিল বাংলা
ভাষাকে।
গোড়ার দিকে বাংলাদেশের জাতীয়তা নিয়ে কোন বিতর্ক ছিল না। এই জাতীয় বিতর্কের প্রথম
সূত্রপাত ঘটায়– ভারতীয় দক্ষিণ পন্থী কিছু গোষ্ঠী ও কিছু ভারতীয় পত্র-পত্রিকা।
ভারতীয় সাংবাদিক বসন্ত চট্টোপাধ্যায় স্বাধীন বাংলাদেশের বাঙালিদের 'বাংলাদেশী'
নামকরণের প্রস্তাব দিয়েছিলেন তাঁর 'Inside
Bangladesh today: an eye-witness account'
গ্রন্থে। উল্লেখ্য এই গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দে।
বিভিন্নভাবে এরা প্রচার করা শুরু করে যে, বাংলাদেশের মানুষ যদি নিজেদেরকে বাঙালি
জাতি বলে পরিচয় দেয়, তা হলে পশ্চিম বাংলার বাঙালিদের পরিচয় কি হবে? তারা দাবী
তুলেছিলো– বাংলাদেশের অধিবাসীদের জাতীয়তা বাঙালি ছাড়া অন্য কিছু খুঁজে নেওয়া উচিত্। এই প্রচারণার অন্যতম
হোতা ছিলেন পশ্চিম বাংলার প্রখ্যাত দৈনিক আনন্দবাজারের নির্বাহী সম্পাদক শ্রী
সন্তোষ কুমার ঘোষ। এর সাথে যুক্ত হয়েছিল অখণ্ড ভারতে বিশ্বাসী ভারতীয়
গোষ্ঠীগুলো। তাদের শঙ্কা ছিলো– বাংলাদেশ সৃষ্টির নিদর্শন দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে,
পশ্চিম বাংলায় বাঙালি জাতীয়তাবোধ তীব্রতর হতে পারে এবং তা থেকে পশ্চিম বাংলায় পৃথক
রাষ্ট্রের দাবি উঠতে পারে। ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত ভারতীয়রা অজস্র লিখা-লেখি ও প্রচারণা
সত্ত্বেও– বাংলাদেশের অধিবাসীদের জাতীয়তা বাঙালিই থেকে যায়। এরপর ভারতীয় এই
বুদ্ধিজীবীরা আবার তৎপর হয়ে উঠেছিল বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠার জন্য। একই সাথে
নূতন সামরিক শাসক হিসাবে জিয়াউর রহমান– তার নূতন রাজনৈতিক আদর্শের সাথে বাংলাদেশী
জাতীয়তাবাদ অংশ যুক্ত করে দেন। ১৯৭৭ সালে জিয়াউর রহমান হ্যাঁ/না ভোটের মাধ্যমে
প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর এই নূতন জাতীয়তাবাদের বিষয়টি সংবিধানে যুক্ত করেন। যদিও ১৯৭২
সালের ২৬ মার্চ তারিখের দৈনিক বাংলা পত্রিকায় জিয়াউর রহমানো– বাঙালী জাতীয়তাবাদকে
স্বীকার করে নিয়েছিলেন। উক্ত পত্রিকার 'একটি জাতির জন্ম নামক' প্রবন্ধের
শুরুতেই লিখেছিলেন- 'পাকিস্তান সৃষ্টির পর পরই ঐতিহাসিক ঢাকা নগরীতে মিঃ জিন্না যে
দিন ঘোষণা করলেন উর্দু এবং উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা- আমার মতে ঠিক
সেদিনই বাঙালী হৃদয়ে অঙ্কুরিত হয়েছিল বাঙালী জাতীয়তাবাদ।'
বর্তমানে বাংলাদেশে বাঙালী ও বাংলাদেশী জাতীয়রাবাদের দ্বন্দ্ব তীব্রতররূপ লাভ
করেছে। বাংলাদেশের ভৌগলিক পরিমণ্ডলের নিরিখে ও নাগরিকত্বের বিচারে– বাংলাদেশের
অধিবাসীরা বাংলাদেশী হিসাবে পরিচিত হতে পারে এটা সবাই মেনে নিলেও, জাতীয়তার প্রশ্নে
এই দ্বন্দ্ব বাংলাদেশের অধিবাসীদের দ্বি-বিভক্ত করেছে।
১. আমরা বাংলাদেশী ও বাঙালি?/ আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরী। অক্ষরবৃত্ত প্রকাশনী। ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৩।