চাকমা
অপরাপর নাম : চাঙ্‌মা, চাকামা,  সাকমা।

বাংলাদেশ ও ভারতের একটি জাতিসত্তার নাম। বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম, উত্তর-পূর্ব মিজোরাম, অরুণাচল প্রদেশ, ত্রিপুরা প্রদেশ এবং মায়ানমারের রাখাইন প্রদেশে এই জাতিসত্তার লোকেরা বসবাস করে। বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের সবচেয়ে বড় জাতি।

 

চাকমারা মোট ৪৬টি গোজায় (গোষ্ঠী) বিভক্ত। এই জাতির নিকটতম জাতিগোষ্ঠী হলো তঞ্চংগ্যা। ভাষা ও সংস্কৃতির বিচারে এই দুটি জাতির বেশ মিল রয়েছে।

 

চাকমা জাতির ইতিহাস
চাকমা ভাষা
অলঙ্কার
আলাম
বিজু উৎসব

চাকমা জাতির ইতিহাস
এরা নৃতাত্ত্বিকদের মতে মঙ্গোলীয়। দেহের আকার মধ্যমাকার। মুখমণ্ডল গোলাকার, নাক চ্যাপ্টা, গণ্ডদেশ উন্নত। চুল অকুঞ্চিত, পুরুষদের মুখমণ্ডলে দাড়ি উঠে না। এদের গায়ের রঙ চাপা তাম্রবর্ণের হয়। তবে চাকমাদের নৃতাত্ত্বিক সংমিশ্রণ ঘটেছে বাঙালীদের সূত্রে অন্যান্য নৃগোষ্ঠীর। একসময় বাঙালিদের সাথে মিলেমিশে মগ বা আরাকানদের প্রতিরোধ যুদ্ধ করেছে চাকমারা। সে সময় মোগল আফগানদের সাথে রক্তের সংমিশ্রণ ঘটেছিল। ত্রিপুরাদের সাথেও রক্তের সংমিশ্রণ ঘটেছিল অনেকাংশে। ইতিহাস থেকে দেখি চাকমা রাজা ধরম বক্স খাঁ প্রথমা স্ত্রী কালাবি বা কালিন্দিরানির গায়ের রঙ ছিল কালো।

 

এদের আদি নিবাস ছিল মায়ানমারে। দীর্ঘদিন ধরে এরা বার্মিজ ভাষাভাষীদের সাথে থাকা অবস্থায় নিজেদের ভাষা এবং সংস্কৃতিকে অক্ষুণ্ণ রাখতে সক্ষম হয়েছে। কালক্রমে এরা নিজেদের রাজ্য স্থাপনে সমর্থ হয়েছিল। কথিত আছে, চম্পক নগরের রাজকুমার বিজয়গিরি ব্রহ্মদেশ অধিকার করেন। কালক্রমে আরাকান এবং উত্তর ব্রহ্মদেশ মিলে স্থাপিত হয়েছিল চাকমা রাষ্ট্র। ১১১৮-১৯ খ্রিষ্টাব্দের দিকে বাঙালি সৈন্যদের সাথে নিয়ে চাকমা রাজা ব্রহ্মদেশের পেগু সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। ১৩৩৩ খ্রিষ্টাব্দে ব্রহ্মদেশীয় রাজা মেঙ্গাদি চাকমা রাজা অরুণ যুগের রাজধানী মনজিগিরি আক্রমণ করে। যুদ্ধে ব্রহ্মদেশের রাজার কাছে চাকমা রাজা পরাজিত হয়। কথিত হয়, কূটকৌশলের মাধ্যমে ব্রহ্মদেশের রাজা চাকমা রাজাকে পরাজিত করেছিল। এই যুদ্ধে মগ রাজা অরুণযুগ এবং তাঁর তিন পুত্র ও দুই কন্যাকে বন্দী করে নিয়ে যান। রাজকুমারীদের মগ রাজা বিবাহ করেন। মগ রাজা বড় দুই রাজকুমারকে অন্যত্র পাঠিয়ে দিয়ে, ছোটো রাজকুমার 'চৌধুথংজা'কে রাজা হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর অধিকার ছিল, শধু করা আদায় করা এবং মগ রাজার কাছে তার সিংহভাগ প্রেরণ করা। একে চাকমার বলেন, ঘাগট্যা রাজা। এই রাজার পুত্র মাইশাং রাজা হন। এই সময়ের মগদের অতিরিক্ত কর আদায়ের কারণে চাকমারা একে একে রাজ্য ত্যাগ করতে থাকেন। রাজা মাইশাং -এর পুত্র মারিক্যা যখন রাজা হন, তখন চাকমারা রোয়াং থেকে পালিয়ে কদমতলীতে চলে আসেন।

 

এরপর পর মগদের করদ রাজ্যের প্রজা হিসাবে চাকমার দিন যাপন করতে থাকেন। মারিক্যার পুত্র কদমথংজা এবং তাঁর পুত্র রদংসা রাজা হন। পরে এঁর পুত্র থৈন সুরেশ্বরী রাজা হন। ১৪৩২-৩৫ খ্রিষ্টাব্দের দিকে গৌড়ের সুলতান থৈন সুরেশ্বরীকে রাজা হিসাবে স্বীকৃতি দেন। এরপর চাকমা রাজা ও বাঙালি সৈন্যদের সমন্বয়ে সৃষ্ট সম্মিলিত বাহিনী মগ রাজার বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। এই যুদ্ধে সম্মিলিত বাহিনী জয়লাভ করে এবং থৈন সুরেশ্বরী সার্বভৌম রাজা হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হন। ধৈন সুরেশ্বরী তাঁর পুত্র জনুর উপর রাজ্যভার অর্পণ করে বানপ্রস্থে চলে যান।

 

১৫৪৬ খ্রিষ্টাব্দে আরাকান রাজা মেং বেং বার্মা রাজার সাথে যুদ্ধ হয়। এই সময় উত্তর দিক থেকে চাকমা রাজা আরাকান রাজ্য আক্রমণ করেন এবং কক্স বাজারের রামু দখল করেন। এই সময় জনু মগ রাজাকে নানা রকম উপঢৌকন দিয়ে শান্ত করেন। রাজা জনুর কোনো পুত্র সন্তান ছিল না। তাঁর দুই কন্যার নাম ছিল রাজেম্বি এবং সাজেম্বি। জনু তাঁর কনিষ্ঠা কন্যা সাজেম্বিকে মগ রাজার সাথে বিবাহ দেন। এই সময় মগ রাজা জনুকে কোংলাপ্রু (সদাশয়) খেতাবে ভূষিত করেন। রাজা জনু বড় মেয়ে রাজেম্বির সাথে তাঁর প্রধান সেনাপতি 'বুড়া বড়ুয়া' বিবাহ দেন। রাজা জনুর মৃত্যুর পর, বুড়া বড়ুয়া রাজ্যের শাসন ভার গ্রহণ করেন। তিনি প্রথমেই একটি সুশিক্ষিত সেনাদল গঠন করেন। বুড়া বড়ুয়া'র মৃত্যুর পর রাজা হন তাঁর পুত্র সাতুয়া বড়ুয়া। ইনি কিছুদিন রাজত্ব করার পর, পাগল হয়ে যান। এই কারণে তিনি পাগলা রাজা নামে খ্যাত হন। পরে পাগলা রাজাকে হত্যা করা হয় এবং রানি কাটুয়া তাঁর নাবালক সন্তানদের পক্ষে রাজত্ব করেন। এই রাজার দুই পুত্রের নাম ছিল চন্দন খাঁ ও রতন খাঁ এবং কন্যার নাম ছিল অমঙ্গলী। রানি কাটুয়ার মৃত্যুর পর চন্দন খাঁ ও রতন খাঁ রাজত্ব শুরু করেন। কিন্তু রাজ্যের প্রধান মন্ত্রী এঁদেরকে গোপনে হত্যা করলে, চাকমা রাজ্যের রাজসিংহাসন শুন্য হয়ে যায়। এরপর সিংহাসন নিয়ে অমঙ্গলীর সন্তানদের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। শেষ পর্যন্ত অমঙ্গলীর চারপুত্রের ভিতর (ধুর্যা, কুর্যা, পীড়ভাঙা, ধাবানা) ধাবানা রাজত্ব লাভ করেন।

 

রাজা ধাবানার মৃ্ত্যুর পর তাঁর দুই পুত্রের ভিতর (ধরম্যা ও মঙ্গল্যা) ধরম্যা রাজা হন। এই রাজার নিঃসন্তান অবস্থায় মৃত্যু হওয়ায়, অপর পুত্র মঙ্গল্যা রাজা হন। রাজা মঙ্গল্যার দুই পুত্রের নাম ছিল সুবল খাঁ এবং ফতে খাঁ। রাজা মঙ্গল্যার প্রথম পুত্র সুবল খাঁ কিছুদিন রাজত্ব করার পর মৃত্যুবরণ করেন। এরপর রাজা হন ফতে খাঁ। ফতে খাঁর সময় চাকমা রাজ্য বেশ শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল। এই সময় চট্টগ্রামকে ঘিরে মোগল আরাকান এবং পোর্তুগিজদের ভিতর সংঘাত চলছিল।
 

পোর্তুগিজ-মোগল-আরাকান সংঘাত
১৫১৭ খ্রিষ্টাব্দের দিকে পোর্তুগিজরা চট্টগ্রামে আসা শুরু করে। এরা প্রথমাস্থায় বাণিজ্য করতে এলেও, পরে তারা জলদস্যু হয়ে যায়। সুলতান এদের দমন করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। কিন্তু এ সময় আফগান শাসক শের শাহ বাংলা আক্রমণ করতে পারে, এই আশঙ্কায় তিনি পোর্তুগিজদের সহায়তা কামনা করেন। তখন সামরিক সহায়তার বিনিময়ে ১৫৩৭ খ্রিষ্টাব্দে পোর্তুগিজরা চট্টগ্রামে বাণিজ্য কুঠি নির্মাণ করে। এই সময় তারা বন্দর এলাকার শুল্ক আদায়ের অধিকার লাভ করে। এতকিছুর পরেও ১৫৩৮ খ্রিষ্টাব্দে শের শাহ‌-র সেনাপতি চট্টগ্রাম দখল করেন। কিন্তু শের শাহ‌-এর এই সেনপাতি চট্টগ্রামের উপর পূর্ণ কর্তৃত্ব লাভ করতে পারেন নি। ১৫৮০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত আফগানদের ত্রিপুরা আর আরাকানীদের সঙ্গে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হয়েছে।

এই যুদ্ধের সূত্রে ১৫৮১ খ্রিষ্টাব্দে আরাকান রাজা চট্টগ্রাম অধিকার করেন এবং ১৬৬৬ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত চট্টগ্রাম সম্পূর্ণভাবে আরাকান রাজাদের অধীনে থেকে যায়। এই সময় পোর্তুগিজরা আবার দস্যুতা শুরু করে। এদের দৌরাত্ম অত্যন্ত বৃদ্ধি পেলে, আরাকান রাজা ১৬০৩ খ্রিষ্টাব্দে পোর্তুগিজদের বিরুদ্ধে অভিযান চালায়। এই অভিযানের ফলে পোর্তুগিজদের সম্পূর্ণরূপে পরাজিত করা সম্ভব হয় নি। বিশেষ করে সন্দীপ অঞ্চল পোর্তুগিজ জলদস্যু গঞ্জালেস দখলে রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। ১৬৬৬ সালে চট্টগ্রাম মোগলদের হস্তগত হওয়ার পূর্বকাল পর্যন্ত পোর্তুগিজরা তাদের দস্যুতা চালিয়ে যেতেই থাকে।

১৬৬৬ খ্রিষ্টাব্দে মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেব বাংলার সুবেদার শায়েস্তা খানকে চট্টগ্রাম দখলের নির্দেশ দেন। সুবেদারের পুত্র উমেদ খাঁর প্রথমে কর্ণফুলী নদীর মোহনায় আরাকানীদের পরাজিত করেন এবং আরাকানী দূর্গ দখল করেন। কথিত আছে পোর্তুগিজরা আরাকানীদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে মোঘলদের পক্ষ নিয়েছিল। উমেদ খাঁ চট্টগ্রামের প্রথম ফৌজদারের দায়িত্ব পান। এই সময়  আরাকানীরা চট্টগ্রাম অধিকারের চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হয়।

 

মোগল-চাকমা সংঘাত

মোগল আমলের প্রথমদিকে এদের সাথে চাকমাদের সম্পর্ক বেশ ভালো ছিল। ১৭০০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে চাকমা রাজ্য বেশ শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল। বিশেষ করে চাকমা রাজা ফতে খাঁর সময়ই অনেক ক্ষেত্রে এরা মোগলদের এরা প্রায় গ্রাহ্যই করতো না। এই সূত্রে উভয় শক্তির ভিতরে এক ধরনের টানপোড়নের সৃষ্টি হয়।  একসময় মোগলরা চট্টগ্রামের সাথে বাণিজ্যের বিষয়ে চাকমাদের কাছে কর দাবী করে। এ নিয়ে চাকমা এবং মোগলদের ভিতর তীব্র তিক্ততার জন্ম দেয়। মোগল সৈন্যরা চাকমা রাজ শক্তিকে তুচ্ছ জ্ঞান করে, আক্রমণ করলে, ফতে খাঁর কৌশলে মোগলরা পরাজিত হয়। এই সময় চাকমা রাজার সৈন্যরা দুটি কামান দখল করে, এদের নাম রাখে ফতে খাঁ এবং কালু খাঁ।

 

রাজা ফতে খাঁর মৃত্যুর পর তাঁর তিনপুত্রের ভিতর (সেরমস্ত খাঁ, ওরমস্ত খাঁ, খেরমস্ত খাঁ) সেরমস্ত খাঁ রাজত্ব লাভ করেন। এই সময় তিনি সমস্ত পার্বত্য চট্টগ্রামে তাঁর অধিকার পাকা করেন। ইনি নিঃসন্তান থাকায়, তাঁর ভাই ওরমস্ত খাঁ-এর ছেলে শুকদেব রায়কে পোষ্য পুত্র হিসাবে গ্রহণ করেন। শুকদেব মোগলদের সাথে সখ্যতা স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। কারণ তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, প্রবল মোগল শক্তির বিরুদ্ধাচরণ করে দীর্ঘকাল রাজত্ব অক্ষুণ্ণ রাখতে পারবেন না। ফলে ১৭১৩ খ্রিষ্টাব্দে চাকমা-মোগলদের ভিতরে শান্তিচুক্তি হয়। এই চুক্তিতে চাকমা রাজা আংশিকভাবে মোগল-করদ রাজ্যে পরিণত হয়। এই কারণে মোগলরা চাকমা রাজাকে পুরস্কৃত করে এবং রায় উপাধি প্রদান করে। এরপর শুকদেব নিজের নামে একটি নগর স্থাপন করেন। এই নগরীর নাম রাখা হয় সুকবিলাশ বা সুখবিলাস।

শুকদেবের মৃত্যুর পর, তাঁর পুত্র সের দৌলৎ খাঁ রাজ্যভার গ্রহণ করেন। ১৭৫৭ খ্রিষ্টাব্দে পলাশীর যুদ্ধে সিরাজদ্দৌলার পরাজয়ের পর, ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি'র পৃষ্ঠপোষকতায় মীরজাফর মুর্শিদাবাদের নবাব হন। এরপর ইংরেজরা মীরজাফরকে সরিয়ে মীরকাসেমকে সিংহাসনে বাসায়। মীরকাসেমের সাথে ইংরেজদের সংঘাত উপস্থিত হলে, ইংরেজরা মীরজাফরকে পুনরায় সিংহাসনে বসায়। বাংলার সিংহাসনের এই টানপোড়নের মধ্যে, ১৭৬১ খ্রিষ্টাব্দের ৫ জানুয়ারিতে
Harry Verlest ইষ্ট ইন্ডিয়ার পক্ষে চট্টগ্রামের শাসন দায়িত্ব পান। ইংরেজরা এরপর ক্রমাগত চট্টগ্রামে অতিরিক্ত রাজকর ধার্য করে, যা চাকমা রাজা দিতে অস্বীকার করে। ফলে ইংরেজরা চাকমা রাজার বিরুদ্ধে মোট চারবার (১৭৭০, ১৭৮০, ১৭৮২ ও ১৭৮৫) আক্রমণ করে। ১৭৭০ খ্রিষ্টাব্দের যুদ্ধে চাকমা রাজার জয়ের পর, ১৭৭৬ খ্রিষ্টাব্দে রাজা শের দৌলত খাঁ ইংরেজদের কর প্রদান বন্ধ করে দেন। ইংরেজরা প্রথম আক্রমণটি করেছিল জলপথে। এরপর ইংরেজরা পরবর্তী দুটি আক্রমণও করেছিল জলপথে এবং পরাজিত হয়েছিল। ইতিমধ্যে সের দৌলৎ খাঁ মৃত্যুবরণ করলে, তাঁর পুত্র জানবক্স খাঁ রাজা হন। ১৭৮৫ খ্রিষ্টাব্দে স্থলপথে চতুর্থবার চাকমা রাজ্য আক্রমণ করে। এই যুদ্ধে ইংরেজরা জয়ী হয়। ১৭৮৭ খ্রিষ্টাব্দে চাকমা রাজার জানবক্সের সাথে ইংরেজদের শান্তি চুক্তি হয়। এই চুক্তি অনুসারে চাকমা রাজা বৎসরে ৫০০ মন তুলা ইরেজদের কর হিসাবে প্রদান করবে বলে অঙ্গীকার করে।

 

এরপর জানবক্স তাঁর রাজ্যের রাজধানী শুকবিলাস থেকে রাঙ্গুনিয়াতে স্থানান্তরিত করেন। ১৮০০ খ্রিষ্টাব্দে জানবক্সের তিন পুত্রের (টাব্বর খাঁ, জব্বর খাঁ এবং ডোলপেটা) মধ্যে টাব্বর খাঁ রাজা হন। দুই বৎসর পরে টাব্বর খাঁ মৃত্যবরণ করলে, ১৮০২ খ্রিষ্টাব্দে রাজা হন, মধ্যম রাজপুত্র জব্বর খাঁ। জব্বর খাঁ ১০ বৎসর রাজত্ব করার পর ১৮১৪ খ্রিষ্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন। এই সময় রাজা হন ধরম বক্স খাঁ। ১৮২৯ খ্রিষ্টাব্দে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাথে চুক্তি নবায়ন হয়।

 

ধরম বক্স খাঁ প্রথমে বিবাহ করেন কুরাকুট্যা গোজার গুজাং চাকমার কন্যা কালাবি-কে। এই কন্যার গায়ের রঙ কালো ছিল। এই কারণে, রাজা তাঁর নাম রেখেছিলেন কালিন্দীরানি। প্রথম দিকে কালিন্দী'র গর্ভে কোনো সন্তান না হওয়ায়, রাজা আটকবি-কে বিবাহ করেন। এরপর বিবাহ করেন কুরাকুট্যার অন্যতম সর্দার দৌলৎ খাঁর কন্যা হারিবি-কে। রাজার প্রথম স্ত্রী কালিন্দীরানি একটি পুত্র সন্তানের জন্ম দেন, কিন্তু এই সন্তানটি আতুর ঘরেই মারা যায়। আটকবি সম্পর্কে চাকমা ইতিহাসে বিশেষ কিছু জানা যায় না। তৃতীয় স্ত্রী হারিবির একটি কন্যা সন্তান জন্মে। এর নাম ছিল চিকনবি।

 

১৮৩২ খ্রিষ্টাব্দে রাজা ধরম বক্স খাঁ মৃত্যুবরণ করেন। চাকমা সিংহাসনের অধিকার নিয়ে সঙ্কটের সৃষ্টি হয়। ধরম বক্স খাঁর মৃত্যুর পর ইংরেজ সরকার রাজকন্যা চিকনবি-কে সিংহাসনের উত্তরাধিকার হিসাবে ঘোষণা দেয়। একই সাথে রাজকুমারীর অভিভাবক হিসাবে রাজ্য শাসনের দায়িত্ব দেওয়া হয় রানি হারিবি-কে। কালিন্দীরানি এর প্রতিবাদ করলে সঙ্কটের সৃষ্টি হয়। এই অবস্থায় ধরম বক্স খাঁর বংশের সুখলাল খাঁকে রাজ্যের প্রশাসক হিসাবে নিয়োগ দেওয়া হয়। ১৮৩৭ খ্রিষ্টাব্দে কালিন্দীরানি-কে দুই বৎসরের জন্য ইজারা প্রদান করা হয়। রানি কিছুদিন এই ব্যবস্থা মেনে নিয়ে শাসন করেন। পরে এই অধিকার প্রত্যাখ্যান করেন। ১৮৪৪ খ্রিষ্টাব্দে কালিন্দীরানি রাজ্যের উত্তরাধিকার মনোনীত হন। ১৮৪৬ খ্রিষ্টাব্দে ইংরেজরা চাকমা রাজ্যের জন্য ১১,৮০৩ টাকা বার্ষিক কর ধার্য করে। এই ব্যবস্থায় কালিন্দীরানি রাজ্য শাসন শুরু করেন।

 

রাজকন্যা চিকনবির সাথে বিবাহ হয়েছিল রণু খাঁ দেওয়ানের প্রপৌত্র গোপীনাথ দেওয়ানের। এঁদের দুই পুত্রের নাম ছিল হরিশচন্দ্র ও  শরৎচন্দ্র। এঁদের একমাত্র কন্যার নাম ছিল চন্দ্রকলা। শৈশবে শরৎচন্দ্র ও চন্দ্রকলা মৃত্যবরণ করেন। কিছুদিন পরে রাজমহিষী হারিবি এবং রাজকন্যা চিকনবি মৃত্যুবরণ করলে, কালিন্দিরানি যত্নের সাথে চিকনবির পুত্র হরিশচন্দ্র প্রতিপালন করেন। এই সময় তিনি গোপীনাথকে দুটি বিবাহ দিয়েছিলেন।

 

হরিশচন্দ্র প্রাপ্তবয়স্ক হলে, কালিন্দিরানি সৌরিন্ধ্রী এবং মনোমোহিনী নামক দুইটি কন্যার সাথে বিবাহ দেন। এই সময় ক্যাপ্টেন লুইসের সাথে কালিন্দিরানির দ্বন্দ্ব হলে, ক্যাপ্টেন লুইস চাকমা রাজ্যের কিছু অংশ মং চীফ মান নামক জনৈক দেওয়ানকে প্রদান করেন। একই সাথে ঈশান নামক একজন দেওয়ানকে রাজ্যের অপর অংশ বন্দোবস্ত করে দেওয়ার প্রস্তাব দিলে, তিনি তা প্রত্যখ্যান করেন।

 

১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশ সরকার ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর কাছ থেকে ক্ষমতা গ্রহণ করে। ১৮৭২ খ্রিষ্টাব্দে ইংরেজেদের লুসাই অভিযানের সময় কালিন্দিরানির আদেশে রাজা হরিশচন্দ্র ইংরেজদের সাহায্য করেন। এই কারণে ব্রিটিশ সরকার রাজা হরিশচন্দ্রকে 'রায় বাহাদুর' খেতাব দেন। ১৮৭৩ খ্রিষ্টাব্দে কালিন্দিরানির মৃত্যুর পর হরিশচন্দ্র রাজ্যশাসনের পূর্ণ অধিকার লাভ করেন।

 

১৮৮৫ খ্রিষ্টাব্দে হরিশচন্দ্রের প্রথমা স্ত্রীর সৌরিন্ধ্রীর গর্ভজাত পুত্র ভুবনমোহন রায় রাজা হন। তবে তিনি নাবালক থাকায়, তাঁর পক্ষে রাজ্যশাসন করেন রায়সাহেব কৃষ্ণচন্দ্র দেওয়ান। ১৮৯৭ খ্রিষ্টাব্দের ৭মে-তে ভুবনমোহন রায়-কে আনুষ্ঠানিকভাবে রাজপদে অভিষিক্ত করা হয়। ভুবনমোহন রায়ের প্রথম স্ত্রী দয়াময়ী'র গর্ভে নলিনাক্ষ রায় এবং বিরুপাক্ষ রায় নামক দুটি পুত্র সন্তান এবং কন্যা বিজনবালার জন্ম হয়। এই স্ত্রীর মৃত্যুর পর তিনি রমাময়ীকে বিবাহ করেন। ১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দে ভুবনমোহন রায় মৃত্যুবরণ করলে, তাঁর প্রথম পুত্র নলিনাক্ষ রায় রাজা হন।

১৯৫১ খ্রিষ্টাব্দে নলিনাক্ষ রায় মৃত্যুবরণ করলে, রাজা হন
ত্রিদিব রায়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ত্রিদিব রায় পাকিস্তানিদের পক্ষ নেয়। দীর্ঘকাল ধরে বাঙালি-চাকমার ঐক্য ছিল, এবং বহুবার বাঙালি-চাকমা মিলিত শক্তি অন্য রাজশক্তিকে পরাজিত করেছিল। সম্ভবত কোনো চাকমা রাজা প্রথমবারের মতো বাঙালিদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল। অনেক পাহাড়িদের মতো চাকমা যুবক সে সময় বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ত্রিদিব রায় পাকিস্তানে পালিয়ে যান। ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানে মৃত্যুবরণ করেন এবং সেখানেই তাঁর মরদেহ দাহ করা হয়।

১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৯৭৭ পর্যন্ত রাজা ত্রিদিব রায়ের জ্যেষ্ঠপুত্র দেবাশীষ রায় অপ্রাপ্ত বয়স্ক থাকায় ত্রিদিব রায়ের কনিষ্ঠ ভ্রাতা কুমার সমিত রায় রাজকার্য পরিচালনা করেন। ১৯৭৮ খ্রিষ্টাব্দ থেকে দেবাশীষ রায় চাকমা রাজার দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
 


 

সূত্র :
শ্রীমাধবচন্দ্র চাক্‌‌মা কর্ম্মী বিরচিত শ্রীশ্রীরাজনামা এবং রাজা ভুবনমোহন রায় বিরচিত চাক্‌মা রাজবংশের ইতিহাস। সম্পাদনা বিপ্রদাশ বড়ুয়া।
বহির্সূত্র : রাজা(কার) ত্রিদিব রায় : এ লাশ সইবে না বাংলার মাটি । অমি রহমান পিয়াল
(
http://www.amarblog.com/omipial/posts/153188)