টিক্কা খান
পাকিস্তানি সেনানায়ক
(জেনারেল)। বালুচিস্তান এবং
বাংলাদেশের হত্যাযজ্ঞ পরিচালনার জন্য কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী হিসেবে চিহ্নিত।
মূল নাম টিক্কা চাক্কা খান। উর্দু: ٹکا خان।
১৯১৫ খ্রিষ্টাব্দের ৭ই জুলাই, অবিভক্ত ভারতের রাওয়ালপিণ্ডির নিকটবর্তী জোছা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।
১৯৪০ খ্রিষ্টব্দের ২২শে ডিসেম্বর ব্রিটিশ-ভারতীয় সেনাবাহিনীর সদস্য হিসেবে ভারতের দেরাদুনে
অবস্থিত সামরিক একাডেমি থেকে কমিশন লাভ করেন।
তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বার্মা ও ভারতের বিভিন্ন ফ্রন্টে ছিলেন। দ্বিতীয়
বিশ্বযুদ্ধকালে দুই বছরেরও অধিক সময় টিক্কা খান যুদ্ধবন্দী থাকার পর পলায়নে সক্ষম
হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তিনি দেরাদুনে সামরিক একাডেমিতে প্রশিক্ষকের
দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে পাক-ভারত বিভাজনের সময় তিনি মেজর হিসেবে
পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগদান করে।
১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি মেজর জেনারেল পদে উন্নীত হন।
১৯৬৫ খ্রিষ্টাব্দে পাকভারত যুদ্ধের সময়, তাঁকে শিয়ালকোটে নিযুক্ত করা হয়।
১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দের আগষ্ট মাসে তিনি লেফটেন্যান্ট জেনারেল পদে উন্নীত হন। এই সময়
তিনি লাহোর সেনানিবাসে
IV Corps
-এর কমান্ডার হিসেবে যোগদান করেন। এই বৎসরের ২৪শে মার্চ আয়ুব খান পদত্যাগ করলে, তিনি
পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হন
ইয়াহিয়া খান। এই
সময় পশ্চিম পাকিস্তানের সামারিক আইন প্রশাসক হন।
১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দে নিষ্ঠুরতার সাথে বালুচিস্তানে বিদ্রোহ দমন করেন। এই কারণে তিনি
'বালুচিস্তানের কসাই' হিসেবে কুখ্যাতি অর্জন করেন।
১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের তৎকালীন
পূর্ব-পাকিস্তানে
অপারেশন সার্চ লাইট
নামক কুখ্যাত সংঘটিত করার জন্য,
পূর্ব-পাকিস্তানের গভর্নর ছিলেন লে.জে.
সাহেবজাদা ইয়াকুব খানকে অপসারিত করে, টিক্কা খানকে গভর্নর করা হয়। একই
সাথে তিনি ইস্টার্ন কমান্ডের কমান্ডার এবং সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব পান। তিনি
১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ৭ই মার্চ এই বিপুল ক্ষমতা নিয়ে ঢাকায় আসেন। ঢাকা বিমানবন্দরে
তাঁকে অভ্যর্থনা করেন
সাহেবজাদা ইয়াকুব খান ও
মেজর জেনারেল
খাদিম হুসেন রাজা। তাঁর ঔদ্ধত্বপূর্ণ আচরণের কারণে অনেকে পাকিস্তানি
সেনাকর্মকর্তাই অপছন্দ করতেন। সে সময়ের
পূর্ব-পাকিস্তানের প্রধান বিচারপতি গভর্নর হিসেবে তাঁকে শপথ বাক্য পাঠে অসম্মতি
জানান। তিনি বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করার চেষ্টা করলে, বঙ্গবন্ধু তা প্রত্যাখ্যান
করে।
এরপর তিনি মনোযোগ দেন, সারাদেশে সৈন্যদের পুনর্বিন্যাসের দিকে। প্রেসিডেন্ট
হন ইয়াহিয়া খান-এর
নির্দেশে তিনি বাঙালি সৈন্যদের নিরস্ত্র করার আদেশ দিয়েছিলেন, কিন্তু কার্যত তা
অনেকাংশে সফল হয় নি। এই সময় বিদেশী সাংবাদিকদের অনেকে লাঞ্ছিত করে পূর্ব পাকিস্তান
থেকে বের করে দেওয়া হয়। টিক্কা খানের এসকল কর্মকাণ্ডের মূল লক্ষ্য ছিল
অপারেশন সার্চ লাইট-কে
সফল করা। ২৫শে মার্চ দিবাগত রাত ১২টার পর
অপারেশন সার্চ লাইট
শুরু হয়।
মার্চ মাসে তিনি ঢাকা আসেন। ২৫শে মার্চ দিবাগত রাত্রি ১২টার পর থেকে―
তাঁর পরিচালনায় পূর্ব-পাকিস্তানে অবস্থানরত পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে তিনি পরিচালনা
করেন। এই অভিযানের মূল লক্ষ্য হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের ভিতর দিয়ে- বাঙালি জাতীয়তাবাদ
আন্দোলনকে সমূলে ধ্বংস করা।
এই অপারশনে অনেক পাকিস্তানি উর্ধ্বতন সেনানায়করা টিক্কা খানের প্রতি সন্তুষ্ট ছিলেন না।
তাই
১০ই
এপ্রিল টিক্কা খানকে এই দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়ে, জেনারেল
আমির আব্দুল্লাহ খান
নিয়াজির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। এর ভিতর
দিয়ে 'অপারেশন সার্চলাইট'
কার্যত বাতিল হয়ে যায়।
১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে পূর্ব-পাকিস্তানের
গভর্নর হিসেবে ১
জুন জেনারেল
পূর্ব পাকিস্তান রাজাকার অর্ডিন্যান্স-১৯৭১ জারি করে আনসার বাহিনীকে
রাজাকার
বাহিনীতে রূপান্তরিত করেন।
১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দে তিনি অবসর গ্রহণ করেন। এই সময় তিনি পাকিস্তানের তদানীন্তন
প্রধানমন্ত্রী
জুলফিকার আলী ভুট্টো'র
মন্ত্রীসভার প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে যোগদান করেন।
১৯৭৭ খ্রিষ্টাব্দে সামারিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে জেনারেল জিয়াউল হক ক্ষমতা দখল
করেন এবং
জুলফিকার আলী ভুট্টো
ও টিক্কা খানকে বন্দী করেন।
১৯৭৯ খ্রিষ্টাব্দে
জুলফিকার আলী ভুট্টো
ফাঁসি দেওয়া হয়। এই সময় টিক্কা খান পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) এর মহাসচিব হন।
১৯৮৮ খ্রিষ্টাব্দে বাহাওয়ালপুর বিমান দুর্ঘটনায় জিয়াউল হকের মৃত্যুর পর, টিক্কা
খান পাঞ্জাবের রাজ্যপাল নিযুক্ত হয়।
১৯৯০ খ্রিষ্টাব্দে বেনজীর ভুট্টোর সরকারের পতনের পর তিনি, রাজনীতি থেকে অবসর গ্রহণ
করে।
২০০২ খ্রিষ্টাব্দের ২৮শে মার্চ তিনি মারা যান।
সূত্র: বাংলাপেডিয়া