রাজাকার
১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সহযোগী একটি আধা-সামরিক বাহিনী। এই বাহিনীর অধিকাংশ ছিল বাঙালি। এই দলের কিছু সদস্য ছিল স্থানীয় উর্দুভাষী লোক। আরবি রি'দাকার (স্বেচ্ছাসেবক) থেকে ফারসি রেজাকার শব্দ সৃষ্টি হয়েছিল। পরে উর্দুতে রেজাকার শব্দ গৃহীত হয়। এই শব্দটিই লোকমুখে তা রাজাকার শব্দ পরিণত হয়। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে পাক-ভারত বিভাগকালে তদানীন্তন হায়দ্রাবাদের শাসক নিজাম ভারতভুক্ত হতে অনিচ্ছুক থাকায়, ভারতের সামরিক বাহিনীকে প্রাথমিকভাবে প্রতিরোধের জন্য রাজাকার নামে একটি স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন করেছিলেন।

রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা কোরআন ছুঁয়ে শপথ নিচ্ছে।

পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে, জামায়েত ই-ইসলামী'র পূর্ব পাকিস্তানি শাখার সহকারী আমীর মাওলানা এ কে এম ইউসুফ এই দলটি তৈরি করেন। এই বহিনীর সদস্যদের পাকিস্তানি সেনাবহিনী প্রশিক্ষণ দেয়। 

২২ এপ্রিল, ময়মনসিংহ জেলা ইসলামী ছাত্রসংঘের (তৎকালীন জামায়েত ই-ইসলামী'র ছাত্র সংগঠন) সভাপতি মুহম্মদ আশরাফ হোসাইনের নেতৃত্বে জামালপুর শহরে আল বদর বাহিনী গঠিত হয়েছিল। এই বাহিনী তৈরি করা হয়েছিল সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে রাজনৈতিক কর্মী এবং বুদ্ধজীবী হত্যার জন্য। কিন্তু রাজাকার তৈরি করা হয়েছিল মুক্তিবাহিনীর মোকাবেলা করার জন্য।
 
১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের মে মাসে খুলনায় প্রথম রাজাকার বাহিনী গঠিত হয়। বাংলাদেশের খুলনা শহরের খানজাহান আলী সড়কে, একটি আনসার ক্যাম্পে ৯৬ জন
জামায়েত ই-ইসলামী'র কর্মী সমন্বয়ে প্রথম রাজাকার বাহিনী তৈরি হয়। রাজাকার বাহিনীর প্রতিটি সদস্যকে কোরআন ছুঁয়ে শপথ নিতে হতো। শপথটি ছিল "I shall bear true allegiance to the constitution of Pakistan as framed by law and shall defend Pakistan, if necessary, with my life." অর্থাৎ, ["আমি আইনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানের সংবিধানের প্রতি সত্যিকার আনুগত্য প্রদর্শন করব এবং প্রয়োজনে জীবন দিয়ে হলেও পাকিস্তানিকে রক্ষা করব।"]।

দৈনিক সংগ্রাম ২১ জুন, ১৯৭১

প্রাথমিক পর্যায়ে রাজাকার-এর উপর নিয়ন্ত্রণ ছিল এলাকার শান্তি কমিটির (জামায়েত ই-ইসলামী এবং সমমনা রাজনৈতিক দলের সদস্যদের দ্বারা ক্ষুদ্রাকার সৃষ্টি স্থানীয় সরকার)। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ১ জুন জেনারেল টিক্কা খান পূর্ব পাকিস্তান রাজাকার অর্ডিন্যান্স-১৯৭১ জারি করে আনসার বাহিনীকে রাজাকার বাহিনীতে রূপান্তরিত করেন। তখন থেকে এই বাহিনী পাকিস্তানের আধা-সামরিক বাহিনীতে পরিণত হলেও, এর নেতৃত্বে ছিলেন স্বাধীনতা বিরোধী বাঙালিদের হাতে। এরপর জামাত নেতা গোলাম আযম-সহ অন্যান্য জামাত নেতারা মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিপক্ষ হিসাবে রাজাকরদের ব্যবহার করার উপর অধিক গুরুত্ব দেয়। পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ৭ই সেপ্টেম্বর জারিকৃত এক অধ্যাদেশ বলে রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা সেনাবাহিনীর সদস্যরূপে স্বীকৃতি পায়।

রাজাকার বাহিনীর প্রাথমিক পর্যায়ের প্রশিক্ষণের মেয়াদ ছিল ১৫ দিন। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ জুলাই, কুষ্টিয়ায় রাজাকার বাহিনীর প্রথম ব্যাচের প্রশিক্ষণ সমাপ্ত হয়। সেপ্টেম্বর মাসে এই বাহিনীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন মেজর জেনারেল মোহাম্মদ জামসেদ।

পূর্বাঞ্চলীয় সামরিক অধিনায়ক জেনারেল আমির আব্দুল্লাহ খান নিয়াজি ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ২৭শে নভেম্বর, সাভারে রাজাকার বাহিনীর কোম্পানি কমান্ডারদের প্রথম ব্যাচের ট্রেনিং শেষে বিদায়ী কুচকাওয়াজে অভিবাদন গ্রহণ করেন। পরবর্তী পর্যায়ে রাজাকার বাহিনী একটি স্বতন্ত্র অধিদপ্তরের মর্যাদায় উন্নীত হয়। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ ডিসেম্বর, পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করলে, রাজাকাররা আত্মগোপন করে। কার্যত তখন থেকেই রাজাকার বাহিনী রাষ্ট্রীয়ভাবে বিলুপ্ত হয়ে যায়।

স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়, এদের হাতে দেখা যেতো হাল্কা আগ্নেয়াস্ত্র। দেশের অভ্যন্তরে মুক্তিবাহিনীর সাথে যুদ্ধে, এরা পাকিস্তানি বাহিনীর সহায়ক বাহিনী হিসাবে কাজ করতো। তাবেদারী বাহিনী হিসাবে, এরা পাকিস্তানি সৈন্যদের মালামাল বহন করতো, পাকিস্তানি সৈন্যদের জন্য গ্রামাঞ্চল থেকে গরু-ছাগল ধরে নিয়ে আসতো এবং পাকিস্তানিদের সন্তুষ্ট করার জন্য যুবতী মেয়েদের সরবরাহ করতো। এছাড়া নিজেদের সম্পদ বৃদ্ধির জন্য লুটতরাজ করতো। তবে এদের প্রধান কাজ ছিল মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের লোকদের সন্ধান পাকিস্তানি বাহিনীর কাছে পৌঁছে দেওয়া।

স্বাধীনতা যুদ্ধের শেষের দিকে, মুক্তি বাহিনীর ভয়ে পাকিস্তানি সৈন্যরা গ্রামাঞ্চলে হানা দেওয়া বন্ধ করে দেয়। এই সময়ে ব্রিজ, কালভার্ট রক্ষার জন্য  রাজাকারদেরকে নিয়োগ দেওয়া হতো এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সহজ লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হতো। স্বাধীনতা যুদ্ধের শেষে পাকিস্তানি সৈন্য পরাজিত হয়ে শহরাঞ্চলের দিকে পালিয়ে যাওয়ার সময়, অধিকাংশ ক্ষেত্রে রাজাকারদের ত্যাগ করে চলে যেতো। মূলত রাজাকাররা যুদ্ধের শেষ দিকে একটি হতভাগ্য দলে পরিণত হয়েছিল। এরা পাকিস্তানি সৈন্যদের প্রাণপণে সেবা করতো প্রাণ রক্ষার তাগিতে। আর পাকিস্তানিরা তাদের ত্যাগ করলে, মুক্তিবাহিনী এদের হত্যা করতো।

বাংলাদেশের রাজাকারদের সম্পূর্ণ তালিকা প্রকাশিত হয় নি। Bangladesh Genocide Archive- অনলাইনে রাজাকারদের একটি তালিকা প্রকাশ করেছিল। এর সর্বশেষ সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছিল ২০০৮ খ্রিষ্টাব্দের ৪ঠা এপ্রিল। ওই তালিকাটি নিচে যুক্ত করা হলো।

রাজাকার-তালিকা [সূত্র: Bangladesh Genocide Archive]