আলবদর
১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সম পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সহায়তা দানকারী একটি আধা-সামরিক বাহিনী। পূর্বাঞ্চলীয় সামরিক অধিনায়ক জেনারেল আমির আব্দুল্লাহ খান নিয়াজি পৃষ্ঠপোষকতায় এই বাহিনী গঠিত হয়েছিল। উল্লেখ্য ইসলামিক ইতিহাসের বদর যুদ্ধকে আদর্শ করে এই বাহিনী গঠিত হলেও এদের কার্যক্রম ছিল পুরোপুরি অনৈসালামিক।

এরা বিনা-বিচারে মানুষ হত্যা করতো, পাকিস্তানি সৈন্যদের জন্য স্থানীয় মেয়ে সরবরাহ করতো এবং নিজেরাও ধর্ষণ করতো, লুটতরাজে অংশগ্রহণ করতো। মূলত এই দল রাজাকারদের মতো প্রত্যক্ষভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয় নি। তবে এরা সন্ত্রাসী পদ্ধতিতে রাজনৈতিক গণহত্যার মাধ্যমে জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করার কাজে লিপ্ত ছিল। স্বাধীনতা যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে ঢাকাতে যে বুদ্ধিজীবী হত্যা সংঘটিত হয়েছিল, তা আলবদর বাহিনীর দ্বারাই সংঘটিত হয়েছিল। ১৪ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু শিক্ষককে এর ধরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করে।

 

এই বাহিনী গঠন হয়েছিল রাজাকার বাহিনীর আগে। উল্লেখ্য ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের মে মাসে খুলনায় প্রথম রাজাকার বাহিনী গঠিত হয়। পক্ষান্তরে  ২২ এপ্রিল, ময়মনসিংহ জেলা ইসলামী ছাত্রসংঘের (তৎকালীন জামায়েত ই-ইসলামী'র ছাত্র সংগঠন) সভাপতি মুহম্মদ আশরাফ হোসাইনের নেতৃত্বে জামালপুর শহরে আল বদর বাহিনী গঠিত হয়েছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলা ও ক্যাম্পাসের অন্যান্য মাঠে এবং মোহাম্মদপুর ফিজিক্যাল ট্রেনিং কলেজে রাজাকার-আলবদরদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ দেয়া হতো।
 

দৈনিক পাকিস্তান ও পূর্বদেশ পত্রিকায় ২৩ এপ্রিল, ১৯৭১ তারিখে প্রকাশিত সংবাদে আল বদর বাহিনী নিজেদের সম্পর্কে বলে,"আলবদর একটি নাম! একটি বিস্ময়। আলবদর একটি প্রতিজ্ঞা! যেখানে তথাকথিত মুক্তিবাহিনী আলবদর সেখানেই! যেখানেই দুষ্কৃতকারী, আলবদর সেখানেই। ভারতীয় চর বা দুষ্কৃতকারীদের কাছে আলবদর সাক্ষাৎ আজরাইল।"

 

এই দল গঠন করার পর, জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রসংঘের হাইকমান্ড তাদের নেতা  কামারুজ্জামানের নেতৃত্বে পরীক্ষামূলকভাবে ময়মনসিংহে আলবদর বাহিনীকে বিশেষ ট্রেনিং দেয়া শুরু করে। এই সময় মতিউর রহমান নিজামী ছিলেন পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘের সভাপতি। 

 

আশরাফ হোসাইন-এর পর সেপ্টেম্বর মাসে আলবদর-এর দায়িত্ব নেন মতিউর রহমান নিজামী। এর পর ধীরে সারা দেশের ইসলামী ছাত্রসংঘের শাখাগুলোকে আলবদর বাহিনীতে রূপান্তর করা হয় এবং কেন্দ্রীয়ভাবে সংগঠিত করা হয়। ঢাকা শহরে আলবদর বাহিনীর প্রধান নিযুক্ত হন মুহম্মদ শামসুল হক ও শওকত ইমরান। এছাড়া অন্যান্য অঞ্চলে যে সকল ইসলামী ছাত্রসংঘের নেতারা আলবদরের নেতৃত্বে ছিলেন, তাঁরা হলেন রাজশাহীতে আবদুল হাই ফারুকী, ঢাকা জেলায় সরদার আবদুল সালাম, খুলনায় মতিউর রহমান খান, চট্টগ্রামের একটি অংশের এনামুল হক মঞ্জু ও মীর কাশেম আলী, চট্টগ্রাম অপর অংশে আবদুল জাকের ও মুহম্মদ আবু নাসের, ময়মনসিংহে আশরাফ হোসেন ও মাজহারউল ইসলাম।

 

অক্টোবর মাসে এই বাহিনীর প্রধান হন আলী আহসান মুজাহিদ। তার নেতৃত্বে আলবদর বাহিনী যুদ্ধের মধ্যে ফরিদপুর, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে হত্যা, অপহরণ, লুটপাটের মতো ব্যাপক মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ড চালায়। মূলত ১৪ই ডিসেম্বরে ঢাকাতে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়, তার মুজাহিদ-এর নেতৃত্বে আলবদর বাহিনীর দ্বারা সংঘটিত হয়েছিল। এমনকি ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের প্রস্তুতির সময়ও মুজাহিদ তাঁর বাহিনী নিয়ে আত্মসমর্পণ না করার সিদ্ধান্ত নেন।

১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ ডিসেম্বর, পাকিস্তানী বাহিনী আত্মসমর্পণ করলে, এরা আত্মগোপন করে। কার্যত তখন থেকেই এই বাহিনী রাষ্ট্রীয়ভাবে বিলুপ্ত হয়ে যায়। এরপর এরা পুরোপুরি আত্মগোপন করে, সাধারণ মানুষের সাথে মিশে যায়।