জামায়েত-ই-ইসলামী আমীরের তালিকা

মাওলানা সাইয়েদ আবুল আ'লা মওদুদী (১৯৪৭-৭২)
উফায়েল মুহাম্মদ (১৯৭২)
কাজী হুসাইন (১৯৭২)
মওলানা জাকারিয়া (১৯৭২-জুলাই ১৯৭৩)
মাস্টার মোঃ শফিউল্লাহ (জুলাই ১৯৭৩-সেপ্টেম্বর ১৯৭৪)
মাওলানা আব্দুল খালেক (সেপ্টেম্বর ১৯৭৪-মার্চ ১৯৭৫)
সৈয়দ মোহাম্মদ আলী (মার্চ ১৯৭৫-সেপ্টেম্বর ১৯৭৫)
মওলানা আবদুর রহীম (সেপ্টেম্বর ১৯৭৫-১৯৭৮)
অধ্যাপক গোলাম আজম (১৯৭৮-২০০০)
মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী (২০০০-)

জামায়েত-ই- ইসলামী
একটি রাজনৈতিক দল। কেন্দ্রীয় অফিস- লাহোর, পাকিস্তান। বাংলাদেশ জামায়েত-ই-ইসলামী'র কেন্দ্রীয় অফিস ঢাকা, বাংলাদেশ।

বিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে অবিভক্ত ব্রিটিশ ভারতে ইসলামী আন্দোলন গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে মাওলানা সাইয়েদ আবুল আ'লা মওদুদী একটি রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে তোলার উদ্যোগ নেন। মাসিক তারজুমান আল-কোরআন নামক পত্রিকায় এই সংগঠনের প্রচার কার্য শুরু হয় ১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দ থেকে। ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দে মাওলানা মওদুদী আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে 'ইসলামী হুকুমত প্রতিষ্ঠার পথ' শীর্ষক এক বক্তৃতায়, তৎকালীন মুসলিম লীগের সাথে তাঁর মতপার্থক্য তুলে ধরেন। ১৯৪১ খ্রিষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি একটি ইসলামী রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে তোলার লক্ষ্যে একটি সম্মেলন সভা ডাকেন। এই সভায় তিনি আনুষ্ঠানিক একটি ইসলামী রাজনৈতিক দল গঠনের ঘোষণা দেন। এই বৎসরের ২৬ আগষ্টে, লাহোরে অনুষ্ঠিত একটি সম্মেলনে এই দলের নাম এবং লক্ষ্য-উদ্দেশ্য প্রকাশ করেন। এই দিন এই দলের নাম আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হয়। দলটির নাম হয় “জামায়াতে ইসলামী হিন্দ”। এই সময় এই দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয় স্থাপন করা হয় লাহোর। এই সভায় মোট ৭৫ জন সদস্য উপস্থিত ছিলেন। মওদুদী এই দলের আমীর নির্বাচিত হন। এই সময় থেকে তিনি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার তীব্র বিরোধিতা করেন। তিনি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা প্রসঙ্গে বলেন- পাকিস্তান রাষ্ট প্রতিষ্ঠার দাবী করা সবাই, মুসলীম লীগ, জিন্নাহ এরা কেউই “খাটি মুসলিম” না ।

১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দে দলের কার্যালয় লাহোর থেকে পাঠানকোটে স্থানান্তর করা হয়।
১৯৪৩ খ্রিষ্টাব্দে মাসিক 'তরজমানুল কোরআন' পত্রিকার মাধ্যমে মওদুদী নিজেদের মতবাদ প্রচার করা শুরু করে। এই পত্রিকার ফেব্রুয়ারি সংখ্যায় মওদুদী পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরোধিতা করে লিখেন, 'পাকিস্তান নামক কোনো রাষ্ট্রের জন্ম হলে সেটা “আহাম্মকের বেহেশত” এবং “মুসলমানদের কাফেরানা রাষ্ট্র” হবে।

১৯৪৪-৪৫ খ্রিষ্টাব্দের ভিতরে মওদুদী প্রচুর সমর্থক সংগ্রহ করতে সক্ষম হন।১৯৪৫ খ্রিষ্টাব্দের ১৯-২১ এপ্রিল পাঞ্জাবের পাঠনকোটে দলের নিখিল ভারত সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।

১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে ভারত পাকিস্তান বিভাজিত হয়ে গেলে, এই দলটিও দেশ অনুসারে বিভাজিত হয়। ভারতে এর নাম হয় জামায়েত-ই-ইসলামী ভারত এবং পাকিস্তানে এর নাম হয় জামায়েত -ই-ইসলামী পাকিস্তান। পাকিস্তানের জামায়েত-ই- ইসলামীর আমীর হন মাওলানা মওদুদী। পাকিস্তানের জামায়েত -ই-ইসলামী'র সদর দফতর স্থাপন করা হয় লাহোরে। এই সময় পাকিস্তানের কাশ্মীরের জন্য আন্দোলন করাকে হারাম ঘোষণা দেয়।

১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দে মওদুদী ইসলামী সংবিধান ও ইসলামী সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য প্রচারণা শুরু করেন। এই কারণে পাকিস্তান সরকার জননিরাপত্তা আইনে মওদুদীকে গ্রেফতার করে । এই বছরেই পাকিস্তানি জামায়েত-ই- ইসলামীর পূর্ব শাখা খোলা হয় তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানে।

১৯৪৯-৫০ খ্রিষ্টাব্দের ভিতরে জামায়েত -ই-ইসলামী'র জনসংযোগের মাধ্যমে দলের শক্তি বৃদ্ধিও করতে থাকেন। ১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দে পাকিস্তান সরকার তাঁকে মুক্তি দেন।
১৯৫১ খ্রিষ্টাব্দের অনুষ্ঠিত পাঞ্জাবের প্রাদেশিক নির্বাচনে জামায়েত -ই-ইসলামী অংশগ্রহণ করে এবং লজ্জাজনক ফলাফল লাভ করে।

এরপর এই দল পাকিস্তানে নানারকম সামাজিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করে, বেশ কিছু সমর্থক তৈরি করতে সক্ষম হলেও, পাকিস্তানের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ এই দলের রাজনৈতিক দর্শনকে প্রত্যাখ্যান করে।

১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে তদানীন্তন পূর্ব-পাকিস্তানে রাষ্ট্রভাষা 'বাংলা'-র জন্য যে আন্দোলন হয়, তাতে জামায়েত -ই-ইসলামী বিরোধিতা করে।
১৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দে আহমদিয়া সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে এই দল। ১৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দে মাওলানা মওদুদী তার বই
'Qadiani Problem'-তে আহমেদিয়া সম্প্রদায়কে অমুসলিম ঘোষণা করেন। তিনি পাকিস্তানের জুলফিকার আলী ভুট্টো-সহ বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতা এবং পাকিস্তান সরকারকে আহমেদিয়া সম্প্রদায়কে অমু্সলিম ঘোষণা করার জন্য চাপ দেন। মাওলনা মওদুদীর নেতৃত্বে এই দলের সমর্থকরা, এক সময় লাহোরে আহমদীয়াদের উপর নৃশংস আক্রমণ করে। প্রাথমিক আক্রমণে প্রায় ২০০ আহমদীয়া সম্প্রদায়ের মানুষ নিহত হয়। পরে এই ঘটনা দাঙ্গায় পরিণত হয়। পরে সামারিক বাহিনীর হস্তক্ষেপে এই দাঙ্গা শেষ হয়। সমগ্র দাঙ্গায় প্রায় ১০,০০০ লোক নিহত হয়। ভারত-পাকিস্তানের বিভাজনের পর একটি দাঙ্গায় এত লোক নিহত হওয়ার ঘটনা এই প্রথম। এই সময় মাওলানা মওদুদীকে সেনাবহিনীর সদস্যরা গ্রেফতার করে। প্রাথমিকভাবে বিচারে মওদুদীকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়। শেষ পর্যন্ত তাঁকে মুসলিম কিছু রাষ্ট্রের আবেদনে মৃত্যুদণ্ড মওকুফ করা হয়। ১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দে জেল থেকে তিনি মুক্তি লাভ করেন।

১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দে পূর্ব পাকিস্তানে জামায়েত -ই-ইসলামী  ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য প্রতিষ্ঠা করে 'ইসলামী ছাত্রসংঘ'। এই সংঘের আমির নির্বাচিত হন মাওলানা আবদুর রহীম। এই বছরেই গোলাম আযম এই জামায়েত -ই-ইসলামী-তে যোগদান করেন।

১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দে 'ইসলামী ছাত্রসংঘ' আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যক্রম শুরু করে।
১৯৫৭ খ্রিষ্টাব্দের অক্টোবর মাসে গোলাম আযমকে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের, জেনারেল সেক্রেটারি নিযুক্ত করা হয়।
১৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দে আইয়ুব খান সকল রাজনৈতিক দলের কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা করে । বলাই বাহুল্য এই সময় রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়েত -ই-ইসলামীও নিষিদ্ধ হয়। ১৯৬২ সাল পর্যন্ত এই আদেশ বলবৎ ছিল।

১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দে পাকিস্তানে মুসলিম পরিবার আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নিলে, জামায়েত -ই-ইসলামী তার বিরোধীতা করে এবং সে সময়ের শিক্ষা আন্দোলনের বিপক্ষে অবস্থান নেয়। ১৯৬৩ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত পাকিস্তানে মুসলিম পরিবার আইন প্রণয়নের বিপক্ষে জোর প্রচারণা চালায়।

১৯৬৪ খ্রিষ্টাব্দের ৪ঠা জানুয়ারি, পাকিস্তানে জেনারেল আয়ুব খান জামায়েত-ই-ইসলামী নিষিদ্ধ করে। এই সময় মওদুদী সহ ৬০ জন জামাত নেতাকে গ্রেফতার করা হয়। পূর্ব-পাকিস্তানে গ্রেফতার হয়েছিলেন গোলাম আজম। অক্টোবর মাসে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়।

১৯৬৪-৬৫ খ্রিষ্টাব্দের নির্বাচনের আগে, মাওলানা মওদুদী নারীর ক্ষমতায়নের তীব্রভাবে বিরোধিতা করেন। কিন্তু এই নির্বাচনে ক্ষমতার লোভে, এই দল নিয়ে মাওলানা মওদুদী ফাতেমা জিন্নাহকে সমর্থন করেন। নির্বাচনে ফাতেমা জিন্নাহর পরাজয় ঘটলে দলটি কোণঠাসা হয়ে পড়ে। উল্লেখ্য, ১৯৬৫ খ্রিষ্টাব্দে পাকিস্তানে গণতান্ত্রিক মোর্চা গঠিত হলে মাওলানা ভাষানী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান-এর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন।

১৯৬৬ খ্রিষ্টাব্দে
 শেখ মুজিবর রহমান ৬ দফা পেশ করলে, জামায়েত-ইসলামী তার বিরোধিতা করে। ৬ দফা দাবির সূত্রে পূর্ব-পাকিস্তানে যে গণ-আন্দোলনের সূচনা হয়, তখন এই আন্দোলন ব্যাহত করার জন্য, ১৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দে জামায়েত-ই-ইসলামী ৫ দফা দাবি উত্থাপন করে।

১৯৬৮ খ্রিষ্টাব্দে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাকে কেন্দ্র করে পূর্ব পাকিস্তান উত্তাল হয়ে উঠলে, পাকিস্তানে চরম রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হয়। এই সময় মওদুদী আইয়ুব খানকে সমর্থন করেন এবং তাঁর আস্থা অর্জন করেন।

১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দে পূর্ব-পাকিস্তানের গণ অভ্যুত্থানের সময়, গোলাম আযম পাকিস্তানিদের ব্যাপক সহায়তা করেন এবং তিনি পুরস্কার স্বরূপ পূর্ব-পাকিস্তান আমীরের পদ লাভ করেন।

১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দে এই দল পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনে ১৫১টি আসনে অংশগ্রহণ করে এবং ৪টি আসনে জয়লাভ করতে সক্ষম হয়।

বাংলাদেশ জামায়েত-ই-ইসলামীর প্রতীক

১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে ২৫ মার্চ দিবাগত রাত্রি ১২টার পর থেকেপাকিস্তানী সেনাবাহিনী কর্তৃক তদানীন্তন পূর্ব-পাকিস্তানে সামরিক অভিযান শুরু করে। শুরুর দিকের এই অভিযানের নাম ছিল- অপারেশন সার্চ লাইট। এই অভিযানের মূল লক্ষ্য ছিল হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের ভিতর দিয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদ আন্দোলনকে সমূলে ধ্বংস করা। এই অপারেশন আনুষ্ঠানিকভাবে শেষ হয় ১০ এপ্রিল-এ। এরপর ১০ এপ্রিল টিক্কা খান জেনারেল এ.এ.কে. নিয়াজির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। এর ফলে 'অপারেশন সার্চালাইট' কার্যত বাতিল হয়ে যায়। এরপর শুরু হয়- জেনারেল নিয়াজির নবতর পদ্ধতির বাঙালি জাতিসত্ত্বা নিধনের কার্যক্রম। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় এই দল পাকিস্তানীদের পক্ষালম্বন করে এবং পাকিস্তানী সৈন্যদের ব্যাপক হত্যাকাণ্ড, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, লুণ্ঠনে এই দলের সকল সদস্য পাকিস্তানী বাহিনীর তাবেদার বাহিনী হিসাবে কাজ করে। এদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা এবং অংশগ্রহণের মাধ্যমে রাজাকার, আলবদর এবং আল্ শামস  নামক কুখ্যাত বাহিনী তৈরি হয়। বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবী হত্যার সময় এই দলের দ্বারা সৃষ্ট 'আলবদর' বাহিনীই মূল হত্যাকাণ্ড চালায়। এছাড়া এরা বিশ্ববাসীর কাছে এই সকল কুকর্ম লুকিয়ে রাখার জন্য, পাকিস্তানী বাহিনীর সহযোগিতায় 'শান্তিবাহিনী' নামে স্থানীয় সরকার গঠন করে। এই সময় এই দলের আমীর ছিলেন গোলাম আজম।

১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে জামায়েত-ই-ইসলামী প্রত্যক্ষভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করে। পাকিস্তানি সৈন্যদের সহযোগিতার জন্য রাজাকার আলবদর এবং আলশামস নামক আধাসামারিক বাহিনী সৃষ্টি করে। এরা গণহত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগের মতো যুদ্ধাপরাধে পাকাস্তানি সৈন্যদের সাথে সক্রিয় অংশগ্রহণ করে। এদের দলীয় পত্রিকা 'দৈনিক সংগ্রাম' স্বাধীনতা বিরোধী শক্তির মুখপত্র হিসেবে প্রকাশিত হয়।

১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের স্বাধীনতার পর এই দল নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দে মাওলানা আবদুর রহিম ইসালমিক ডেমোক্র্যাটিক লীগ (আই.ডি.এল) রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা শুরু করে। এই দলের আশ্রয়ে জাময়েতের নেতাকর্মীরা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু করে।

১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের শুরু থেকেই জামায়েত-ই-ইসলামীর আমির গোলাম আযম 'স্বাধীন বাংলাদেশ'কে অকার্যকর করার নানারকম প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকেন। যেমন-


১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দে সরকারি এক আদেশে গোলাম আযম-সহ ৩৮ জনের নাগরিকত্ব বাতিল করা হয়।
১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দ বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর, আত্নগোপনে চলে যাওয়া জামাত নেতারা আস্তে আস্তে দেশে ফিরতে শুরু করেন। এই সময় কুখ্যাত যুদ্ধপরাধী শাহ আজিজুর রহমান দেশে ফিরেন। পরে তিনি বিএনপির প্রথম প্রধানমন্ত্রী হন।

১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দে সরকার এক প্রেসনোটে নাগরিকত্ব ফেরত পাওয়ার জন্য ইচ্ছুক ব্যাক্তিদের আবেদন জানাতে বলেন। এই সময় গোলাম আজম আবেদন করেন এবং প্রত্যাখাত হয়।
১৯৭৭ খ্রিষ্টাব্দে গোলাম আজম আবারো নাগরিকত্ব ফিরে পাওয়ার জন্য আবেদন করেন এবং সেবারও সে আবেন নাকচ করে দেওয়া হয়। এই বছরের ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম দিকে জামায়াতের তৎকালীন আমির মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী, সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহম্মদ মুজাহিদ, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম আহজারুল ইসলাম, কাদের মোল্লা, মীর কাশেম আলী, আবু তাহের সহ অন্যান্যদের উপস্থিতিতে- 'ইসলামী ছাত্র-সংঘ'-এর নাম পরিবর্তন করা হয়। এই সংঘের নতুন নাম হয় 'ইসলামী ছাত্রশিবির'। ছাত্রশিবিরের প্রথম কমিটির সভাপতি ছিলেন মীর কাশেম আলী। আর সাধারণ সম্পাদক ছিলেন কামারুজ্জামান

১৯৭৮ খ্রিষ্টাব্দে গোলাম আযম জিয়াউর রহমানের আনুকূল্যে পাকিস্তানি পাসপোর্ট নিয়ে সাময়িকভাবে বাংলাদেশে আসেন এবং কোন ভিসা ছাড়াই ১৯৭৮-১৯৯৪ পর্যন্ত বাস করেন। এই সময় তিনি ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে স্বাধীনতা বিরোধী কাজে লিপ্ত ব্যক্তিবর্গের আমির হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৭৯ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকাযর একটা কনভেনশনের মাধ্যমে 'জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ' গঠিত হয়। এই সময় গোপনে গোলাম আজমকে আমির করে, আব্বাস আলী খানকে ভারপ্রাপ্ত আমিরের দায়িত্ব দেওয়া হয়। এই সময়ের সাধারণ নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটিক দলের ব্যানারে জামায়েতে ইসালমীর ৬ জন নেতা জয় লাভ করে। ১৯৭৯ খ্রিষ্টাব্দে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল গঠনের উপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়। এই সময় জামায়েত ইসালমী স্বনামে আত্মপ্রকাশ করে। এই সময় দলের আমির নির্বাচিত হন মাওলানা আব্বাস আলী খান।

১৯৮০ খ্রিষ্টাব্দে প্রথমবারের মত বায়তুল মোকারমের সামনে 'জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ' সভা হয়। স্বাধীন বাংলাদেশে এটাই ছিল তাদের প্রথম প্রকাশ্য সম্মেলন।

১৯৮১ খ্রিষ্টাব্দের ২১ মার্চ মুক্তিযোদ্ধা সংসদের চেয়ারম্যান কাজী নুরুজ্জামান রাজাকার-আলবদরদের বিচারের জন্য ৭ দফা দাবি পেশ করেন এবং আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করেন। চাপের মুখে জিয়াউর রহমান তৎকালীন সংস্থাপনমন্ত্রী মাজেদুল হককে এ ব্যাপারটি দেখার জন্য বলেন। কিন্তু শেষ পযর্ন্ত বিচারে দাবি চাপা পড়ে যায়।

১৯৮২ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে জামাত-কর্মীরা অধিকার করতে থাকে। এই সময় কাদের মোল্লা ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়।

১৯৮৪ খ্রিষ্টাব্দে জামাতের সাবেক আমির মাওলানা আবদুর রহিম জামাত ছেড়ে, ইসলামী ঐক্য (জোট) নামে নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেন।
১৯৮৫ খ্রিষ্টাব্দে এরশাদ সরকারের সাথে দলটার সখ্য গড়ে উঠে। এই সময় কাদের মোল্লা ঢাকা মহানগর আমির নির্বাচিত হয়।

১৯৮৬ খ্রিষ্টাব্দের সাধারণ নির্বাচনে জামায়েত ইসলামী ১০টি আসন লাভ করে। তৎকালীন সামরিক সরকার জেনারেল হুসেন মুহম্মদ এরশাদ-এর বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হলে, জামায়েত-ই- ইসলামীর সাংসদরা ১৯৮৭ খ্রিষ্টাব্দের ৩ ডিসেম্বরে সংসদ থেকে পদত্যাগ করে।
আওয়ামী লীগবিএনপি-র সংক্রিয় অংশগ্রহণের কারণে, এই আন্দোলনে তীব্রতর হয়ে উঠে এবং এরশাদ সরকারের পতন ঘটে।

১৯৮১ খ্রিষ্টাব্দে জামায়েত-ই-ইসলামী ১৮টি আসনে জয়লাভ করে।

১৯৮২ থেকে ১৯৮৮ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত জামাত নানাভাবে নিজেদের স্থান পোক্ত করার কার্যক্রম চালিয়ে যেতে থাকে। এই সময় এদের সহযোগী সংগঠন 'ছাত্রশিবির' উগ্র সন্ত্রাসী সংগঠনে পরিণত হয়। এবং চট্টগ্রাম রাজশাহী সহ বিভিন্ন জেলায় তাদের ট্রেডমার্ক রগ কাটার রাজনীতি শুরু করে।

১৯৯০ খ্রিষ্টাব্দ এরশাদ সরকারের পতন ঘটলে,  টিভিতে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা নেতৃরা বক্তৃতা বিবৃতি দেন। এই সময় জামাতের নেতারাও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নেতা হিসেবে টিভিতে এলে সারা দেশে প্রতিবাদের ঝড় উঠে।

১৯৯১ খ্রিষ্টাব্দে বিএনপির সহযোগিতায় জামাত ১৮টি আসনে জয় লাভ করে। উচ্চ আদালতে জামায়েত-ই-ইসলামীর প্রাক্তন আমির গোলাম আযম নাগরিকত্বের বৈধতা ঘোষিত হওয়ার পর, তিনি এই দলের আমির নির্বাচিত হন। এর ফলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিটি তীব্রভাবে বিষয়টি উঠে আসে। এই বৎসরের ২৯ ডিসেম্বর গোলাম আযমকে, জামায়েত-ই-ইসলাম তাদের দলের আমির ঘোষণা করলে, বাংলাদেশে গণ-অসন্তোষের সৃষ্টি হয়। 

১৯৯২ খ্রিষ্টাব্দে স্বাধীনতা বিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন শুরু হয়। এই আন্দোলনের সূত্রে, ১৯৯২ খ্রিষ্টাব্দের ১৯ জানুয়ারিতে শহিদ জননী জাহানারা ইমাম নেতৃত্বে ১০১ সদস্যবিশিষ্ট একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গঠিত হয়। ২২শে জানুয়ারিতে নিজামী এ আন্দোলনকারীদের 'সংবিধানের শত্রু' হিসেবে আখ্যা দিলে
২৭ জানুয়ারি শহিদ জননী জাহানারা ইমাম, এর কড়া জবাব দেন। ২৭শে জানুয়ারি আওয়ামী লীগ, ৫ দলীয় জোট, গণতান্ত্রিক ফ্রন্টসহ দেশের অন্য অনেক রাজনৈতিক দল জাহানারা ইমাম-এর সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে। ফেব্রুয়ারি মাসে এই আন্দোলন আরও বেগবান হয়। এই আন্দোলনকে কার্যকরী করার জন্য একটি গণ-আদালত গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এই গণ-আদালত-এর সূত্রে আন্দোলন নতুন মোড় নেয়। এবং পুরো ফেব্রুয়ারি মাস তা অব্যাহত থাকে।

১৯৯৩ খ্রিষ্টাব্দে  গণ-আদালতের কারণে জামাত কিছুটা কোণঠাসা হয়ে পড়ে। এই সময় গণ-আদালত মতিউর রহমান নিজামী,
কাদের মোল্লা, দেলোয়ার হোসেন সাঈদী, কামারুজ্জামান, সহ আট জনকে মৃত্যুদণ্ডেযোগ্য অপরাধী হিসেবে ঘোষণা করে।

১৯৯৪ খ্রিষ্টাব্দে উচ্চ আদালতের এক রায়ে গোলাম আজম জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব ফিরে পান । ১৯৯৪ খ্রিষ্টাব্দে
আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকার দাবীতে আন্দোলন শুরু হলে, জামায়েত ইসলামী এই আন্দোলনকে সমর্থন করে।

১৯৯৫ খ্রিষ্টাব্দে জামাত প্রথমবারের মত একদিন হরতাল দেয়। তবে এই হরতাল ঢিলেঢালা ভাবে পালিত হয়।

১৯৯৬ খ্রিষ্টাব্দে জামাত এবং আওয়ামীলীগ তত্ত্ববধাক সরকারের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। তবে উভয় দল জোটবদ্ধ না হয়ে পৃথক পৃথক দল হিসেবে আন্দোলন করেছিল। এই নির্বাচনে জামাত একাই অংশগ্রহণ করে ৩টি আসনে লাভ করেছিল।

১৯৯৭ খ্রিষ্টাব্দে শিবির বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আধিপত্য বিস্তারের উদ্যোগ নেয় এবং অনেকাংশে সাফল্য লাভ করে। এই সময় দেলোয়ার হোসেন সাঈদী ইসলামী সভার নামে দলীয় কার্যক্রম চালিয়ে যেতে থাকে।

১৯৯৮ খ্রিষ্টাব্দে জামাত বিএনপির সাথে জোটবাধার উদ্যোগ নেয়। আওয়ামী লীগকে ঠেকানোর জন্য বিএনপি জামাতের ঐক্য সুদৃঢ় হয়।

১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দে আনুষ্ঠানিকভাবে বিএনপির সাথে জামাত ও অন্য দুটি দল মিলিত হয়ে চার দলীয় জোট গঠন করে।

২০০০ খ্রিষ্টাব্দে জামায়েত-ই-ইসলামীর আমির পদে নির্বাচিত হন মতিউর রহমান নিজামী।

২০০১ খ্রিষ্টাব্দে  বিএনপি-র সাথে জোট তৈরি করে নির্বাচন করে এবং ১৮টি আসনে জয়ী হয়। এই সময় জামাতের দলের শীর্ষ দুই নেতা নিজামী এবং মুজাহীদ মন্ত্রিত্ব লাভ করে। স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরোধী শক্তির নেতা হলেও এরা নির্লজ্জের মতো তাদের গাড়িতে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা বহন করে।

২০০২ থেকে ২০০৫ খ্রিষ্টাব্দে জামাত তাদের অবস্থানকে আরো সুদৃঢ় করার কার্যক্রম হয়। একই সাথে জঙ্গী তৎপরতা চালানোর উপযোগী দল তৈরিতে হাত দেয়। ২০০৫ খ্রিষ্টাব্দে জামাতের আমন্ত্রণে পাকিস্তান জামাতে ইসলামীর শীর্যস্থানীয় নেতৃবৃন্দ বাংলাদেশে আসেন। তারা শিরিরের দ্বিবার্ষিক সম্মেলনে অংশ নেন।

২০০৭ খ্রিষ্টাব্দ থেকে নতুন প্রজন্ম জমাতের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে থাকে।

২০০৮ খ্রিষ্টাব্দের সাধারণ নির্বাচনে চারদলীয় জোটের ভরাডুবি হয়। এই ফলাফলের জন্য বিশেষভাবে দায়ী ছিল বিএনপির সীমাহীন দুর্নীত এবং জামতের ঔদ্ধত্যপূর্ণ এবং সহিংস আচরণ।

২০০৯ খ্রিষ্টাব্দে মহান জাতীয় সংসদে একজন সংসদ সদস্য যুদ্ধপরাধীদের বিচারের প্রস্তাব পেশ করলে তা সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। উল্লেখ্য এই প্রস্তাব পাশ হওয়ার সূত্রে জামাত এবং অন্য দলের যুদ্ধাপরাধীরা আতঙ্কিত হয়ে পড়ে।

২০১০ খ্রিষ্টাব্দে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল গঠিত হয়। এরপর উল্লেখযোগ্য যুদ্ধাপরাধীদের গ্রেফতার করার উদ্যোগ নেওয়া হয়।

২০১১ খ্রিষ্টাব্দে জামাত দেশ বিদেশে ট্রাইবুনালের নামে অপপ্রচার চালাতে থাকে। একই সাথে প্রচুর টাকা পয়সা খরচ করে চলতে থাকে আন্তর্জাতিক লবিং।

২০১২ খ্রিষ্টাব্দে যুদ্ধাপরাধীর স্বপক্ষে বিপক্ষের সমর্থকদের মধ্যে আদালতে এবং আদালতের বাইরে শীতল যুদ্ধ চলতে থাকে।

২০১৩ খ্রিষ্টাব্দের ৫ ফেব্রুয়ারি [মঙ্গলবার], জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ দেওয়া হয়। মঙ্গলবার বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এই রায় দেন। এই রায় প্রকাশের পর স্বাধীনতার স্বপক্ষীরা অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়ে উঠে। এরই ধারাবাহিকতায় জন্ম নেয় শাহবাগ জনজাগরণ।
                    দেখুন : শাহবাগ গণজাগরণের দিবসানুক্রমিক বিবরণ

এই বিচারালয়ে যাদের বিচার করা হয়, তাঁরা হলেন - আলী আহসান মুজাহিদ, কাদের মোল্লা, দেলোয়ার হোসেন সাঈদী, কামারুজ্জামান, গোলাম আযম, মতিউর রহমান নিজামী, ।
ক্রমশ...


সূত্র :
বাংলাপেডিয়া
http://en.wikipedia.org/wiki/Jamaat-e-Islami