জাহানারা
ইমাম
(মে ৩, ১৯২৯ — জুন ২৬, ১৯৯৪)।
কথাসাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ এবং একাত্তরের ঘাতক দালাল বিরোধী আন্দোলনের নেত্রী।
১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দের ৩ মে তারিখে ভারতের
পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার সুন্দরপুর গ্রামের এক
রক্ষণশীল বাঙালি মুসলমান পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। জাহানারা ইমামের বাবা সৈয়দ আবদুল
আলী ছিলেন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। মা সৈয়দা হামিদা বেগম। জাহানারা
ইমামের ডাক নাম ছিল
জুড়ু।
১৯৪২
খ্রিষ্টাব্দে রংপুর থেকে প্রাইভেট পরীক্ষা দিয়ে ম্যাট্রিক পাস করেন এবং
১৯৪৫ খ্রিষ্টাব্দে রংপুর কারমাইকেল কলেজ থেকে আইএ পাস করেন। এরপর
১৯৪৫ খ্রিষ্টাব্দে ভর্তি হন কলকাতার
লেডি ব্রেবোর্ন কলেজে এবং এই
কলেজ থেকে বিএ পাস করেন ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে।
১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দে
তিনি ময়মনসিংহ
বিদ্যাময়ী বালিকা বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসাব যোগদান
করেন এবং ১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত তিনি এখানে শিক্ষকতা করেছেন।
১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে ইনি ঢাকাতে আসেন এবং এখানে সিদ্ধেশ্বরী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের
প্রধান শিক্ষক হিসাবে যোগদান করেন। ১৯৬০ খ্রিষ্টাব্দে বিএড ডিগ্রি অর্জন করেন ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। এরপর ১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দে বুলবুল একাডেমি
কিন্ডারগার্টেন স্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসাবে যোগদান করেন। উচ্চা
শিক্ষার জন্য ইনি যুক্তরাষ্ট্রে যান, ১৯৬৪ খ্রিষ্টাব্দে ইনি
যুক্তরাষ্ট্র থেকে সার্টিফিকেট ইন এডুকেশন ডিগ্রি অর্জন করেন। যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফিরে ১৯৬৫
খ্রিষ্টাব্দে বাংলায় এমএ পাস করেন ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। এরপর ১৯৬৬
খ্রিষ্টাব্দে ইনি ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজে প্রভাষক
হিসাবে
যোগদান করেন এবং ১৯৬৮ খ্রিষ্টাব্দ
পর্যন্ত ইনি এখানেই ছিলেন। তিনি কিছুদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক
ভাষা ইনস্টিটিউটেও অবৈতনিক খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসাবে কাজ করেন।
১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে
বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে জাহানারা ইমামের ছেলে মুক্তিযোদ্ধা শাফী
ইমাম রুমী শহীদ হন।
এছাড়া যুদ্ধের সময় তাঁর স্বামী প্রকৌশলী শরীফুল ইমাম
আহমেদকে পাকবাহিনী নির্যাতন করে এবং ১৪ ডিসেম্বর ইনি মৃত্যবরণ করেন।
স্বাধীনতার পর ইনি ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে
তাঁর পুত্রের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ এবং
মৃত্যু ও অন্যান্য বিষয় নিয়ে, বিখ্যাত গ্রন্থ 'একাত্তুরের দিনগুলি' রচনা করেন।
১৯৯১ খ্রিষ্টাব্দের ২৯ ডিসেম্বর গোলাম আযমকে জামায়াতে ইসলামী তাদের দলের আমীর ঘোষণা করলে,
বাংলাদেশে জনবিক্ষোভের সূত্রপাত হয়। বিক্ষোভের অংশ হিসাবে ১৯৯২ খ্রিষ্টাব্দের ১৯ জানুয়ারি
জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে ১০১ সদস্যবিশিষ্ট একাত্তরের
ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গঠিত হলে। তিনি এর আহ্বায়ক হন।
এ ছাড়া মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী প্রতিরোধ মঞ্চ, ১৪টি
ছাত্র সংগঠন, প্রধান প্রধান রাজনৈতিক জোট, শ্রমিক-কৃষক-নারী এবং সাংস্কৃতিক জোটসহ
৭০টি সংগঠনের সমন্বয়ে— ১৯৯২ খ্রিষ্টাব্দের ১১ ফেব্রুয়ারি
'মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয়
কমিটি’ গঠিত হয়। সর্বসম্মতিক্রমে এর আহ্বায়ক নির্বাচিত হন জাহানারা ইমাম। এই কমিটি
১৯৯২ খ্রিষ্টাব্দের ২৬ মার্চ 'গণআদালত' এর
মাধ্যমে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে একাত্তরের নরঘাতক গোলাম আযমের ঐতিহাসিক বিচার
অনুষ্ঠান করে। গণ-আদালতে
গোলাম আযমের বিরুদ্ধে দশটি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ উত্থাপিত হয়।
১৯৯৩ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসে গণ-আদালত বার্ষিকীতে জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে
গণতদন্ত কমিটি ঘোষিত হয় এবং আরও আটজন যুদ্ধাপরাধীর নাম ঘোষণা করা হয়। এরা
হলেন—আব্বাস আলী খান, মতিউর রহমান নিজামী, মো. কামরুজ্জামান, আবদুল আলীম, দেলাওয়ার
হোসাইন সাঈদী, মওলানা আবদুল মান্নান, আনোয়ার জাহিদ ও
আবদুল কাদের মোল্লা। ১৯৯৩ সালের ২৮
মার্চ নির্মূল কমিটির সমাবেশে পুলিশ বাহিনী হামলা চালায়। পুলিশের লাঠিচার্জে আহত
হন জাহানারা ইমাম এবং তাঁকে পিজি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
১২ জন বিচারকের সমন্বয়ে গঠিত গণআদালতের চেয়ারম্যান জাহানারা ইমাম গোলাম আযমের ১০টি অপরাধ মৃত্যুদণ্ডযোগ্য বলে ঘোষণা করেন। তাঁর আপোষহীন সংগ্রামের জন্য 'শহীদ জননী' নামে অভিষিক্ত হন।
জাহানারা ইমাম গণআদালতের রায় কার্যকর করার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানান। এই গণআদালতের সদস্য ছিলেনঃ এডভোকেট গাজিউল হক, ডঃ আহমদ শরীফ, স্থপতি মাজহারুল ইসলাম, ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ, সুফিয়া কামাল, কবীর চৌধুরী, কলিম শরাফী, শওকত ওসমান, লেঃ কর্ণেল (অবঃ) কাজী নুরুজ্জামান, লেঃ কর্ণেল (অবঃ) আবু ওসমান চৌধুরী এবং ব্যারিস্টার শওকত আলী খান। দীর্ঘদিন ধরে দুরারোগ্য ক্যান্সার রোগে আক্রান্ত হয়ে জাহানারা ইমাম ১৯৯৪ খ্রিষ্টাব্দের ২৬ জুন মৃত্যুবরণ করেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এক হাসপাতালে মৃত্যবরণ করেন।
সাহিত্যকর্মের জন্য তিনি ১৯৮৮ খ্রিষ্টাব্দের "বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ সাহিত্য পুরস্কার" ও "কমর
মুষতারী সাহিত্য পুরস্কার" লাভ করেন। ১৯৯১ সালে তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ
করেন।
গ্রন্থতালিকা
শিশু সাহিত্য |
অন্যান্য |