কাদের মোল্লা, আবদুল
বাংলাদেশ-এর স্বাধীনতা যুদ্ধের চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধী। যুদ্ধাপরাধী হিসেবে শাস্তি
পাওয়ার সময় তিনি
জামায়েত-ই-ইসলাম-এর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ছিলেন।
১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দের ২রা ডিসেম্বর ফরিদপুর জেলার সদরপুর উপজেলার জরিপের ডাঙ্গী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর স্কুল জীবন শুরু স্থানীয় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। ১৯৬৪ খ্রিষ্টাব্দে এসএসসি পাশ করেন। এরপর ভর্তি হন ফরিদপুরের রাজেন্দ্রপুর কলেজে ভর্তি হন। এই কলেজ থেকে ১৯৬৬ খ্রিষ্টাব্দে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন। এরপর রাজেন্দ্রপুর কলেজেই বিএসসিতে ভর্তি হন।
এই সময় তিনি
জামায়েত-ই-ইসলাম-এর অঙ্গ সংগঠন, ইসলামী ছাত্র সংঘের সাথে
পরিচিত হন। কোনো কোনো মতে, তিনি এই সময়ে কিছুদিনের জন্য সমাজতান্ত্রিক আদর্শে
অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। ১৯৬৮ খ্রিষ্টাব্দে বিএসসি পাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থ
বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন।
১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দে ছাত্র সংঘের সদস্য পদ লাভ করেন এবং ছাত্র সংঘের ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয় সভাপতি ও ঢাকা মহানগর সভাপতি হন। একই সাথে তিনি কেন্দ্রিয় ছাত্র
সংঘের কার্যকরী সদস্যও ছিলেন। ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দের নির্বাচনে তিনি,
ছাত্রসংঘের-এর নেতা হিসাবে
পাকিস্তানিদের পক্ষালম্বন করেন।
কিন্তু ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলে,
তিনি সক্রিয়ভাবে
পাকিস্তানি সৈন্যদের সহায়তা দান করেন।
১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে পাকিস্তানিদের সহায়তা করার জন্য যে সকল মানবতাবিরোধী কাজ করেন,
তার ভিত্তিতে যুদ্ধাপরাধী হিসাবে বিচারের সময় (২০১৩
খ্রিষ্টাব্দের ৫ ফেব্রুয়ারি'র রায়ের ভিত্তিতে)
যে সকল ঘটনা উল্লেখ করা হয় সেগুলো হলো―
স্বাধীনতা যুদ্ধের পর ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে যুদ্ধাপরাধী হিসাবে গ্রেফতার হন। পরে স্বাধীনতা বিরোধী শক্তির সহায়তায় মুক্তি লাভ করেন।
১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ডিপ্লোমা পরীক্ষায় পাশ করেন। ১৯৭৭ খ্রিষ্টাব্দে তিনি শিক্ষা প্রশাসন বিভাগে এমএ পাশ করেন।
১৯৭৭ খ্রিষ্টাব্দে তিনি
জামায়েত-ই-ইসলাম-এ আনুষ্ঠানিকভাবে যোগদান করেন। এই বৎসরের
৮ই অক্টোবর বেগম সানোয়ারা জাহানের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তিনি চার
কন্যা ও এক পুত্র সন্তানের জনক।
১৯৭৭ খ্রিষ্টাব্দে মাস্টার্স পরীক্ষার পর, সিনিয়র শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন বাংলাদেশ
রাইফেলস পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজে। সেখানেই কিছুদিন ভারপ্রাপ্ত প্রিন্সিপালের
দায়িত্বও পালন করেন। এরপর গবেষক হিশেবে ১৯৭৮ খ্রিষ্টাব্দে যোগ দেন ইসলামিক
ফাউন্ডেশনে। এরপর প্রতিষ্ঠাতা সেক্রেটারি হিসেবে মানারাত ইন্টারন্যাশনাল স্কুল এন্ড
কলেজ যোগদান করেন। ১৯৭৮ খ্রিষ্টাব্দের নভেম্বর মাসে জামায়েত-ই-ইসলাম-এ রুকন পদ লাভ করেন। এই সময়
তিনি
অধ্যাপক
গোলাম আযম-এর ব্যক্তিগত সচিব নিযুক্ত হন। সে বছরই ঢাকা মহানগর
জামায়েত-ই-ইসলাম-এত শুরা ও কর্ম পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হন।
১৯৮১ খ্রিষ্টাব্দে দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকায় যোগদান করেন। এই পত্রিকার তিনি নির্বাহী
সম্পাদক ছিলেন।
১৯৮২ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকা মহানগর
জামায়েত-ই-ইসলাম-এর সেক্রেটারি হিসেবে দায়িত্ব পান।
ঢাকা জাতীয় প্রেসক্লাবের সদস্য প্রেসক্লাবের কার্যালয় ১৯৮৩-৮৪ সালে কাদের মোল্লা ও
কামারুজ্জামান
সদস্যপদ পেয়েছিলেন। উল্লেখ্য, কী যোগ্যতায় এরা সদস্যপদ পেয়েছিলেন,
সে-সংক্রান্ত নথিপত্র প্রেসক্লাবের কার্যালয়ে খুঁজে পাওয়া যায়
নি। ক্লাবে
সংরক্ষিত তালিকা অনুযায়ী, সে সময়ে প্রেসক্লাবের সভাপতি ছিলেন গিয়াস কামাল চৌধুরী
এবং সাধারণ সম্পাদক ছিলেন শফিকুর রহমান। জাতীয় প্রেসক্লাবের সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে,
২০০৪ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত সদস্য চরিতাভিধান-এ দেখা যায়, মোহাম্মদ কামারুজ্জামান
১৯৮০ খ্রিষ্টাব্দের ১ জানুয়ারি জামায়াতের দলীয় সাপ্তাহিক সোনার বাংলায় সাংবাদিকতা
শুরু করেন। তিনি মিরপুর ১১ নম্বর সেকশনে সাংবাদিক আবাসিক এলাকায় একটি প্লটও পান।
সেখানে ৪ নম্বর সড়কে তাঁর বাড়িও রয়েছে। সদস্য চরিতাভিধান-এ আবদুল কাদের মোল্লার
কোনো পরিচিতি প্রকাশিত হয় নি। ক্লাব কার্যালয় সূত্র জানায়, প্রকাশের জন্য তিনি
তথ্যাদি সরবরাহ করেন নি।
১৯৮২- ৮৩ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের নির্বাচিত সহ-সভাপতি ছিলেন তিনি। ১৯৮৫ খ্রিষ্টাব্দে সংগঠনের ঢাকা মহানগর আমীর এবং কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৯১ খ্রিষ্টাব্দে জামায়েত-ই-ইসলাম-তাঁকে দলের প্রচার সম্পাদকের দায়িত্ব দেয়। ২০০০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি এই দলটির সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল দায়িত্ব পদ লাভ করেন।
মুক্তিযুদ্ধকালে মোস্তফা নামের এক ব্যক্তিকে
হত্যার অভিযোগে ২০০৭ সালের ১৭ ডিসেম্বর কাদের মোল্লাসহ কয়েকজন জামায়াত নেতার
বিরুদ্ধে কেরানীগঞ্জ থানায় একটি মামলা হয়। এছাড়া ২০০৮ সালে পল্লবী থানায় আরো একটি
মামলা হয় কাদেরের বিরুদ্ধে। এই মামলাতেই ২০১০ সালের ১৩ জুলাই তাকে গ্রেপ্তার করা
হয়। মানবতাবিরোধী অপরাধ তদন্ত সংস্থা ২০১০ খ্রিষ্টাব্দের ২১ জুলাই থেকে কাদের
মোল্লার বিরুদ্ধে অভিযোগের তদন্ত শুরু করে। তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন আবদুর রাজ্জাক
খান ও মনোয়ারা বেগম। ২০১০ এরপর ১৯ জুলাই কাদের মোল্লাকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে
রাখা হয়।
২০১১ সালের ২৪ জুন তাঁকে কাশিমপুর কারাগারে স্থানান্তর করা হয়। ২০১১ খ্রিষ্টাব্দের
১৮ ডিসেম্বর ট্রাইব্যুনাল-১-এ কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করে
রাষ্ট্রপক্ষ।
২২ মার্চ-এ নবগঠিত ট্রাইব্যুনাল-২ মামলাটি
স্থানান্তরিত হয়। ওই বছরের ২৮ মে
কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী
অপরাধের ছয়টি ঘটনায় অভিযোগ গঠন করে
আনুষ্ঠানিকভাবে বিচার শুরু করেন
ট্রাইব্যুনাল-২।
৩ জুলাই থেকে রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষ্য
নেওয়া শুরু হয়। দুই তদন্ত কর্মকর্তাসহ
রাষ্ট্রপক্ষে সাক্ষ্য দেন ১২ জন। পরে
আসামিপক্ষে প্রথম সাক্ষী কাদের মোল্লাসহ
ছয়জন সাক্ষ্য দেন। রাষ্ট্রপক্ষ ১৭ থেকে
২৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত পাঁচ দিন যুক্তি
উপস্থাপন করে। ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দের ৭ জানুয়ারি শুরু হয়ে আট
দিন চলে আসামিপক্ষের যুক্তি উপস্থাপন। ১৭
জানুয়ারি যুক্তি উপস্থাপন শেষ হলে
ট্রাইব্যুনাল মামলার রায় অপেক্ষমাণ বা
সিএভি (কেস অ্যায়োইটস ভারডিক্ট) রাখেন।
২০১৩ খ্রিষ্টাব্দের ৫ ফেব্রুয়ারি রায় ঘোষণার আগে তাঁকে আবার ঢাকা কেন্দ্রীয়
কারাগারে আনা হয়।
২০১৩ খ্রিষ্টাব্দের ৫ ফেব্রুয়ারি [মঙ্গলবার], জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি
জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের (১৫ বৎসর) আদেশ দেওয়া হয়। মঙ্গলবার
বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২
এই রায় দেন। রায় ঘোষণার পর ৭ ফেব্রুয়ারিতে তাঁকে আবার কাশিমপুর কারাগারে পাঠানো
হয়। এখানে তাঁকে কারাগারের বাগানে মালির কাজ দেওয়া হয়েছে।
২০১৩ খ্রিষ্টাব্দের ৫ ফেব্রুয়ারি রায় প্রকাশের পর স্বাধীনতার স্বপক্ষীরা অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়ে উঠে। এরই ধারাবাহিকতায় জন্ম নেয় শাহবাগ গণজাগরণ। উল্লেখ্য শাহবাগ গণজাগরণ-এ তাঁর ফাঁসির দাবি তোলা হয়। এবং ঢাকা জাতীয় প্রেসক্লাবের সদস্যপদ বাতিলের দাবি তোলা হয়। এই দাবির সূত্রে, প্রেসক্লাবের ব্যবস্থাপনা কমিটির সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, প্রেসক্লাবের গঠনতন্ত্রের ১৩(ক), ১২(ক) ও ৩৪ অনুচ্ছেদ মোতাবেক, ক্লাবের তাঁর সদস্যের স্থায়ী সদস্যপদ বাতিল করা হয়।
শাহবাগ গণজাগরণ
মঞ্চের আন্দোলন এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে
স্বপক্ষ শক্তিদের দাবির প্রেক্ষিতে
২০১৩ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ ফেব্রুয়ারি
আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) সংশোধন
বিল, জাতীয় সংসদে পাস হয়। উল্লেখ্য আগে
এই আইনে দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে সরকারের আপিল
করার সুযোগ ছিল না। এই সংশোধিত আইনে, ২০১৩
খ্রিষ্টাব্দের ৩ মার্চ কাদের মোল্লার
সর্বোচ্চ শাস্তি চেয়ে আপিল করে
রাষ্ট্রপক্ষ। আর সাজা থেকে অব্যাহতি চেয়ে
৪ মার্চ আপিল করেন কাদের মোল্লা। এরপর
২০১৩ খ্রিষ্টাব্দের ১ এপ্রিল থেকে এই
বিচারের শুনানি শুরু হয়। অবশেষে
২০১৩
খ্রিষ্টাব্দের ১৭ সেপ্টেম্বর
বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত আবদুল কাদের
মোল্লার বিরুদ্ধে ফাঁসির রায় ঘোষণা করে।
২০১৩ খ্রিষ্টাব্দের ১২ ডিসেম্বর দিবাগত
রাত্রি ১২টা ১ মিনিটে সরকার ফাঁসি কার্যকর
করা উদ্যোগ নেয়। কিন্তু এইদিন রাতে কাদের
মোল্লার আইনজীবীরা অ্যাটর্নি জেনারেলকে না
জানিয়েই সুপ্রিম কোর্টের চেম্বার জজ সৈয়দ
মাহমুদ হোসেনের কাছে ফাঁসি কার্যকর
স্থগিতের আবেদন জানান৷ চেম্বার জজ তাদের
আবেদন গ্রহণ করে ১২ ডিসেম্বর সকাল সাড়ে
১০টা পর্যন্ত ফাঁসির দণ্ড কার্যকর স্থগিত
করেন৷ বুধবার সকালে সুপ্রিম কোর্টের আপিল
বিভাগে শুনানি শুরু হলে তা শেষ না হওয়া
পর্যন্ত ফাঁসি স্থগিতের আদেশ দেন
আদালত৷ফলে এই আদেশ ১৩ই ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত
স্থগিত করা হয়। এই দিন এই আপিল বাতিল করে
আদালত ফাঁসির আদেশ বহাল রাখে। এই দিন ১০টা
১মিনিটে তাঁর ফাঁসি কার্যকর করা হয়।