৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ১০ ফেব্রুয়ারি
|
শাহবাগ গণজাগরণ
বাংলাদেশ-এর স্বাধীনতা যুদ্ধের চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায়ে, অসন্তুষ্ট
স্বাধীনতার স্বপক্ষীদের আন্দোলন বিশেষ।
২০১৩ খ্রিষ্টাব্দের ৫ ফেব্রুয়ারি থেকে,
বাংলাদেশ-এর রাজধানী
ঢাকার
শাহবাগ-এর
চৌরাস্তার মোড়ে আন্দোলনকারীরা সমবেত হয়ে আন্দোলন শুরু করে। এই আন্দোলনে
স্বাধীনতার স্বপক্ষী বিশাল জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করে। এরই সূত্র ধরে
আন্দোলনটি সমগ্র বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। ক্রমে ক্রমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিরোধী
পক্ষ ছাড়া সকল মানুষ এই
জাগরণকে সমর্থন করে এবং সক্রিয়ভাবে গণ-জমায়েতের অংশভাগী হয়। এই কারণে একে শাহবাগ
গণজাগরণ বলা হয়।
প্রেক্ষাপট
১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে ২৫ মার্চ দিবাগত রাত্রি ১২টার পর থেকে―পাকিস্তানী
সেনাবাহিনী কর্তৃক তদানীন্তন পূর্ব-পাকিস্তানে সামরিক অভিযান শুরু করে। শুরুর দিকের এই অভিযানের নাম ছিল-
অপারেশন সার্চ লাইট।
এই অভিযানের মূল লক্ষ্য ছিল হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের ভিতর দিয়ে― বাঙালি জাতীয়তাবাদ
আন্দোলনকে সমূলে ধ্বংস করা। এই অপারেশন আনুষ্ঠানিকভাবে শেষ হয়
১০ এপ্রিল-এ। এরপর
১০ এপ্রিল টিক্কা খান
জেনারেল এ.এ.কে. নিয়াজির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। এর ফলে 'অপারেশন সার্চালাইট'
কার্যত বাতিল হয়ে যায়। এরপর শুরু হয়- জেনারেল নিয়াজির নবতর পদ্ধতির বাঙালি
জাতিসত্ত্বা নিধনের কার্যক্রম।
পাকিস্তানী বাহিনীর সাথে যোগ দিয়েছিল তদানীন্তন পূর্ব-পাকিস্তানের কতিপয় ক্ষুদ্র পাকিস্তান-পন্থি দল। এদের শীর্ষে ছিল জামায়েত-ই-ইসলামী। পাকিস্তানী সেনাবাহিনী এবং তাদের অনুগত এই দলগুলো― ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাপক গণহত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ এবং লুটপাট করে। এই সূত্রে পূর্ব-পাকিস্তানে অবস্থানরত বাঙালি সৈন্য, সীমান্তরক্ষী বাহিনী (ইপিআর), আনসার এবং সাধারণ মানুষ, সম্মিলিত পাক-বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে। একই সূত্রে ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী, মিত্রবাহিনীর (ভারতীয় সেনাবাহিনী ও বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী) কাছে আত্মসমর্পণ করে।
এই যুদ্ধের সময়, পাকিস্তানী সমর্থকরা পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর সহায়তায়
রাজাকার, আল বদর,
আল্ শামস
নামে তিনটি বাহিনী তৈরি করে। এই তিন বাহিনী সদস্যার পাকিস্তানী বাহিনীর
সহযোগী হিসেবে থেকে সকল ধরনের যুদ্ধাপরাধ করে।
১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ২৯ ডিসেম্বর, চলচ্চিত্রকার জহির রায়হান কর্তৃক প্রথম বুদ্ধিজীবী
হত্যা তদন্ত কমিশন গঠিত হয়। কিছুদিনের মধ্যে জহির রায়হানকে গুম করা হয়।
১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের ২৪ জানুয়ারি থেকে ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দ ২০ এপ্রিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান শাসনামলে দালালদের বিচারের প্রক্রিয়া কার্যকর করা হয়। এদের বিচারের জন্য, ১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ জুলাই আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন প্রণয়ন করা হয়। এই সময় দালাল আইনে সারাদেশে মোট ৭৩টি ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয়। এই ট্রাইবুনালের প্রাথমিক বিচারে ২৮৪৮ জনের ভিতর এবং শাস্তি পায় ৭৫২ জন।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর, নানা ধরনের ক্ষমতা দখলের খেলা শেষে লেফ্ট্যান্ট জেনারেল জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসেন। তিনি বন্দী যুদ্ধাপরাধীদের মুক্তি দেন এবং রাজনীতিতে পুনর্বাসিত করেন। এই সময় আইন করে পর্যায়ক্রমে এই পুনর্বাসনের কাজটি করা হয়েছিল। যেমন
―১৯৮১ খ্রিষ্টাব্দের ২১ মার্চ মুক্তিযোদ্ধা সংসদের চেয়ারম্যান কাজী নুরুজ্জামান রাজাকার-আলবদরদের বিচারের জন্য ৭ দফা দাবি পেশ করেন এবং আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করেন। চাপের মুখে জিয়াউর রহমান তৎকালীন সংস্থাপনমন্ত্রী মাজেদুল হককে এ ব্যাপারটি দেখার জন্য বলেন। জিয়ার মৃত্যুর পর দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা শুরু হয় এই সুযোগে লে.জে. হোসাইন মোহম্মদ এরশাদ ক্ষমতা দখল করেন। এরপর মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কর্তৃক ১৯৮৪, ৮৬, ৮৯ সালে রাজাকার আলবদরদের বিচারের জন্য এরশাদ সরকারকে চাপ প্রয়োগ করা হয়।
১৯৪৮ সনের ৯ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে গৃহীত রেজ্যুলেশন ২৬০ (৩) এ-র অনুচ্ছেদ-২, ৩ গণহত্যা বিষয়ক বিধান। |
(ক) পরিকল্পিতভাবে একটি জাতি বা গোষ্ঠীকে
নির্মূল করার জন্য তাদের সদস্যদেরকে হত্যা বা নিশ্চিহ্নকরণ। |
একাত্তরের ঘাতক
দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটি গঠন
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিটি তীব্রভাবে বিষয়টি উঠে আসে, ১৯৯১ খ্রিষ্টাব্দের। এই
বৎসরের ২৯ ডিসেম্বর
গোলাম আযমকে,
জামায়েত-ই-ইসলাম তাদের দলের আমির ঘোষণা করলে,
বাংলাদেশে গণ-অসন্তোষের সৃষ্টি হয়।
১৯৯২ খ্রিষ্টাব্দে স্বাধীনতা বিরোধী শক্তির
বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন শুরু হয়। এই আন্দোলনের সূত্রে, ১৯৯২ খ্রিষ্টাব্দের ১৯ জানুয়ারিতে
শহীদ জননী
জাহানারা ইমাম নেতৃত্বে ১০১ সদস্যবিশিষ্ট একাত্তরের
ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গঠিত হয়।
২২শে জানুয়ারিতে নিজামী এ আন্দোলনকারীদের 'সংবিধানের শত্রু' হিসেবে আখ্যা দিলে―
২৭ জানুয়ারি শহিদ জননী
জাহানারা ইমাম, এর কড়া জবাব দেন। ২৭শে জানুয়ারি আওয়ামী লীগ, ৫ দলীয় জোট,
গণতান্ত্রিক ফ্রন্টসহ দেশের অন্য অনেক রাজনৈতিক দল
জাহানারা ইমাম-এর সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে।
১৯৯২ খ্রিষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে এই আন্দোলন আরও বেগবান হয়। এই আন্দোলনকে
কার্যকরী করার জন্য একটি গণ-আদালত গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এই গণ-আদালত-এর সূত্রে
আন্দোলন নতুন মোড় নেয়। এবং পুরো ফেব্রুয়ারি মাস তা অব্যাহত থাকে।
১৯৯২ খ্রিষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসের আন্দোলন
১৯৯৩ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসের আন্দোলন
১৯৯৩ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসে গণ-আদালত বার্ষিকীতে জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে ১২ সদস্যের গণতদন্ত কমিটি গঠন করা হয় কমিটি ঘোষিত হয়। ১৯৯৩ সালের ২৮ মার্চ নির্মূল কমিটির সমাবেশে পুলিশ বাহিনী হামলা চালায়। পুলিশের লাঠিচার্জে আহত হন জাহানারা ইমাম এবং তাঁকে পিজি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
১৯৯৪ খ্রিষ্টাব্দের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসে গণআদালতের ২য় বার্ষিকীতে গণতদন্ত কমিশনের চেয়ারম্যান কবি সুফিয়া কামাল ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটের সামনে রাজপথের বিশাল জনসমাবেশে জাহানারা ইমাম-এর হাতে জাতীয় গণতদন্ত কমিশিনের রিপোর্ট হস্তান্তর করেন। গণতদন্ত কমিশনের সদস্যরা হচ্ছেন শওকত ওসমান, কে এম সোবহান, সালাহউদ্দিন ইউসুফ, অনুপম সেন, দেবেশচন্দ্র ভট্টাচার্য, খান সারওয়ার মুরশিদ, শামসুর রাহমান, শাফিক আহমেদ, আবদুল খালেক এবং সদরুদ্দিন। এই সমাবেশে আরো ৮ জন যুদ্ধাপরাধীর বিরুদ্ধে তদন্ত অনুষ্ঠানের ঘোষণা দেয়া হয়। এরা হলেন−আব্বাস আলী খান, মতিউর রহমান নিজামী, মুহাম্মদ কামারুজ্জামান, আবদুল আলীম, দেলোয়ার হোসেন সাঈদী, মওলানা আবদুল মান্নান, আনোয়ার জাহিদ ও আবদুল কাদের মোল্লা।
১৯৯৪ খ্রিষ্টাব্দের ২৬ জুন শহীদ জননী
জাহানারা ইমাম মৃত্যুবরণ করেন।
১৯৯৫ খ্রিষ্টাব্দের ২৬ মার্চ আরো ৮ জনের বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করে
গণতদন্ত কমিশন।
২০০১-২০০৬ খ্রিষ্টাব্দে নিজামী ও মুজাহিদ
বাংলাদেশের দুটি মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করার
পরও, নির্লজ্জের মতো বাংলাদেশের ফ্ল্যাগ নিয়ে সরকারী গাড়ি ব্যবহার করে।
২০০৭ খ্রিষ্টাব্দের ২৭ মার্চ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে, জেনারেল মইন উ আহমেদের
সঙ্গে সব পত্রিকার সম্পাদকদের সাথে ঘাতকদের বিচার নিয়ে মতবিনিময় সভা হয়। এই সময়
সেক্টর কমান্ডারস ফোরামসহ অনেক রাজনৈতিক দল নির্বাচনে জামায়াতকে সুযোগ না দেয়ার
অনুরোধ করে। ৩০ অক্টোবর ২০০৭ সালে প্রধান উপদেষ্টা ফখরুদ্দীন আহমদ ঘাতকদের বিচার
করা উচিত বলে মত দেন। কিন্তু আইন উপদেষ্টা ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন এর বিরুদ্ধে
মতামত দেন।
২০০৭ খ্রিষ্টাব্দে ৮ ও ১১ নভেম্বর মাদারীপুরের চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট
কোর্টে দুটি মামলা দায়ের করা হয় কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে।
২০০৯ সালে ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস স্ট্র্যাটেজি ফোরাম নামে একটি ভলান্টারি সচেতন
সংগঠন আত্মপ্রকাশ করে। সংগঠনটি ঘাতকদের কিভাবে দেশীয় আইনে, দেশীয় ব্যবস্থায় বিচার
হতে পারে এমন বিষয়ে বহুবার মতামত ব্যক্ত করেছে। চলমান বিচারের বিভিন্ন আইনি দিক
নিয়ে কাজ করে সাধারণ জনগণের কাছে তুলে ধরেছে প্রতিনিয়তই। ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত
নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যুদ্ধাপরধীদের বিচারের অঙ্গীকার ছিল বাংলাদেশ
আওয়ামী লীগ-এর।
নির্বাচনে জয়লাভ করার পর, বাংলাদেশ
আওয়ামী লীগ
সরকার গঠন করে এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক আদালত স্থাপন করে।
বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে আজ ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) অ্যাক্ট
সংশোধন করে 'ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস (ট্রাইব্যুনাল) (সংশোধন) আইন- ২০০৯' পাস হয়।
২০১০ সালের ২৫ মার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে বিচার
শুরু হয় একাত্তরের ঘাতকদের বিরুদ্ধে। একে একে প্রথম দফায় গ্রেফতার হয় আট ঘাতক। এরা
হলো সাঈদী, নিজামী, মুজাহিদ, কাদের মোল্লা, কামারুজ্জামান, গোলাম, সাকা, আবদুল
আলীম। পরে গ্রেফতার হয় মীর কাশেম ও এটিএম আজহারুল। পলাতক থাকে বাচ্চু রাজাকার।
২০১২ খ্রিষ্টাব্দে যুদ্ধাপরাধীদের জন্য আন্তর্জাতিক আদালত স্থাপিত হয়। মানবতাবিরোধী
অপরাধের মামলার প্রথম রায় হয় গত ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দের ২১ জানুয়ারি। ওই রায়ে
জামায়াতের সাবেক সদস্য (রুকন) আবুল কালাম আযাদের বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেয়
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। অবশ্য রায়ের সময় তিনি পলাতক ছিলেন। কাদের
মোল্লার বিরুদ্ধে প্রদেয় রায় ছিল দ্বিতীয়।
গণজাগরণের সূত্রপাত
এবং এর ধারাক্রম
২০১৩ খ্রিষ্টাব্দের ৫ ফেব্রুয়ারি [মঙ্গলবার], জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি
জেনারেল
আবদুল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ দেওয়া হয়। মঙ্গলবার
বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২
এই রায় দেন। এই রায় প্রকাশের পর স্বাধীনতার স্বপক্ষীরা অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়ে উঠে।
এরই ধারাবাহিকতায় জন্ম নেয় শাহবাগ জনজাগরণ।
দেখুন :
শাহবাগ গণজাগরণের দিবসানুক্রমিক বিবরণ
সূত্র : সমকালীন
পত্রপত্রিকাসমূহ