গোলাম
আযম
বাংলাদেশ-এর স্বাধীনতা বিরোধিতাকারী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এবং
জামায়েত ই-ইসলামী নামক দলের প্রাক্তন আমীর।
১৯২২ খ্রিষ্টাব্দের ৭ নভেম্বর বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা শহরের লক্ষ্মীবাজারস্থ শাহ
সাহেব বাড়িতে, তাঁর মামার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মাওলানা গোলাম
কবির। মাতার নাম সাইয়েদা আশরাফুন্নিসা। তাঁর পৈত্রিক বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার
বীরগাঁও। ১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দে এই গ্রামের জুনিয়র মাদ্রাসা পরীক্ষায় কৃতিত্বের
সাথে উত্তীর্ণ হন। এরপর ঢাকা বোর্ড থেকে এস.এস.সি. পরীক্ষায় মেধা তালিকায় তিনি
ত্রয়োদশ স্থান লাভ করেন। ১৯৪৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ইসলামিক ইন্টারভিউ কলেজ থেকে আই.এ
পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে ঢাকা এবং বোর্ডে দশম স্থান অধিকার করেন। এরপর তিনি ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ পাশ করেন।
১৯৭১ সালে বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য |
|
২৫শে মার্চ রাতে সংঘটিত অপারেশন সার্চলাইট এর ছয় দিন পর গোলাম আযম ঢাকা বেতার কেন্দ্র থেকে একটি ভাষণ দেন। এ ভাষণে তিনি ভারতের কড়া সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, | |
" ভারত সশস্ত্র অনুপ্রবেশকারী প্রেরণ করে কার্যত পূর্ব পাকিস্তানীদের দেশপ্রেমকে চ্যালেঞ্জ করেছে।...আমি বিশ্বাস করি যে, এই অনুপ্রবেশকারীরা পূর্ব পাকিস্তানী মুসলমানদের নিকট হতে কোন প্রকার সাহায্য পাবে না। সূত্র: দৈনিক সংগ্রাম, ৭ এপ্রিল ১৯৭১। | |
দৈনিক
পাকিস্তান পত্রিকায় ১১ এপ্রিল, ১৯৭১ (২৮ চৈত্র, ১৩৭৭ বাংলা সন) তারিখে
প্রকাশিত "ঢাকায় নাগরিক শান্তি কমিটি গঠিত" শিরোনামের খবরে বলা হয় "গত ৯ই এপ্রিল ঢাকায় প্রতিনিধিত্বশীল নাগরিকদের এক সভায় এক শান্তি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটি খাজা খয়েরউদ্দিনকে আহ্বায়ক মনোনীত করেছে। কমিটিতে মোট ১৪০ জন সদস্য রয়েছেন। এই কমিটির বৃহত্তর ঢাকার ইউনিয়ন ও মহল্লা পর্যায়ে অনুরূপ কমিটি গঠনের ক্ষমতা রয়েছে। কেন্দ্রীয় কমিটির পরিচালনায় এগুলো কাজ করবে। নাগরিকদের দৈনন্দিন জীবনে দ্রুত স্বাভাবিক অবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠার পরিবেশ সৃষ্টির জন্য কমিটি সকল ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। কমিটির অন্যান্য বিশিষ্ট সদস্যদের মধ্যে রয়েছেন এ. কিউ. এম. শফিকুল ইসলাম, অধ্যাপক গোলাম আজম, মওলানা সৈয়দ মোহাম্মদ মাসুম, আবদুল জব্বার খদ্দর, মাহমুদ আলী, এম. এ. কে. রফিকুল হোসেন, ইউসুফ আলী চৌধুরী, আবুল কাসেম, এম. ফরিদ আহমদ, অধ্যাপক গোলাম সারওয়ার, সৈয়দ আজিজুল হক, এ. এস. এম. সোলায়মান, পীর মোহসেনউদ্দীন, এডভোকেট শফিকুর রহমান, মেজর (অবঃ) আফসার উদ্দিন, সৈয়দ মোহসিন আলী, এডভোকেট ফজলুল হক চৌধুরী, আলহাজ্ব সিরাজউদ্দিন, এডভোকেট এ. টি. সাদী, এডভোকেট আতাউল হক খান, মকবুলুর রহমান, আলহাজ্ব মোহাম্মদ আকিল, অধ্যক্ষ রুহুল কুদ্দুস, ইয়ং পাকিস্তান সম্পাদক নুরুজ্জামান, মওলানা মিয়া মফিজুল হক, এডভোকেট আবু সালেক, এডভোকেট আবদুল নায়েম ও অন্যান্য। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে হিন্দুস্তানের ঘৃণ্য ক্রিয়াকলাপের নিন্দা করে নিম্নলিখিত প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়েছে। এই সভা পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হিন্দুস্তানের নির্লজ্জ হস্তক্ষেপের তীব্র নিন্দা করছে। এই বিপজ্জনক খেলায়―যা মহাযুদ্ধের পথে এগুতে পারে―লিপ্ত না হওয়ার জন্য এই সভা ভারতীয় নেতাদের দ্ব্যর্থহীন ভাষায় হুঁশিয়ার করে দিচ্ছে। এই সভা মনে করে যে, পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলে সশস্ত্র অনুপ্রবেশকারী পাঠিয়ে হিন্দুস্তান বস্তুতঃপক্ষে পূর্ব পাকিস্তানীদের দেশপ্রেমে চ্যালেঞ্জ করছে। এই সভা আমাদের প্রিয় দেশের সংহতি ও মর্যাদা রক্ষার উদ্দেশ্যে এই চ্যালেঞ্জ সাহসিকতার সঙ্গে মোকাবিলার জন্য দেশপ্রেমিক জনগণের প্রতি আকুল আহ্বান জানাচ্ছে।" |
|
দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকায় ১৩ এপ্রিল, ১৯৭১ তারিখে প্রকাশিতখবরে বলা হয় ১২ এপ্রিল ১৯৭১ তারিখে পরিচালিত শান্তি কমিটির মিছিল শেষে গোলাম আযমের নেতৃত্বে পরিচালিত মোনাজাত সম্পর্কে বলা হয়, | |
পাকিস্তানের সেনাবাহিনীকে সত্যিকারের মুসলিম সৈনিক হিসেবে দেশরক্ষার যোগ্যতা অর্জনের জন্য আল্লাহর দরগাহে দোয়া করেন। সত্যিকারের মুসলমান ও পাকিস্তানী হিসেবে বেঁচে থাকার ও পাকিস্তানে চিরদিন ইসলামের আবাসভূমি হিসেবে টিকিয়ে রাখার জন্য সর্বশক্তিমানের নিকট দোয়া করেন।" | |
১৯৭১ সালের ৫ ও ৬ সেপ্টেম্বর দৈনিক সংগ্রাম এ গোলাম আযমের পশ্চিম পাকিস্তান সফরকালের একটি সাক্ষাৎকারের পূর্ণ বিবরণ দুই কিস্তিতে ছাপা হয়। এই সাক্ষাৎকারে তিনি মুক্তিবাহিনীর সাথে তার দলের সদস্যদের সংঘর্ষের বিভিন্ন বিবরণ ও পূর্ব পাকিস্তান পরিস্থতির ওপর মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, | |
"বিচ্ছিন্নতাবাদীরা জামায়াতকে মনে করতো পহেলা নম্বরের দুশমন। তারা তালিকা তৈরি করেছে এবং জামায়াতের লোকদের বেছে বেছে হত্যা করছে, তাদের বাড়িঘর লুট করছে জ্বালিয়ে দিয়েছে এবং দিচ্ছে। এতদসত্বেও জামায়াত কর্মীরা রাজাকারে ভর্তি হয়ে দেশের প্রতিরক্ষায় বাধ্য। কেননা তারা জানে 'বাংলাদেশে' ইসলাম ও মুসলমানদের জন্য কোন স্থান হতে পারে না। জামায়াত কর্মীরা শহীদ হতে পারে কিন্তু পরিবর্তিত হতে পারে না। (দৈনিক সংগ্রাম, ৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭১) |
১৯৪৫ খ্রিষ্টাব্দ থেকে তিনি
ছাত্র আন্দোলনের সাথে জড়িত হয়ে পড়েন। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের
কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দের ভাষা
আন্দোলনের সাথে জড়িত হয়ে পড়েন, ফলে এমএ পরীক্ষা দিতে পারেন নি। ১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দে
দাঙ্গাজনিত উত্তেজনাকর পরিস্থিতির কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়
নি। ফলে তিনি ১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দে এম.এ. পরীক্ষা দেন এবং দ্বিতীয় বিভাগ পেয়ে উত্তীর্ণ
হন। এই সময় তিনি রংপুর সরকারি কারমাইকেল কলেজে কিছুদিন অধ্যাপনা করেন। ভাষা
আন্দোলনের জড়িত হওয়ার কারণে, তিনি ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে গ্রেফতার হন এবং তিনি তাঁর
শিক্ষকতার চাকরি হারান। উল্লেখ্য পশ্চিম পাকিস্তানের শুক্কুরে ১৮ই জুন (১৯৭০) এক
সংবর্ধনা সভায় জামায়াত নেতা গোলাম আযম বলেন, উর্দু পাক ভারত উপমহাদেশের মুসলমানদের
সাধারন ভাষা। তিনি বলেন, ৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের সময় তিনিও তাতে অংশ নিয়েছিলেন।
কিন্তু তা ভুল হয়েছিল।
১৯৫২ থেকে ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দের
ভিতরে কোনো এক সময় তিনি রংপুরে তবলিগ জামাতের সাথে যুক্ত হন এবং এই দলের আমীরের
সাথে পরিচিত হন। ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দের এপ্রিলে পূর্ব-পাকিস্তান ইসলামী সাংস্কৃতিক
সংগঠন তমাদ্দুন মজলিশের রংপুর শাখার প্রধান পদ লাভ করেন। ১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দে
রাজনৈতিক কারণে গ্রেফতার হন। রংপুর কারাগারে অবস্থানকালেই
জামায়েত ই-ইসলামী'র আদর্শে অনুপ্রাণিত হন এবং এবং
রুকন হন। ১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দে জুন মাসে তিনি রাজশাহী বিভাগীয় জামায়াতে ইসলামীর
সেক্রেটারি নিযুক্ত হন। এর এক বছর পর তাঁকে পূর্ব পাকিস্তান
জামায়েত ই-ইসলামী
সহকারী সেক্রেটারি এবং রাজশাহী বিভাগীয় আমীরের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৫৭
খ্রিষ্টাব্দের অক্টোবর মাসে গোলাম আযমকে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের জামায়াতের
জেনারেল সেক্রেটারি নিযুক্ত করা হয়। ১৯৬৪ খ্রিষ্টাব্দে পাকিস্তানে জেনারেল আয়ুব খান
জামায়েত-ই-ইসলামী নিষিদ্ধ করে। এই সময় সামরিক সরকার তাঁকে গ্রেফতার করে। এই সময়
বিনা বিচারে তাঁকে আট মাস কারাগারে আটক রাখা হয়।
১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দে তিনি পূর্ব-পাকিস্তান আমীরের পদ লাভ করেন। ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দের সাধারণ নির্বাচনে গোলাম আযম আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে নির্বাচনের জন্য প্রস্ততি গ্রহণ। এই সময় জামাতের কর্মীরা বেশ কয়েকস্থলে বিরোধীপক্ষের সভা ভাঙচুর করে এবং অনেক রাজনৈতিক কর্মীকে দৈহিকভাবে আক্রমণ করে। বিরোধী দলের অফিসের লুটপাট ও ধ্বংসের জন্য তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়।
১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে পর্যন্ত তিনি পূর্ব-পাকিস্তানের আমিরের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে গোলাম আযম বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের তীব্র বিরোধিতা করেন।
১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের গোলাম
আষমের কার্যক্রম
গোলাম আযম মুক্তিযুদ্ধের শুধুমাত্র রাজনৈতিক বিরোধিতাই করেননি বরং তিনি এবং তাঁর দল
জামায়েত ই-ইসলামী
পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সাহায্য করতে
রাজাকার,
আলবদর, আলশামস্
প্রভৃতি বাহিনী গড়ে তোলেন। এরা পুরো মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানী বাহিনীর পক্ষে
কাজ করে। ৩০শে জুন লাহোরে সাংবাদিকদের কাছে গোলাম আযম বলেন, "তাঁর দল পূর্ব
পাকিস্তানে দুস্কৃতকারীদের(মুক্তিযোদ্ধা) তৎপরতা দমন করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা
করছে এবং এ কারণেই দুস্কৃতকারীদের হাতে বহু জামায়াত কর্মী নিহত হয়েছে। ১৯৭১ সালের
১০ এপ্রিল পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষার উদ্দেশ্য ঢাকায় শান্তি কমিটি গঠন করা হয়।
গোলাম আযম ও এই কমিটির সদস্য ছিলেন। উল্লেখ্য এই কমিটিতে গোলাম আযমসহ ১৪০ জন এই
কমিটির সদস্য ছিলেন।
১৯৭১ সালে জামায়াতের মুখপত্র দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকা সেখান থেকে সংকলিত কিছু বিবৃতি।
৮ এপ্রিল ১৯৭১ : একাত্তরে জামায়াত ইসলামীর প্রচার সম্পাদক মওলানা নুরজ্জামান ও জামায়াতের অন্যতম নেতা গোলাম সারওয়ারের সঙ্গে যুক্ত বিবৃতিতে গোলাম আযম বলেন, ‘ভারত পূর্ব পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করেছে। ভারতীয় বা পাকিস্তান বিরোধী এজেন্টদের বা অনুপ্রবেশকারী যেখানেই যাবে, সেখানেই পূর্ব পাকিস্তানের দেশ প্রেমিকরা তাদের নির্মূল করবে।’
৯ এপ্রিল ১৯৭১ : মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পর্কে গোলাম আযম বলেন, ‘পূর্ব পাকিস্তনে সশস্ত্র অনুপ্রবেশকারী পাঠিয়ে ভারত প্রকৃতপক্ষে আমাদের দেশপ্রেমের মূলে আঘাত হেনেছে। এ ধরনের অনুপ্রবেশ এ প্রদেশের মুসলমানদের কাজেই আসবে না।’
১০ এপ্রিল ১৯৭১ : ইসলামীর ছাত্র সংঘের এক বিবৃতিতে এই দিন বলা হয়, ‘দুষ্কৃতকারী ও অনুপ্রবেশকারীদরে হাত থেকে পূণ্য ভূমি পাকিস্তানকে রক্ষা করার জন্য ছাত্র সংঘের প্রতিটি কর্মী তাদের শেষ রক্ত বিন্দু দিয়ে যাবে। হিন্দুস্তানের ঘৃণ্য চক্রান্তের দাঁতভাঙা জবাব দেবার জন্য ছাত্র সংঘ কর্মীরা সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা করতে সম্পূর্ণ প্রস্তুত।’
১২ এপ্রিল ১৯৭১, বায়তুল মোকাররম, পূর্ব-পাকিস্তান : গোলাম আজমের নেতৃত্বের প্রথম মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী মিছিল বিরোধী বের হয় বায়তুল মোকাররম মসজিদের সামনে থেকে। মিছিলে বহন করা পোস্টার, ফেস্টুনে লেখা ছিলো "দুষ্কৃতিকারীরা দূর হও" "মুসলিম জাহান এক হও" "পাকিস্তানকে রক্ষা কর"। "পাকিস্তান জিন্দাবাদ, কায়েদে আযম জিন্দাবাদ।" "পাকিস্তানের উৎস কি- লাইলাহা ইল্লাল্লাহ।" "মিথ্যা প্রচার বন্ধ কর।" "ব্রাক্ষ্মবাদ নিন্দাবাদ, সাম্রায্যবাদ মূর্দাবা”।" মিছিলে পাকিস্তানের জন্য মুনাজাতও করেন গোলাম আজম।
১৩ মে ১৯৭১ : ইসলামী ছাত্র সংঘের এক বিবৃতিতে বলা হয়, ‘দেশের বর্তমান দুরবস্থার জন্য ছাত্রসমাজকে দায়ী করা হয়। অথচ ছাত্র সংঘের কর্মীরাই বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দমন ও (পাকিস্তান) সেনাবাহিনীকে সহায়তা করার ক্ষেত্রে বেশি তৎপর। ছাত্রনামধারী ভারতের সাম্রাজ্যবাদের যে সমস্ত চর তথকথিত “বাংলাদেশ”-প্রচারণা চালিয়েছিল তারা ছাত্র সমাজের কলঙ্ক। তাদের জন্য সমুদয় ছাত্র সমাজকে দায়ী করা ঠিক নয়।’
১৭ জুন ১৯৭১ : এই দিন গোলাম তার এক বিবৃতিতে বলেন, ‘দুষ্কৃতিকারীরা এখনও তাদের ধ্বংসাত্মক কাজে লিপ্ত রয়েছে। তাদের লক্ষ্যই হচ্ছে জনগণের মধ্যে আতঙ্ক ছড়ানো এবং বিশৃঙ্খলাপূর্ণ পরিস্থিতিকে দীর্ঘায়িত করা। পূর্ব পাকিস্তানের এমন নিভৃত অঞ্চল রয়েছে যেখানে দুষ্কৃতকারীরা জনগণকে পাকিস্তান রেডিও শুনতে দেয় না।’
১৯ জুন ১৯৭১, লাহোর, পশ্চিম পাকিস্তান : প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সাথে বৈঠক শেষে তিনি বলেন, "কেবলমাত্র দেশপ্রেমিক জনগনের সাহায্যে দুষ্কৃতিকারীদের প্রতিহত করা যেতে পারে। (এ দেশপ্রেমিকরাই রাজাকার, আল বদর, আস শামস)
২০ জুন ১৯৭১ : গোলাম আযম লাহোরের বিমানবন্দরে এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, ‘পূর্ব পাকিস্তানে অধিক সংখ্যক অমুসলমানদের সহায়তায় শেখ মুজিবুর রহমানের হয়তো বিচ্ছিন্নতার ইচ্ছা থাকতে পারে।...অবশ্য তার ছয় দফা স্বাধীনতাকে সম্ভব করে তুলতে পারত।...সেনাবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে প্রায় সকল দুষ্কৃতকারীদের উৎখাত করেছে এবং বর্তমানে এমন কোন শক্তি নাই যা সেনাবাহিনীর প্রাধান্যকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে।’
২২ জুন ১৯৭১ : এই দিন গোলাম আযমের এক সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়। সেখানে তিনি বলেন, ‘পূর্ব পাকিস্তানের মুসলমানরা ইসলামকে কখনও পরিত্যাগ করতে পারে না। এ কারণে তারা পাকিস্তানকেও ত্যাগ করতে পারবে না। পূর্ব পাকিস্তান ইসলাম ও পাকিস্তানের জন্য অপরিসীম ত্যাগ স্বীকার করেছে।’ সংবাদ সম্মেলনে মুক্তিযুদ্ধকে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন এবং মুক্তিযোদ্ধাদেরকে দুষ্কৃতিকারী ও রাষ্ট্র বিরোধী হিসেবে আখ্যা দেন।
২৩ জুন ১৯৭১: এক কর্মিসভায় গোলাম আযম বলেন, ‘পূর্ব পাকিস্তানিরা সর্বদাই পশ্চিম পাকিস্তানি ভাইদের সাথে একত্রে বাস করবে।...নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের ছয় দফা কর্মসূচির উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া। যেসব দল খোলাখুলিভাবে বিচ্ছিন্নতার আন্দোলন শুরু করেছিল এবং স্বাধীন বাংলা গঠনের জন্য জনতাকে উত্তেজিত করেছিল সেসব দলকে নিষিদ্ধ ঘোষণার জন্য তিনি সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।’
৩ আগস্ট ১৯৭১: এই দিনে মাদ্রাসা শিক্ষা সম্মেলনে গোলাম আযম বলেন, ‘এই যুদ্ধ শুধু অস্ত্রের যুদ্ধ নয়, আদর্শিক যুদ্ধ। আল্লাহর দীনকে প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে এই দেশকে বাঁচিকে রাখার জন্য যুদ্ধে আমাদের জয়ী হতেই হবে।’
এ ছাড়া ২৫ মার্চের বর্বরোচিত হামলা সম্পর্কে গোলাম আযম বলেন, ‘২৫ মার্চের পর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী যে পদক্ষেপ গ্রহণ করে তা ছিল এদেশের মাটি রক্ষার জন্য।’
১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ১২ আগষ্ট: “তথাকথিত বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনকারীরা ইসলাম ও পাকিস্তানের শত্রু।”
২৬ নভেম্বর ১৯৭১, রাওয়াল পিন্ডি, পশ্চিম পাকিস্তান: রাজাকারদের প্রশংসা করে তিনি বলেন, যদি তাদের হাতে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র তুলে দেয়া হয়, তাহলে তারা দুষ্কৃতিকারীদেরকে নিজেরাই খতম করে দিতে পারবে।
২৭ নভেম্বর ১৯৭১, রাওয়াল পিন্ডি, পশ্চিম পাকিস্তান : গোলাম আজম পাকিস্তান সরকারকে আশ্বস্ত করে বলেন, আমরা দুষ্কৃতিকারী বিচ্ছিন্নবাদীদের বিরুদ্ধে সরকারের সাথে সহযোগিতা করছি।
১ লা ডিসেম্বর ১৯৭১, রাওয়াল পিন্ডি, পশ্চিম পাকিস্তান : প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সাথে ৭০ মিনিট বৈঠক করেন। বৈঠক শেষে সংবাদ সম্মেলনে মুক্তিবাহিনীকে শত্রুবাহিনী আখ্যায়িত করে গোলাম আজম বলেন, "এদেরকে ধ্বংস করার জন্য রাজাকার বাহিনীই যথেষ্ট।"
১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ১২ অক্টোবরে পাকিস্তানের সামরিক সরকার প্রধান ইয়াহিয়া খান এক ঘোষণায় জানান যে, নভেম্বরের ২৫ থেকে ডিসেম্বরের ৯ তারিখের ভিতরে একটি সাধারণ নির্বাচন হবে। এই নির্বাচনে গোলাম আযম অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। কিন্তু ১৫ অক্টোবরে পাকিস্তান সরকার ১৫জন প্রতিযোগী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয় লাভ করেছে। এই প্রহসনমূলক নির্বাচনে জামায়েত-ই-ইসলামের ১৪ জন সদস্য বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয় লাভ করেন।
১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ৩ ডিসেম্বরে, গোলাম আযম ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দেন। কিন্তু ইতিমধ্যে ভারত-বাংলাদেশের যৌথবাহিনীর সাথে পাকিস্তানী বাহিনীর যুদ্ধ শুরু হলে, বিমান ঘুরিয়ে তিন সৌদি আরবে চলে যান। ১৬ই ডিসেম্বরে পাকিস্তানী বাহিনী ঢাকাতে আত্মসমর্পণের পর, নতুন রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশের জন্ম হয়। এই সময় জামায়েত ই-ইসলামী বাংলাদেশে নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়।
১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরও তার তিনি বাংলাদেশ বিরোধী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত থাকেন। তিনি মধ্য-প্রাচ্য ও পাকিস্তানের অনেক নেতাকে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দেওয়ার জন্য অনুরোধ করে। অধ্যাপক আনিসুজ্জামান গোলাম আযমের বিরোদ্ধে আনীত সকল অভিযোগ ১৯৯২ সালে গঠিত গণআদালতে উপস্থাপন করেন। আনিসুজ্জামানের উপত্থাপিত অভিযোগের কিছু বিশেষ অংশ নিচে তুলে ধরা হলো‒
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ শত্রুমুক্ত হলে গোলাম আযম পাকিস্তানে বসে মাহমুদ আলী ও খাজা খয়েরউদ্দীনেরমত দেশদ্রোহীর সঙ্গে মিলিত হয়ে পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধার কমিটি নামে একটি সংগঠনের সূচনা করেন এবং বিভিন্ন দেশে পূর্ব পাকিস্তান পূণঃপ্রতিষ্ঠার আন্দোলন গড়ে তোলার আয়োজন করতে থাকেন। তিনি এই উদ্দেশ্যে দীর্ঘকাল পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতের আমীর বলে পরিচয় দিতেন।
১৯৭২ সালে গোলাম আযম লন্ডনে পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধার কমিটি গঠন করেন এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্র উচ্ছেদ করে আবার এই ভূখন্ডকে পাকিস্তানের অংশে পরিণত করার ষড়যন্ত্র করেন। ১৯৭৩-এ ম্যানচেস্টারে অনুষ্ঠিত ফেডারেশন অফ স্টুডেন্টস ইসলামিক সোসাইটিজের বার্ষিক সম্মেলনে এবং লেসটারে অনুষ্ঠিত ইউকে ইসলামিক কমিশনের বার্ষিক সভায় তিনি বাংলাদেশ বিরোধী বক্তৃতা দেন। ১৯৭৪-এ মাহমুদ আলীসহ কয়েকজন পাকিস্তানিকে নিয়ে তিনি পূর্ব লন্ডনে পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধার কমিটির একটি বৈঠক করেন। বাংলাদেশকে পাকিস্তানে পরিণত করার প্রচেষ্ঠা ব্যার্থ হয়েছে দেখে এই সভায় স্থির করা হয় যে, তারা এখন থেকে বাংলাদেশ ও পাকিস্তান নিয়ে একটি কনফেডারেশন গঠনের আন্দোলন করবেন। এই সভায় গোলাম আযম ঝুঁকি নিয়ে হলেও বাংলাদেশে ফিরে অভন্ত্যর থেকে কাজ চালানোর প্রয়োজনীয়তা ব্যাক্ত করেন। ১৯৭৭-এ লন্ডনের হোলি ট্রিনিটি চার্চ কলেজে অনুষ্ঠিত একটি সভায় তিনি এ কথারই পুনরাবৃত্তি করেন এবং সেই উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য পাকিস্তানি পাসপোর্ট ও বাংলাদেশি ভিসা নিয়ে ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশে আগমন করেন।
১৯৭২ সালের ডিসেম্বরে গোলাম আযম রিয়াদে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক ইসলামি যুব সম্মেলনে যোগদান করেন ও পূর্ব পাকিস্তান পূণঃপ্রতিষ্ঠার সংগ্রামে সকল মুসলিম রাষ্ট্রের সাহায্য প্রার্থনা করেন। ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত তিনি সাতবার সৌদি বাদশার সঙ্গে সাক্ষাত করে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দিতে অনুরোধ করেন। ১৯৭৪ সালে রাবেতায়ে আলমে ইসলামির উদ্যোগে মক্কায় অনুষ্ঠিত একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে এবং ১৯৭৭ সালে কিং আব্দুল আজিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত একটি সভায় বাংলাদেশের বিরুদ্ধে বক্তৃতা করেন।
অনুরূপভাবে গোলাম আযম ১৯৭৩ সালে বেনগাজিতে অনুষ্ঠিত ইসলামি পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সম্মেলনে আগত প্রতিনিধিদের কাছে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দেওয়ার জন্য লবিং করেন। একই বছরে ত্রিপলিতে অনুষ্ঠিত ইসলামি যুব সম্মেলনে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের পক্ষে হানিকর বক্তব্য উপস্থাপন করেন।
১৯৭৩ সালে গোলাম আযম মিশিগান স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত মুসলিম স্টুডেন্টস এসোসিয়েশন অফ আমেরিকা এন্ড কানাডার বার্ষিক সম্মেলনে বাংলাদেশকে আবার পাকিস্তানে পরিনত করতে সবাইকে কাজ করার আহ্বান জানান।
১৯৭৭ সালে গোলাম আযম ইস্তাম্বুলে অনুষ্ঠিত ইসলামিক ফেডারেশন অফ স্টুডেন্টস অর্গানাইজেশনের আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বাংলাদেশবিরোধী বক্তৃতা করেন।
১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ই এপ্রিল সরকারী এক আদেশে ৩৮ জন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের সাথে গোলাম আযমকেও বাংলাদেশের নাগরিক হবার অনুপযোগী ঘোষণা করা হয়। এই সময় তিনি বিভিন্ন দেশে বাস করেন। ১৯৭৮ খ্রিষ্টাব্দে তিনি জিয়াউর রহমানের আনুকূল্যে পাকিস্তানি পাসপোর্ট নিয়ে সাময়িকভাবে বাংলাদেশে আসেন এবং কোন ভিসা ছাড়াই ১৯৭৮-১৯৯৪ পর্যন্ত বাস করেন। এই সময় তিনি ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে স্বাধীনতা বিরোধী কাজে লিপ্ত ব্যক্তিবর্গের আমির হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৯১ খ্রিষ্টাব্দে উচ্চ আদালতে
জামায়েত-ই-ইসলামীর প্রাক্তন আমীর গোলাম আজম নাগরিকত্বের বৈধতা ঘোষিত হওয়ার পর, তিনি
এই দলের আমীর নির্বাচিত হন। ২০০০ খ্রিষ্টাব্দে জামায়েত-ই-ইসলামীর আমীর পদে
নির্বাচিত হন মতিউর রহমান নিজামী।
গোলাম আযমের বিচার প্রক্রিয়া
২০১০ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ জুলাই, ৭১-র মানবতাবিরোধী অপরাধের ‘মাস্টারমাইন্ড’ খ্যাত গোলাম আযমের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে তদন্ত শুরু করেন তদন্ত সংস্থা।
২০১১ খ্রিষ্টাব্দের ৩১ অক্টোবর তদন্ত শেষে তদন্ত প্রতিবেদন, অন্যান্য তথ্য-প্রমাণ এবং আলামত তদন্ত সংস্থার পক্ষ থেকে এ মামলার প্রসিকিউশনের (সরকারপক্ষের আইনজীবীদের) কাছে দাখিল করা হয়।
২০১১ খ্রিষ্টাব্দের ১২ ডিসেম্বর প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে ট্রাইব্যুনালের কাছে গোলাম আযমের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগপত্র (ফরমাল চার্জ) দাখিল করা হয়।
২০১১ খ্রিষ্টাব্দের ২৬ ডিসেম্বর, অভিযোগপত্রে বর্ণিত অভিযোগগুলো আমলে নেয়ার জন্য ধার্য দিনে দাখিলকৃত অভিযোগপত্রটি সঠিক বিন্যাসে উপস্থাপিত না হওয়ায় ট্রাইব্যুনাল তা আবার প্রসিকিউশনের কাছে ফেরত পাঠান।
২০১২ খ্রিষ্টাব্দের ৫ জানুয়ারি, ফেরতপ্রাপ্ত অভিযোগপত্রটিকে সঠিকভাবে বিন্যস্ত করে প্রসিকিউশন টিম পুনরায় ট্রাইব্যুনালের কাছে দাখিল করেন। ট্রাইব্যুনালে প্রসিকিউশনের জমা দেয়া ওই আনুষ্ঠানিক অভিযোগপত্রে গোলাম আযমের বিরুদ্ধে মোট ৬১টি অভিযোগ উপস্থাপন করা হয়। মোট ৩৬০ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদনের পাশাপাশি ১০ হাজার পৃষ্ঠার নথিপত্র সংযুক্ত করা হয়।
২০১২ খ্রিষ্টাব্দের ৯
জানুয়ারি, গোলাম আযমকে ১১ জানুয়ারি সশরীরে হাজির করার জন্য ট্রাইব্যুনাল
নির্দেশ দেন। ওই দিন হাজির না হলে গোলাম আযমের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা
জারির কথা জানান ট্রাইব্যুনাল।
২০১২ খ্রিষ্টাব্দের ১০ জানুয়ারি গোলাম আযমের আইনজীবীরা তার জামিনের আবেদন করেন।
২০১২ খ্রিষ্টাব্দের ১১ জানুয়ারি ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয় গোলাম আযমকে। ট্রাইব্যুনাল তার বিরুদ্ধে দায়েরকৃত অভিযোগ আমলে নেন এবং জামিন নামঞ্জুর করে গোলাম আযমকে গ্রেফতার করে জেলহাজতে পাঠানোর নির্দেশ দেন। তার স্বাস্থ্য ও বয়সের দিকটি বিবেচনা করে ট্রাইব্যুনাল তাকে বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের প্রিজন সেলে রাখার নির্দেশ দেন।
২০১২ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ২৯ মার্চ পর্যন্ত গোলাম আযমের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের ওপর শুনানি হয়। রাষ্ট্রপক্ষের চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপু ও প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুম অভিযোগ গঠনের পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করেন। অন্যদিকে গোলাম আযমকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতির আবেদন জানিয়ে যুক্তি দেন তার প্রধান আইনজীবী ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক ও আইনজীবী অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম।
২০১২ খ্রিষ্টাব্দের ১৩ মে, মানবতাবিরোধী ৫ ধরনের অপরাধের ৬১টি অভিযোগে অভিযুক্ত করে গোলাম আযমের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন ট্রাইব্যুনাল।
২০১২ খ্রিষ্টাব্দের ৩০মে গোলাম আযমের মামলাটি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ থেকে ট্রাইব্যুনাল-২-এ স্থানান্তরের আবেদন করেন আসামিপক্ষ। শুনানি শেষে ১৮ জুন তা খারিজ করে দেন ট্রাইব্যুনাল।
২০১২ খ্রিষ্টাব্দের ১০ জুন গোলাম আযমের বিরুদ্ধে সূচনা বক্তব্য (ওপেনিং স্টেটমেন্ট) উপস্থাপন করে রাষ্ট্রপক্ষ। ১৪২ পৃষ্ঠার সূচনা বক্তব্য উপস্থাপন করেন রাষ্ট্রপক্ষের চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপু, প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুম, নূরজাহান বেগম মুক্তা, এ কে এম সাইফুল ইসলাম, সুলতান মাহমুদ ও মীর ইকবাল হোসেন।
২০১২ খ্রিষ্টাব্দের ১ জুলাই থেকে শুরু করে ৪ নভেম্বর পর্যন্ত রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীদের সাক্ষ্যগ্রহণ ও জেরা সম্পন্ন হয়। তদন্ত কর্মকর্তা মতিউর রহমানসহ গোলাম আযমের বিরুদ্ধে জব্দ তালিকার ৭ সাক্ষীসহ রাষ্ট্রপক্ষের মোট ১৭ জন সাক্ষী সাক্ষ্য দিয়েছেন। তাদের মধ্যে ১ জন সাক্ষীর তদন্ত কর্মকর্তার কাছে দেয়া জবানবন্দিকেই সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করেছেন ট্রাইব্যুনাল। গোলাম আযমের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষে সাক্ষ্য দেয়া ঘটনার সাক্ষীরা হলেন- বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ ও গবেষক ড. মুনতাসীর মামুন, বীর মুক্তিযোদ্ধা মাহবুব উদ্দিন আহম্মদ বীরবিক্রম, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা, মানবাধিকারকর্মী বীর মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল, মুক্তিযোদ্ধা শফিউদ্দিন আহমেদ, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পৈরতলা দক্ষিণপাড়া গ্রামের সোনা মিয়া, একজন শহীদ পরিবারের নারী (ক্যামেরা ট্রায়াল), দেশবরেণ্য গীতিকার ও সুরকার মুক্তিযোদ্ধা আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল, রাজধানীর নাখালপাড়ার ফরিদ আলম এবং মহসিন আলী খান। আর জব্দ তালিকার সাক্ষীরা হলেন- বাংলা একাডেমীর সহ-গ্রন্থাগারিক মোঃ এজাব উদ্দিন মিয়া, পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের (এসবি) রাজনৈতিক শাখার উচ্চমান সহকারী সেলিনা আফরোজ, কুষ্টিয়া জেলা পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের উচ্চমান সহকারী কাজী আইয়ুব হোসেন, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ার কামালের বোন ডা. মুনিয়া ইসলাম চৌধুরী, জাতীয় জাদুঘরের কিপার ড. স্বপন কুমার বিশ্বাস, পুলিশের উপ-পরিদর্শক (এসআই) আমিনুল ইসলাম এবং মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে কর্মরত সাঁট মুদ্রাক্ষরিক জামিনুর শেখ।অন্যদিকে গোলাম আযমের পক্ষে তার আইনজীবীরা দুই হাজার ৯৩৯ জন সাক্ষীর তালিকা জমা দিয়েছিলেন। এর মধ্যে ১২ জন সাফাই সাক্ষী সাক্ষ্য দেবেন বলে নির্ধারণ করে দেন ট্রাইব্যুনাল। নির্ধারিত ১২ জনের মধ্যে মাত্র ১ জন সাফাই সাক্ষীকে হাজির করে সাক্ষ্য দেয়াতে পেরেছে আসামিপক্ষ।
২০১২ খ্রিষ্টাব্দের ১২ নভেম্বর, গোলাম আযমের পক্ষে তাঁর একমাত্র সাফাই সাক্ষী দেন তাঁর ছেলে সেনাবাহিনী থেকে বরখাস্তকৃত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবদুল্লাহিল আমান আযমী। ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দের ৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সাফাই সাক্ষ্য দেন তার বাবার পক্ষে।
২০১২ খ্রিষ্টাব্দের ১৯
ডিসেম্বর মামলাটির পুনর্বিচারের আবেদন জানান গোলাম আযমের প্রধান আইনজীবী
ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক। ২৪ ডিসেম্বর থেকে ১ জানুয়ারি পর্যন্ত ৬ কার্যদিবসে
আবেদনগুলোর ওপর শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। আসামিপক্ষে আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ এমপি, ব্যারিস্টার রফিকুল
ইসলাম মিয়া, সিনিয়র আইনজীবী বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান খন্দকার মাহবুব
হোসেন, আসামিপক্ষের প্রধান আইনজীবী ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক ও অ্যাডভোকেট
মিজানুল ইসলাম। অপরদিকে আবেদনের বিরোধিতা করে রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন
অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম ও প্রসিকিউটর সৈয়দ হায়দার আলী।
আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন বিশেষজ্ঞ বেলজিয়ামের ব্রাসেলস প্রবাসী বাংলাদেশী আহমেদ
জিয়াউদ্দিনের সঙ্গে ট্রাইব্যুনাল-১ এর পদত্যাগী চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল
হকের স্কাইপি কথোপকথনের সূত্র ধরে একটি আবেদন করেন আসামিপক্ষ। ওই স্কাইপি
কথোপকথনের সূত্র ধরে বিচারাধীন জামায়াতের বর্তমান আমীর মতিউর রহমান নিজামী ও
নায়েবে আমীর দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী এবং ট্রাইব্যুনাল-২ এ জামায়াতের দুই সহকারী
সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ কামারুজ্জামান ও আবদুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে
দায়ের করা মামলারও পুনরায় বিচার শুরু করার আবেদন শেষ পর্যন্ত ২০১৩
খ্রিষ্টাব্দের ৩ ও ৭ জানুয়ারি খারিজ করে দেন দুটি ট্রাইব্যুনাল। ১০ জানুয়ারি
এসব খারিজ আদেশের বিরুদ্ধে আসামিপক্ষ রিভিউ (পুনর্বিবেচনা) আবেদন করেন। ১৫-১৬
জানুয়ারি শুনানি শেষে ২১ জানুয়ারি সেসব আবেদনও ট্রাইব্যুনাল খারিজ করে দেন।
অন্যদিকে একই ঘটনার সূত্র ধরে ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল
হক পদত্যাগ করায় ট্রাইব্যুনাল-১ এর পাশাপাশি পুনর্গঠিত হয় দ্বিতীয়
ট্রাইব্যুনালও। ট্রাইব্যুনাল-২ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি এটিএম ফজলে কবীর প্রথম
ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন আর তার স্থলাভিষিক্ত হন এ
ট্রাইব্যুনালেরই বিচারক প্যানেলের সদস্য বিচারপতি ওবায়দুল হাসান।
২০১৩ খ্রিষ্টাব্দের ১১ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রপক্ষ তার জেরা শেষ করেন।
২০১৩ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৮ মার্চ পর্যন্ত এবং ১৭ এপ্রিল ১২ কার্যদিবসে রাষ্ট্রপক্ষে যুক্তিতর্ক (আর্গুমেন্ট) উপস্থাপন করেন প্রসিকিউটররা। অন্যদিকে ১০ মার্চ থেকে ১৭ এপ্রিল পর্যন্ত ১২ কার্যদিবসে আসামিপক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন আসামিপক্ষের আইনজীবীরা। এর মধ্য দিয়ে বিচারিক প্রক্রিয়া শেষ হওয়ায় যে কোনো দিন গোলাম আযমের মামলার রায় দেয়ার জন্য অপেক্ষমান (সিএভি) বলে রেখে দেন ট্রাইব্যুনাল।
২০১৩ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ এপ্রিল এই মামলার বিচারিক কার্যক্রম শেষে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ রায় অপেক্ষাধীন (সিএভি) রাখে এবং জানায়, যে কোনো দিন এ রায় ঘোষণা করা হবে।
২০১৩ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ই জুলাই গোলাম আযমের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার রায় ঘোষণা কার্যক্রম শুরু হয়। পূর্ণাঙ্গ রায়টি ২৪৩ পৃষ্ঠার। বেলা ১১টা দুই মিনিটে ৭৫ পৃষ্ঠার সংক্ষিপ্ত রায় পড়ে শোনান বিচারপতি আনোয়ারুল হক। গোলাম আযমের বিরুদ্ধে ৫ ধরনের ৬১টি অভিযোগ আনা হয়। যার সবগুলোই প্রমাণিত হয়েছে বলে রায়ে উল্লেখ করা হয়। ৬১টি অভিযোগের মধ্যে- মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের ষড়যন্ত্রের অভিযোগ মোট ৬টি, মানবতাবিরোধী অপরাধের পরিকল্পনার অভিযোগ ৩টি, মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের উস্কানি দেওয়ার অভিযোগ ২৮টি, মানবতাবিরোধী অপরাধের সাথে সম্পৃক্ততার অভিযোগ ২৩টি এবং হত্যা ও নির্যাতনের অভিযোগ রয়েছে একটি। প্রথম ও দ্বিতীয় অভিযোগে ১০ বছর করে ২০ বছর, তৃতীয় অভিযোগে ২০ বছর, চতুর্থ অভিযোগে ২০ বছর, পঞ্চম অভিযোগে ৩০ বছর কারাদণ্ড দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। আদেশে ট্রাইব্যুনাল বলেন, “তিনি (গোলাম আযম) যে অপরাধ করেছেন, তা মৃত্যুদণ্ডতুল্য। কিন্তু তাঁর বয়স বিবেচনা করে ট্রাইব্যুনাল তাঁকে ৯০ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন।
২০১৪ খ্রিষ্টাবব্দের ২৩শে অক্টোবর, রাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে চিকিৎসারত অবস্থায় মৃত্যবরণ করেন। ২৫শে অক্টোবর, বাংলাদেশের জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররম-এ জোহরের নামাজের পর তাঁর জানাজার নামাজ সম্পন্ন হয়। জানাজায় ইমামতি করেন গোলাম আযমের সন্তান আবদুল্লাহিল আমান আযমী। এ সময় বাংলাদেশের জাতীয় মসজিদে তাঁর জানাজার বিরোধিতা করে বেশকিছু সংগঠনের কর্মীরা পুলিশের বাধার মুখে বিক্ষোভ করার চেষ্টা করে। জানাজার পর পুলিশি নিরাপত্তায় তাঁর মরদেহ মগবাজারে নিয়ে যাওয়া হয়। এসময় বিদ্রোহকারী সংগঠনের কিছু কর্মী লাশবাহী যানে জুতা নিক্ষেপের চেষ্টা করে। পরবর্তীতে মগবাজারে গোলাম আযমের পারিবারিক কবরস্তানে তাকে সমাহিত করা হয়।
সূত্র :
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস - ড. মোহাম্মদ হাননান পৃষ্ঠা ৩৯৯
গোলাম আযমের বিরূদ্ধে ডঃ আনিসুজ্জামান উত্থাপিত অভিযোগপত্র (Allegations against Ghulam Azam submitted by Prof. Anisuzzaman); The Daily Prothom Alo - March 14, 2008