মুজাহিদ, আলী আহসান মোহাম্মদ
(
১৯৪৮ -১৯১৬ খ্রিষ্টাব্দ)
১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে সৃষ্ট কুখ্যাত আলবদর বাহিনীর অন্যতম সংগঠক, জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল।

১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দের ২ জানুয়ারি ফরিদপুরের কোতোয়ালি থানার পশ্চিম খাবাসপুর গ্রামে মুজাহিদ জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মৃত মওলানা আব্দুল আলী। তিনি প্রথমে ময়েজুদ্দি‌ন উচ্চ বিদ্যালয় ও পরে ফরিদপুর জিলা স্কুলে ভর্তি হন। সেখান হতে মাধ্যমিক পরীক্ষা পাশ করেন।

১৯৬৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজে ভর্তি হন। সেখানেই তিনি ইসলামী ছাত্রসংঘে (জামায়াতের তৎকালীন ছাত্রসংগঠন) যোগ দেন।
১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তি হন। ওই বছর তিনি ঢাকা জেলা ছাত্রসংঘের সভাপতি এবং আগস্ট-সেপ্টেম্বরের দিকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রসংঘের সাধারণ সম্পাদক হন।

১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ২২ এপ্রিল, জামায়েত-ই-ইসলামী-র ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘের প্রধান আশরাফ হোসাইন জামালপুর জেলায়, আলবদর বাহিনী গঠন করেন। সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আলবদর বাহিনীর নেতৃত্ব দেন ইসলামী ছাত্রসংঘের তখনকার সভাপতি মতিউর রহমান নিজামী। অক্টোবর মাসে ওই বাহিনীর প্রধান হন মুজাহিদ। তার নেতৃত্বে আলবদর বাহিনী যুদ্ধের মধ্যে ফরিদপুর, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে হত্যা, অপহরণ, লুটপাটের মতো ব্যাপক মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ড চালায়। এমনকি ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের প্রস্তুতির সময়ও তিনি তাঁর বাহিনী নিয়ে আত্মসমর্পণ না করার সিদ্ধান্ত নেন। স্বাধীনতার দীর্ঘদিন আত্মগোপন করে থাকেন।

১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দে মাওলানা আবদুর রহিম ইসালমিক ডেমোক্র্যাটিক লীগ (আই.ডি.এল) রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা শুরু করে। এই দলের আশ্রয়ে জাময়েতের নেতাকর্মীরা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু করে।

১৯৭৭ খ্রিষ্টাব্দে ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম দিকে জামায়াতের তৎকালীন আমির মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী, সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মুজাহিদ, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম আহজারুল ইসলাম, কাদের মোল্লা, মীর কাশেম আলী, আবু তাহের সহ অন্যান্যদের উপস্থিতিতে- 'ইসলামী ছাত্র-সংঘ'-এর নাম পরিবর্তন করে 'ইসালামী ছাত্রশিবির' নামকরণ করা হয়।

১৯৮২ খ্রিষ্টাব্দে কেন্দ্রীয় পরিষদের সদস্য হন।
১৯৮৬ খ্রিষ্টাব্দে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে পরাজিত হন।
১৯৮৯ খ্রিষ্টাব্দে তিনি দুই বছর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেলের দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৯১ খ্রিষ্টাব্দে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে পরাজিত হন।
১৯৯৬ খ্রিষ্টাব্দে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে পরাজিত হন।
২০০০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল হন।
২০০১ খ্রিষ্টাব্দে চারদলীয় জোট সরকারের সময়ে তিনি সমাজকল্যাণ মন্ত্রীর দায়িত্ব পান মুজাহিদ। এই সময় তিনি জামায়াতের মুখপত্র দৈনিক সংগ্রামের পরিচালনা পর্ষদের প্রধান ছিলেন।
২০০৮ খ্রিষ্টাব্দে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে পরাজিত হন।

২০১০ খ্রিষ্টাব্দে ২৯ জুন, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়ার অভিযোগে একটি মামলায়, মুজাহিদকে গ্রেফতার করা হয়।
২০১১ খ্রিষ্টাব্দের ২১ জুলাই একাত্তরে যুদ্ধাপরাধের ঘটনায় তার বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেন কর্মকর্তারা। এরপর ২ আগস্ট তাকে ট্রাইব্যুনালে গ্রেফতার দেখানো হয়।
২০১২ খ্রিষ্টাব্দের ২১ জুন মুজাহিদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট ৭টি অভিযোগ গঠন করে ট্রাইব্যুনাল। ২৬ আগস্ট শাহরিয়ার কবিরের সাক্ষ্য গ্রহণের মধ্য দিয়ে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। এরপর এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের তদন্ত কর্মকর্তা আব্দুর রাজ্জাকসহ মোট ১৭ জন সাক্ষী সাক্ষ্য দেন। অপরদিকে মুজাহিদের পক্ষে প্রথম এবং একমাত্র সাফাই সাক্ষী হিসেবে জবানবন্দি দেন তার ছোট ছেলে আলী আহমেদ মাবরুর।
২০১৩ খ্রিষ্টাব্দের ২২ এপ্রিল রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হলে আসামিপক্ষের সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য ৫ মে দিন ধার্য করে দেন ট্রাইব্যুনাল।
 

২০১৩ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ এপ্রিল আদালত তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেয়। এই সময় অপর যুদ্ধাপরাধী সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী-ও ফাঁসিতে মৃত্যুদণ্ড হয়েছিল।

বুদ্ধিজীবী হত্যা, গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট, দেশান্তরে বাধ্য করাসহ ৩৪ ধরণের সাতটি অভিযোগে অভিযুক্ত আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ।

  • অভিযোগ-১: পাকিস্তানের বাঙালি সহযোগীদের বিরুদ্ধে একটি দৈনিকে প্রবন্ধ লেখার অপরাধে ১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর রাত আনুমানিক ৩টার দিকে ৫ নম্বর চামেলীবাগের ভাড়া করা বাসা থেকে অস্ত্রের মুখে অপহরণ করা হয় ইত্তেফাকের সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনকে। এর পর তার আর কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। এ ঘটনায় ইন্ধন, অপরাধীদের সুযোগ সৃষ্টি করে অপরাধ সংঘটনে ভূমিকা রাখার অভিযোগ আনা হয়েছে মুজাহিদের বিরুদ্ধে, যা আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন ১৯৭৩-এর ৩ (২) (এ) (জি), ৪ (১), ৪ (২) এবং ২০ (২) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ। অভিযোগ প্রমাণিত। মৃত্যুদণ্ড
  • অভিযোগ-২: একাত্তরের মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে ফরিদপুরের চরভদ্রাসন থানায় বৈদ্যডাঙ্গি, মাঝিডাঙ্গি ও বালাডাঙ্গি গ্রামে হিন্দুদের প্রায় সাড়ে তিনশ’ বাড়ি পুড়িয়ে দেয় পাকিস্তানি সেনা ও তাদের দোসররা। হামলাকারীদের গুলিতে ৫০ থেকে ৬০ জন নরনারী নিহত হন। ওই ঘটনায় ফরিদপুর শহরের হামিদ মাওলানা ছাড়াও ৮/১০ জন অবাঙালি অংশ নেন। এ ঘটনায় বিশেষ ধর্মে বিশ্বাসী মানুষের ওপর হামলায় সহযোগিতা করা ও হামলায় ইন্ধন দেয়ার অভিযোগ আনা হয়েছে মুজাহিদের বিরুদ্ধে। আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন ১৯৭৩-এর ৩ (২) (এ) (সি)(জি) এবং ৪ (১) ধারায় এটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। অভিযোগ সত্য তবে তার সম্পৃক্ততা প্রমাণিত হয়নি।
  • অভিযোগ-৩: একাত্তরের জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে ফরিদপুর শহরের খাবাসপুর মসজিদের সামনে থেকে রাজাকাররা ফরিদপুর জেলার কোতোয়ালি থানার গোয়ালচামট (রথখোলার) এলাকার মৃত রমেশ চন্দ্র নাথের ছেলে রণজিৎ নাথ ওরফে বাবু নাথকে আটক করে। বেলা ১১টার দিকে ফরিদপুর পুরনো সার্কিট হাউসে মুজাহিদের উপস্থিতিতে পাকিস্তানি সেনা অফিসার মেজর আকরাম কোরাইশীর কাছে তাকে হস্তান্তর করা হয়। সেখানে নির্যাতনের পর মুজাহিদের নির্দেশে তাকে হত্যা করার উদ্দেশে বিহারি ক্যাম্পের উত্তর পাশে আব্দুর রশিদের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। তবে ঘরের জানালার শিক ভেঙে রাতে রণজিৎ নাথ বাবু পালিয়ে জীবন বাঁচান। এ ঘটনায় মুজাহিদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ১৯৭৩ এর ৩ (২)(এ) (জি) ধারায় অপরাধ সংঘটনের অভিযোগ আনা হয়েছে। মুজাহিদের অপরাধের দায়বদ্ধতা আছে, অভিযোগ প্রমাণিত।
  • অভিযোগ-৪: একাত্তরের ২৬ জুলাই সকালে ফরিদপুর জেলার আলফাডাঙ্গা থেকে স্থানীয় রাজাকাররা মো. আবু ইউসুফ ওরফে পাখিকে মুক্তিযোদ্ধা সন্দেহে আটক করে। পরে তাকে ফরিদপুর স্টেডিয়ামে আর্মি ক্যাম্পে নিয়ে আটক রাখা হয়। সেখানে মুজাহিদের কাছ থেকে পাখির বিষয়ে জানতে পেরে তার উপর নির্যাতনের মাত্রা বাড়িয়ে দেয় পাকসেনারা। প্রায় এক মাস ৩ দিন তাকে সেখানে নির্যাতন করা হয়। এতে পাখির বুক ও পিঠের হাড় ভেঙে যায়।
    এ ঘটনায় ১৯৭৩ এর ৩(২)(এ) (জি) ধারায় অপরাধ সংঘটনের অভিযোগ আনা হয়েছে মুজাহিদের বিরুদ্ধে, যা ২০(২) ধারায় শাস্তিযোগ্য। অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি।
  • অভিযোগ-৫: যুদ্ধ চলাকালে সুরকার আলতাফ মাহমুদ, জহিরউদ্দিন জালাল, বদি, রুমি, জুয়েল ও আজাদকে আটক করে ঢাকার নাখালপাড়ায় পুরনো এমপি হোস্টেলে রাখা হয়। ৩০ অগাস্ট রাত ৮টার দিকে পূর্ব পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘের সেক্রেটারি মুজাহিদ ও সভাপতি মতিউর রহমান নিজামী সেখানে গিয়ে এক সেনা কর্মকর্তাকে পরামর্শ দেন, রাষ্ট্রপতির সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার আগেই তাদের হত্যা করতে হবে। এ সিদ্ধান্তের পর সহযোগীদের নিয়ে মুজাহিদ আর্মি ক্যাম্পে আটকদের অমানসিক নির্যাতনের পর জালাল ছাড়া বাকিদের হত্যা করে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালস আইন ১৯৭৩ এর ৪(১) এবং ৪(২) ধারায় যা মানবতাবিরোধী অপরাধ।
    অভিযোগ প্রমাণিত।
  • অভিযোগ-৬: একাত্তরে ঢাকার মোহাম্মদপুর ফিজিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে দখলদার পাকিস্তান সেনাবাহিনী ক্যাম্প তৈরি করে। পরবর্তীতে রাজাকার ও আলবদর বাহিনী গঠনের পর সদস্যরা সেখানে প্রশিক্ষণ নিতেন। পূর্ব পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘের সেক্রেটারি হওয়ার সুবাদে ওই আর্মি ক্যাম্পে নিয়মিত যাতায়াত ছিল মুজাহিদের। সেখানে নিয়মিত ঊর্ধ্বতন সেনা অফিসারের সঙ্গে স্বাধীনতাবিরোধী নানা অপরাধের পরামর্শ ও ষড়যন্ত্র করতেন তিনি। এ ধরনের পরামর্শ ও ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ১০ ডিসেম্বর থেকে বুদ্ধিজীবী নিধনসহ গণহত্যার মতো ঘটনা সংঘটিত হয়।
    অভিযোগ প্রমাণিত। মৃত্যুদণ্ড
  • অভিযোগ-৭: একাত্তরের ১৩ মে মুজাহিদের নির্দেশে রাজাকার বাহিনী ফরিদপুরের কোতোয়ালি থানার বকচর গ্রামে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা চালিয়ে বীরেন্দ্র সাহা, নৃপেন সাহা, শানু সাহা, জগবন্ধু মিত্র, জলাধর মিত্র, সত্য রঞ্জন দাশ, নরদবন্ধু মিত্র, প্রফুল্ল মিত্র, উপেন সাহাকে আটক করে। পরে উপেন সাহার স্ত্রী রাজাকারদের স্বর্ণ ও টাকার বিনিময়ে স্বামীর মুক্তি চাইলেও মুজাহিদের নির্দেশে রাজাকাররা সবাইকেই হত্যা করে। একই সময়ে রাজাকাররা সুনীল কুমার সাহার কন্যা ঝর্ণা রানীকে ধর্ষণ করে। হিন্দুদের বসতঘরে লুটপাট চালিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। এছাড়া অনিল সাহা নামে একজনকে দেশত্যাগে বাধ্য করা হয়। এসব অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালসের ৩(২)(এ)(জি) ধারায় মুজাহিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়, যা ৪(১) এবং ৪(২) ধারায় শাস্তিযোগ্য। অভিযোগ প্রমাণিত। মৃত্যুদণ্ড।

তথ্যসূত্র