সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী
(১৩ মার্চ ১৯৪৯ - ২২ নভেম্বর ২০১৫)
সংক্ষেপে সাকা চৌধুরী। রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, সাংসদ।
বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে যুদ্ধাপরাধী।
১৩ মার্চ, ১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দের ১৩ই মার্চ
বাংলাদেশের চট্টগ্রাম জেলার রাউজানে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম ফজলুল কাদের চৌধুরী
(বাংলাদেশের স্বাধীনতার পূর্ববর্তী সময়ে পাকিস্তানের জাতীয় সংসদের স্পিকার
ছিলেন এবং কয়েক দফায় পাকিস্তানের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন)।
তার অপর দুই ভাইয়ের নাম গিয়াসউদ্দিন কাদের চৌধুরী এবং সাইফুদ্দিন কাদের চৌধুরী।
তাঁর স্ত্রীর নাম ফারহাত কাদের চৌধুরী। তার দুই ছেলে হুম্মাম
কাদের চৌধুরী ও ফয়জুল কাদের চৌধুরী এবং এক মেয়ে ফারজিন কাদের চৌধুরী।
সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় পাকিস্থানের সাদিক পাবলিক
স্কুলে। পরে তাঁকে চট্টগ্রামের সেন্ট প্লাসিড স্কুলে ভর্তি করানো হয়। এবং এই স্কুল
থেকেই মাধ্যমিক পাশ করেন। এরপর তিনি কোথায় লেখাপড়া শিখেছেন, তা নিয়ে বিতর্ক আছে।
সাকা চৌধুরীর স্কুল জীবনের সহপাঠী চট্টগ্রামের প্রবীণ সাংবাদিক আবুল মোমেন, তাঁর স্মৃতিচারণায় বলেন, “আমরা প্রাইমারি পড়েছি একসাথে। এক সঙ্গে খেলাধুলা করেছি। এটুকু বলা যায় যে, তার মধ্যে তখন থেকেই এই সচেতনতা ছিল যে সে একটি প্রভাবশালী রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান। এরপর সে চলে যায় ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজে। সেখান থেকে ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু সম্ভবত সেখানেও সে শেষ করতে পারেনি। গ্রাজুয়েশন করেছিল সম্ভবত অন্য কোথাও থেকে”। [সূত্র: সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর রাজনৈতিক উত্থান-পতন। ]
তাঁর পিতার আদর্শ অনুসরণে তিনি মুসলিম লীগের অনুসারী ছিলেন। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় স্বাধীনতার বিপক্ষে অবস্থান নেন। এই সময়, তিনি তাঁর পিতা ফজলুল কাদের চৌধুরীর সহযোগী হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে কাজ করেন। তিনি নিজে বহু অত্যাচার করেন এবং হত্যাকাণ্ড পরিচালনা করেন।
স্বাধীনতার পরে তাঁর পিতা ফজলুল কাদের
চৌধুরীকে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠানো হয়, কিন্তু সালাউদ্দীন আত্মগোপন করে থাকেন।
১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দে বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর, তিনি ধীরে ধীরে রাজনৈতিক অঙ্গনে
আত্মপ্রকাশ করেন। মুসলীম লীগে পিতার প্রভাবের সূত্রে তিনি, দলের ভিতরে সুদৃঢ়
অবস্থান করে নেন।
১৯৭৯ খ্রিষ্টাব্দে দ্বিতীয় সংসদে, মুসলিম লীগ থেকেই প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য
নির্বাচিত হন। এরপর সামরিক শাসক এরশাদের জাতীয় পার্টিতে যোগ দিয়ে মন্ত্রী হন।
তিনি এরশাদের শাসনামলে বিভিন্ন সময়ে ত্রাণ ও পুনর্বাসন, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত এবং
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৮৬ খ্রিষ্টাব্দে তিনি তাঁর নিজ এলাকা রাউজান থেকে জাতীয় পার্টি ব্যানারে দ্বিতীয়
বার সংসদ সদস্য হন। এরপর রাজনৈতিক মতানৈক্যের কারণে, এরশাদ তাঁকে জাতীয় পার্টি থেকে
বহিষ্কার করেন।
১৯৮৮ খ্রিষ্টাব্দে জাতীয় পার্টি থেকে বহিষ্কৃত হওয়ার পর তিনি ন্যাশনাল
ডেমোক্রেটিক পার্টি নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেন।
১৯৯১ খ্রিষ্টাব্দের চতুর্থ বারের মতো সংসদ সদস্য হন। এই বৎসরের ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক
পার্টির ব্যানারে তৃতীয়বারের মতো সংসদ সদস্য হন।
১৯৯৬ খ্রিষ্টাব্দে তিনি নিজের দল বিলুপ্ত করে বিএনপিতে যোগ দেন। এই বছরের নির্বাচনে
তিনি চতুর্থ বারের মতো সংসদ সদস্য হন।
২০০১ খ্রিষ্টাব্দে বিএনপির দলীয় প্রধানকে নিয়ে এক কটূক্তির জের ধরে বহিষ্কৃত হয়ে ওই বছরই আবার
দলীয় মনোনয়ন নিয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। ওই নির্বাচনে বিএনপি
ক্ষমতায় আসলে তিনি প্রধানমন্ত্রীর সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টার পদ পান। এই পদে তিনি ২০০৬
খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত বহাল ছিলেন।
২০০৮ খ্রিষ্টাব্দে নবম সংসদ নির্বাচনের পর দলের কয়েকজন নেতাকে নিয়ে তার মন্তব্য আলোচনার
ঝড় তুলেছিল, এমন কি ঢাকার গুলশানে দলীয় চেয়ারপার্সনের কার্যালয়ের সামনে তার
বিরুদ্ধে মিছিলও করেছিল দলেরই নেতাকর্মীরা। তারপরও বিএনপির মনোয়ন লাভ করেন এবং সংসদ
সদস্য নির্বাচিত হন।
২০১০ খ্রিষ্টাব্দে ১৬ই ডিসেম্বর সকাকে তাঁকে
আটক করা হয়। ১৯শে ডিসেম্বর আটকের কারণ হিসেবে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী হিসেবে উল্লেখ
করা হয়।
২০১১ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ই নভেম্বর তাঁর বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগে আদালতে জমা দেওয়া হয়।
এই অভিযোগ আদালত গ্রহণ করে ১৮ই নভেম্বর।
২০১২ খ্রিষ্টাব্দের ৪ঠা এপ্রিল ২৩টি অভিযোগের সূত্রে বিচার প্রক্রিয়া চালু হয়। এই
সূত্রেই ৩রা মে থেকে প্রসিকিউশনের সূচনা বক্তব্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে বিচারের সূচনা
হয়। এই বিচারে যে সকল বিষয় বিশেষভাবে উঠে আসে তা হলো
১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ৪-৫ই এপ্রিল সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু সম্প্রদায়ের ৭ জনকে অপহরণ ও এর মধ্যে ৬ জনকে হত্যা করেন।
১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ১৩ই এপ্রিল রাউজানের মধ্য গহিরা হিন্দু পাড়ায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সাথে গণহত্যা পরিচালনা করেন।
১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ১৩ই এপ্রিল কুন্দেশ্বরী ওষুধালয়ের মালিক নতুন চন্দ্র সিংহাকে হত্যা করেন।
এই সময় তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সাথে মিলে ৩২ জনকে হত্যা করেন এবং তাঁর অনুগত বাহিনীর লোকেরা বেশ কিছু বাড়িতে আগুন দেয়। এই সময় তিনি ধর্ষণ করেছিলেন বলেও অভিযোগ ছিল।
১৪ই এপ্রিল সতিশ চন্দ্র পালিত হত্যা, তার বাড়িতে আগুন ও পরিবারের সদস্যদের ধর্মান্তরে বাধ্য করেছিল। এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সাথে মিলে বোয়ালখালির শাখাপুর হিন্দু অধ্যুষ্যিত অঞ্চলে হামলা ও ৭৬ জনকে হত্যা করেছিল।
২০১৩ খ্রিষ্টাব্দের ১লা অক্টোবর, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল, সাকা চৌধুরীকে ২৩টি মামলার মধ্যে হত্যা, নির্যাতন, গণহত্যা ইত্যাদি, মোট ৯টি মামলায় দোষী প্রমাণিত হওয়ায় ফাঁসির আদেশ প্রদান করে। এই সময় তাঁর রাজনৈতিক দল বিএনপি কোনো প্রমাণ ছাড়াই অভিযোগ করে যে, এই বিচার রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত।
সালাউদ্দিনের আইনজীবীরা এই রায়ের আপিল
করেছিল। এই আপলের রায় প্রকাশিত হয় ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ই নভেম্বর। এই রায় অনুসারে
একটি অভিযোগ থেকে তাঁকে মুক্তি দেয়া হলেও অন্য অপরাধের জন্য ফাঁসির সাজা বহাল
থাকে। এরপর ২১শে নভেম্বর সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীও অপর দণ্ডপ্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধী
আলী আহসান মোহম্মদ মুজাহিদ কারা-কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদের নিকট
প্রাণভিক্ষার জন্য আবেদন করেন। শেষ পর্যন্ত আদালতের রায় অনুসারে, ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দের
২২শে নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে রাত ১২টা ৪৫ মিনিটে তাঁদের দু'জনকে
ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।
সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী মৃত্যুর পর যে সম্পত্তি রেখে যান, সে বিষয়ে 'বাংলাদেশ
প্রতিদিন পত্রিকার অনলাইন সংখ্যায় (সোমাবার, ৫ সেপ্টেম্বর ২০১৬), তাঁর সম্পত্তির যে
বিবরণ দেওয়া হয়েছে, তা নিচে তুলে ধরা হলো—
ফাঁসি কার্যকর হওয়া যুদ্ধাপরাধী সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ছিলেন ঢাকা বৃহৎ কর ইউনিটের করদাতা। তার কর শনাক্তকরণ নম্বর ছিল ৩০৫-১০০-১৭০১। তার মালিকানায় ছিল কিউসি কনটেইনার লাইন লিমিটেডের ৭ লাখ ১৮ হাজার শেয়ার (মূল্য ৫ কোটি ৭০ লাখ টাকা), ঢাকা ডাইং এমএফজি কো. লিমিটেডের ৮ লাখ ৬৮ হাজার ৭০৬টি শেয়ার (মূল্য ৮৬ লাখ ৮৭ হাজার ৬০ টাকা), কিউসি ফিডারস লিমিটেডের ২৫ হাজার শেয়ার (মূল্য ২৫ লাখ টাকা), কিউসি প্রোপার্টিজ লিমিটেডের ৩০০ শেয়ার (মূল্য ৩০ হাজার টাকা), কিউসি স্টেট লিমিটেডের ২৫০টি শেয়ার (মূল্য ২৫ হাজার টাকা), কিউসি হোল্ডিং লিমিটেডের ৩০ হাজার শেয়ার (মূল্য ৩০ লাখ টাকা), কিউসি এন্টারপ্রাইজ লিমিটেডের ৫ হাজার ২৫০টি শেয়ার (মূল্য ৫২ লাখ ৫০ হাজার টাকা), কিউসি ট্রেডিং লিমিটেডের ৫ হাজার ২৫০টি শেয়ার (মূল্য ৫২ লাখ ৫০ হাজার টাকা), কিউসি শিপিং লিমিটেডের ৫ হাজার ২৫০টি শেয়ার (মূল্য ৫২ লাখ ৫০ হাজার টাকা), বারউইন কিউসি এজেন্সিস লিমিটেডের ২ হাজার ৬৮টি শেয়ার (মূল্য ২০ লাখ ৬৮ হাজার টাকা), কিউসি স্টেট লিমিটেডের শেয়ার মানি ডিপোজিট ৩০ লাখ টাকা, কিউসি নেভিগেশন লিমিটেডের শেয়ার মানি ডিপোজিট ১০ লাখ টাকা, ফোকাস মাল্টিমিডিয়া লি. ও সিএসবি লিমিটেডের ৯৫ হাজার শেয়ার (মূল্য ৮০ লাখ টাকা)। তার মালিকানায় ছিল মোট ১০ কোটি ৩২ লাখ ১৩ হাজার ৫০৪ টাকার শেয়ার। সাকা চৌধুরী কিউসি হোল্ডিংসের চেয়ারম্যান এবং কিউসি নেভিগেশন ও মার্কারী এয়ার বিডির পরিচালক ছিলেন। আয়কর রিটার্ন অনুসারে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর নামে ঢাকার ধানমন্ডির ১০/এ রোডের ২৮ নম্বর বাড়ি, চট্টগ্রামের রহমতগঞ্জের গুডসহিল ও রাউজানের গহিরায় তিনটি বাড়ির মালিকানা ছিল। কৃষিজমি ছিল চট্টগ্রামের রাউজানের গহিরায় মাত্র ৯ হাজার টাকার। এইচএসবিসি, এবি ব্যাংক ও সোনালী ব্যাংকের তিনটি অ্যাকাউন্টে জমা ছিল মাত্র ১২ লাখ ১৯ হাজার ৯০৯ টাকা। সুদ ও জামানতমুক্ত ঋণ ছিল ২ কোটি ৩৯ লাখ টাকার। দুটি গাড়ির একটির মূল্য ৫৪ লাখ ১৫ হাজার ও অন্যটির ১২ লাখ টাকা। ঋণ দিয়েছিলেন ১ কোটি ৪৯ লাখ টাকা। বিভিন্ন কোম্পানি থেকে সম্মানী ভাতা পেতেন বার্ষিক ১৭ লাখ টাকা। তার ঘোষিত মোট পরিসম্পদ মাত্র ৬৩ লাখ। তার নিজের ও স্ত্রীর মালিকানায় সোনার পরিমাণ ৪ লাখ ৬০ হাজার টাকার। ইলেকট্রনিক ও আসবাবপত্র ছিল ৬ লাখ ৬৫ হাজার টাকার। অন্যান্য স্থাবর সম্পত্তির পরিমাণ ছিল ৬৩ লাখ টাকার।