আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজি
(১৯১৫
-২০০৪ খ্রিষ্টাব্দ)
উর্দু: امیر عبداللہ خان نیازی‎‎; 

পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রাক্তন লেফট্যানেন্ট জেনারেল পূর্ব পাকিস্তানে তিনি সর্বশেষ গভর্নর, সামরিক আইন প্রশাসক এবং পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় সামরিক হাই কমান্ডের সর্বশেষ কমান্ডার।

১৯১৫ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশ ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশের নুয়াবওয়ালীর এক পশতু পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।

১৯৩২ তিনি ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীতে জুনিয়র নন-কমিশন্ড অফিসার হিসেবে যোগ দেন। ভারতীয় সামরিক একাডেমি তিনি সামরিক বিজ্ঞানে বিএসসি ও প্যারাট্রুপার কোর্স সম্পন্ন করেন।

১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দে তিনি পাঞ্জাব রেজিমেন্টের ৫ম প্যারাট্রুপারে সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হিসেবে কমিশন লাভ করেন এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রশান্ত মহাসাগরীয় রণাঙ্গণে অংশ নেন।

১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দের ১১ই জুন নিয়াজী আসাম-বার্মা যুদ্ধক্ষেত্রের কেকরিমা অঞ্চলে আসেন। এই সময় তিনি জেনারেল স্লিমের অধীন ১৪তম আর্মি অফেন্সিভ গ্রুপে ছিলেন। তিনি লেফটেন্যান্ট হিসেবে বার্মার বাউথি-ডাউং সুড়ঙ্গে জাপানি সেনাদের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করেছিল। ১৬১তম ইনফেন্ট্রি ডিভিশনের কমান্ডিং অফিসার ব্রিগেডিয়ার ডি এফ ডব্লিউ ওয়ারেন, জাপানিদের বিরুদ্ধে সাহসিকতার সাথে লড়াই করার জন্য নিয়াজীকে 'টাইগার' উপাধি দেন। যুদ্ধের শেষ ব্রিটিশ সরকার তাকে মিলিটারি ক্রস পদক দেয়। ১৯৪৪ খ্রিষ্টাব্দ ১৫ই ডিসেম্বর ভারতের ভাইসরয় লর্ড ওয়াভেল ইমফলে এলে, তিনি জেনারেল স্লিম এবং তার অধীনস্থ কমান্ডার ফ্রেডরিক স্টপফোর্ড, জিওফ্রে স্কুনস ও ফিলিপ ক্রিস্টিসনকে লর্ড মাউন্টব্যাটেনের উপস্থিতিতে দুই জন ভারতীয়কে নাইটহুড প্রদান করেন। এঁরা ছিলেন আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজী এবং মেজর শ্যাম মানেকশ।

১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে ভারত বিভাগের পর নিয়াজী পাকিস্তানের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন এবং নবগঠিত পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগ দেন।
১৯৬৫ খ্রিষ্টাব্দে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় তিনি পাঞ্জাব রেজিমেন্টের ৫ম প্যারাট্রুপারের কর্নেল ও কমান্ডিং অফিসার হিসেবে অংশগ্রহণ করেন। এসময় তিনি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হিসেবে পদোন্নতি পান। কাশ্মির ও শিয়ালকোটের অপারেশনে তিনি ১৪তম প্যারাট্রুপার ডিভিশন, ৫০তম এয়ারবর্ন ডিভশনের নেতৃত্ব দেন। চাভিন্দার যুদ্ধে তিনি অংশ নেন। যুদ্ধের পর নিয়াজী করাচি ও লাহোরের সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে নিযুক্ত হন।
১৯৬৮ খ্রিষ্টাব্দে তিনি মেজর জেনারেল হিসেবে পদোন্নতি পান এবং করাচির ৫২তম মেকানাইজড ডিভশনের জিওসি নিযুক্ত হন। ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ৫০তম এয়ারবর্ন ডিভিশনের নেতৃত্ব দেন।

১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে তিনি লেফটেন্যান্ট জেনারেল পদ লাভ করেন। পৈশাচিক হত্যাযজ্ঞ দিয়ে বাঙালি নিধন যজ্ঞ শুরু হয়। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ভাষায় তার নাম ছিল অপারেশন সার্চ লাইট। এই অপারেশন পরিচালনা করেছিলেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান ও মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী আন্তর্জাতিকভাবে এই সামরিক অভিযান নিন্দিত হয়। এই কারণে টিক্কা খানকে অপসারিত করা হয় এবং তার জায়গায় নিয়াজিকে নিয়োগ দেওয়া হয়।
টিক্কা খান এপ্রিল মাসের ১০ তারিখে, নিয়াজির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে পশ্চিম পাকিস্তানে চলে যান। এই সময় থেকে তিনি এই হত্যাযজ্ঞ ১৫ই ডিসেম্বর পর্যন্ত পরিচালনা করেন। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর এই হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের বিরুদ্ধে, পূর্ব-বাংলার মানুষ যুদ্ধ ঘোষণা করে।

তাঁর অনুমোদনে,
১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ জুলাই, কুষ্টিয়ায় রাজাকার বাহিনীর প্রথম ব্যাচের প্রশিক্ষণ সমাপ্ত হয়। সেপ্টেম্বর মাসে এই রাজাকার দায়িত্ব গ্রহণ করেন মেজর জেনারেল মোহাম্মদ জামসেদ। পূর্বাঞ্চলীয় সামরিক অধিনায়ক হিসেবে ২৭শে নভেম্বর, তিনি সাভারে রাজাকার বাহিনীর কোম্পানি কমান্ডারদের প্রথম ব্যাচের ট্রেনিং শেষে বিদায়ী কুচকাওয়াজে অভিবাদন গ্রহণ করেন। এছাড়া তাঁর নির্দেশে সৃষ্টি হয়েছিল- আল্‌ বদর আল্ শামস বাহিনী।
 

মুক্তিবাহিনীর ক্রমাগত আক্রমণের ফলে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়ে। অক্টোবর-নভেম্বর মাসের দিকে অধিকাংশ গ্রামাঞ্চলগুলো মুক্তি যোদ্ধাদের দখলে চলে যায়। এই অবস্থায় ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর থেকে ভারতীয় বিমান আক্রমণের মুখে নিয়াজীর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কয়েক দিনের মধ্যেই ভেঙে পড়ে। ১০ ডিসেম্বর থেকে সীমান্ত অঞ্চলে মোতায়েন  সেনা-ইউনিটগুলি নিরাপত্তার জন্য পশ্চাদপসরণ শুরু করে এবং ১৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত এ অবস্থা অব্যাহত থাকে। যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার প্রয়োজনীয় সকল শক্তি নিয়াজী হারিয়ে ফেলেন।

এরপর ১৬ই ডিসেম্বর মিত্রবাহিনীর (বাংলাদেশ ও ভারতীয় বাহিনী) পক্ষে ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের প্রধান জেনারেল জগজিত সিং অরোরার কাছে আত্মসমর্পণ করেন। বাংলাদেশের ইতিহাসে এই দিনটি বিজয় দিবস হিসেবে পালন করা হয়।


এ সময় নিয়াজির সাথে ৯৩,০০০ সেনা আত্মসমর্পণ করে। পরে তাদের যুদ্ধবন্দী হিসেবে ভারতে নিয়ে যাওয়া হয়। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সিমলা চুক্তির পর  যুদ্ধবন্দীরা পাকিস্তানে ফিরে আসে। নিয়াজীও এসময় পাকিস্তান ফেরেন। জুলফিকার আলী ভুট্টো নিয়াজীকে তার সামরিক পদ থেকে অব্যাহতি দেন এবং তার খেতাবগুলো কেড়ে নেয়া হয়। এছাড়াও যুদ্ধে আত্মসমর্পণের জন্য তাকে দোষারোপ করা হয়। বিচারপতি হামুদুর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত কমিশন পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে দায়িত্বপালনের সময় নিয়াজীর বিরুদ্ধে বেশ কিছু অন্যায়ের অভিযোগ আনে। নিজেকে নির্দোষ দাবি করে নিয়া
জি সামরিক আদালতের মুখোমুখি হওয়ার প্রস্তাব দেন।

১৯৯৮ খ্রিষ্টাব্দে তিনি আত্মসমর্থনমূলক গ্রন্থ 'দ্য বিট্রেয়াল অব ইস্ট পাকিস্তান' প্রকাশিত হয়। এতে তিনি ইয়াহিয়া খান, রাও ফরমান আলি, টিক্কা খান ও জুলফিকার আলী ভুট্টোকে পাকিস্তানের বিভক্তির জন্য দায়ী করেন।

২০০৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি লাহোরে মৃত্যুবরণ করেন।


সূত্র :
১. আমি বিজয় দেখেছি । এম আর আখতার মুকুল।
২.
লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে। মেজর রফিকুল ইসলাম।
৩. মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। মেজর(অবঃ) রফিকুল ইসলাম পিএসসি।
৪. মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ব্যক্তির অবস্থান। এ.এস.এম. সামছুল আরেফিন।
৫. দ্য বিট্রেয়াল অব ইষ্ট পাকিস্তান। লে.জে.: এ.এ.কে.নিয়াজী। ভাষান্তর সাহাদত হোসেন খান।
৬.
ফল অফ ঢাকা। লেঃ জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা।
৭.
বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের দলিলপত্র তৃতীয় খণ্ড, প্রকাশকাল: নভেম্বর ১৯৮২
৮.স্বাধীনতার রজত জয়ন্তী। ৭ই ডিসেম্বর ১৯৯৫

৯.
Witness to Surrender Salik, Siddiq