পাকিস্তনের পতাকা :

পাকিস্তানের জাতীয় পতাকার নকশা প্রণয়ন করেন সৈয়দ আমিরুদ্দিন কেদোয়াই। ১৯০৬ খ্রিষ্টাব্দের অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের পতাকার উপর ভিত্তি করে তৈরি করা এই পতাকা তৈরি করা হয়েছিল়। পাকিস্তান স্বাধীনতা লাভ করার ৩ দিন আগে, ১৯৪৭ সালের ১১ই আগষ্ট তারিখে এই পতাকাটির নকশা গৃহীত হয়।

পতাকাটিকে পাকিস্তানে সাব্‌জ হিলালি পারচাম বলা হয়। উর্দু ভাষার এই বাক্যটির অর্থ হলো "নতুন চাঁদ বিশিষ্ট সবুজ পতাকা"। এছাড়াও এটাকে "পারচাম-ই-সিতারা আও হিলাল" অর্থাৎ "চাঁদ ও তারা খচিত পতাকা" বলা হয়ে থাকে। পতাকাটির খুঁটির বিপরীত দিকের গাঢ় সবুজ অংশটি ইসলাম ধর্মের প্রতীক। খুঁটির দিকে সাদা অংশ রয়েছে, যা পাকিস্তানে বসবাসরত সংখ্যালঘু অমুসলিমদের প্রতীক। পতাকার মধ্যস্থলে রয়েছে একটি সাদা নতুন চাঁদ, যা প্রগতির প্রতীক; এবং একটি পাঁচ কোণা তারকা, যা ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের প্রতীক।

পাকিস্তান
উর্দু : اسلامی جمہوریۂ پاکستان (ইস্‌লামী জুম্‌হূরিয়াতে পাকিস্তান্‌)।
ইংরেজি :
Islamic Republic of Pakistan

দক্ষিণ
এশিয়া, দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়া এবং মধ্য এশিয়ার সংযোগস্থলে অবস্থিত একটি দেশ এবং ভারত উপমহাদেশের অংশ। ফার্সি, সিন্ধি ও উর্দু ভাষায়, "পাকিস্তান" নামটির অর্থ "পবিত্রদের দেশ"। কিন্তু নামটি গ্রহণ করা হয়েছিল তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের পাঁচটি রাজ্যের নাম থেকে। এই নামগুলো হলো- প - পাঞ্জাব, আ - আফগানিয়া (নর্থ-ওয়েস্ট ফ্রন্টির প্রভিন্স), ক - কাশ্মীর, স - সিন্ধু এবং তান - বালুচিস্তান। ১৯৩৩ খ্রিষ্টাব্দে চৌধুরী রহমত আলী তাঁর "নাও অর নেভার" (Now or Never) পুস্তিকায় এই নামটির প্রস্তাব রাখেন।

ভৌগোলিক অবস্থান: ৩৩
°৪০ উত্তর ৭৩°১০পূর্ব। এর পশ্চিমে রয়েছে আফগানিস্তান ইরান, পূর্বে ভারত, এবং উত্তর-পূর্বে চীনর তিব্বত ও শিঞ্চিয়াং অঞ্চল, দক্ষিণদিকে ওমান উপসাগর ও আরব সাগর।
স্থানাঙ্ক :
আয়তন : ৭,৯৬,০৯৫ বর্গকিলোমিটার (৩,০৭,৩৭৪ বর্গমাইল)
জনসংখ্যা: ১৮,২৪,৯০,৭২১ জন (২০১২)

রাজধানী : ইসলামাবাদ
ভাষা :
প্রদেশিক ভাষা -পাঞ্জাবী, সিন্ধি, পাস্তু, বালুচি, সারাইকি, হিন্দকো, ব্রাহুই।
রাষ্ট্রীয় ভাষা : ইংরেজি ও উর্দু।
স্বাধীনতা দিবস: ১৪ই আগষ্ট।
ইসলামী প্রজাতন্ত্র দিবস:
১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দের ২৩ মার্চ।
মুদ্রার নাম: রুপি


ইতিহাস: বর্তমান পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটি ভারত উপমহাদেশের পশ্চিমাংশে অবস্থিত।
১ লক্ষ ২৫ হাজার বৎসর থেকে ৬০ হাজার বৎসরের ভিতরে এরা আফ্রিকা ইথিওপিয়া অঞ্চল থেকে Homo sapiens sapiens -এর একটি দল এশিয়া এবং ইউরোপে প্রবেশ করে। এদের একটি দল ভারতবর্ষে প্রবেশ করেছিল, এদেরকে বিজ্ঞানীরা নামকরণ করেছেন নেগ্রিটো। খ্রিষ্টপূর্ব ৪০-২০ হাজার বৎসরের মধ্যে এরা ভারতবর্ষে বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিল। এদের দ্বারাই সূচিত হয়েছিল ভারতের প্রাচীন প্রস্তরযুগ। এই যুগে নেগ্রিটোরা হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতো অমসৃণ পাথর। এদের নিদর্শন পাওয়া গেছে পাকিস্তানের সোয়ান উপত্যাকায়।

আফ্রিকা থেকে অপর একটি দল প্রায় ৬৫ হাজার বৎসর আগে অন্যান্য মহাদেশের দিকে যাত্রা শুরু করেছিল। এই দ্বিতীয় দলটি প্রোটো-অস্ট্রালয়েড নামে বিজ্ঞানীরা চিহ্নিত করেছেন। ৫০-৬০ হাজার বৎসর আগে এরা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে পড়েছিল। প্রায় ৪০ হাজার বৎসর আগে, এরা সাগর পাড়ি দিয়ে অস্ট্রেলিয়া মহাদেশে প্রবেশ করেছিল। এরাই হলো অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসী। 

প্রোটো-অস্ট্রালয়েডরা বঙ্গদেশ বা ভারতবর্ষে কোন সময় থেকে আসা শুরু করেছিল, তা সুষ্পষ্টভাবে জানা যায় না। ধারণা করা এরা ছড়িয়ে পড়েছিল খ্রিষ্টপূর্ব ২০-৬ হাজার বৎসর পূর্বে। এদের আগমনের ফলে আদি  নেগ্রিটো-রা অপ্রধান হয়ে পড়েছিল। হয়তো  নেগ্রিটোরা আত্মরক্ষায় অপারগ হয়ে ক্রমে ক্রমে উত্তর ভারতে বিলীন হয়ে গিয়েছিল। কিম্বা এরা দক্ষিণের দিকে সরে গিয়েছিল। কিম্বা এদের সাথে প্রোটো-অস্ট্রালয়েডদের সংমিশ্রণের ফলে নিজেদের জাতিগত স্বতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্য হারিয়েছিল। এই বিচারে ভারতের মধ্য-প্রস্তরযুগের সভ্যতা সৃষ্টি হয়েছিল নেগ্রিটো আর প্রোটো-অস্ট্রালয়েডদের সংমিশ্রণে। 

ভারতের আদি জনগোষ্ঠীতে ব্যাপক প্রভাব পড়েছিল প্রোটো-অস্ট্রালয়েডদের দ্বারা। কিন্তু সে প্রভাবকে ম্লান করে দিয়েছিল দ্রাবিড় জাতির মানুষ। খ্রিষ্টপূর্ব ৬-৫ হাজার বৎসর আগে এরা ভারতবর্ষে প্রবেশ করেছিল। এদের উত্তর-পশ্চিম ভারতে নগরপত্তন ঘটিয়েছিল। এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ হলো সিন্ধু সভ্যতা। আয়তনের বিচারে এই সভ্যতা প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতার চেয়ে অনেক বড়। প্রত্নতাত্ত্বিকদের মতে এই সভ্যতার বিকাশ ঘটেছিল আয়তন সব মিলিয়ে ১২,৫০,০০০ বর্গ কিলোমিটার।

এর কিছু পরে ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চল দিয়ে প্রবেশ করেছিল মোঙ্গোলীয় মহাজাতির মানুষ। ভাষাতাত্ত্বিকরা এই নৃগোষ্ঠীর ভাষাসমূহকে সিনো-তিব্বতীয় ভাষা পরিবার সদস্য হিসেবে বিবেচনা করে থাকেন। হিমালয়ের পিকিং মানবগোষ্ঠীর (হোমো এরেক্টাস) উত্তরসূরী এবং হোমো স্যাপিয়েন্স (আধুনিক মানুষ) -দের ভাষার সংমিশ্রণে এই ভাষা পরিবারের আদি রূপ সৃষ্টি হয়েছিল। এরা বসবাস করতো চীনের ইয়াংজি, হুয়াং হো প্রভৃতি নদীর তীরবর্তী অঞ্চলে। খ্রিষ্ট-পূর্ব ৪০০০ অব্দের দিকে প্রাগ্ সিনো-তিব্বতীয় ভাষা পরিবারের মানুষ চীন এবং অন্যান্য দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। এদের সাথে হিমালয় সংলগ্ন সমতল অঞ্চলের দিকে নেগ্রিটো, প্রোটো-অস্ট্রালয়েড দ্রাবিড় জনগোষ্ঠীর সাথে মোঙ্গোলীয় মহাজাতির মানুষের রক্তের মিশ্রণ ঘটেছিল।

আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ২০০০ অব্দের দিকে পাকিস্তানের বর্তমান খাইবার পাখতুনখাওয়া প্রদেশের সোয়াত নদের তীরে প্রথম দ্রাবিড় গোষ্ঠীর লোকের বসতি স্থাপন করেছিল। এই অঞ্চলটি সোয়াত উপত্যাকা' সভ্যতা হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। কালক্রমে এই অঞ্চলে রাজতন্ত্রের বিকাশ ঘটে এবং প্রাচীরবেষ্টিত নগরের পত্তন হয়।

এরপর আর্যরা ভারতে প্রবেশ করেছিল খ্রিষ্টপূর্ব ১৫০০ অব্দের দিকে। ক্রমে ক্রমে এরা উত্তর-পশ্চিম ভারতে নিজেদের আধিপত্য বিস্তারে সক্ষম হয়। ধারণা করা এদের দ্বারা তাম্রযুগের সূচনা হয়েছিল খ্রিষ্টপূর্ব ১২০০ অব্দের দিকে। আর লৌহযুগের সূচনা হয়েছিল খ্রিষ্টপূর্ব ৮০০ অব্দের দিকে। এরই ধারাবাহিকতায় বঙ্গদেশেও একই সময় তাম্র এবং লৌহের ব্যবহার শুরু হয়েছিল।

আগের জনগোষ্ঠীকে সাধারণভাবে অনার্য নামে চি্হ্নিত করা হয়ে থাকে। নৃবিজ্ঞানীরা অনার্য নামধারী ভারতবর্ষের আদিবাসী হিসাবে চিহ্নিত করে থাকেননেগ্রিটো, প্রোটো-অস্ট্রালয়েড, দ্রাবিড়, মোঙ্গোলীয়  জাতিগোষ্ঠীর লোকদেরকে।

ভারতবর্ষের প্রাচীন ষোড়শ জনপদের 'গান্ধার' তক্ষশীলা (বর্তমান পাকিস্তানের রাওয়ালপিণ্ডি) এবং কাশ্মীর উপত্যাকা নিয়ে গঠিত হয়েছিল। খ্রিষ্টপূর্ব ষোড়শ শতকে পারস্য গান্ধার দখল করে নেয়। খ্রিষ্টপূর্ব ৩২৭ অব্দে হিন্দুকুশ পর্বত অতিক্রম করে আলেকজান্ডার ভারতের দিকে যাত্রা করেন। এই সময় আলেকজান্ডার সোওয়াত উপত্যাকা'র প্রাচীরবেষ্টিত নগর এবং তৎসংলগ্ন অঞ্চল দখল করে।

খ্রিষ্টপূর্ব ৩২৬ অব্দে আলেকজান্ডার সিন্ধু নদ পার হয়ে তক্ষশীলায় প্রবেশ করেন। আলেকজান্ডার
ভারতের পূর্ব-দিকের অভিযান ত্যাগ করে, ঝিলম ও বিপাশা নদীর মধ্যাভাগের অঞ্চল পুরুকে এবং সিন্ধু ঝিলম নদীর মধ্যভাগের অঞ্চল অম্ভির কাছে ছেড়ে দেন এবং আলেকজান্ডার পারস্যে ফিরে যান। এরপর চন্দ্রগুপ্ত (মৌর্য) উত্তর ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের উপর আধিপত্য বিস্তরে সক্ষম হন। তিনি পারশ্য সীমান্ত থেকে দক্ষিণ ভারতের মহীশূর এবং সৌরাষ্ট্র থেকে বঙ্গদেশ পর্যন্ত রাজ্য বিস্তারে সক্ষম হয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে মৌর্য বংশের রাজা বিন্দুসার এবং অশোক রাজত্ব করেন। খ্রিষ্টপূর্ব ১৮৫ অব্দে, মৌর্যবংশীয় শেষ রাজা বৃহদ্রথকে তাঁর সেনাপতি পুষ্যামিত্র শুঙ্গ হত্যা করে মৌর্য সিংহাসন দখল করেন। অশোকের শাসনামলে বর্তমান  পাকিস্তান, বেলুচিস্তান, এবং হেরাত ও কান্দাহার-সহ আধুনিক আফগানিস্তানের অনেকাংশ এই সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল।

খ্রিষ্টপূর্ব ১৮০ অব্দের দিকে গ্রিকো-ব্যাকট্রীয় রাজা  ডিমেট্রিয়াস প্রথম (Demetrius I ) শুঙ্গরাজ্য আক্রমণ করে কিছু জায়গা দখল করেন এবং একটি ইন্দো-গ্রিক রাজ্য স্থাপন করতে সক্ষম হন। খ্রিষ্টপূর্ব ১৬৫ অব্দ পর্যন্ত বর্তমান পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের বিভিন্ন অঞ্চলকে তিনি তাঁর এই রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেন। পরবর্তী দুই শতাব্দী ধরে একাদিক্রমে ৩০ জনেরও বেশি গ্রিক রাজারা এই অঞ্চল শাসন করেন। খ্রিষ্টপূর্ব ১৫০ অব্দে এই রাজ্যের মিনান্দর। শুঙ্গরাজ্যের অনেকাংশ দখল করে নেয়। এই সময় এর অযোধ্যা এবং চিতরের নিকটবর্তী মধ্যমিকা পর্যন্ত অগ্রসর হয়। পরে যুবরাজ অগ্নিমিত্র গ্রিকবাহিনীকে পরাজিত করে, রাজ্য রক্ষা করেছিলেন।

১৫২৬ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৮শ শতক পর্যন্ত এলাকাটি মুঘল সাম্রাজ্যের অংশ ছিল। এরপর এটি ব্রিটিশ শাসনের অধীনে আসে। িটিশ ভারতের শেষের দিকে, নানা কারণে তৎকালীন মুসলিম নেতারা ভাবা শুরু করেন যে, মুসলমানদের জন্য একটি পৃথক রাষ্ট্র থাকা বাঞ্ছনীয়। ঘটনাক্রমে এই ভাবনার প্রধান দাবীদার হয়ে উঠে তৎকালীন মুসলিম লীগ। ১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দের সাধারণ নির্বাচনে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশসমূহে মুসলিম লীগের পরাজয়ের কারণ বিশ্লেষণের জন্য মুহম্মদ আলী জিন্নাহ, ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দে লাহোরে নিখিল ভারত মুসলিম লীগের সাধারণ অধিবেশন আহবান করেন। এই  অধিবেশনে যোগদানের জন্য বাংলার মুসলিম লীগের নেতৃত্ব দেন আবুল কাশেম ফজলুল হক

মুহম্মদ আলী জিন্নাহ প্রায় দুই ঘণ্টার ধরে দেওয়া বক্তৃতায় কংগ্রেস ও জাতীয়তাবাদী মুসলমানদের সমালোচনা করেন। এর পাশাপাশি তিনি দ্বি-জাতি তত্ত্ব ও মুসলমানদের স্বতন্ত্র আবাসভূমি দাবি করার পেছনের যুক্তিসমূহ তুলে ধরেন। তৎকালীন পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী সিকান্দার হায়াত খান লাহোর প্রস্তাবের প্রারম্ভিক খসড়া তৈরি করেন। এই আলোচনাটি সংশোধনের জন্য নিখিল ভারত মুসলিম লীগের সাবজেক্ট কমিটি সমীপে পেশ করা হয়। সাবজেক্ট কমিটি এ প্রস্তাবটিতে আমূল সংশোধন আনয়নের পর ২৩শে মার্চ সাধারণ অধিবেশনে আবুল কাশেম ফজলুল হক সেটি উত্থাপন করেন এবং চৌধুরী খালিকুজ্জামান ও অন্যান্য মুসলিম নেতৃবৃন্দ তা সমর্থন করেন।

[লাহোর প্রস্তাব]
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র: প্রথম খণ্ড। পৃষ্ঠা ২।

১৯৪১ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ই এপ্রিল মাদ্রাজে অনুষ্ঠিত অধিবেশনে লাহোর প্রস্তাবকে নিখিল ভারত মুসলিম লীগের গঠনতন্ত্রে একটি মৌল বিষয় হিসেবে সন্নিবেশ করা হয়। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের স্বাধীনতা পর্যন্ত এটি লীগের প্রধান বিষয় ছিল।

প্রকৃতপক্ষে, ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দের পরবর্তী সময় থেকে ভারতীয় স্বাধীনতার বিতর্কের প্রধান প্রাসঙ্গিক বিষয় হিসেবে পাকিস্তানের কথা উঠে এসেছিল। ১৯৪১ খ্রিষ্টাব্দে মাদ্রাজে অনুষ্ঠিত নিখিল ভারত মুসলিম লীগের অধিবেশনে প্রস্তাবটিকে ঐ রাজনৈতিক দলটির মৌল বিষয় হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছিল।

১৯৪৬ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসে ব্রিটিশ মন্ত্রী মিশন ভারতে পৌঁছালে, ৭ এপ্রিল দিল্লিতে নিখিল ভারত মুসলিম লীগ তাদের 'পাকিস্তান' দাবিটি প্রবলভাবে উপস্থাপন করে। এই সূত্রে মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক আইন পরিষদের সদস্যদের তিন-দিনব্যাপী এক সম্মেলন অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত নেয়। সম্মেলনে উপস্থাপনের জন্য একটি খসড়া প্রস্তাব তৈরি করতে মুসলিম লীগের ওয়ার্কিং কমিটি চৌধুরী খালিকুজ্জামান, হাসান ইস্পাহানি ও অন্যান্যদের সমবায়ে একটি উপ-কমিটি নিয়োগ করে। এর  একটি খসড়া প্রস্তাবের  তৈরি করেছিলেন চৌধুরী খালিকুজ্জামান। অন্যান্য সদস্যদের সাথে খসড়াটি নিয়ে আলোচনা করা হয় এবং সামান্য পরিবর্তনের পর উপ-কমিটি এবং অতঃপর সাবজেক্ট কমিটি কর্তৃক অনুমোদিত হয়। এই প্রস্তাবে 'স্টেটস'
(States) শব্দটিকে একবচন শব্দ 'স্টেট' (State)করা হয়। এ পরিবর্তনের ফলে মূল লাহোর প্রস্তাবের মৌলিক পরিবর্তন সাধিত হয়েছিল। ৯ই এপ্রিল মুসলিম লীগ ব্যবস্থাপক সভার সদস্যদের সভায় এক পাকিস্তান প্রস্তাব পেশ করেন শহিদ সোহারাওয়ার্দী।
   [এক পাকিস্তান প্রস্তাব]
    বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র: প্রথম খণ্ডের পৃষ্ঠা ১৫-১৬ পৃষ্ঠা থেকে এর নমুনা।

১৯৪৬ খ্রিষ্টাব্দের ৩০শে জুলাই তারিখে জিন্নাহ তাঁর মালবারি পাহাড়ে অবস্থিত বাসভবনে বসে আবুল হাশিমকে লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে অভীষ্ট লক্ষ অর্জনের জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে উৎসাহিত করেন।

১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের ভারত উপমহাদেশ বিভাজনের সূত্রে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়। পাকিস্তানের স্বাধীনতা লাভ ঘটে ১৪ই আগষ্ট। মুসলিম-প্রধান এলাকার সূত্রে ভারতের পূর্ব ও পশ্চিম অঞ্চল নিয়ে এই রাষ্ট্রটি গঠিত হয়। পশ্চিমের অংশের নাম হয় পশ্চিম পাকিস্তান এবং পূর্বের অংশের নাম হয়
পূর্ব পাকিস্তান। পাকিস্তানের এই দুই অংশের মধ্যকার দূরত্ব ছিল প্রায় ১৬০০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ছিল।

পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক ও জনসংখ্যাগত গুরুত্ব সত্ত্বেও, নব্য পাকিস্তানের সরকার পূর্ব-পাকিস্তানীদের উপর শোষণ ও বৈষম্য নীতি প্রয়োগ করতে থাকে। ফলে ধীরে ধীরে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ, পশ্চিম পাকিস্তানীদের উপর আস্থা হারাতে থাকে। এর বড়ধরনের প্রভাব ফেলে বাংলা 
ভাষা-আন্দোলন। পশ্চিম পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠী সংখ্যা গরিষ্ঠ ভাষা বাংলাকে উপেক্ষা করে একমাত্র উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার উদ্যোগ নেয়।

রমনা রেসকোর্স ময়দান কায়েদে আজমের ভাষণ

পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মুহম্মদ আলী জিন্নাহ  ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দের ১৯শে মার্চ ঢাকা আসেন। ২১শে মার্চ রমনা রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহ্‌রাওয়ার্দী উদ্যান) মুহম্মদ আলী জিন্নাহকে গণ-সংবর্ধনা দেওয়ার আয়োজন করা হয়। সেখানে তিনি পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাকে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করেন। তিনি ভাষা আন্দোলনকে পাকিস্তানের মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির ষড়যন্ত্র হিসেবে উল্লেখ করেন। প্রসঙ্গক্রমে তিনি বলেন পূর্ববঙ্গের প্রাদেশিক ভাষা নির্ধারিত হবে প্রদেশের অধিবাসীদের ভাষা অনুযায়ী। কিন্তু দ্ব্যর্থহীন চিত্তে ঘোষণা করেন- "উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা, অন্য কোনো ভাষা নয়"। একই সাথে তিনি সতর্ক করে দিয়ে বলেন, "জনগণের মধ্যে যারা ষড়যন্ত্রকারী রয়েছে, তারা পাকিস্তানের শত্রু এবং তাদের কখনোই ক্ষমা করা হবে না"। মুহম্মদ আলী জিন্নাহ'র এ বিরূপ মন্তব্যে তাৎক্ষণিকভাবে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে উপস্থিত ছাত্র-জনতার একাংশ। ২৪শে মার্চ মুহম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে গিয়েও তিনি একই ধরণের বক্তব্য রাখেন। এখানে তিনি উল্লেখ করেন যে, এ আন্দোলন সঙ্কীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গীর বহিঃপ্রকাশ এবং অভিযোগ করেন যে, কিছু লোক এর মাধ্যমে তাদের ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করতে চাইছে। যখন তিনি উর্দুর ব্যাপারে তাঁর অবস্থানের কথা পুনরুল্লেখ করেন, এখানেও উপস্থিত ছাত্ররা সমস্বরে না, না বলে চিৎকার করে ওঠে। একই দিনে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের একটি প্রতিনিধিদল মুহম্মদ আলী জিন্নাহর সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানিয়ে একটি স্মারকলিপি দেন। উল্লেখ্য, জিন্নাহর এই ইচ্ছা শেষ পর্যন্ত পূরণ হয় নি। ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্থান পেয়েছিল বাংলা।

১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দের ২১শে ফেব্রুয়ারিতে বাংলা ভাষার জন্য আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ লাভ করে। এই সূত্রে পূর্ব-পাকিস্তানে বাঙালি জাতীয়তাবাদ চেতনার বিকাশ ঘটে। এর সাথে যুক্ত হয় পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের ভিতর অর্থেনৈতিক বৈষম্য। এর ভিতরে পূর্ব-পাকিস্তানের রাজনৈতিক দলগুলোর ভিতর মেরুকরণ শুরু হয়।
১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দের ২১-২৩ অক্টোবরে ঢাকায় অনুষ্ঠিত দলের তৃতীয় কাউন্সিল অধিবেশনে ধর্মনিরপেক্ষ চর্চা এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যেম 'আওয়ামী মুসলিম লীগ'  সংগঠনটির নাম থেকে 'মুসলিম' শব্দটি বাদ দেওয়া হয় এবং আওয়ামী লীগ নামক রাজনৈতিক দলের যাত্রা শুরু হয়। ১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দের ৫ জুন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান পাকিস্তানের গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। আওয়ামী লীগ উদ্যোগে ১৭ জুন ঢাকার পল্টন ময়দানের জনসভা থেকে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন দাবি করে একুশ দফা ঘোষণা করা হয়।

১৯৬৬ খ্রিষ্টাব্দের ৫ ও ৬ই ফেব্রুয়ারি লাহোরে অনুষ্ঠিত বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর এক সম্মেলনে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ছয় দফা দাবি পেশ করেন। ১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দের  গণঅভ্যুত্থান অনুষ্ঠিত হয়। এই সময়ে শেখ মুজিবুর রহমান এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ-সহ আরও কিছু ছাত্র সংগঠন এক সাথে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে তাদের ঐতিহাসিক এগার দফা কর্মসূচী পেশ করেন। ১৯৬৯

১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা চাপিয়ে আবার শেখ মুজিবর রহমান গ্রেপ্তার করা হয়। আন্দোলনের মুখে এই বৎসরের ২৫শে মার্চ আয়ুব খান পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। পাকিস্তানের প্রেসিডন্ট হন, জেনারেল ইয়াহিয়া খান। ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দের ১১ই নভেম্বর এক প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ে পূর্ব পাকিস্তানের উপকূলীয় অঞ্চলে প্রায় ৫ লাখ লোকের মৃত্যু ঘটে। এ সময় পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার অসহযোগিতা ও ঔদাসীন্য প্রকট হয়ে ওঠে। ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দের সংসদীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করলেও সামরিক সরকার ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহানা করতে থাকে। সামরিক শাসনের মাধ্যমে পূর্ব-পাকিস্তানে হত্যা এবং ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে আন্দোলন প্রতিহত করার উদ্যোগ নেয় পাকিস্তান সরকার। এই ভাবনা থেকে প্রণীত হয় অপারেশন সার্চ লাইট । এই অপারেশনের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী পূর্ব-পাকিস্তানে বাঙালি জাতিসত্তাকে নির্মূল করার উদ্যোগকে বাস্তব রূপ দেয়। পাকিস্তানের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জেনারেল জেনারেল ইয়াহিয়া খান ২৫শে মার্চ গভীর রাতে মুজিবকে গ্রেপ্তার করেন এবং পাকিস্তানী সেনাবাহিনী অপারেশন সার্চলাইটের অংশ হিসাবে বাঙালিদের উপর নির্বিচারে আক্রমণ শুরু করে। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ই মিত্রবাহিনীর (ভারতীয় সেনাবাহিনী ও মুক্তিবাহিনী) কাছে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আত্ম সমর্পণ করলে, পূর্ব-পাকিস্তান আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতা লাভ করে এবং নতুন দেশটির নাম হয় 'বাংলাদেশ

 

পাকিস্তানের রাজনীতি বর্তমানে একটি অর্ধ-রাষ্ট্রপতিশাসিত যুক্তরাষ্ট্রীয় প্রজাতন্ত্র কাঠামোয় সংঘটিত হয়, যদিও অতীতে বিভিন্ন সময়ে সংসদীয় ও রাষ্ট্রপতি শাসিত ব্যবস্থার প্রচলন ছিল। রাষ্ট্রপতি হলেন রাষ্ট্রের প্রধান। সরকারপ্রধান হলেন প্রধানমন্ত্রী। রাষ্ট্রের নির্বাহী ক্ষমতা সরকারের উপর ন্যস্ত। আইন প্রণয়নের ক্ষমতা প্রধানত আইনসভার উপর ন্যস্ত।