চন্দ্রগুপ্তের রাজ্যসীমা

চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য
ভারতের মৌর্য রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা।

চন্দ্রগুপ্তের বংশ পরিচয় নিয়ে মতান্তর আছে। প্রাচীন হিন্দু কিংবদন্তী থেকে জানা যায়, ইনি  নন্দবংশের সন্তান ছিলেন। অন্যমতে তাঁর মাতা (মতান্তরে মাতামহী) ছিলেন মুরা ছিলেন শুদ্রাণী। এই মতে নন্দরাজের উপপত্নী মুরা'র সন্তানের মৌর্য নামে অভিহিত হয়েছে। হিন্দু পুরাণ থেকে এই সাক্ষ্য পাওয়া যায় না। পুরাণে বরং পাওয়া যায়, নন্দবংশের পতনের পর শূদ্র বংশের আরম্ভ হয়েছিল। বৌদ্ধ গ্রন্থাদিতে মৌর্য বংশের রাজাদের ক্ষত্রিয় হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে।

চন্দ্রগুপ্ত আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ৩৪০ অব্দে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার মৃত্যুর পর, তিনি তাঁর মায়ের সাথে পাটালিপুত্রে আসেন। শৈশবে তাঁর মা তাঁর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব দেন এক গো-পালককে। কিন্তু এই গো-পালক চন্দ্রগুপ্তকে এক শিকারীর কাছে বিক্রয় করেন। এই শিকারীটিও তাঁকে গো-চারণে নিযুক্ত করেন। বয়স বাড়ার সাথে সাথে তিনি স্থানীয় রাখাল বালকদের নেতা হয়ে উঠেন। এই সময় তক্ষশীলাবাসী চাণক্য (কৌটিল্য), চন্দ্রগুপ্তের দেহে রাজ-সদৃশ চিহ্ন দেখে শিকারীর কাছ থেকে চন্দ্রগুপ্তকে ক্রয় করেন। এরপর চাণক্য তাঁকে তক্ষশীলায় নিয়ে আসেন। এরপর চাণক্য তাঁকে রাষ্ট্রবিদ্যা এবং সমরবিদ্যায় শিক্ষিত করে তোলেন। এরপর চাণক্য উচ্চাশিক্ষার তাঁকে পাটালিপুত্রে পাঠান। এই সময় পাটালিপুত্রের রাজা ছিলেন নন্দরাজ ধননন্দ।

চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের প্রচলিত রৌপ্য মুদ্রা

নন্দরাজ অত্যন্ত অত্যাচারী রাজা ছিলেন। এই কারণে পাটালিপুত্রের অধিবাসীরা ধননন্দের উপর অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিল। এই সময় আলেকজান্ডার ভারতবর্ষ আক্রমণ করে। মূলত খ্রিষ্টপূর্ব ৩২৭ অব্দে হিন্দুকুশ পর্বত অতিক্রম করে আলেকজান্ডার ভারতের দিকে যাত্রা করেন। খ্রিষ্টপূর্ব ৩২৬ অব্দে আলেকজান্ডার সিন্ধু নদ পার হয়ে তক্ষশিলায় প্রবেশ করেন। চন্দ্রগুপ্ত নন্দরাজকে উৎখাত করার লক্ষ্যে গ্রিকদের সাহায্য পাওয়ার জন্য আলেকজান্ডারের শিবিরে যান। আলেকজান্ডার প্রথমে তাঁর কথা মনোযোগ দিয়ে শোনেন। কিন্তু চন্দ্রগুপ্তের উদ্ধত ব্যবহারের জন্য, তিনি ক্ষুব্ধ হয়ে চন্দ্রগুপ্তের মৃত্যু দণ্ডাদেশ প্রদান করেন। কিন্তু কৌশলে তিনি গ্রিক সৈন্যদের হাত থেকে পালিয়ে বিন্ধ্যাপর্বতের গভীর জঙ্গলে আশ্রয় নেন। এই সময় নন্দরাজ কর্তৃক অপমানিত হয়ে চাণক্য এই বনে আশ্রয় নিয়েছিলেন। এই বনে উভয়ের দেখা হওয়ার পর, উভয়ই নন্দরাজের পতনের লক্ষ্যে একমত হন। প্রাথমিকভাবে সৈন্য সংগ্রহ, প্রশিক্ষণ ইত্যাদি বিষয়ে চাণক্য চন্দ্রগুপ্তকে সাহায্য করেন।

এরপর চন্দ্রগুপ্ত নন্দরাজের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করেন। প্রথম দুটি যুদ্ধে চন্দ্রগুপ্ত পরাজিত হয়ে অরণ্যে আশ্রয় নেন। তৃতীয় বারের যুদ্ধে তিনি নন্দরাজের বিরুদ্ধে জয়লাভ করেন। অনেকে মতে আলেকজান্ডারের ভারত ত্যাগের পর, যে গ্রিক সৈন্যরা ভারতের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল শাসন করছিলেন, তাঁরা চন্দ্রগুপ্তকে এই যুদ্ধে সাহায্য করেছিলেন। কথিত আছে এই যুদ্ধে ১০ হাজার হাতি, ১ লক্ষ অশ্বারোহী এবং ৫ হাজার রথচালক নিহত হয়েছিল। আনুমানিক ৩২৪-৩২৩ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে চন্দ্রগুপ্ত নন্দরাজকে পরাজিত করে রাজত্ব লাভ করেন। মহাবংশ-টীকা গ্রন্থ মতে নন্দরাজ যুদ্ধে নিহত হয়েছিলেন। অন্যমতে চন্দ্রগুপ্ত নন্দরাজকে কিছু সামান্য আসবাবপত্র ও তাঁর পরিবারপরিজনসহ নন্দরাজকে পাটালিপুত্র থেকে বিতারিত করেছিলেন।

তাঁর সিংহাসন লাভের সময় নিয়ে নানা মতভেদ আছে। যে মতগুলো পাওয়া যায় তা হলো

নন্দরাজকে পরাজিত করে তিনি পাঞ্জাব ও গঙ্গা-যমুনা উপত্যাকার অধিকার লাভ করেন। এরপর তিনি উত্তরভারতে গ্রিক সৈন্যদের উৎখাত করার উদ্যোগ নেন। তিনি গ্রিকদের বিরুদ্ধ অভিযান চালিয়ে গ্রিক সেনাপতি সেলিউকসকে পরাজিত করেন এবং আলেকজান্ডারের সাম্রাজ্যের ব্যকট্রিয় থেকে সিন্ধু উপত্যকা পর্যন্ত বিস্তীর্ণ অঞ্চল তাঁর অধিকারে আনতে সক্ষম হন। এরপর তিনি প্রায় ছয় লক্ষ সৈন্য নিয়ে পশ্চিম ভারতের মালব ও সৌরাষ্ট্র দখল করেন। এরপর তিনি দক্ষিণ ভারতে অভিযান চালান। ঠিক কতদূর পর্যন্ত তিনি দক্ষিণ ভারতকে তাঁর রাজ্যভুক্ত করতে সক্ষম হয়েছিলেন, এ নিয়ে মতভেদ আছে।

তাঁর রাজত্বের শেষ দিকে গ্রিক সেনাপতি সেলিউকস আবার ভারত আক্রমণ করেছিলেন। খ্রিষ্টপূর্ব ৩০৫ অব্দের দিকে গ্রিকরা এই অভিযান চালিয়েছিল। এই সময় আদৌও বড় ধরনের কোনো যুদ্ধ হয়েছিল কিনা তা ঐতিহাসিকদের কাছ থেকে জানা যায় না। তবে ছোটোখাটো একটা যুদ্ধ যে হয়েছিল, তা জানা যায় গ্রিক ঐতিহাসিক স্ট্রাবোর বিবরণ থেকে। এই বিবরণে যুদ্ধের বিবরণ নেই, কিন্তু চন্দ্রগুপ্তের সাথে সেলিউকস-এর  মৈত্রী চুক্তি সাক্ষরিত হয়েছিল এটা জানা যায়। এই মৈত্রীচুক্তির সময় সেলিউকস তাঁর কন্যাকে চন্দ্রগুপ্তের বিয়ে দিয়েছিলেন। এই সময় সেলিয়াকাস-এর রাষ্ট্রদূত হিসেবে মেগাস্থিনিস চন্দ্রগুপ্তের দরবারে স্থান পেয়েছিলেন।

সেলিউকসের সাথে বিবাদ মিটে যাওয়ার পরে, চন্দ্রগুপ্ত একে একে পার্শ্ববর্তী অন্যান্য রাজ্য দখল করতে সক্ষম হন। তিনি পারস্য সীমান্ত থেকে দক্ষিণ ভারতের মহীশূর এবং সৌরাষ্ট্র থেকে বঙ্গদেশ পর্যন্ত রাজ্য বিস্তারে সক্ষম হয়েছিলেন।

কিম্বদন্তী আছে তিনি পরিণত বয়সে জৈন ধর্মগ্রহণ করেন। এই ধর্মের অনুশাসন অনুসারে তিনি তাঁর পুত্র বিন্দুসারের কাছে রাজ্য সমর্পণ করেন এবং জৈন সন্ন্যাসী ভদ্রবাহুর সাথে দাক্ষিণাত্য যাত্রা করেন। আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ২৯৮-২৯৫ অব্দের দিকে বর্তমানে‌ কর্ণাটকের শ্রাবণবেলগোলায় স্বেচ্ছায় উপবাসে দেহত্যাগ করেন।

চন্দ্রগুপ্তের স্ত্রীর নাম ছিল দুর্ধরা। এবং একমাত্র পুত্র ছিলেন বিন্দুসার।


সূত্র :
ভারতের ইতিহাস । অতুলচন্দ্র রায়, প্রণবকুমার চট্টোপাধ্যায়।