ব্রিটিশ মিউজিয়ামে রক্ষিত আলেকজান্ডারের মূর্তি |
আলেকজান্ডার
প্রখ্যাত গ্রিক সমরনায়ক। সাধারণভাবে মহামতি আলেকজান্ডার
(Alexander the great)
নামে পরিচিত। গ্রিক শব্দানুসারে আলাকেজান্ডার নামের অর্থ হলো- মানুষের সাহায্যকারী
{গ্রিক αλέξω alexo (প্রতিরক্ষা
করা সাহায্য করা)" + ανήρ aner
(মানুষ)।
খ্রিষ্টপূর্ব ৩৫৬ অব্দে তিনি গ্রিসের মেসেডোনের (Macedon) রাজধানী পেল্লা (Pella) নগরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর জন্ম তারিখ ছিল, প্রাচীন গ্রিক পঞ্জিকার হেকাটোম্বাইয়োন (Hekatombaion) মাসের ষষ্ঠ দিবস। আধুনিক গ্রেগোরিয়ান পঞ্জিকা অনুসারে এই দিনটি ছিল ২০ জুলাই।
ইনি ছিলেন মেসেডোনের রাজা ফিলিপ
(দ্বিতীয়) এবং রাজার চতুর্থ স্ত্রী ওলিম্পিয়াস (Olympias)
-এর পুত্র। উল্লেখ্য রাজা ফিলিপের সাত থেকে আট জন স্ত্রী ছিলেন। এর ভিতরে
ওলিম্পিয়াস ছিলেন প্রধানা রানী।
আলেক্জান্ডারের জন্মের সাথে বেশ কিছু গল্প প্রচলিত আছে। প্লুটার্চ
(Plutarch)-র মতে, ফিলিপের সাথে ওলিম্পিয়াসের বিবাহ সুসম্পন্ন হ্ওয়ার
আগেই, অলিম্পিয়াস স্বপ্নে দেখেন যে, তাঁর গর্ভকে বজ্র আঘাত করেছে এবং এর ফলে একটি
আগুনের শিখা চারিদিক ছড়িয়ে পড়ছে। এর কিছুদিন পর ফিলিপের সাথে বিবাহ হয়।
ফিলিপ স্বপ্নে দেখেন যে, অলিম্পাসের গর্ভকে সিংহ-চিহ্নিত সিল দ্বারা রক্ষিত হচ্ছে।
প্লুটার্চ এই স্বপ্নের ব্যাখ্যা
বলেন যে, অলিম্পিয়াসের বিবাহের
আগেই দেবরাজ
জিউস -এর
দ্বারা গর্ভবতী হয়েছিলেন। আলেক্জান্ডারের জন্মের সময়—
তুরস্কের বন্দর নগরী ইজমির ৫০ কিলোমিটার দক্ষিণে এই এ্যাফেসাস নগরীতে অবস্থিত
আর্তেমিসের মন্দির
আগুনে পুড়ে যায়। সে সময়ের পুরোহিতরা এর
ব্যাখ্যায় বলেন যে, আলেকজান্ডারের জন্মের সময়, আর্তেমিস তাঁর মন্দির রক্ষা
করার বদলে
অলিম্পিয়াসের কাছে ছিলেন।
শৈশবে লানিকে (Lanike) নামক একজন সেবিকার কাছে তিনি প্রতিপালিত হন। এরপর তিনি লেওনিডাস নামক একজন শিক্ষকের কাছে শিক্ষা গ্রহণ করেন। এই সময় লেখাপড়ার পাশাপাশি তিনি বীণা বাজানো, ঘোড়ায় চড়া, যুদ্ধ, শিকার ইত্যাদির চর্চা করেন। আলেকজান্ডারের দশ বৎসর বয়সে একজন ব্যবসায়ী রাজা ফিলিপের কাছে একটি ঘোড়া বিক্রয়ের জন্য নিয়ে আসে। এই ঘোড়াটি এতটা অস্থির ছিল যে, এর ধারে কাছে কেউ যেতে পারছিল না। আলেকজান্ডার এই ঘোড়াটি কেনার জন্য তাঁর পিতার কাছে আবদার করেন। ফিলিপ এই ঘোড়া কেনার বিষয়ে শর্ত দিয়ে বলেন যে, যদি আলেকজান্ডার এই ঘোড়াটাকে বশে আনতে পারে, তবেই তাকে ঘোড়াটাকে কিনে দেবেন। আলেকজান্ডার তাতেই রাজি হন। ইনি লক্ষ্য করে দেখলেন, ঘোড়াটা তার নিজের ছায়া দেখে ভীত হয়ে লাফাচ্ছে। তাই তিনি ঘোড়াটার সূর্যের দিকে মুখ করালেন, যেন সে তার নিজের ছায়ার দিকে লক্ষ্য করতে না পারে। এইভাবে তিনি সহজে ঘোড়াটাকে বশে আনলেন। এরপর ফিলিপ আলেকজান্ডারকে ঘোড়াটি কিনে দিলেন। আলেকজান্ডার পরে ঘোড়াটার নামকরণ করলেন, বুসেফেলাস (যার অর্থ ষাড়ের মাথা)। উল্লেখ্য বুসেফেলাস আলেকজান্ডারের শেষ যুদ্ধে মৃত্যুবরণ করার আগ পর্যন্ত সকল যুদ্ধে আলেকজান্ডারের সাথে ছিল। উল্লেখ্য ভারতের ঝিলম নদীর তীরে আলেকজান্ডার এই ঘোড়াটির নামে বুসেফেলাসের নামক একটি নগর তৈরি করেছিলেন।
আলেকজান্ডারের বয়স যখন ১৩ বৎসর বয়স, তখন
তাঁর পিতা তাঁর জন্য একজন ভালো শিক্ষক খুঁজছিলেন। রাজা ফিলিপ আলেকজান্ডারকে
এ্যারিস্টোটল-এর মিয়েজা (Mieza)
নামক একটি আবাসিক স্কুলে ভর্তি করে দেন। এখানে তিন টলেমি, হেফাইস্টাশান, ক্যাসান্ডার-এর
মতো বেশ কিছু বন্ধু লাভ করেন। এঁরা সবাই
এ্যারিস্টোটল-এর কাছে চিকিৎসাবিজ্ঞান, সাহিত্য,
দর্শন, নীতিশাস্ত্র, ধর্ম, যুক্তিবিদ্যা এবং শিল্পকলা সম্পর্কে বিশেষ শিক্ষা লাভ
করেন।
১৬ বৎসর বয়সে আলেকজান্ডার এ্যারিস্টোটল-এর কাছে তাঁর লেখাপড়া শেষ করেন। এই সময় বাইজান্টাইনদের সাথে যুদ্ধের কারণে ফিলিপ মেসেডোন ত্যাগ করেন। ফলে উত্তরাধিকার সূত্রে মেসেডোনের শাসনভার অর্পিত হয় আলেকজান্ডারের উপর। একই সময় থ্রেসিয়ান মিডি উপজাতির লোকেরা মেসেডোনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘো্ষণা করে। আলেকজান্ডার দ্রুত এই বিদ্রোহ দমন করেন। এরপর ইনি মিডিদের এলাকাকে গ্রিকের উপনিবেশে পরিণত করেন। এরপর খ্রিষ্টপূর্ব ৩৪০ অব্দে থ্রেসিয়ানে একটি নগর স্থাপন করেন। এই নগরীর নাম করেন আলেকজান্ড্রোপোলিস (Alexandropolis)।
এরাজা ফিলিপ ফিরে আসার পর, তিনি দক্ষিণ থ্রেসের বিদ্রোহ দমনের জন্য ছোট একটি সেনাদলসহ আলেকজান্ডারকে পাঠান। আলেকজান্ডার থ্রেস দখল করার পর, ইল্লিয়ার দখল করেন। খ্রিষ্টপূর্ব ৩৩৮ অব্দে ফিলিপ এবং আলেকজান্ডার সম্মিলিতভাবে থের্মোপাইলি দখল করে। এরপর এঁরা এলাটেয়া (Elatea) দখল করার উদ্দেশ্যে রওনা হন। এই সময় এথেন্স এবং থিবিস মেসেডোনিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। গ্রিসের বোয়েসিয়া (Boeotia) অঞ্চলের ক্যারোনিয়া (Chaeronea) শহরের নিকটে এথেন্স এবং থিবিস-এর যৌথবাহিনী অবরোধ করে। ফিলিপ ডান প্রান্ত দিয়ে আক্রমণ করেন, পক্ষান্তরে আলেকজান্ডার বাম প্রান্ত দিয়ে আক্রমণ করেন। আলেকজান্ডার থিবিয়ানদের পরাজিত করেন। এরপর ফিলিপও এথেন্স-বাহিনীকে পরাজিত করেন। এই জয়ের পর এঁরা বিনা বাধায় পেলোপোনিজ-এ প্রবেশ করেন। এরপর এদের যৌথ বাহিনী স্পার্টা (Sparta) নগরীতে প্রবেশ করে। এই নগরীর লোকেরা এঁদেরকে ভালোভাবে গ্রহণ করে নি, কিন্তু এঁদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণাও করে নি। কোরিন্থ নগরে রাজা ফিলিপ একটি সমন্বিত গ্রিক বাহিনী প্রতিষ্ঠা করেন। এই বাহিনী Hellenic Alliance নামে চিহ্নিত হয়ে থাকে। এই বাহিনীতে স্পার্টা ছাড়া সকল নগর-রাষ্ট্র যোগদান করেছিল। এই সময় ফিলিপ Hegemon (সর্বাধিনায়ক) হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর তিনি পারশ্য আক্রমণের ঘোষণা দেন।
খ্রিস্টপূর্ব ৩৩৭ বা ৩৩৮ অব্দে ফিলিপ মেসিডোনিয়ান ক্লিওপেট্রা ইউরিদাইস (Cleopatra
Eurydice)-কে তার পঞ্চম স্ত্রী হিসেবে
গ্রহণ করেন। আলেকজান্ডারের মা অলিম্পাস ছিলেন পশ্চিম গ্রিক উপত্যকার ইপিরাস-এর
অধিবাসী। এই অর্থে ইপিরাস মেসিডোনিয়ার অংশ ছিল না, অপরদিকে ক্লিওপেট্রা ছিলেন পুরোপুরি
মেসিডোনের অধিবাসী। এই বিচারে ক্লিওপেট্রার সন্তানদের রাজ্যে পূর্ণ অধিকার থাকবে
এবং আলেকজান্ডারের অধিকার থাকবে তার অর্ধেক। প্লুটার্কের মতে—ক্লিওপেট্রার চাচা
এ্যাট্টালাস (Attalus) ফিলিপ-ক্লিওপেট্রার বিয়ের
ভোজ-সভায় ঘোষণা দেন, এই ভোজ-অনুষ্ঠানই নির্দেশ করবে ভবিষ্যত মেসিডোনিয়ার শাসক কে
হবে। আলেকজান্ডার ক্ষিপ্ত হয়ে তাঁর পানপাত্র এ্যাট্টালাসের মাথায় নিক্ষেপ দিকে ধরে চিৎকার করে বলেন, "তুমি
খলনায়ক, তবে আমি
কি, জারজ সন্তান?" এই সময় ফিলিপ এ্যাট্টালাসের পক্ষ নিয়ে আলেকজান্ডারের দিকে ধেয়ে
যাবার চেষ্টা করেন। কিন্তু নেশার ঘোরে পা পিছলে মেঝেতে পরে যান। এরপর অপমানিতচিত্তে আলেকজান্ডার
চিৎকার করে বলেন, "এখানে একব্যক্তি (আলেকজান্ডার স্বয়ং) গ্রিস থেকে এশিয়া জয় করার
পরিকল্পনা করছে, তার এই ইচ্ছার আসন থেকে সরানো যাবে না "।
এরপর
আলেকজান্ডার, তাঁর মা অলিম্পাসকে সাথে নিয়ে ইপিরাসে চলে যান। উল্লেখ্য ইপিরাসের
রাজা আলেকজান্ডার প্রথম (Alexander
I) ছিলেন তাঁর
মামা। এই সময় আলেকজান্ডারের বোন ক্লিওপেট্রা পেল্লাতেই থেকে যান। এই অবস্থায় ফিলিপ
'আলেকজান্ডার প্রথম'-এর সাথে জোট বাধার জন্য, তাঁর কন্যা ক্লিওপেট্রাকে 'আলেকজান্ডার
প্রথম-এর (ক্লিওপেট্রার মামা) সাথে বিবাহ দেওয়ার সিদ্ধান্ত জানান। ফলে
আলেকজাণ্ডারের মা অলিম্পাস যখন 'আলেকজান্ডার প্রথম'কে ফিলিপের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা
করার কথা বলেন। তখন 'আলেকজান্ডার প্রথম' এই যুদ্ধে রাজি হলেন না।
খ্রিষ্টপূর্ব ৩৩৬ অব্দে 'আলেকজান্ডার প্রথম'-এর সাথে ফিলিপের মেয়ে
ক্লিওপেট্রার বিবাহের সময়, ফিলিপের দেহরক্ষী পাউসানিয়াস(Pausanias)
তাঁকে হত্যা করে। ধারণা করা হয়, ফিলিপের খুনের পরিকল্পনাকারী
ছিলেন আলেকজান্ডার অথবা অলিম্পাস অথবা উভয়ই।
কিন্তু ফিলিপের মৃত্যুর পরপরই আলেকজান্ডারে বন্ধুরা পাউসানিয়াস-কে হত্যা করেন। ফলে
এই হত্যাকাণ্ডের সাথে কারা জড়িত ছিল, তা জানা যায় নি।
ফিলিপের মৃত্যুর পর মেসেডোনিয়ার অভিজাত সমাজ এবং সেনাবাহিনী আলেকজান্ডারকে মেসিডোনিয়ার রাজা হিসেবে ঘোষণা দেয়। খ্রিষ্টপূর্ব ৩৩৬ অব্দের অক্টোবর মাসে আলেকজান্ডার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। ক্ষমতা গ্রহণের পর প্রথমে তিনি তাঁর নিকট আত্মীয় লাইনেস্টিস (Lyncestis)-এর দুই রাজপুত্র Heromenes এবং Arrhabaeus-কে রাজা ফিলিপের হত্যাকারী সন্দেহে মৃত্যদণ্ড দেন। এঁদের অপর ভাই Alexander Lyncestes আলেকজান্ডরকে রাজা হিসাবে মেনে নেওয়ার কারণে, তাঁকে ক্ষমা করে দেওয়া হয়। ক্লিওপেট্রা ইউরিডাইস, তাঁর কন্যা ইউরোপা এবং এ্যাট্টালাসকে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়। কথিত আছে, আলেকজান্ডারের রাজত্বকে নিষ্কণ্টক করার জন্য রানী অলিম্পাসের আদেশে এই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছিল।
ফিলিপের মৃত্যু এবং তরুণ আলেকজান্ডার ক্ষমতা গ্রহণের সংবাদ প্রচার হওয়ার পরপরই অনেক রাষ্ট্র স্বাধীনতা ঘোষণা করে। এর ভিতরে উল্লেখযোগ্য রাষ্ট্রগুলো ছিল থিবিস, এথেন্স, থেস্যালি উত্তর মেসিডোনের থ্রসিয়ান গোত্রসমূহ।
বিদ্রোহী থেস্যালিয়ান (Thessalian) বাহিনী অলিম্পাস এবং ওস্সা পর্বতের মধ্যবর্তী গিরিপথ দখল করে নেয়। আলেকজান্ডরের সৈন্যরা ওস্স্যা রাতের অন্ধকারে পর্বতের উপরে উঠে থেস্যালিয়ান সৈন্যদের ঘিরে ফেলে। সকালে থেস্যালিয়ান সেনাপতি আলেকজান্ডারের সৈন্যদের দ্বারা বেষ্টিত হয়ে আত্মসমর্পণ করে। এরপর আলেকজান্ডার দ্রুত অধিকৃত সেনা-সরঞ্জাম তাঁর বাহিনীর সাথে যুক্ত করে পেলোপোন্নেসে-এর (Peloponnese)-পথে রওনা দেন।
খ্রিস্টপূর্ব ৩৩৫ অব্দের ভিতরেই আলেকজান্ডার মেসিডোনিয়ার উত্তর সিমান্তের
ডানবির নিরাপত্তা নিশ্চিত করেন। থিবস্ সর্বশক্তি দিয়ে আলেকজান্ডারের প্রতিরোধ করেও
জয়ী হতে পারে নি। থিবস জয়ের পর আলেকজান্ডার থিবস্ নগরীকে ধ্বংস করে
দেন এবং এর অঞ্চলসমূহ বিওশিয়ান নগরগুলির ভিতর ভাগ করে দেন। নগরীর সকল নাগরিককে
দাস হিসেবে বিক্রি করে দেওয়া হয়। শুধুমাত্র পুরোহিত, মেসিডোনিয়ার আগের নেতারা ও
পিন্দারের বংশধরদের মুক্তি দেওয়া হয়। শুধুমাত্র পিন্দারের বাড়িটিই অভিযানের পর
দণ্ডায়মান ছিল। থিবসের পরিণতি দেখে এথেন্স আত্মসমর্পণ করে।
খ্রিস্টপূর্ব ৩৩৪ অব্দে প্রায় ৪৮,০০০ পদাতিক, ৬০,০০০ অশ্বারোহী সৈন্যের নিয়ে
হেলিস্পন্ট (Hellespont)
অতিক্রম করেন। এছাড়া তাঁর সাথে ১২০টি যুদ্ধজাহাজের একটি বহর। এই বহরে নৌসৈন্য ছিল
প্রায় ৩৮,০০০। এই বাহিনীর বেশির ভাগ সৈন্য ছিল মেসিডোন এবং
গ্রিসের। তাছাড়াও কিছু থ্রাসিয়ান, পাইওনিয়ান এবং ইলিরিয়ান সৈন্য এই বাহিনীতে ছিল।
খ্রিষ্টপূর্ব ৩৩৪ অব্দে গ্রানিকাসে (Granicus)-এ পারস্যবাহিনীর সাথে আলেকজান্ডারের মোট তিনবার যুদ্ধ হয়। প্রতিটি যুদ্ধেই তিনি জয়লাভ করেন। এরপর আলেকজান্ডার পারস্যের প্রাদেশিক রাজধানী সার্দিস (Sardis) দখল করেন। এই নগরী অধিকারের ফলে সার্দিসের অর্থভাণ্ডার তাঁর দখলে আসে। এরপর তিনি আইওনিয়া (Ionian) উপকুল ধরে এগিয়ে যান। হেলিকারনাস-এ আলেকজান্ডার সফলভাবে যুদ্ধের দ্বারা বিভিন্ন বাধা অতিক্রম করেন। তার বিপক্ষের রোডস্-এর মেমন (Memnon) এবং কারিয়ার পারস্যিয়ান সাত্রাপ (Persian satrap of Caria) সমুদ্র পথে পালিয়ে যায়। আলেকজান্ডার কারিয়ার (Caria) শাসন ভার এডার (Ada) কাছে ছেড়ে দেন। পরে অবশ্য এডাকে তার ভাই পিক্সোদারাস ক্ষমতাচ্যুত করেছিলেন।
হেলিকারনাসাস্ থেকে আলেকজান্ডার পাহাড়ি লিসিয়া (Lycia) এবং প্যামফিলিয়ান (Pamphylian) সমতল ভূমি বরাবর অভিযান পরিচালনা করেন। এই সময় তিনি পথে সকল উপকূলীয় শহর দখল করেন। প্যামফিলিয়া থেকে সামনে আর কোন গুরুত্বপূর্ণ স্থান না থাকায় আলেকজান্ডার উপকূল ছেড়ে মূল ভূখণ্ডের দিকে অভিযান শুরু করেন। এই পথে টারমেসাসে (Termessos) আলেকজান্ডার পিসিডিয়ান (Pisidian) নগরী দখল করেন।
এরপর প্রাচীন ফ্রিজিয়ান (Phrygian) রাজ্যের রাজধানী গোড়ডিয়ামে পৌঁছলে সেখানে তাকে জানানো হয় যে, সেখানে অ্যাপোলোর মন্দিরে একটি দড়ির জট (Gordian Knot) রাখা আছে। কথিত আছে এই জট খুলতে পারবে 'এশিয়ার রাজা' সে হবে। মন্দিরের পুরোহিতদের এই কথা শোনার পর, আলেকজান্ডার তলোয়ার দিয়ে জটটি কেটে ফেলেন। অন্য মতে তিনি কৌশলে জটটি খুলতে পেরেছিলেন।
শীতকাল শেষ হলে, খ্রিষ্টপূর্ব ৩৩৩ অব্দে আলেকজান্ডার তাঁর সেনাবাহিনী নিয়ে সিসিলিয়ান দরজা পার হন। এরপর তিনি পারস্য সম্রাট তৃতীয় দারিয়ুসের মূল সেনাবাহিনীর মুখোমুখী হন। এই যুদ্ধটি ইসাস-এর যুদ্ধ (Battle of Issus) নামে পরিচিত। এই যুদ্ধ স্বয়ং দারিয়ুসের তাঁর সৈন্যবাহিনী পরিচালনা করেছিলেন। খ্রিষ্টপূর্ব ৩৩৩ অব্দের নভেম্বর মাসে এই যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এই যুদ্ধে পারস্য সম্রাট তৃতীয় দারিয়ুস পরাজিত হন এবং যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে যান। এই সময় দারিয়ুস তাঁর স্ত্রী, দুই কন্যা, তাঁর মা সিসিগাম্বিস্ এবং তার ব্যক্তিগত সম্পদের বেশির ভাগ ফেলে যান। দারিয়ুস ভূ-মধ্যসাগরের উপকুল ধরে টায়ার এবং গাজা অঞ্চলে চলে যান। এদিকে আলেকজান্ডার জেরুজালেমের নিকটবর্তী জুডিয়া দিয়ে এগিয়ে যান। তবে আলেকজান্ডার জেরুজালেমে প্রবেশ করেন নাই। পরে দারিয়ুস আলেকজান্ডারের কাছে, তাঁর পরিবারের সদস্যদের জন্য ১০,০০০ ট্যালেন্ট (স্বর্ণমুদ্রা) মুক্তিপণ দেওয়ার প্রস্তাব করেন। একই সাথে তিনি তাঁর হারানো রাজ্যের জন্য একটি চুক্তি করার প্রস্তাব পাঠান। আলেকজান্ডার সংক্ষিপ্ত দারিয়ুসকে উত্তরে জানান যে, 'তিনি বর্তমানে এশিয়ার একক রাজা, তাই রাজ্য ভাগাভাগির বিষয়টি কে সিদ্ধান্ত দেবে?'।
এরপর আলেকজান্ডার সিরিয়া দখল করেন এবং ভূমধ্যসাগরীয় উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে আধিপত্য বিস্তারে সক্ষম হন। খ্রিষ্টপূর্ব ৩৩৩ অব্দে আলেকজান্ডার টায়ার (Tyre) আক্রমণ করেন। একটি দীর্ঘকালীন যুদ্ধের শেষ তিনি টায়ার অধিকার করেন। তিনি যুদ্ধ করার উপযুক্ত সকল পুরুষদের হত্যা করেন এবং নারী ও শিশুদের দাস হিসাবে বিক্রয় করে দেন। এরপর আলেকজান্ডার দ্রুত মিশরের অন্যান্য নগরগুলো দখল করে নেন। তবে গাজা অঞ্চলে প্রচুর দুর্গ থাকায়, তিনি প্রথমে এই এলাকা দখলের চেষ্টা করেন নি। ছোটো ছোটো শহরগুলো দখল করার পর, তিনি গাজা দখলের জন্য আক্রমণ চালান। তিনি পর পর তিনবার গাজা দখলের চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। এই সময় তিনি কাঁধে মারত্মক আঘাত পান। চতুর্থবারে তিনি গাজা দখল করতে সমর্থ হন। এখানেও তিনি টায়ারের মতো— যুদ্ধ করার উপযুক্ত সকল পুরুষদের হত্যা করেন এবং নারী ও শিশুদের দাস হিসাবে বিক্রয় করে দেন।
এরপর তিনি জেরুজালেমে অভিযান পরিচালনা করেন। মূলত জেরুজালেমে আলেকজান্ডারকে কোনো যুদ্ধ করতে হয় নি। টায়ার এবং গাজার পরিণতি দেখে জেরুজালেমের অধিপতি আত্মসমর্পণ করেন। এখানে তিনি একটি ভবিষ্যৎবাণীর বইতে দেখেন যে, কোনো এক গ্রিক বীর পারশ্যের রাজাকে পরাজিত করে জেরুজালেম দখল করবেন এবং মিশরের দিকে যাত্রা করবেন।
খ্রিষ্টপূর্ব ৩৩২ অব্দে আলেকজান্ডার মিশরের দিকে অগ্রসর হন। যুদ্ধের পরিবর্তে মিশরবাসীরা আলেকজান্ডারকে মিশরে মুক্তিদাতা হিসেবে স্বাগতম জানায়। সে সময় লিবিয়ান মরুভূমির সিউয়া (Siwa) উপত্যাকার অধিবাসীরা মিশরে প্রধান দেবতা আমুনের পুজারী ছিলেন। আমুনের পুরোহিতরা আলেকজান্ডারকে আমুনের পুত্র হিসাবে স্বীকৃতি দেন এবং নব্য পৃথিবীর প্রভু হিসাবে ঘোষণা দেন। উল্লেখ্য গ্রিসে আলেকজান্ডারকে জিউস-এর পুত্র হিসাবে মান্য করা হতো। কথিত আছে, আলেকজান্ডার নিজেই জিউসকে তাঁর পিতা বলে স্বীকার করে নিয়েছিলেন। উল্লেখ্য সেই সময়ের মুদ্রায় আলেকজান্ডারের প্রতিচ্ছবিতে তাঁর মাথায় ভেড়ার শিং থাকত।
আলেকজান্ডার মিশরে আলেকজান্দ্রিয়া প্রতিষ্ঠা করেন। আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর এই আলেকজান্দ্রিয়া মিশরে টলেমী শাসকদের রাজধানীতে পরিণত হয়েছিল। মিশর জয়ের পর আলেকজান্ডার আরো পূর্বে আসরিয়ার (বর্তমানে উত্তর ইরাক) দিকে অভিযান পরিচালনা করেন। সেখানে দারিয়ুস এর নেতৃত্বে গৌগামেলার (Battle of Gaugamela) যুদ্ধে— আলেকজান্ডার পারস্য সম্রাট তৃতীয় দারিয়ুসের সেনাবাহিনীকে পরাজিত করেন। যুদ্ধে দারিয়ুসের রথের সারথীর মৃত্যুবরণ করলে দারিয়ুস আবার পালাতে থাকেন এবং আলেকজান্ডার তাকে আরবেলা পর্যন্ত ধাওয়া করেন। দারিয়ুস ইকবাটানা পাহাড়ে আশ্রয় নিলে আলেকজান্ডার ব্যাবিলনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন।
খ্রিষ্টপূর্ব ৩৩১ অব্দে গ্রিক আলেকজান্ডার মিশরের প্রাচীন রাকোটিশ (Rhacotis) নগরীকে ঢেলে সাজান। আলেকজান্ডারের নামানুসারে এই নাগরীর নামকরণ করা হয় আলেকজান্দ্রিয়া । আলেকজান্ডার-এর প্রধান স্থপতি ডাইনোক্র্যাটেস (Dinocrates)-এর উপর এই নগর নির্মাণের দায়িত্ব দেওয়া হয়। মূলত আলেকজান্ডার মিশরের নাউক্রেটিস (Naucratis) নগরীরর উপর আধিপত্য বিস্তারের জন্য এবং গ্রিস নীল-উপত্যাকার মধ্যে যোগাযোগ স্থাপনের জন্য এই নগরী স্থাপন করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। এই ভিত্তি স্থাপন করে আলেকজান্ডার মিশর ত্যাগ করেন। এরপরে তিনি আর মিশরে ফিরে আসেন নি।
খ্রিষ্টপূর্ব ৩৩১ অব্দে মিশর ত্যাগ করে তিনি ম্যাসেপটেমিয়ার দিকে অগ্রসর হন। পথে গুয়াগামেলা নামক স্থানে দারিয়ুসের সাথে আলেকজান্ডারের বাহিনীর দেখা হয়। গুয়াগামেলার যুদ্ধে ( Battle of Gaugamela) দারিয়ুস পরাজিত হয়ে একবাটানা (Ecbatana, বর্তমানে এর নাম হামেডান (Hamedan)) পার্বত্য এলাকায় পালিয়ে যান। এরপর আলেকজান্ডার ব্যবিলন দখল করেন।
ব্যববিলন থেকে আলেকজান্ডার অ্যাকামেনিড-এর একটি প্রাদেশিক রাজধানী সুসা (Susa) দখল করেন এবং এই নগরীর কিম্বদন্তীতুল্য রাজকীয় কোষাগার দখল করেন। এরপর তিনি তাঁর সেনাবাহিনীর একটি বড় অংশ রয়েল রোড হয়ে পারস্যের রাজধানী পার্সেপলিস্-এর দিকে পাঠিয়ে দেন। অন্যদিকে, নিজে সরাসরি পারস্যের দিকে অগ্রসর হন। অত্যন্ত দ্রুততার সাথে তিনি পারশ্যের দরজা নামে খ্যাত জাগরস্ পর্বত (Zagros Mountains) দখল করেন। এখানে আরিওবার্জানেস (Ariobarzanes) -এর পরিচালিত পারস্যের সেনাবাহিনী'র বাধার সম্মুখীন হন। এই যুদ্ধে পারশ্য সৈন্যকে পরাজিত করে পার্সেপলিস্ (Persepolis) দখল করেন। এখানকারএর রাজকোষ লুট হবার আগেই সেখান থেকে চলে যান। পরে অবশ্য আলেকজান্ডার সেনাবাহিনী মনের সুখে পার্সেপলিস্ লুট করে। এই সময় পার্সেপলিসের পূর্ব দিকের প্রাসাদ জেরেসেক্স (Xerxex) আগুনে লাগে এবং একসময় তা পুরো শহরকে ভষ্মীভূত করেছিল।
এই সময় দারিয়ুস পারশ্যের
সিংহাসনে বসার উপযুক্ত দারিয়ুস বিকল্প ব্যক্তির সন্ধান করতে থাকেন। এদিকে, দারিয়ুস
অপহৃত হন। তাঁর ব্যাক্ট্রিয়ার গভর্নর, বেসাস্ ও এক পুরুষ আত্মীয়ের সহকারীরা তাঁকে হত্যা
করে। বেসাস্ নিজেকে দারিয়ুসের উত্তরাধিকারী ঘোষণা করে এবং আলেকজান্ডারের বিরুদ্ধে
গেরিলা যুদ্ধের পরিকল্পনা করে মধ্য এশিয়ার দিকে হটতে থাকেন। দারিয়ুসের মৃত্যুর পর
আলেকজান্ডার প্রতিশোধের এই যুদ্ধের ইতি ঘোষণা করেন এবং গ্রিক ও অন্যান্য মিত্রদেরকে
লীগ অফ করিন্থ হতে মুক্ত করে দেন। তবে, যারা স্বেচ্ছায় তার সাথে যুদ্ধে অংশগ্রহণে
উৎসাহী ছিল তিনি তাদের সেনাবাহিনীতে গ্রহণ করেন।
আলেকজান্ডার প্রায় তিন বছর প্রথমে বাসাস্ এবং পরে সোগডিয়ানা, স্পিটামেনস্-এর
গভর্নরদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেন। এই অভিযান চালাতে গিয়ে আলেকজান্ডার
মিডিয়া, পার্থিয়া, আরিয়া, ড্রাজিয়ানা, আর্কোশিয়া, ব্যাক্ট্রিয়া এবং সিথিয়া
জয় করেন। তিনি আফগানিস্থানের হেরাত এবং সমরখন্দ দখল করেন। আলেকজান্ডার অনেকগুলো
নতুন আলেকজান্ড্রিয়া প্রতিষ্ঠা করেন। এগুলোর মধ্যে আছে আধুনিক কালের আফগানিস্তানের
কান্দাহার এবং আলেকজান্ড্রিয়া ইসচেট (বর্তমানে তাজাকিস্তানে)।
বেসাস (Bessus) খ্রিষ্টপূর্ব ৩২৯ অব্দে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। পরে আলেকজান্ডারের একজন বিশ্বস্ত সেনাপতি টলেমি এই বিদ্রোহ দমন করেন। খ্রিষ্টপূর্ব ৩২৮ অব্দে স্পিটামেনস্ (Spitamenes) বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। আলেকজান্ডার স্বয়ং এর বিরুদ্ধে সৈন্য পরিচালনা করেন এবং গাবাই যুদ্ধে (Battle of Gabai) স্পিটামেনস্ পরাজিত হন। পরে অবশ্য স্পিটামেনস্ তাঁর নিজের লোকের হাতেই নিহত হন।
পারশ্য দখল করার পর আলেকজান্ডার পারশ্য সংস্কৃতি দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত হন। প্রথম তিনি পারশ্য রাজ উপাধি শাহানশাহ ব্যবহার করা শুরু করেন। এছাড়া পোশাক-পরিচ্ছদে পারশ্য ধারার উপকরণ যুক্ত করেন। অধ্বস্তনরা হাঁটু মুড়ে তাঁর সামনে বসে হাতে চুম্বন করে আনুগত্য প্রকাশ করতো।
স্পিটামেনস্-এর মৃত্যুর পর, আলেকজান্ডার ভারত অভিযানে মনস্থির করেন। তিনি খ্রিষ্টপূর্ব ৩২৭ অব্দে হিন্দুকুশ পর্বত অতিক্রম করে ভারতের দিকে যাত্রা করেন। কাবুলের নিকবর্তী কয়েকটি স্থানে তিনি সৈন্যশিবির স্থাপন করে স্থানীয় রাজন্যবর্গের প্রতি আত্মসমর্পণের আহ্বান জানান। তক্ষশীলার রাজা অম্ভি আলাকজান্ডারকে জানান যে, যদি আলেকজান্ডার তাঁর রাজ্য আক্রমণ না করেন, তবে তিনি আলাকজান্ডারকে ভারত প্রবেশে সাহায্য করবেন। এই সময় আলেকজান্ডার কোফিউস, শশীগুপ্ত সঞ্জয় প্রমুখ স্থানীয় রাজাদের কাছ থেকেও সাহায্য পেয়েছিলেন।
এরপর কাবুল উপত্যাকা দিয়ে আলেকজান্ডার অগ্রসর হলে পুষ্কলাবতীর রাজা অষ্টক বাধা দেন। যুদ্ধে অষ্টক পরাজিত ও নিহত হলে, আলকজান্ডার পূর্ব দিকে অগ্রসর হতে থাকেন। এই সময় অষ্টক জাতির লোকেরা আলাকজান্ডারের বাহিনীকে প্রাণপণে বাধা দেন। যুদ্ধে আলেকজান্ডারের বাহিনী ব্যাপক হত্যাকাণ্ড চালায় এবং প্রায় ৪০,০০০ সাধারণ মানুষকে বন্দী করে। পুষ্কলাবতী জয় করার পর, বিনা যুদ্ধে আলেকজান্ডার তক্ষশিলায় প্রবেশ করেন। খ্রিষ্টপূর্ব ৩২৬ অব্দে আলেকজান্ডার সিন্ধু নদ পার হয়ে তক্ষশিলায় প্রবেশ করেন।
তক্ষশিলার রাজা অম্ভি আলেকজান্ডারের কাছে বশ্যতা স্বীকার করে তক্ষশিলায় অভ্যর্থনা করেন। এরপর অভিসার জাতির নেতাও বশ্যতা স্বীকার করে। এই সময় চন্দ্রগুপ্ত নন্দরাজকে উৎখাত করার লক্ষ্যে গ্রিকদের সাহায্য পাওয়ার জন্য আলেকজান্ডারের শিবিরে যান। আলেকজান্ডার প্রথমে তাঁর কথা মনোযোগ দিয়ে শোনেন। কিন্তু চন্দ্রগুপ্ত উদ্ধত ব্যবহারের জন্য, তিনি ক্ষুব্ধ হয়ে চন্দ্রগুপ্তের মৃত্যু দণ্ডাদেশ প্রদান করেন। কিন্তু কৌশলে তিনি গ্রিক সৈন্যদের হাত থেকে পালিয়ে বিন্ধ্যাপর্বতের গভীর জঙ্গলে আশ্রয় নেন।
এরপর আলেকজান্ডার তক্ষশিলা থেকে পূর্বদিকে অগ্রসর হয়ে ঝিলম নদীর তীরে পৌঁছায়। প্রথমে আলেকজান্ডার পুরুকে বশ্যতা স্বীকারের জন্য অনুরোধ করলে, পুরু যুদ্ধ করার সংকল্প নেন। ঝিলম নদীর তীরে উভয় সেনাবহিনী মুখোমুখী হয়। এই সময় পুরুর সেনাবাইনীতে ছিল ৩০ হাজার পদাতিক, ৪ হাজার অশ্বারোহী. ৩ শত যুদ্ধরথ এবং ২ শত হাতি। যুদ্ধে পুরু পরাজিত হন। তবে যুদ্ধে পুরুর অসীম সাহসিকতায় মুগ্ধ হয়ে, আলেকজান্ডার পুরুকে তাঁর রাজ্য ফিরিয়ে দেন। এই সময় ঝিলম নদীর তীরে তিনি দুটি নগর পত্তন করেন। এই নগর দুটি হলো বুসেফেলা ( Bucephala) ও নিকয়া (Nicaea)।
এরপর আলেকজান্ডার পুরুর রাজ্যের পূর্ব দিকের আরও কয়েকটি রাজ্য জয় করেন এবং বিপাশা নদীরে তীরে এসে আস্তান গাড়েন। এরপর আলেকজান্ডারের সৈন্যরা আর পূর্বদিকে অগ্রসর হতে রাজি হন নি। এর পিছনে ঐতিহাসিকরা যে কারণগুলো উল্লেখ করেন তা হলো—
দীর্ঘকাল ধরে যুদ্ধের কারণে সৈন্যরা ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। এছাড়া দীর্ঘদিন ধরে পরিবার-পরিজন থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার কারণে সৈন্যরা গৃহকাতরতায় ভুগছিল।
পুরুর এবং অন্যান্য ছোটো
ছোটো রাজন্যবর্গের সৈন্যদের সাথে যুদ্ধ করতে গিয়ে আলাকজান্ডারের বিপুল সৈন্য
হতাহত হয়েছিল। সৈন্যরা মনে করেছিল, পূব-দিকের বড় রাজ্যগুলোর সাথে যুদ্ধে তাদের
পরাজয় হবে। বিশেষ করে বঙ্গদেশের
গঙ্গারিডাই রাজ্যের শক্তিশালী
সেনাবাহিনী সম্পর্কে অবগত হওয়ার পর আলেকজান্ডারের সৈন্যরা অগ্রসর হতে রাজি হয়
নি।
গঙ্গারিডাই রাজ্য সম্পর্কে ভীত হওয়ার পিছনে যে ঐতিহাসিক তথ্য কাজ করেছিল,
তা হলো—
মেগাস্থিনিস (৩৫০-২৯০ খ্রিষ্ট-পূর্বাব্দ ) আলেকজান্ডারের সেনাপতি ও বন্ধু
সেলুকাসের রাজত্বকালে গ্রিক দূত হিসাবে ভারতে এসেছিলেন। তাঁর মতে—
'গঙ্গারিডাই
রাজ্যের বিশাল হস্তী-বাহিনী ছিল। এই বাহিনীর জন্যই এ রাজ্য কখনই বিদেশী রাজ্যের
কাছে পরাজিত হয় নাই। অন্য রাজ্যগুলি হস্তী-বাহিনীর সংখ্যা এবং শক্তি নিয়ে
আতংকগ্রস্ত থাকিত'।
'ভারতের সমূদয় জাতির মধ্যে গঙ্গারিডাই সর্বশ্রেষ্ঠ। এই গঙ্গারিডাই রাজার সুসজ্জিত
ও যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত চার হাজার হস্তী-বাহিনীর কথা জানিতে পারিয়া আলেকজান্ডার
তাহার বিরূদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হইলেন না' - ডিওডোরাস (৯০-৩০খ্রিষ্ট-পূর্বাব্দ)
ডিওডোরাস ও ক্যুইন্টাস কার্টিয়াস রুফাস উভয়েই উল্লেখ করেছেন নন্দরাজের সেনাবাহিনীতে পদাতিক সৈন্য ২ লক্ষ, অশ্বারোহী সৈন্য ২০ হাজার, রথ ২ হাজার, এবং
তিন থেকে চার হাজার হাতি ছিল।
ধ্রুপদী গ্রিক ও ল্যাটিন বর্ণনায় রাজার নাম আগ্রাম্মেস। তিনি ছিলেন নীচকূলোদ্ভব
নাপিতের পূত্র। হিন্দু পুরাণে তিনি মহাপদ্মনন্দন এবং বৌদ্ধ শাস্ত্র মাহাবোধিবংশে
উগ্রসেন, অর্থ এমন এক ব্যক্তি যাঁর 'প্রকাণ্ড ও পরাক্রান্ত সেনাবাহিনী' আছে।
হেমচন্দ্রের পরিশিষ্টপর্ব নামক জৈন গ্রন্থেও মহাপদ্মনন্দকে বলা হয়েছে নাপিত কুমার।
পুরাণে বলা হয়েছে শূদ্রোগর্ভোদ্ভব। আরও বলা হয়েছে, 'সর্বক্ষত্রান্তক নৃপঃ' অর্থাৎ
সকল ক্ষত্রিয়কে নিধন করে সিংহাসনে বসেছিল।
আলেকজান্ডার ভারতের পূর্ব-দিকের অভিযান ত্যাগ করেন। তিনি ঝিলম ও বিপাশা নদীর মধ্যাভাগের অঞ্চল পুরুকে এবং সিন্ধু ঝিলম নদীর মধ্যভাগের অঞ্চল অম্ভির কাছে ছেড়ে দেন এবং আলেকজান্ডার পারশ্যে ফিরে যাওয়ার উদ্যোগ নেন। তিনি সেনাবাহিনীর একটি অংশকে সাগর পথে পারশ্যে প্রেরণ করেন। সেনাবাহিনীর অপরাংশ নিয়ে তিনি পাঞ্জাব ও বেলুস্তিতানের মধ্য দিয়ে পারস্যের দিকে রওনা হন। পথে তিনি কিছু কিছু ক্ষুদ্র জাতির দ্বারা আক্রান্ত হলে, সবাইকে পরাজিত করে পারশ্যের পথে অগ্রসর হন।
খ্রিষ্টপূর্ব ৩২৪ অব্দে
তিনি পারস্যের সুসা নগরে পৌঁছান। খ্রিষ্টপূর্ব ৩২৩ অব্দের জুন
মাসের ১১ বা ১২ তারিখে ব্যাবিলনে দ্বিতীয় নেবুচাদনেজারের প্রাসাদে মৃত্যুবরণ
করেন।
আলেকজান্ডারের স্ত্রী এবং সন্তান
স্ত্রী : রোক্সানা (Roxana)
পুত্র :
Alexander IV
Aegus.
স্ত্রী : স্টাটেরিয়া দ্বিতীয় (Stateira
II)
পুত্র :
Philip III of Macedon
স্ত্র : (পারসিয়ার পারিসাটিস দ্বিতীয়) : Parysatis II of Persia
তথ্যসূত্র:
ভারতের ইতিহাস।
অতুল চন্দ্র রায় এবং প্রণবকুমার চট্টোপাধ্যায়।
http://en.wikipedia.org/wiki/Alexander_the_Great