তক্ষশীলা
ইংরেজি :
Taxila,
Takshashila।
উর্দু :
: ٹیکسلا।
প্রাচীন ভারতের একটি শিক্ষা-নগরী।
১৯৮০ সালে ইউনেস্কো কর্তৃক
world heritage site
হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।
ভৌগোলিক অবস্থান : ৩৩°৪৪′৪৫″
উত্তর দ্রাঘিমাংশ ৭২°৪৭′১৫″
পূর্ব অক্ষাংশ।
বর্তমানে তক্ষশিলা পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের রাওয়ালপিন্ডি জেলার অন্তর্গত একটি প্রত্নতাত্ত্বিক এলাকা হিসাবে সুপরিচিত। পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদ থেকে ৩২ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। সাগরপৃষ্ঠ থেকে এর উচ্চতা ৫৪৯ মিটার।
হিন্দু পৌরাণিক কাহিনি মতে— দশরথের পৌত্র এবং ভরত গান্ধার দেশ জয় করে নিজের পুত্র তক্ষের নামানুসারে তক্ষশীলা ও পুষ্কলের নামানুসারে পুষ্কলাবতী নগর স্থাপন করেন।
তক্ষশীলার বৌদ্ধবিহার |
মহাভারতের মতে এই স্থান গান্ধারের অন্তর্গত। রাজা জনমেজয় এই নগরীতে সর্পযজ্ঞ করেছিলেন। এই নগরীর ভগ্নাবশেষ এখনও বর্তমান। অনেকের মতে এই স্থানে তক্ষ নামক একটি জাতি বাস করতো। এই জাতির নামানুসারে এই স্থানের নামকরণ করা হয়েছিল তক্ষখণ্ড। কালক্রমে তক্ষখণ্ড নামটি তক্ষশীলা নামে পরিবর্তিত হয়।
খ্রিষ্টপূর্ব ৫৫০-৪৬৫ অব্দের ভিতরে পারশ্যে রাজারা এই অঞ্চলে অনেকগুলো সামরিক অভিযান পরিচালনা করে। ঐতিহাসিক প্লিনির মতে খ্রিষ্টপূর্ব ৫৫০-৫৩০ অব্দের ভিতরে পারশ্য সম্রাট কাইরাস ভারতে কয়েকবার আক্রমণ করেন এবং কপিশা নগরী দখল করতে সমর্থ হন। আরিয়ান নামক অপর একজন ঐতিহাসিকের মতে- কাইরাস কাবুল ও সিন্ধু নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চল দখল করে নেন এবং এই অঞ্চল থেকে কর আদায় করতেন। কাইরাসের তৃতীয় উত্তরসূরী সম্রাট প্রথম দারায়ুস খ্রিষ্টপূর্ব ৫২২ অব্দ থেকে ৪৮৬ অব্দের ভিতরে গান্ধার, সিন্ধু-উপত্যাকা এবং পাঞ্জাব দখল করেন। এরপর জারেক্সিস খ্রিষ্টপূর্ব ৪৮৬ অব্দ পর্যন্ত এই অঞ্চলের উপরে আধিপত্য বজায় রাখতে সক্ষম হন। এই সময় এই অঞ্চলের অন্যান্য এলাকার সাথে তক্ষশিলাও পারসিকদের অধিকারে ছিল।
তক্ষশিলায় প্রাপ্ত মূর্তি। |
খ্রিষ্টপূর্ব ৪০৫ অব্দের দিকে চৈনিক পরিব্রাজক ফা-হিয়েন তক্ষশীলা পরিদর্শন করেন এবং এই স্থানকে অত্যন্ত পবিত্র এলাকা হিসাবে উল্লেখ করেন। খ্রিষ্টপূর্ব ৩২৬ অব্দে আলেকজান্ডার সিন্ধু নদ পার হয়ে তক্ষশিলায় প্রবেশ করেন। এই সময় তক্ষশিলার রাজা অম্ভি আলেকজান্ডারের কাছে বশ্যতা স্বীকার করে তক্ষশিলায় অভ্যর্থনা করেন। এরপর অভিসার জাতির নেতাও আলেকজান্ডারের কাছে বশ্যতা স্বীকার করে। এরপর আলেকজান্ডার তক্ষশিলা থেকে পূর্বদিকে অগ্রসর হয়ে ঝিলম নদী পার হয়ে পুরুর রাজ্য আক্রমণ করেছিলেন।
আলেকজান্ডারের ভারত ত্যাগের আগে ঝিলম ও বিপাশা নদীর মধ্যাভাগের অঞ্চল পুরুকে এবং সিন্ধু ঝিলম নদীর মধ্যভাগের অঞ্চল অম্ভির কাছে ছেড়ে দেন। এরপর চন্দ্রগুপ্তের গুরু এবং বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ কৌটিল্যের (চাণক্য) পৃষ্ঠপোষকতায় তক্ষশিলায় রাজত্বের পত্তন করেন চন্দ্রগুপ্ত। কালক্রমে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য বিশাল রাজত্বের অধিকারী হন। চন্দ্রগুপ্ত তাঁর পুত্র বিন্দুসারে কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করার পর, তক্ষশীলাবাসী রাজশক্তির অত্যাচরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। বিন্দুসারে নির্দেশে তাঁর যুবরাজ অশোক তক্ষশীলার বিদ্রোহ কঠোরভাবে দমন করেন। খ্রিষ্টপূর্ব ২৭৩ অব্দের দিকে অশোক রাজত্ব লাভ করেন। তখন মৌর্য রাজাদের রাজধানী ছিল পাটালীপুত্র। কিন্তু তক্ষশিলা বৌদ্ধ সংস্কৃতির কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছিল। অশোক পাটালিপুত্র থেকে তক্ষশিলার ভিতরে প্রায় ১৬০০ কিলোমিটার রাস্তা তৈরি করেন।
ব্রিটিশ মিউজিয়ামে রক্ষিত খ্রিষ্টপূর্ব- ২০০-১০০ অব্দের তক্ষশীলার মুদ্রা |
খ্রিষ্টাপূর্ব ১৮৫ অব্দের দিকে শেষ মৌর্য সম্রাট বৃহদ্রথকে হত্যা করেন তাঁর সেনাপতি পুষ্যমিত্র। এই সময় মৌর্য সম্রাট বৃহদ্রথের আত্মীয় যজ্ঞসেন বিদর্ভের স্বাধীন রাজা হিসাবে ঘোষণা দেন। পুষ্যমিত্রের সাথে যজ্ঞসেনের বাহিনীর সাথে যুদ্ধ হলে, যজ্ঞসেন পরাজিত হন। পরে যজ্ঞসেনের দুই আত্মীয়ের ভিতর বিদর্ভরাজ্যকে ভাগ করে দেওয়া হয়। পুষ্যামিত্রের রাজত্বকালে গ্রিকরা তাঁর রাজ্য আক্রমণ করলে, গ্রিকরা পরাজিত হয়। পুষ্যামিত্র বৌদ্ধধর্ম-বিদ্বেষী ছিলেন। ফলে তাঁর সময় তক্ষশীলা গুরুত্ব হারাতে থাকে। অনেকে মনে করেন এই সময় তক্ষশীলারা বৌদ্ধ-স্থাপনা ধ্বংস করা হয়েছিল।
খ্রিষ্টপূর্ব ১৪৯ অব্দে পুষ্যামিত্র পরলোক গমন করার পর, তাঁর পুত্র অগ্নিমিত্র বিদিশার ক্ষমতা দখল করেন এবং বিদর্ভরাজকে পরাজিত করেন। অগ্নিমিত্রের পর পর এদের উত্তরপুরুষরা রাজত্বের সমৃদ্ধিকে বজায় রাখতে ব্যর্থ হন। এই বংশের শেষ সম্রাট সুমিত, মুলাদেব নামক এক আততায়ীর হাতে নিহত হন। এরপর এই অঞ্চলে শুঙ্গবংশের রাজত্ব শুরু হয়। এই রাজবংশের রাজত্বকালে গ্রিকরা তক্ষশীল দখল করে নেয়। এরপর শকদের কাছে গ্রিকরা ক্ষমতা হারায় এবং তক্ষশিলা শকদের অধীনে চলে যায়। এপর শকদের উৎখাত করে ভারতে আধিপত্য বিস্তার করে কুষাণ রাজবংশ। কুষাণদের রাজ্য বিস্তারের সময় তক্ষশীলা ধ্বংস হয়ে যায়। পরবর্তী সময় কুষাণ রাজবংশের শাসনমলেই তক্ষশিলা আবার তার পুরানো ঐতিহ্য ফিরে পেতে থাকে। কালক্রমে তক্ষশীলা বৌদ্ধদের বিহার ও শিক্ষাকেন্দ্রে প্রসিদ্ধ হয়ে উঠে। বৌদ্ধ রাজশক্তি দুর্বল হয়ে পড়লে, হিন্দু রাজারা ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে শক্তশালী হয়ে উঠে। বৌদ্ধধর্ম-বিদ্বেষী রাজাদের দ্বারা তক্ষশীলা নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। এছাড়া পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে তক্ষশীলা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক-ছাত্র হীন কাঠামোতে পরিণত হয়। এবং তক্ষশীলা জন-পরিত্যাক্ত নগরীতে পরিণত হয়। ৪৫০ খ্রিষ্টাব্দে তক্ষশীলায় সর্বশেষ আক্রমণটি আসে হুনদের পক্ষ থেকে। এরপর পুরো তক্ষশীলা ধীরে ধীরে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়।
তক্ষশীলা
বিশ্ববিদ্যালয়
এই বিশ্ববিদ্যালয়ে সাধারণত ছাত্র ভর্তি হতো ১৬ বৎসর বয়সে। এই সময় এরা বেদ
অধ্যয়ন করতো। ১৮ বৎসর বয়স থেকে ছাত্রদের শেখানো হতো শিল্পকলা, তীর নিক্ষেপ, শিকার,
আইন, চিকিৎসা এবং সমরবিদ্যা। শিক্ষকদের জন্য আবসিক ব্যবস্থা ছিল। বিভিন্ন পণ্ডিতদের
কাছে পর্যায়ক্রমে এ সকল শিক্ষা চলতো। বৌদ্ধ ধর্মের বিকাশের পর হতে শিক্ষা দেওয়া
শুরু হয়েছিল বৌদ্ধ দর্শন। উচ্চতর শিক্ষার ক্ষেত্রগুলো ছিল—
বেদ, ভাষা, ব্যাকরণ, দর্শন, চিকিৎসাশাস্ত্র
(আয়ুর্বেদ), ধনুর্বিদ্যা, রাজনীতি, যুদ্ধবিদ্যা, জ্যোতিঃশাস্ত্র, হিসাব বিজ্ঞান,
গণিত, অর্থনীতি, সঙ্গীত ও হস্তশিল্প।
প্রায় ১০ হাজারের উপর ছাত্র-শিক্ষকের মুখরিত ছিল এই বিশ্ববিদ্যালয়। ছাত্রদের কাছ
থেকে শিক্ষা বাবদ এবং থাকা-খাওয়ার জন্য অর্থ গ্রহণ করতো বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু
শিক্ষক ও বিশ্বদ্যালয়ের অন্যান্য খরচ আসতো রাজকোষ ও ছাত্রদের কাছ থেকে। দরিদ্র ছাত্ররা তক্ষশীলায়
নানা রকম কাজ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচ মেটাতো। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে নারী শিক্ষার কোনো
প্রমাণ পাওয়া যায় নাই।
তক্ষশীলার উল্লেখযোগ্য
পণ্ডিতবর্গ
চাণক্য (অর্থনীতিবিদ)
পাণিনি
(ব্যাকরণবিদ, অষ্টাধ্যায়ী নামক ব্যাকরণের রচয়িতা)
চরক (চিকিৎসক, চরক সংহিতা নামক আয়ুর্বেদ-গ্রন্থের রচয়িতা)
জীবক (শৈল্য চিকিৎসক,
গৌতমবুদ্ধের চিকিৎসক)
সূত্র:
ভারতের ইতিহাস। অতুলচন্দ্র রায়/প্রণবকুমার চট্টোপাধ্যায়।
বাংলা বিশ্বকোষ। দ্বিতীয় খণ্ড। নওরোজ কিতাবিস্তান, ঢাকা। ডিসেম্বর ১৯৭৫।
http://en.wikipedia.org/
http://www.pakistantumhetoho.com.pk/ImageGallery