তক্ষক
দেখুন: তক্ষক (অভিধান)

হিন্দু পৌরাণিক কাহিনি মতে- অষ্ট নাগের ভিতর অন্যতম নাগ। মহর্ষি কশ্যপের ঔরসে দক্ষ কন্যা কদ্রুর গর্ভে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বাস করতেন খাণ্ডববনে। কৃষ্ণার্জুন খাণ্ডববন দাহনকালে তিনি সেখানে অনুপস্থিত ছিলেন। এঁর স্ত্রী ও সন্তানেরা পলায়নের সময় তাঁদেরকে হত্যা করেন। সেই কারণে তিনি অর্জুন এবং তাঁর বংশধরদেরকে শত্রু জ্ঞান করতেন। অর্জুনের পুত্র অভিমন্যুর মৃত্যুর পর তাঁর সন্তান পরীক্ষিৎকে পাণ্ডবরা অত্যন্ত যত্নের সাথে বড় করে তোলেন। পাণ্ডবদের মহাপ্রস্থানের সময় পরীক্ষিৎকে তাঁরা রাজ্য দান করে যান।

একবার রাজা পরীক্ষিৎ মৃগয়ায় গিয়ে একটি হরিণকে বাণবিদ্ধ করে তার অনুসরণ করতে করতে গভীর বনে প্রবেশ করেন। এই বনে তখন শমীক নামক এক ঋষি মৌনব্রত অবলম্বনে ছিলেন। পরীক্ষিৎ এই মুনিকে হরিণটি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে কোন উত্তর না পেয়ে, তাঁর গলায় একটি মৃত সাপ ঝুলিয়ে প্রাসাদে ফিরে আসেন। তপস্যারত মুনির পুত্র শৃঙ্গী এই বিষয় অবগত হয়ে অভিশাপ দেন যে, মৃগয়ার সাত দিনের মধ্যে তক্ষক নামক নাগের দংশনে পরীক্ষিৎ মারা যাবেন। শৃঙ্গী এই অভিশাপের কথা শমীক ঋষিকে জানালে, শমীক বলেন যে, এই অভিশাপ অত্যন্ত অন্যায় হয়েছে। কারণ রাজা জানতেন না যে, তিনি মৌনতা অবলম্বন করে আছেন। শৃঙ্গী এর উত্তরে জানান যে, এই অভিশাপ ফিরবে না। এরপর শমীক নিজ উদ্যোগে পরীক্ষিৎকে এই বিষয়টি জানান।

পরীক্ষিৎ সকলের সাথে পরামর্শ করে, অতিদ্রুত একটি স্তম্ভের উপর একটি বাড়ি নির্মাণ করেন এবং স্তম্ভের চারদিকে লোক নিযুক্ত করেন। ষষ্ঠদিন অতিবাহিত হওয়ার পর বিষ চিকিৎসক কাশ্যপ পরীক্ষিৎকে রক্ষা করার জন্য হস্তিনাপুরে রওনা হন। পথে কাশ্যপের সাথে তক্ষকের সাক্ষাৎ হলে তক্ষক বলেন, তুমি কোন ক্রমেই রাজাকে বাঁচাতে পারবে না। ব্রাহ্মণ কৃতকার্যতার বিষয়ে দৃঢতা প্রকাশ করলে, পরীক্ষার্থে তক্ষক নিকটস্থ একটি বটগাছকে দংশন করেন। বিষের প্রভাবে বটগাছ জ্বলতে থাকলে, ব্রাক্ষণ স্বীয় বিদ্যাবলে গাছটিকে রক্ষা করলেন। এরপর তক্ষক ধনলোভী ব্রাহ্মণকে অর্থের প্রলোভন দেখিয়ে, তাঁকে হস্তিনাপুরে যেতে নিষেধ করেন। কাশ্যপ ধ্যানযোগে পরীক্ষিতের মৃত্যু অবধারিত জেনে হস্তিনাপুরে না গিয়ে তক্ষকের উপহার নিয়ে নিজ দেশে ফিরে যান। তক্ষকের নির্দেশে তাঁর কয়েকজন অনুচর তপস্বীর বেশে বিভিন্ন প্রকারের ফল নিয়ে পরীক্ষিতের কাছে উপস্থিত হন। উক্ত ফলগুলোর একটিতে তিনি একটি তাম্রবর্ণের পোকা দেখতে পান। এরপর পরীক্ষিৎ শৃঙ্গীর বাক্যই সত্য হোক, এই কীটই তক্ষক হয়ে দংশন করুক বলে, কীটটি তুলে তাঁর কণ্ঠের উপর স্থাপন করেন। এরপর তক্ষক নিজ রূপ ধারণ করে পরীক্ষিৎকে দংশন করেন। এর ফলে পরীক্ষিতের মৃত্যু হয়।
[সূত্র: মহাভারত। আদিপর্ব। ৪০-৪৪ অধ্যায়] তক্ষক ও উতঙ্কের দ্বন্দ্ব
রাজা পৌষ্যের ক্ষত্রিয়া-পত্নীর দুটি কুণ্ডলের প্রতি তক্ষকের দীর্ঘদিনের লোভ ছিল। কিন্তু এই কুণ্ডল দুটি তিনি হস্তগত করতে পারেন নি বলে ক্ষোভ ছিল। এই কুণ্ডল একবার পেয়েও তিনি অপমানজনকভাবে ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হন। মহাভারতের মতে, বেদ নামক ঋষির শিষ্য উতঙ্কের শিক্ষা শেষে যখন গুরু দক্ষিণা দেওয়ার কথা বলেন, তখন বেদ প্রথমে বিষয়টি স্থগিত রাখার কথা বললেন। কিন্তু উতঙ্কের বারবার তাগাদা দিতে থাকলে, বেদ বলেন যে, তাঁর স্ত্রী যা প্রার্থনা করবেন তাই হবে তাঁর গুরুদক্ষিণা। এরপর উতঙ্ক গুরুপত্নীর কাছে গলে- গুরুপত্নী তাঁকে রাজা পৌষ্যের ক্ষত্রিয়া-পত্নীর দুটি কুণ্ডল চেয়ে আনতে বললেন। তিনি আরো বললেন যে, চারদিন পর তিনি একটি পুণ্যব্রত পালন করবেন। উক্ত ব্রতে ব্রাহ্মণ ভোজনের সময়- ওই কুণ্ডল ধারণ করে ব্রাহ্মণদের সামনে খাবার পরিবেশ করবেন।

উতঙ্ক রানীর সাথে দেখা করে কুণ্ডল প্রার্থনা করলে, রানী তাকে কুণ্ডল প্রদান করে বললেন যে, নাগরাজ তক্ষক এই দুটি কুণ্ডলের প্রার্থী, সে কারণে উতঙ্ক যেন অতি সাবধানে এটিকে নিয়ে যায়। এরপর উতঙ্ক কুণ্ডল নিয়ে রওনা হন। পথে উতঙ্ক একজন বৌদ্ধ ভিক্ষু দেখতে পান। তিনি লক্ষ্য করলেন যে, এই ভিক্ষু মাঝে মাঝে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছেন। উতঙ্ক বিষয়টিকে আমল না দিয়ে, স্নান-তর্পণের জন্য কুণ্ডল মাটিতে রেখে সরোবরে যান। এই সময় ওই ভিক্ষু কুণ্ডল দুটি নিয়ে পলায়ন করেন। উতঙ্ক ওই সন্ন্যাসীকে ধরার জন্য তাড়া করলেন। কিন্তু ভিক্ষুকে ধরার উপক্রম করতেই, ভিক্ষু তক্ষকের রূপ ধরে- অকস্মাৎ একটি গর্ত দিয়ে ভূগর্ভে প্রবেশ করে নাগলোকে চলে গেলেন। উতঙ্ক প্রথমে একটি দণ্ড দিয়ে উক্ত গর্ত খুঁড়তে শুরু করেন। কিন্তু তিনি কৃতকার্য না হওয়ায় ইন্দ্র উক্ত দণ্ডে বজ্র অধিষ্ঠিত করে দেন। এই বজ্র-অধিষ্ঠিত দণ্ড দ্বারা গর্ত বড় করে তিনি নাগলোকে প্রবেশ করেন। সেখানে গিয়ে কুণ্ডল ফিরে পাওয়ার জন্য তিনি নাগদের স্তব করতে থাকেন। সেখানে নানা বিষয় দেখতে দেখতে একজন সুদর্শন পুরুষ এবং একটি অশ্ব দেখতে পান। এঁদের স্তব করায় সেই পুরুষ উতঙ্ককে বর প্রার্থনা করতে বললেন। উতঙ্ক নাগদের বশ করার বর চাইলে- উক্ত পুরুষ অশ্বের গুহ্যদেশে ফুৎকার দিতে বললেন। এই আদেশ পালন করলে- অশ্বের সমস্ত ইন্দ্রিয়দ্বার থেকে সধূম অগ্নিশিখা বের হয়ে নাগলোক ব্যাপ্ত করলো। এই অবস্থায় তক্ষক অত্যন্ত ভীত হয়ে উতঙ্ককে কুণ্ডল প্রত্যর্পণ করলো।
[সূত্র: মহাভারত। আদিপর্ব। তৃতীয় অধ্যায়, পৌষ্যপর্ব]
এই কারণে, উতঙ্ক তক্ষকের শত্রুতে পরিণত হন। ফলে উতঙ্ক হস্তিনাপুরে গিয়ে রাজা জনমেজয়কে তক্ষকের উপর প্রতিশোধ নেওয়া পরামর্শ দেন। জনমেজয় পুরোহিতদের পরামর্শ অনুসারে সর্পসত্র নামক একটি মহাযজ্ঞের আয়োজন করেন। এই যজ্ঞকুণ্ডে একে একে সকল সাপ নিহত হতে থাকলে, আস্তীক তাঁর মাতৃ-আদেশে যজ্ঞস্থলে এসে প্রশংসার দ্বারা সকলকে প্রসন্ন করেন। জনমেজয় আস্তীকের প্রতি প্রসন্ন হয়ে, বর প্রার্থনা করতে বলেন। কিন্তু পুরোহিতরা জানান যে, এখনো তক্ষক যজ্ঞে পতিত হয় নি, তাই বরপ্রদানে বিলম্ব করা উচিৎ। এরপর যজ্ঞের পুরোহিতদের কাছে থেকে জনমেজয় জানতে পারেন যে, তক্ষক ইন্দ্রের কাছে লুকিয়ে আছেন। এরপর জনমেজয় পুরোহিতদের ইন্দ্রের আরাধনা করার কথা বলেন। ইন্দ্র এই আরাধনায় সাড়া দিয়ে, অমরাবতী থেকে যজ্ঞস্থলের দিকে রওনা দেন। এই সময় তক্ষক প্রাণের ভয়ে ইন্দ্রের উত্তরীয়ের ভিতরে আশ্রয় নেন। পুরোহিতরা তক্ষকের নামে যজ্ঞে আহুতি দিলেন। এই সময় ইন্দ্র আকাশে তাঁর পারিষদদের নিয়ে প্রকাশ পেলেন। জনমেজয় এবার রেগে গিয়ে পুরোহিতদের বলেন, যদি তক্ষক ইন্দ্রের উত্তরীয়ের ভিতর লুকিয়ে থাকে, তবে ইন্দ্র-সহ তক্ষককে যজ্ঞে নিক্ষেপ করুন। পুরোহিতরা রাজার আদেশে পুনরায় আহুতি দিলে, ইন্দ্র এবং তক্ষক যজ্ঞের অগ্নিকুণ্ডের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। যজ্ঞের ভয়ঙ্কর রূপ দেখে, ইন্দ্র তক্ষককে পরিত্যাগ করে ফিরে যান। তক্ষক মন্ত্র প্রভাবে হতচেতন হবে ঘুরতে ঘুরতে যজ্ঞের দিকে ছুটে আসতে থাকেন। তক্ষকের মৃত্যু নিশ্চিত জেনে, জনমেজয়কে বরপ্রদানে কথা বলেন। এই অবসরে আস্তীক তিনবার 'তিষ্ট' উচ্চারণ করেন। ফলে অর্ধপথে শূন্যের উপর তক্ষকের পতন থেমে যায়। আস্তীক রাজার কাছে সর্পযজ্ঞ বন্ধ করে সর্পনিধন বন্ধের বর প্রার্থনা করেন। অত্যন্ত জনমেজয় দুঃখের সাথে এই বর প্রদান করেন। এর ফলে যজ্ঞ থেমে যায় এবং তক্ষক রক্ষা পান।
[সূত্র: মহাভারত। আদিপর্ব। ষট্‌পঞ্চাশ-অষ্টপঞ্চাশত্তম  অধ্যায়]