উতঙ্ক
ঊর্ধ্বক্রমবাচকতা { | ঋষি |  হিন্দু পৌরাণিক সত্তা | ভারতীয় পৌরাণিক সত্তা | পৌরাণিক সত্তা | কাল্পনিক সত্তা | কল্পনা | সৃজনশীলতা | কর্মক্ষমতা | জ্ঞান
 | মনস্তাত্ত্বিক ঘটনা | বিমূর্তন  | বিমূর্ত-সত্ত | সত্তা |}

হিন্দু পৌরাণিক কাহিনি মতে জনৈক ঋষি। এঁর গুরুর নাম ছিল বেদ। রাজা জনমেজয় ও পৌষ্য নামক রাজা বেদকে পুরোহিত হিসাবে গ্রহণ করলে, যাজন ক্রিয়া সম্পন্ন করার জন্য তিনি আশ্রম ত্যাগ করেন। এই সময় বেদ তাঁর ঘরের সকল কাজের ভার উতঙ্ককে প্রদান করে যান। এই সময়ে একদিন আশ্রমের নারীরা এসে উতঙ্ককে জানান যে- গুরুপত্নী ঋতুমতী হয়েছেন। তাই উতঙ্ককে গুরুপত্নীর ঋতুরক্ষা করার জন্য, তাঁর সাথে মিলিত হতে হবে। গুরুর বিনা আদেশে এই প্রস্তাব পালন অনুচিত বলে- তা প্রত্যাখ্যান করেন। পরে বেদ আশ্রমে ফিরে এসে এই বিষয়ে জেনে- উতঙ্ককে আশীর্বাদ করে ঘরে ফিরে যতে বলেন।

ঘরে ফেরার পূর্বে তিনি গুরুকে দক্ষিণা দিতে ইচ্ছা করলেন। তখন
বেদ তাঁকে এই বিষয়টি স্থগিত রাখতে বলেন। কিন্তু উতঙ্ক পুনরায় এই আবদার করলে, বেদ বললেন যে,- তাঁর স্ত্রী যা প্রার্থনা করবেন তাই হবে তাঁর গুরুদক্ষিণা। এরপর উতঙ্ক গুরুপত্নীর কাছে গলে- গুরুপত্নী তাঁকে রাজা পৌষ্যের ক্ষত্রিয়া-পত্নীর দুটি কুণ্ডল চেয়ে আনতে বললেন। তিনি আরো বললেন যে, চারদিন পর তিনি একটি পুণ্যব্রত পালন করবেন। উক্ত ব্রতে ব্রাহ্মণ ভোজনের সময়- ওই কুণ্ডল ধারণ করে ব্রাহ্মণদের সামনে খাবার পরিবেশ করবেন।

উতঙ্ক যথাসময়ে কুণ্ডল আনার জন্য রওনা হলেন। পথে ষাড়ের পিঠে উপবিষ্ট একজন বিরাট পুরুষের সাথে দেখা হলে- এই পুরুষ তাকে ষাঁড়ের গোবর খেতে বললেন। উতঙ্ক প্রথমে রাজি হলেন না। তখন এই পুরুষ বললেন যে- এর গোবর তাঁর গুরুও এক সময় ভক্ষণ করেছেন। এরপর উতঙ্ক গোবর ভক্ষণ করলেন- এবং খুব দ্রুত হাতমুখ ধুয়ে রাজা পৌষ্যের কাছে এলেন। রাজা সব শুনে রানীকে গিয়ে এই প্রার্থনা জানাতে বললেন। কিন্তু উতঙ্ক রানীকে কোথাও দেখতে না পয়ে- তিনি আবার রাজাকে জানালেন। রাজা বললেন, সম্ভবত অশুচি থাকার কারণে,- রানীর দর্শন মেলেনি। এবার উতঙ্ক আরো ভালোভাবে নিজেকে পরিশুদ্ধ করে অন্তঃপুরে গেলে তিনি রানীকে দেখতে পেলেন। রানী তাকে কুণ্ডল প্রদান করে বললেন যে, নাগরাজ তক্ষক এই দুটি কুণ্ডলের প্রার্থী, সে কারণে উতঙ্ক যেন অতি সাবধানে এটিকে নিয়ে যায়। এরপর রাজা উতঙ্কের আপ্যায়নের ব্যবস্থা করলেন। খাদ্য শীতল ও তাতে চুল থাকার কারণে- উতঙ্ক রাজাকে অভিশাপ দিলেন যে- অশুচি খাদ্য পরিবেশনের জন্য তাকে অন্ধ হতে হবে। রাজাও তাকে অভিশাপ দিয়ে বললেন- উতঙ্ক নিঃসন্তান হবে। উতঙ্ক এবার বললেন,- অশুচি অন্নদাতার অভিশাপ দেওয়া অনুচিত। রাজা তখন খাদ্য পরীক্ষার পর সন্দেহ প্রকাশ করে বললেন- খাদ্য হয়ত কোনো মুক্তকেশী স্ত্রী এনেছে, তাই এতে চুল পড়েছে। নিজের ভুল বুঝতে পরে- রাজা উতঙ্কের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করলেন। উতঙ্ক রাজাকে জানালেন- ক্ষমা প্রার্থনা করায় অন্ধত্বলাভের পর আবার দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাবেন এবং অন্নে দোষ স্বীকার করায় তাঁর অভিশাপ নিষ্ফল হবে।

এরপর উতঙ্ক কুণ্ডল নিয়ে রওনা হন। পথে উতঙ্ক একজন বৌদ্ধ ভিক্ষু দেখতে পান। তিনি লক্ষ্য করলেন যে, এই ভিক্ষু মাঝে মাঝে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছেন। উতঙ্ক বিষয়টিকে আমল না দিয়ে,  স্নান-তর্পণের জন্য মাটিতে রেখে সরোবরে যান। এই সময় ওই ভিক্ষু কুণ্ডল দুটি নিয়ে পলায়ন করেন। উতঙ্ক ওই সন্ন্যাসীকে ধরার জন্য তাড়া করলেন। কিন্তু ভিক্ষুকে ধরার উপক্রম করতেই, ভিক্ষু তক্ষকের রূপ ধরে- অকস্মাৎ একটি গর্ত দিয়ে ভূগর্ভে প্রবেশ করে নাগলোকে চলে গেলেন। উতঙ্ক প্রথমে একটি দণ্ড দিয়ে উক্ত গর্ত খুঁড়তে শুরু করেন। কিন্তু তিনি কৃতকার্য না হওয়ায় ইন্দ্র উক্ত দণ্ডে বজ্র অধিষ্ঠিত করে দেন। এই বজ্র-অধিষ্ঠিত দণ্ড দ্বারা গর্ত বড় করে তিনি নাগলোকে প্রবেশ করেন। সেখানে গিয়ে কুণ্ডল ফিরে পাওয়ার জন্য তিনি নাগদের স্তব করতে থাকেন। তিনি সেখানে দেখলেন,- দুই স্ত্রী সাদা ও কালো সুতো দিয়ে তাঁতে কাপড় বুনছে এবং ছয় জন কুমার দ্বাদশ অর (পাখি) যুক্ত একটি চাকা ঘুরাচ্ছে। এ ছাড়া সেখানে একজন সুদর্শন পুরুষ এবং একটি অশ্ব দেখতে পেলেন। এঁদের স্তব করায় সেই পুরুষ উতঙ্ককে বর প্রার্থনা করতে বললেন। উতঙ্ক নাগদের বশ করার বর চাইলে- উক্ত পুরুষ অশ্বের গুহ্যদেশে ফুৎকার দিতে বললেন। এই আদেশ পালন করলে- অশ্বের সমস্ত ইন্দ্রিয়দ্বার থেকে সধূম অগ্নিশিখা বের হয়ে নাগলোক ব্যাপ্ত করলো। এই অবস্থায় তক্ষক অত্যন্ত ভীত হয়ে উতঙ্ককে কুণ্ডল প্রত্যর্পণ করলো।

এদিকে গুরুপত্নী পুণ্যব্রতের দিন স্নান শেষে দেখলেন উতঙ্ক তখনও ফিরে আসে নি। এই কারণে ইনি অভিশাপ দেবার উপক্রম করছিলেন। এমন সময় উতঙ্ক সেখানে উপস্থিত হয়ে কুণ্ডল প্রদান করেন।

এরপর উতঙ্ক গুরুর কাছে তাঁর এই বিচিত্র অভিজ্ঞতা বর্ণনা করলে- গুরু তাঁকে জানান যে,- ষাড়ের পিঠে অধিষ্ঠিত পুরুষ হলো-
ইন্দ্র, আর ষাঁড়ের গোবর ছিল অমৃত। নাগলোকে বস্ত্রবয়নকারী দুই স্ত্রী হলেন ধাতা ও বিধাতা, সাদা ও কালো সুতা হলো- রাত্রি ও দিন। ছয় কুমার হলো ছয় ঋতু, দ্বাদশ অর হলো দ্বাদশ মাস, পুরুষ হলো ইন্দ্র ও অশ্বটি হলো- অগ্নি । নাগলোকে উতঙ্ক নিরাপদ ছিলেন কারণ,  ইন্দ্র তাঁকে রক্ষা করেছেন। উল্লেখ্য, উতঙ্কের গুরু বেদ ছিলেন ইন্দ্রের সখা। সে কারণেই ইন্দ্র তাঁর জন্য এত সব করেছেন। সব শেষে বেদ -উতঙ্ককে গৃহে যেতে বললেন। এরপর উতঙ্ক হস্তিনাপুরে গিয়ে রাজা জনমেজয়কে তক্ষকের উপর প্রতিশোধ নেবার পরামর্শ দেন।
        [সূত্র: মহাভারত। আদিপর্ব। তৃতীয় অধ্যায়, পৌষ্যপর্ব]