অগ্নি (পৌরাণিক হিন্দু)
[অগ্নি অভিধান]
হিন্দু বৈদিক এবং পৌরাণিক কাহিনি মতে – অগ্নি নামক শক্তির দেবতা। হিন্দু ধর্মের বিভিন্ন গ্রন্থে অগ্নিকে নানা নামে অভিহিত করা হয়।
অগ্নি এই শব্দটির সহিত ইন্দো-ইওরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত ল্যাটিন ও স্লাভনিক ভাষায় প্রচলিত যথাক্রমে
ignis
এবং ogni
শব্দদ্বয়ের সাদৃশ্য লক্ষণীয়।
ইন্দো-ইরানীয় অগ্নি-উপাসক আর্যদের মধ্যে অগ্নিপূজার প্রচলন সুবিদিত।
অগ্নি দেবতার উল্লেখ পাওয়া যায়, বেদ, মহাভারত ও বিভিন্ন পুরাণে
-
ঋগ্বেদ: ঋগ্বেদের সূচনা হয়েছে অগ্নিকে দিয়ে। এর প্রথম মণ্ডলের প্রথম
সূক্তের প্রথম শ্লোকে বলা হয়েছে
'হে অগ্নি যজ্ঞের পুরোহিত এবং দীপ্তিমান; অগ্নি দেবগণের আহ্বানকারী ঋত্বিক
এবং প্রভূতরত্নধারী; আমি অগ্নির স্তুতি করি। এই দেবতার উদ্দেশ্যে ঋগ্বেদে
দুইশত সূক্ত পাওয়া যায়। অগ্নি ছাড়া যজ্ঞ হয় না, তাই অগ্নিকে বেদে 'পুরোহিত'
বলা হয়েছে। ঋগ্বেদের ১।৩১।১ অংশে অঙ্গিরা ঋষিদের আদি ঋষি হিসাবে অগ্নিকে
উল্লেখ করা হয়েছে।
অগ্নির আকৃতি সম্পর্কে ঋগবেদে বেশ কিছু বিশেষণ্ব্যবহার করা হয়েছে। যেমন-ঘৃত-নির্ণিক্’, ‘ঘৃত-কেশ’, ‘দ্রুন্ন’, ‘ধূম্-কেতু’, ‘তমোহ্ন্’, ‘চিত্র-ভানু’, ‘শুক্র-শোচি, ‘শুচিদ্ন্’, ‘কৃষ্ণ-ব্র্ত্তনি্’, ‘হিরণ্য-রথ’। অগ্নির বাহনের নাম ‘রোহি্ৎ'।
অগ্নির কর্ম প্রধানত যজ্ঞস্থলে দেবতাদের আবাহন ও দেবগণের উদ্দেশে হবিবহন। তিনি মনুষ্য ও দেবতাগণের দূত-স্বরূপ্ দেব্তাদের্হবি বহন করেন বলে, এর নাম ‘হব্য-বাটু’ বা ‘হব্য-বাহন। ঋগবেদে অগ্নিকে ‘হো্তা’, ‘পুরাহিত এবং ঋত্বিক’ রূপেও নির্দেশ করা হইয়াছে।
অগ্নির জন্ম বা উৎপত্তি সম্পর্কেও ঋগবেদে বহুবিধ কল্পনা করা হইয়াছে। ঋগ্বেদে অগ্নির উৎপত্তির সম্পর্কে উল্লেখ করা হয়েছে- 'অরণিদ্বয় থেকে জন্ম' [১।৭।৪]। এই কারণে ঋগ্বেদে অগ্নিকে বলা হয়েছে -দ্বিমাতৃ [১।৩১।২]। উল্লেখ্য আর্য ঋষিরা দুটি শুকনো কাঠের ঘর্ষণে অগ্নির উৎপন্ন করতেন্ এই কাঠ দুটিকে অরণি বলা হয়। সুতরাং অরণিদ্বয় অগ্নির পিতা-মাতা। জন্ম মাত্রই অগ্নি তাঁর পিতা-মাতাকে ভক্ষণ করেন।
কখনও বলা হইয়াছে, মাতরিশ্বা কর্তৃক দুলোক্থেকে অগ্নিকে আহরণ করা হয়েছে। কখনও মেঘদ্বয়ের মধ্য থেকে ইন্দ্র-কর্তৃক তিনি উৎপাদিত হন—এইরূপ বলা হইয়াছে। কোনও কোনও মন্ত্রে দ্যাবা পৃথিবীকে তাঁর্মাতা ও পিতা রূপে বর্ণনা করা হইয়াছে। আচার্য শাকপূণির মতানুসারে পৃথিবী, অন্তরিক্ষ ও দ্যুলোক—অগ্নি এই ত্রিবিধ স্থানেই আশ্রিত্ অগ্নিদেব পৃথিবীতে অগ্নি, অন্তরিক্ষে বিদ্যুৎরূপে এবং দুলোকে সুর্যরূপে অধিষ্ঠিত।
ঋগবেদীয় মন্ত্রসমূহে অগ্নির সহিত ‘ত্রিত্ব’ সংখ্যার সম্বন্ধ বিশেষভাবে লক্ষ্য করা যায়। ‘ত্রিষধস্থ,’ ‘ত্রিপস্ত্য'; ‘গার্হপত্য, ‘আহবনীয়’ ও ‘দক্ষিণ’ রূপে তাহার রূপত্রয় সুবিদিত। ‘হব্য-বাহন’, ‘ক্রব্য-বাহন’ ও ‘আমাদ’ রূপে তাঁর ত্রিবিধ রূপও যজুর্বেদে দৃষ্ট হয়। | ঋগবেদে ‘দৈববাদাস’, ‘ত্রাসদস্যব’, ‘বাধ্রেশ্ব’ প্রভৃতি নামে অভিহিত হয়েছে। ঋগবেদে প্রধানতঃ রক্ষক ও পুত্র, পশু, হিরণ্য প্রভৃতির দাতা রূপে অগ্নির আবাহন লক্ষিত হয়। তিনি বিশ্বপতি', তিনি
‘রক্ষোহন্'।
-
মহাভারত: ধর্মের্ ঔরসে
বসুভার্যার গর্ভে অগ্নির জন্ম।
এক রাক্ষস্,
পুলোমা নামক
এক নারীকে বিবাহ করতে ইচ্ছা প্রকাশ করলে,
পুলোমার
পিতা তাতে সম্মত না হয়ে, মহর্ষি
ভৃগুর
হাতে কন্যাকে সম্প্রদান করেন রাক্ষস এই কথা জানতে পেরে,
পুলোমার
সন্ধানে ভৃগুর কুটিরে আসেন
ভৃ্গু
তখন সেখানে না থাকায়,অগ্নির কাছ থেকে
পুলোমার
পরিচয় জেনে নিয়ে রাক্ষস তাকে অপহরণ করেন্ এই সময়
চ্যাবন ঋষি
পুলোমার
গর্ভে ছিলেন তিনি গর্ভ্যচ্যুত হয়ে রাক্ষসকে দগ্ধ করেন ভৃগু গৃহে প্রত্যাবর্তনের পর অগ্নিকে 'সর্বভুক্হও'
অভিশাপ দেন এরপর অগ্নি নিজেকে অগ্নিহোত্র যজ্ঞ থেকে
নিজেকে প্রত্যাহার করেন ফলে দেবতারা হব্য থেকে বঞ্চিত হতে থাকলে-
ব্রহ্মা অগ্নিকে বলেন যে, কেবলমাত্র গুহ্যদেশের শিখা ও ক্রব্যাদ (মাংসভক্ষক) শরীর সর্বভুক হবে এবং মুখে যে আহুতি দেওয়া হবে
,
তাই দেবগণের ভাগরূপে গৃহীত হবে [৫-৭ অধ্যায়।
আদিপর্ব। মহাভারত]
অগ্নি
শ্বেত্কি্রাজার
যজ্ঞে অতিরিক্ত হবি ভক্ষণ করে কঠিন উদরাময় রোগে আক্রান্ত হন্
নিরুপায় হয়ে অগ্নি
ব্রহ্মার কাছে গেলে—
ব্রহ্মা
তাঁকে
খাণ্ডববনের
সমস্ত জীবজন্তু
দৈত্যদানব, সর্প ইত্যাদি ভক্ষণ
করার উপদেশ দেন্ কিন্তু খাণ্ডববন দেব-রক্ষিত বলে
ইন্দ্র্তাতে বাধা
দেন তখন অগ্নি কৃষ্ণ্ও
অর্জুনের সাহায্য
প্রার্থনা করেন্কিন্তু তাঁরা দেবতাদের সাথে যুদ্ধ করবার উপযুক্ত অস্ত্রের অভাব জানালে
অগ্নি বরুণ্দেবতার কাছ থেকে
অর্জুনের জন্য কপিধ্বজ রথ্,
গাণ্ডীব-ধনু ও অক্ষয় তূণী এবং
কৃষ্ণের
জন্য
সুদর্শনচক্র ও কৌমদকী গদা এনে দেন্এর পর এঁরা দুজন খাণ্ডববন দগ্ধ করতে
সমর্থ হন্ উক্ত বনের সমস্ত জীবজন্তু,
দৈত্যদানব, সর্প ইত্যাদি ভক্ষণ
করে অগ্নি রোগমুক্ত হন।
[২২৩-২৪ অধ্যায়। আদিপর্ব। মহাভারত]
নিষ্ঠার সাথে অগ্নির পূজা করতেন। এই কন্যার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে অগ্নি ব্রাহ্মণবেশে এই
কন্যার সাথে বিহার করতেন। রাজা নীল এদের শাসন করলে- অগ্নি ক্রোধে প্রজ্জলিত হয়ে
উঠলেন। এতে রাজা অত্যন্ত ভীত হয়ে- রাজকন্যার সাথে অগ্নির বিবাহ দেন। এই নগরীকে
অগ্নি সব সময় রক্ষা করে চলতেন।
যুধিষ্ঠিরের্রাজসূয়যজ্ঞের
সময় সহদেব মাহিষ্মতী নগরী আক্রমণের সময় অগ্নিকে স্তব দ্বারা তুষ্ট করে, রাজা
নীলের রাজ্য অধিকার করেছিলেন। [৩০ অধ্যায়। সভাপর্ব। মহাভারত]
হরিবংশে আছে অগ্নির অঙ্গ কালো বস্ত্রে আবৃত,সঙগে থাকে ধূম্রপতাকা ও জ্বলন্ত বর্শা
এঁর বাহন ছাগ এঁর চারটি হাত্ দুই বা ততোধিক অরুণ বা পিঙ্গল বর্ণের অশ্বচালিত
উজ্জ্বল রথে ইনি ভ্রমণ করেন সপ্তবসু এঁর রথের চক্র অগ্নি পূর্ব-দক্ষিণ কোণের
অধিপতি, এই কারণে এই কোণকে অগ্নিকোণ বলা হয় ইনি পিতৃলোকের অধিপতি, দেবতাদের জন্য
যজ্ঞভাগ বহনকারী এবং দূত ও যজ্ঞের সারথী্ অগ্নির সাতটি শিখা আছে
এই শিখাগুলির নাম হলো করালী্, ধামিনী, নীললোহিতা, পদ্মরাগ, লোহিতাশ্বেতা, সুবর্ণা
অগ্নিকে নিয়ে বেশ কিছু কাহিনী প্রচলিত আছে। যেমন্-
-
দেবতারা ব্রহ্মার
কাছে খাদ্য প্রার্থনা করলে
ব্রহ্মা
বিষ্ণুর কাছে পরামর্শের
জন্য যান্ বিষ্ণু অগ্নিকে
বলেন যে, যজ্ঞ উপলক্ষে প্রদত্ত হবি দেবতাদের আহার হব্ এরপর ব্রাহ্মণেরা হবি প্রদান
শুরু করেন কিন্তু সেই হবি দেবতাদের কাছে পৌঁছুতো না তাই দেবতারা আবার
ব্রহ্মার শরণাপন্ন হন।
ব্রহ্মা তখন
দেবতাদেরকে প্রকৃতি দেবীর পূজা করতে বলেন্ পরে সমবেত পূজায়
প্রকৃতি্দেবী সন্তুষ্ট
হয়ে
ব্রহ্মার
প্রার্থনা করতে বলেন।
ব্রহ্মা
প্রার্থনা
করেন, যেন প্রকৃতি দেবী অগ্নির
দাহিকা শক্তি ও অগ্নির স্ত্রী হয় এবং অগ্নি তাঁর (প্রকৃতি দেবী) সাহায্য ছাড়া
হোমীয় দ্রব্য ভস্ম করতে না পারে। কিন্তু প্রকৃতি দেবী (স্বাহা)
তাতে রাজী না হয়ে
বি্ষ্ণু্র শরণাপন্ন
হন বি্ষ্ণু
স্বাহাকে
বলেন যে
দ্বাপরে আমি যখন পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করবো তখন
তুমি নগ্নজিৎ রাজার কন্যারূপে
(নাগ্নজিতী্) জন্মগ্রহণ
করে আমাকে স্বামী হিসাবে লাভ করবে দ্বাপর যুগের উক্ত ঘটনার পূর্ব পর্যন্ত তুমি
অগ্নির দাহিকা শক্তি রূপে কাজ করবে উল্লেখ্য স্বাহা নগ্নজীতের কন্যা হিসাবে দ্বাপরে
জন্মগ্রহণ করেন এবং পিতার নামানুসারে তাঁর নাম হয়
নাগ্নজিতী
বি্ষ্ণু্ অবতার
হিসাবে
কৃষ্ণরূপে জন্মগ্রহণ করলে
কৃষ্ণের সাথে তাঁর বিবাহ হয়।
-
দক্ষের কন্যা
স্বাহা
অগ্নিকে কামনা করে ব্যর্থ হন। অগ্নি এই সময় সপ্তর্ষিদের স্ত্রীদের দিকে
তাকিয়ে অত্যন্ত কামার্ত হয়ে পড়েন্ কিন্তু এই নারীদের পাবেন না বলে তিনি দুঃখে
বনে যান।
স্বাহা
এই সংবাদ জেনে একে একে ছয়জন ঋষির স্ত্রীর রূপ ধারণ করে অগ্নির কাছে যান।
সপ্তর্ষি্দের স্ত্রীদের মধ্যে
বশি্ষ্ঠ্মুনির স্ত্রী
অরুন্ধতী ছিলেন
তীব্র তাপসিনী এই কারণে স্বাহা
অরুন্ধতী’র
রূপ ধরতে ব্যর্থ হয়েছিলেন অগ্নির সাথে স্বাহা ছদ্মবেশে মিলিত হন প্রতিবারের মিলনের পর অগ্নির স্খলিত বীর্য
স্বাহা একটি
কুণ্ডে নিক্ষেপ করেন। পরে এই কুণ্ড থেকে স্কন্দ্
(কার্তিকেয়)-এর জন্ম হয়।
| এই ঘটনার পর ঋষিরা তাঁদের স্ত্রীদের দুশ্চরিত্রা জ্ঞানে ত্যাগ করেন। স্বাহা পরে সব স্বীকার করে নিলে এবং
স্কন্দের অনুরোধে ঋষিরা তাঁদের
স্ত্রীদের গ্রহণ করেন।
স্বাহা
অগ্নির
সাথে বাস করার জন্য স্কন্দের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করল স্কন্দ বলেন যে, হোমাগ্নিতে আহুতি প্রদানকালে স্বাহা অগ্নির সাথে থাকার
ইচ্ছা প্রকাশ করলেই তাঁর অগ্নির সাথে থাকা সম্ভব হবে।
অগ্নির স্ত্রীগণ
-
অগ্নি্দেবতা
দক্ষের কন্যা স্বাহাকে বিবাহ করেছিলেন স্বাহার গর্ভে তাঁর তিনটি পুত্র
জন্মে এরা ছিলেন- পাবক, পবমান ও শুচী এ ছাড়া
অগ্নিবেশ্য নামে আরও একটি পুত্রের কথা জানা যায় দেখুন:
স্বাহা
অগ্নির বিভিন্ন নাম
- অগ্নির তিনটি রূপ রূপ তিনটি হলো-
১. আকাশের সূর্য
২. বায়ুময় অন্তরীক্ষে বিদ্যুৎ
৩. পৃথিবীতে আগুন্
কিন্তু বিভিন্ন অর্থে অগ্নির আরও সমার্থ রয়েছে।
যেমন
-
ঋক্বেদে অগ্নিকে বিভিন্ন
নামে উল্লেখ করা হয়ছে এই নামগুলো হলো-
অর্চিষ্মান,
ঘৃতপৃষ্ঠ্,
জ্বালাকেশ, জ্বালাময়, নীলপৃষ্ঠ, তীক্ষ্ণ দংষ্ট্র,
পিঙ্গলাশ্মশ্রু, বৈশ্বানর, মধুজিহ্বা, সপ্তজিহ্বা,
হিরণাদন্ত, হিরণ্যকেশ।
অন্যান্য পৌরাণিক কাহিনিতে অগ্নির অন্যান্য যে নাম পাওয়া যায়, সেগুলো্ অ,
অব্জহস্তু, অনল, ছাগরথ, তোমারধর, ধূমকেতু, পাবক, বহ্নি বৈশ্বানর্, ভরণাম
রোহিতাশ্ব,
হুতভুজ, হুতাশ্
হুতাশন
জুহু: জুহু' নাম্ক্ হাতায় করে যজ্ঞে ঘৃতাহুতি দেওয়া হতো বলে এর নাম
জুহু্ পুরোহিত: অগ্নি ছাড়া যজ্ঞ হয় না বলে একে পুরোহিত বলা হয়।
প্রমন্থ : দুটি কাঠের ঘর্ষণে অগ্নির উৎপত্তি
বলে এর নাম প্রমন্থ্
বহুজন্মা : গৃহে গৃহে অগ্নি অধিষ্ঠিত বলে এর নাম-
বহুজন্মা
হব্যবাহক : দেবতাদের হব্য পৌঁছে দেয় বলে্
্এর নাম হব্যবাহক