কৃষ্ণ
হিন্দু ধর্ম মতে- বিষ্ণুর দ্বাপর যুগের একজন অবতার এবং মোট দশম অবতারের অষ্টম অবতার।

বসুদেবের ঔরসে দেবকীর অষ্টম গর্ভে কৃষ্ণের জন্ম হয়েছিল। কংস নামক এক অত্যাচারী রাজার অত্যাচার থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য দেবতারা ব্রহ্মার শরণাপন্ন হলে, ব্রহ্মা সকল দেবতাদের নিয়ে সমুদ্রের ধারে বসে বিষ্ণুর আরাধনা শুরু করেন। বিষ্ণু সে আরাধনায় সন্তুষ্ট হয়ে তাঁর সাদা ও কালো রঙের দুটি চুল দিয়ে বললেন যে, বসুদেবের ঔরসে দেবকীর সন্তান হিসাবে কৃষ্ণ হয়ে জন্মাবেন। কৃষ্ণের প্রতীক হলো কালো চুল। তাঁর সহযোগী হবে বলরাম, এর প্রতীক সাদা চুল। এই জন্মে তিনি কংসাসুরকে হত্যা করবেন। উল্লেখ্য বসুদেবের  অপর স্ত্রী রোহিণীর গর্ভে বলরাম জন্মেছিলেন।

দেবকীর পিতা দেবককংসের পিতা উগ্রসেন আপন দুই ভাই ছিলেন। সেই সূত্রে কংস ছিলেন দেবকীর কাকাতো ভাই অর্থাৎ কংস ছিলেন শ্রীকৃষ্ণের মামা। দেবর্ষি নারদ এসে কংসকে কৃষ্ণ- বলরাম-এর জন্মের কারণ বর্ণনা করে যান। এই সংবাদ পেয়ে কংস দেবকীর গর্ভজাত সকল সন্তানকে জন্মের পরপরই হত্যা করতে থাকলেন। শ্রীকৃষ্ণের জন্ম হয় দ্বাপর যুগের শেষে ভাদ্র-রোহিণী নক্ষত্রে,এক ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ রাত্রিতে। জন্মের পরপরই বসুদেব কংসের ভয়ে এই শিশুটিকে ব্রজধামে নন্দের বাড়িতে রেখে আসেন এবং তাঁর সদ্যজাতা কন্যাকে আনেন। ব্রহ্ম-বৈবর্ত্ত পুরাণের মতে এই কন্যা ছিলেন দুর্গা। এই পুরাণে এই সদ্যজাতা কন্যাকে অংশা নামে অভিহিত করা হয়েছে। বিষ্ণুর অনুরোধে তিনি যশোদার গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন। [ব্রহ্ম-বৈবর্ত্ত পুরাণ, শ্রীকৃষ্ণখণ্ড, সপ্তম অধ্যায়]

নন্দপত্নী যশোদা কৃষ্ণকে আপন পুত্র হিসাবেই পালন করেন। কৃষ্ণের জীবিত থাকার খবর পেয়ে- তাঁকে হত্যা করার জন্য- কংস বেশ কিছু দৈত্য-দানব পাঠান। এদের সবাইকে বিভিন্ন কৌশলে কৃষ্ণ হত্যা করেন এবং একই সাথে বিভিন্ন অলৌকিক কর্মকাণ্ড ঘটে। কৃষ্ণ কর্তৃক কংসবধের আগে যে ঘটনা ঘটে, সেগুলো হলো- রাধাকৃষ্ণ-লীলা
এই ঘটনার পরপরই আমরা বৃন্দাবনে রাধাকৃষ্ণের লীলা অংশ পাই। এই লীলা অংশ হিন্দু পৌরাণিক গ্রন্থগুলিতে সমানভাবে দেখা যায় না। এই লীলা অংশে আমরা যে কাহিনী দেখতে পাই তা হলো-
রাধা-কৃষ্ণের উৎপত্তি: পদ্মপুরাণ ও ভাগবতের মতে- গোলকধামে কৃষ্ণের বামপাশ হতে রাধার উৎপত্তি হয়েছিল। জন্মের পর পরই তিনি কৃষ্ণের আরাধনা শুরু করেন। তিনি উৎপত্তিকালে ১৬ বৎসরের নব-যৌবনারূপে কৃষ্ণের সিংহাসনের বামপাশে অবস্থান নেন। এই সময় রাধার লোমকূপ হতে লক্ষকোটি গোপিকা ও কৃষ্ণের লোমকূপ থেকে লক্ষকোটি গোপের জন্ম হয়। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের মতে- একবার বিষ্ণু রম্যবনে প্রবেশ করে রমণ ইচ্ছা প্রকাশ করেন। ফলে কৃষ্ণের ডান অংশ থেকে কৃষ্ণমূর্তি ও বাম অংশ থেকে রাধা মূর্তি প্রকাশ পায়। রাধা কৃষ্ণকে কামাতুর দেখে তাঁর দিকে অগ্রসর হন। রা অর্থ লাভ এবং ধা অর্থ ধাবমান। তিনি অগ্রসর হয়ে কৃষ্ণকে লাভ করেছিলেন বলে- এঁর নাম হয়েছিল রাধা। একবার কৃষ্ণ রাধার অজ্ঞাতে বিরজা নামক এক গোপীর সাথে মিলিত হন। দূতীদের মুখে রাধা এই সংবাদ পেয়ে অনুসন্ধানের জন্য অগ্রসর হলে- সুদামা কৃষ্ণকে উক্ত সংবাদ দেন। কৃষ্ণ এই সংবাদ পেয়ে বিরজাকে ত্যাগ করে অন্তর্হিত হন। বিরজা এই দুখে প্রাণত্যাগ করে নদীরূপে প্রবাহিত হন। রাধা পরে কৃষ্ণের দেখা পেয়ে তাঁকে তীব্রভাবে ভৎর্‍সনা করলে- সুদামা তা সহ্য করতে না পেরে-রাধাকে তিরস্কার করেন। রাধা এতে ক্ষুব্ধ হয়ে সুদামাকে অসুর হয়ে জন্মনোর অভিশাপ দেন। সুদামাও ক্ষুব্ধ হয়ে রাধাকে গোপী হয়ে পৃথিবীতে জন্মানোর অভিশাপ দিয়ে বলেন যে- সহস্র বত্সর কৃষ্ণবিরহ যন্ত্রণা ভোগ করার পর তিনি পৃথিবীতে কৃষ্ণের সাথে মিলিত হবেন। রাধা'কে সকল গোপীদের মধ্য সর্বপ্রধানা হিসাবে বিবেচনা করা হয়। মূলতঃ বৃন্দাবন লীলা রাধাকে কেন্দ্র করে উঠা উপাখ্যান মাত্র। বৃন্দাবনে রাধা ছিলেন কৃষ্ণের চেয়ে বড়। প্রথমাবস্থায় কৃষ্ণ রাধাকে পাবার জন্য বিবিধ ছলের আশ্রয় নেন। পরে উভয়ের মধ্যে গভীর সম্পর্ক গড়ে উঠে। এই সম্পর্ক উন্নয়নে যে সকল কাহিনী পাওয়া যায়- তা হলো- কৃষ্ণের সাথে রাধা সহ অন্যান্য গোপিনীদের সম্পর্ক গড়ে উঠে। গোপীরা কৃষ্ণকে স্বামী হিসাবে পাবার জন্য একমাসের কাত্যায়ন ব্রত করেন। এই এক মাস গোপীরা দলবদ্ধভাবে যমুনা নদীতে এসে এক সাথে স্নান করতো। এই সময় গোপীরা সকল বস্ত্র নদীর পারে রেখে উলঙ্গ অবস্থায় নদীতে স্নান করতে নামতো। কৃষ্ণ এই ব্রতের শেষ দিনে গোপীদের অনুসরণ করে নদীর পারে আসেন। গোপীরা বস্ত্র ত্যাগ করে নদীতে নামলে কৃষ্ণ পরিত্যাক্ত বস্ত্রগুলি অপহরণ করেন। এরপর কৃষ্ণের কাছে গোপীরা নিজেদের সমর্পণ করে বস্ত্র সংগ্রহ করলেন। এরপর গোপীরা গৃহত্যাগ করে কৃষ্ণের সাথে মিলিত হওয়ার জন্য কুঞ্জবনে আসে। এবং সেখানে গোপীরা ঈশ্বর জ্ঞানে তাঁর সাথে মিলিত হয়। কথিত আছে কৃষ্ণ নিজেকে গোপীদের মাঝে ছড়িয়ে দেন। ফলে প্রতি গোপীই একই সময়ে কৃষ্ণের সান্নিধ্য পান। কংসবধের জন্য কৃষ্ণ বৃন্দাবন পরিত্যাগ করেন।
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে কৃষ্ণের ভূমিকা :

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের শেষে গান্ধারী তাকে অভিশাপ দিয়ে বলেছিল- এই জ্ঞাতিক্ষয় যুদ্ধ নিবারণে কৃষ্ণ সমর্থ হয়েও তা করেন নি বলে- তিনি ছত্রিশ বৎসর পরে অপঘাতে মৃত্যুবরণ করবেন এবং কৃষ্ণের বংশ ধ্বংস হবে।

যদুবংশ ধ্বংস প্রাপ্ত হওয়ার পর- কৃষ্ণ-বলরাম সংসার ছেড়ে বনে চলে যান। যাবার সময় অর্জুনের কাছে তিনি তাঁর সারথি দারুককে পাঠিয়ে সকল বিষয় অবগত করান। বনে গিয়ে তিনি যোগাবলম্বনপূর্বক একস্থানে শয়ন করে থাকলেন। ইতোমধ্যে বলরাম দেহত্যাগ করেন। এই সময় জরা নামক এক শিকারী হরিণ মনে করে- কৃষ্ণের পায়ে শরবিদ্ধ করে। এর ফলে কৃষ্ণের মৃত্যু হয়। পরে অর্জুন দ্বারকায় এসে কৃষ্ণসহ সকল যাদবদের সত্কার করেন।

কৃষ্ণের নাম: কৃষ্ণ অসংখ্য নামে খ্যাত হয়েছিলেন। এই নামগুলির মধ্য থেকে উল্লেখযোগ্য কিছু নাম এখানে তুলে ধরা হলো- অঘনাশন, অচ্যুত, অনঙ্গমোহন, অনন্ত, অরিমর্দন, অরিষ্টমথন, অরিষ্টসূদন, অহিমার, অহিরিপু, কংসহা, কংসারি, কানাই, কানু, কালা, কালাচাঁদ, কালিয়া, কালীয়দমন, কালোশশী, কৃষ্ণ, কেশব, কেশিমথন, কেশিসূদন, কেষ্ট, গদাধর, গিরিধর, গিরিধারী, গোকুলনাথ, গোকুলপতি, গোকুলেশ্বর, গোপবল্লভ, গোপাল, গোপিকামোহন, গোপিকারমণ, গোপিনীবল্লভ, গোপীজনবল্লভ, গোপীনাথ, গোপীমোহন, গোপ্রে, গোবর্ধনধারী, গোবিন্দ, গোষ্ঠপতি, গোষ্ঠবিহারী, ঘনশ্যাম, জনার্দন, ত্রিভঙ্গ, ত্রিভঙ্গমুরারি, দর্পহারী, দামোদর, দেবকীনন্দন, দ্বারিকাপতি, নগধর, নটবর, ননীচোরা, নন্দদুলাল, নরনারায়ণ, নারায়ণ, নরোত্তম, নীলমণি, নীলমাধব, পদ্মঁখি, পাণ্ডবসখ, পাণ্ডবসখা, পার্থসারথী, পুণ্ডরীকাক্ষ, পীতবাস, পীতাম্বর, প্যারীমোহন, বংশীধর, বংশীধারী, বংশীবদন, বংশীবাদন, বনবিহারী, বনমালী, বনোয়ারি, বনোয়ারী, বহুবল্লভ, বালগোপাল, বাসুদেব, বিপিনবিহারী, বিশ্বম্ভর, বৃন্দাবনেশ্বর, বৃষ্ণি, ব্রজকিশোর, ব্রজদুলাল, ব্রজনারায়ণ, ব্রজবল্লভ, ব্রজমোহন, ব্রজরাজ, ব্রজসুন্দর, ব্রজেশ, ব্রজ্রে, বলানুজ, মথুরাপতি, মথুরেশ, মদনগোপাল, মদনমোহন, মধুসূদন, মাধব, মুকুন্দ, মুরলীধর, মুরলীমোহন, মুরারি, যজ্ঞেশ, যদুকুলনাথ, যশোদাদুলাল, যশোদানন্দন, যদুকুলপতি, যাদব, রসরাজ, রাখালরাজ, রাধাকান্ত, রাধানাথ, রাধাবল্লভ, রাধামাধব, রাধারঞ্জন, রাধারমণ, রাধিকামোহন, রাধিকারঞ্জন, রাধিকারমণ, রাসবিহারী, রাসেশ্বর, শকটারি, শৌরি, শ্যাম, শ্যামচন্দ্র, শ্যামচাঁদ, শ্যামরায়, শ্যামসুন্দর, শ্রীকৃষ্ণ, শ্রীগোবিন্দ,হরি, হৃষীকেশ।