নারদ
ভারতীয় পৌরাণিক কাহিনি এবং ভারতীয় সঙ্গীতশাস্ত্রে একাধিক নারদের নাম পাওয়া যায়। যেমন-
১.  বৈদিক নারদ। ঋগ্বেদের মন্ত্ররচয়িতা। ঋগ্বেদের ৮ম মণ্ডলের ১৩ নম্বর সূক্ত রচনা করেছিলেন। বেদে একে কণ্ব গোত্রীয় হিসেবে পরিচয় দেওয়া হয়েছে। কালানুক্রমিকতার বিচারে এই নারদ জীবিত ছিলেন খ্রিষ্টপূর্ব ১২০০ থেকে ৬০০ অব্দের ভিতরে।

২.পৌরাণিক নারদ। হিন্দু পৌরাণিক কাহিনী মতে- ব্রহ্মার মানসপুত্র। তিনি ত্রিকালজ্ঞ, বেদজ্ঞ ও তপস্বী। নার শব্দের অর্থ জল। তিনি সবসময় তর্পণের জন্য জলদান করতেন বলে এঁর নাম হয় নারদ।

ভগবত মতে- তিনি জনৈক ব্রাহ্মণের এক দাসীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি তাঁর মায়ের আদেশে সবসময় যোগীদের সেবা করতেন এবং এই যোগীদের উচ্ছিষ্ট খাবার খেয়ে ধর্মপরায়ণ হয়ে উঠেন। এই সময় সাপের কামড়ে তাঁর মায়ের মৃত্যু ঘটে। এরপর তিনি তপস্যার জন্য বনে যান। তিনি মাত্র একবার ঈশ্বরের দর্শন লাভ করতে সক্ষম হন। ঈশ্বরকে পাবার জন্য আকুল চেষ্টা করেও ঈশ্বরকে তিনি দ্বিতীয় বার দর্শন করতে পারলেন না। এরপর তিনি বিভিন্ন সাধুদের সেবা করে তাঁর বুদ্ধিকে দৃঢ় করেন এবং ঈশ্বর চিন্তায় মগ্ন থেকেই পৃথিবী ভ্রমণ করতে থাকেন। এই ভ্রমণের মধ্য দিয়েই তিনি ঈশ্বরে লীন হয়ে যান।

এরপর কল্প শেষে বিষ্ণু যখন সমুদ্রের জলে শায়িত ছিলেন, তখন তাঁর নিঃশ্বাস যোগে নারদ বিষ্ণুর অন্তরে প্রবেশ করেন। বিষ্ণু তাঁর নিদ্রা ত্যাগ করে যখন সৃষ্টির ইচ্ছা করেন তখন তাঁর ইন্দ্রিয় থেকে ব্রহ্মার উৎপত্তি হয় এবং ব্রহ্মার মন থেকে নারদ আবির্ভূত হন। তিনি সেই থেকে দেবদত্ত বীণায় হরি গান করে সর্বত্র ভ্রমণ করতে থাকেন। ব্রহ্মাবৈবর্ত পুরাণের মতে- এঁর জন্ম হয়ে ছিল ব্রহ্মার কণ্ঠ থেকে। প্রথমে ব্রহ্মা তাঁকে সৃষ্টির ভার দেন। সৃষ্টির কাজে ব্যস্ত থাকলে ঈশ্বর চিন্তা বিঘ্নিত হবে বিবেচনা করে তিনি ব্রহ্মার আদেশ মানতে রাজী হলেন না। ফলে ব্রহ্মা তাঁকে অভিশাপ দিয়ে বলেন যে, নারদকে গন্ধমাদন পর্বতে গন্ধর্বযোনিতে জন্মগ্রহণ করতে হবে। যথা সময়ে তিনি গন্ধর্বযোনিতে জন্মগ্রহণ করেন। এই সময় তাঁর নাম ছিল উপবর্হণ। এই জন্মে তিনি চিত্ররথের ৫০টি কন্যাকে বিবাহ করেন। এর পরে তিনি এক আসরে রম্ভার নাচ দেখে উত্তেজিত হলে, তাঁর বীর্যপাত হয়। এতে ব্রহ্মা আরও ক্রুদ্ধ হয়ে- তাঁকে মানুষ হয়ে জন্মানোর অভিশাপ দেন। ব্রহ্মার এই অভিশাপে কলাবতী নামক এক নারীর গর্ভে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। উল্লেখ্য কান্যকুব্জের গোপরাজ দ্রুমিলের বন্ধ্যা স্ত্রী ছিলেন কলাবতী। একদিন কশ্যপ স্বর্গের অপ্সরা মেনকাকে দেখে উত্তেজিত হয়ে পড়েন এবং তাঁর বীর্যস্খলন হয়। কলাবতী এই বীর্য পান করে গর্ভবতী হন এবং এই গর্ভ থেকে অভিশপ্ত নারদের জন্ম হয়। ব্রাহ্মণরা নারদকে ব্রহ্মার পুত্র জেনে তাঁকে বিষ্ণুমন্ত্রে দীক্ষিত করেন। এরপর তিনি বিষ্ণুর ধ্যান করতে করতে ব্রহ্মে লীন হয়ে যান।

৩. কল্পান্তরের নারদ। আদি কল্প শেষে ব্রহ্মা পুনরায় সৃষ্টি আরম্ভ করলে আবার দ্বিতীয় নারদের জন্মগ্রহণ। এই নারদ সঙ্গীতজ্ঞ ছিলেন ইনি বীণাবাদনে পারদর্শী ছিলেন পুরাণ মতে- নারদ সর্বদাই নানা রাগ-রাগিণী যুক্ত সঙ্গীত পরিবেশন করতেন। কিন্তু সবসময় তাঁর সঙ্গীতে কিছু না কিছু ত্রুটি থেকে যেতো। কিন্তু নারদ এই ত্রুটি নিজে বুঝতে পারতেন না, সেই কারণে নারদ তাঁর নিজের গান নিয়ে খুব গর্ব করতেন। নারদের এই গর্বকে খর্ব করার জন্য একবার রাগ-রাগিণীরা বিকলাঙ্গ নর-নারীর রূপ গ্রহণ করে নারদের যাত্রা পথে উপস্থিত হলেন। নারদ এই বিষয় অবগত ছিলেন না বলে- তিনি উক্ত বিকলাঙ্গ নারী-পুরুষরূপী রাগ-রাগিণীকে তাঁদেরকে বিকলাঙ্গের কারণ জিজ্ঞাসা করলেন। তখন তাঁরা বললেন যে, তাঁরা নারদের বিকৃত সঙ্গীতের রূপ। নারদ এই কথা শুনে ব্যাকুল হয়ে, তাঁদেরকে প্রকৃষ্টরূপে সঙ্গীত পরিবেশনের উপায় জিজ্ঞাসা করলেন। উত্তরে তাঁরা বললেন যে, মহাদেবের গান শুনলে তাঁদের বিকলাঙ্গতা দূর হবে। এরপর নারদ মহাদেবের কাছে সঙ্গীত শোনার আবেদন জানালে- মহাদেব জানালেন যে, প্রকৃষ্ট শ্রোতা ছাড়া তিনি গান শোনাবেন না। পরে নারদ মহাদেবের পরামর্শ অনুসারে  ব্রহ্মা ও বিষ্ণু-কে অনুরোধ করে আসরে নিয়ে আসেন। মহাদেবের গান শোনার পর রাগ-রাগিণীদের বিকলাঙ্গতা দূর হয়। এই সঙ্গীতের মর্ম ব্রহ্মা বুঝতে পারলেন না। কিন্তু বিষ্ণু কিছুটা বুঝতে পেরেছিলেন। ফলে ইনি আংশিক দ্রবীভূত হন। বিষ্ণুর এই দ্রবীভূত অংশ ব্রহ্মা তাঁর কমণ্ডলুতে ধারণ করেন। বিষ্ণুর এই দ্রবীভূত অংশই গঙ্গা নামে খ্যাত হয়। নারদের সঙ্গীতের প্রতি আকর্ষণ লক্ষ্য করে, বিষ্ণু উলুকেশ্বর নামক এক গন্ধর্বের কাছে তাঁকে সঙ্গীত শিক্ষার জন্য পাঠান। প্রাচীন সঙ্গীত শাস্ত্রে বর্ণিত নারদ, ছিলেন এই দ্বিতীয় নারদ। সম্ভবত তিনি গান্ধার গ্রাম সৃষ্টি করেছিলেন তাঁকে বিভিন্নস্থানে বিভিন্ন ভূমিকায় দেখা যায়। ইনি কৃষ্ণের জন্মবৃত্তান্ত পূর্বেই কংসকে জানিয়েছিলেন, ধ্রুবের তপস্যায় মন্ত্রদাতা ছিলেন, মহাদেব-পার্বতীর বিবাহের ঘটক ছিলেন, দক্ষের অহঙ্কার নাশে ইনি বিশেষ ভূমিকা রাখেন। রাময়ণের মূল কাহিনী তিনি বাল্মীকিকে শুনিয়েছিলেন। পরে এই কাহিনী অবলম্বনে বাল্মীকি রামায়ণ রচনা করেছিলেন। এছাড়া তিনি দূত হিসাবেও বিভিন্ন সময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন।  ইনি কথা গোপন করে রাখতে পারতেন না। কখনো কখনো অবিবেচকের মতো কথা বলে, বিপর্যয় ডেকে আনতেন। কংসের কাছে কৃষ্ণের কাছে জন্মগ্রহণ এবং কৃষ্ণকর্তৃক কংসবধের কথা বলেছিলেন। বিন্ধ্যপর্বতের কাছে সুমেরুর গুণকীর্তন করে, পৃথিবী বিপর্যস্ত করেন। পরে এই বিপর্যয় থেকে অগস্ত্য মুনি পৃথিবী রক্ষা করেন।

৪. নারদীয় শিক্ষা গ্রন্থের রচয়িতা। অনুমান করা হয়, নারদীয় শিক্ষার আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ১০০-২০০ অব্দের ভিতরে গ্রন্থটি রচনা করেছিল। নাট্যশাস্ত্রের প্রথম অধ্যায়ে বলা হয়েছে ঋগ্বেদ থেকে পাঠ্যবস্তু, সামবেদ থেকে গান, যজুর্বেদ থেকে অভিনয় এবং অথর্ববেদ থেকে রসসমূহ গ্রহণ করেন। এরূপ ব্রহ্মা বেদ ও উপবেদ (আয়ুর্বেদ, ধনুর্বেদ, গান্ধর্ববেদ ও স্থাপত্য) নিয়ে তৈরি করেছিলেন নাট্যবেদ। ব্রহ্মা ভরতকে এই নাট্যবেদ প্রদান করেন। পরে ব্রহ্মার আদেশে ভরত তাঁর একশত পুত্রকে এই নাট্যবেদের শিক্ষা দেন। এ ছাড়া ভরত ইন্দ্রধ্বজ মহোৎসবে প্রথম নাট্যাভিনয়ে স্বাতি বাদক হিসেবে নিযুক্ত নিয়েছিলেন। গায়ক হিসেবে ছিলেন নারদ। তবে এই নারদ নারদীয় শিক্ষার নারদ কিনা তা জানা যায় না।

. বৃহদ্দেশীর নারদ। বৃহদ্দেশী গ্রন্থটি রচিত হয়েছিল ৫০০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে। এই গ্রন্থের রচয়িতা মতঙ্গসঙ্গীত বিষয়ক আলোচনা করেছেন- নারদের সাথে। এই নারদ সঙ্গীতজ্ঞা ছিলেনখ তবে নারদীয় শিক্ষার নারদের অনেক ছোটো ছিলেন বৃহদ্দেশী গ্রন্থের নারদ।

. সঙ্গীতমকরন্দঃ গ্রন্থের রচয়িতা। স্বামী প্রজ্ঞানন্দ তাঁর 'রাগ ও রূপ' গ্রন্থে এই নারদের জন্মকাল উল্লেখ করেছেন- খ্রিষ্টীয় ১৫শ-১৬শ শতক। সঙ্গীতমকরন্দঃ গ্রন্থের বাংলা-অনুবাদক ডঃ প্রদীপকুমার ঘোষের মতে- 'বিদ্যাপুর-নরেশ রাজাদের অধীনস্থ জনৈক কৃ্ষ্ণাজী দত্ত, ১৫৯৯ শকাব্দে (১৬৭৭ খ্রিষ্টাব্দ) বিজয়দশমীর দিন সঙ্গীত-মকরন্দ নামক গ্রন্থের রচনা শেষ করেছিলেন।

. পঞ্চমসার সংহিতা রচয়িতা নারদ: খ্রিষ্টীয় সপ্তদশ শতাব্দীতে এই নারদ পঞ্চমসার সংহিতা রচনা করেছিলেন। এই গ্রন্থটিতে নৃত্য ও রাগ নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।

. চত্বারিংশচ্ছত-রাগ-নিরূপণম্-এর রচয়িতা নারদ: খ্রিষ্টীয় অষ্টাদশ শতাব্দীতে এই নারদ চত্বারিংশচ্ছত-রাগ-নিরূপণম্ রচনা করেছিলেন।


তথ্যসূত্র: