সমূহবাচিনৌ গ্রামৌ স্বর-শ্রুত্যাদিসংযুতৌ।
যথা কুটুম্বিনঃ সর্ব একীভূতা বসন্তী হি।
সর্বলোকস্য স গ্রামো যত্র নিত্যং ব্যবস্থিতিঃ॥
অর্থাৎ সর্বলোকের রীতি অনুসারে কোন গ্রামে গৃহস্থ যেমন সর্বদাই তার পরিবারের সদস্যদের নিয়ে একত্রে বসবাস করে তেমনি সংগীতেও স্বর-শ্রুতি ইত্যাদির সমন্বয়কে গ্রাম বলে।
খ্রিষ্টাপূর্ব ৬০০-৫০০ অব্দের ভিতরে রচিত হয়েছিল লোককাহিনি ও পৌরাণিক উপাখ্যানের
সমন্বয়ে মহাকাব্য 'রামায়ণ'। রামায়ণের যুগে সামগানের প্রচলন ছিল।
কিষ্কিন্ধ্যাকাণ্ডের ২৮তম সর্গের ৫৪তম শ্লোকে সামগানের উল্লেখ পাওয়া যায়।
উত্তরকাণ্ডের ১৬তম সর্গের ৩৩-৩৪তম শ্লোকে অনার্য (রাক্ষস) মহাদেবের স্তুতি করেছেন
সামগানের দ্বারা। বাল্মীকি রামায়ণের আদিকাণ্ডের চতুর্থ সর্গে উল্লেখ আছে, বাল্মীকি
রামের দুই পুত্র কুশী ও লবকে রাম-সীতার চরিত্রসহ রাবণ-বধ নামক কাব্য শেখান। কুশীলব
এই কাব্য পাঠ করা ও গান হিসেবে পরিবেশন করার প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। এ বিষয়ে রামায়ণের
এই অধ্যায়ে বলা হয়েছে- এই পাঠ ও গান মধুর, দ্রুত, মধ্য ও বিলম্বিতরূপে
ত্রিবিধ-প্রমাণ-সংযুক্ত ষড়্জ ও মধ্যম প্রভৃতি সপ্তস্বর-সংযুক্ত, বীণালয় বিশুদ্ধ
এবং শৃঙ্গার, করুণ, হাস্য, রৌদ্র, ভয়ানক ও বীর প্রভৃতি সমুদয়-রসসংযুক্ত। স্থান ও
মূর্চ্ছনাভিজ্ঞ, গান্ধর্ব্ববিদ্যাভিজ্ঞ কুশী ও লব তাহা গাহিতে লাগিলেন।'
রামায়ণের পাঠ থেকে জানা যায় গ্রাম এবং গ্রাম থেকে মূর্চ্ছনার উদ্ভব হয়েছিল এই সময়ে।
হয়তো
প্রাচীন ভারতের সঙ্গীতশিল্পীদের কণ্ঠে
কণ্ঠে গীতের যে বিকাশ ঘটেছিল, তার প্রকৃতি বিশ্লেষণ এবং কাঠামোগত বিন্যাসকে
শাস্ত্রীয় শৃঙ্খলে বাধার জন্য গ্রামের সূচনা হয়েছিল। প্রতিটি
গ্রামের অধীনে রাখা হয়েছিল মূর্চ্ছনা।
খ্রিষ্টীয় প্রথম শতাব্দীতে নারদ 'শিক্ষা' নামক একটি গ্রন্থ রচনা করেন।
এই গ্রন্থ থেকে বৈদিক গান থেকে শুরু করে গান্ধর্ব গানের প্রাথমিক বিকাশের রূপরেখা
পাওয়া যায়। এই গ্রন্থের তৃতীয় কণ্ডিকায় বলা হয়েছে-
''ষড়্জমধ্যমগান্ধারাস্ত্রয়ী গ্রামাঃ প্রকীতর্তিতা।
ভূলোকজ্জায়তে ষড়্জো ভূবর্লোকচ্চা মধ্যমঃ৬
সর্গান্ননাত্র গান্ধারো নারদস্য মতং যথা।
স্বররাগবিশেষণ গ্রামরাগো ইতি স্মৃতাঃ। ৭
নারদের সময়ে প্রচলিত তিনটি গ্রাম ছিল যড়্জ, গান্ধার ও মধ্যম।
নারদ এই সকল রাগের প্রচলনের স্থান হিসেবে পৌরাণিক ভাবনা থেকে লিখেছিলেন- পৃথিবীতে
ষড়্জগ্রাম, ভুর্বলোকে মধ্যমগ্রাম এবং স্বর্গলোকে গান্ধার গ্রাম প্রচলিত ছিল।
নারদ যদিও
ষড়্জ, মধ্যম ও গান্ধার গ্রামের কথা উল্লেখ করেছেন, কিন্তু সে সময়ে গান্ধার গ্রামের
প্রচলন ছিল না। তবে গান্ধার গ্রাম সম্পর্কে নারদ বিশেষভাবে অবগত ছিলেন।
নারদীয় শিক্ষায় পাওয়া যায় ৭টি গ্রামরাগের কথা। এগুলো হলো- ষড়জগ্রাম, পঞ্চম, কৈশিক,
কৈশিক মধ্যম, মধ্যমগ্রাম, সাধারিত ও ষাড়ব। এগুলোর উদ্ভব হয়েছিল গ্রাম থেকে।
গ্রাম সম্পর্কে প্রথম বিস্তৃত তথ্য পাওয়া যায়-
খ্রিষ্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দীতে ভরতের নাট্যশাস্ত্রে। ভারতের নাট্যশাস্ত্রে দুটি গ্রামের উল্লেখ পাওয়া যায়। এই গ্রাম দুটি হলো- ষড়্জ
গ্রাম ও মধ্যম গ্রাম (দ্বৌগ্রামৌ ষড়্জোমধ্যমশ্চেতি।
দ্রষ্টব্য
:
ষড়্জ গ্রাম,
মধ্যমগ্রাম মতঙ্গের মতে- সামবেদ থেকে জাত স্বরসমূহ থেকে ষড়্জ ও মধ্যম
গ্রামের উৎপত্তি হয়েছে। উভয় গ্রামের মধ্যে প্রধান বা মুখ্য গ্রাম হচ্ছে ষড়জ
গ্রাম। গ্রামের এই সাধারণ কাঠামোর উপর ভিত্তি করে আরোহণ ও
অবরোহণের সূত্রে তৈরি হয়েছিল
মূর্চ্ছনা।
তথ্যসূত্র: