ষড়্জ গ্রাম
ভারতীয় সঙ্গীত পদ্ধতির একটি পারিভাষিক শব্দ।
খ্রিষ্টীয় প্রথম শতাব্দীতে নারদ 'শিক্ষা' নামক একটি গ্রন্থ রচনা করেন।
এই গ্রন্থ থেকে বৈদিক গান থেকে শুরু করে গান্ধর্ব গানের প্রাথমিক বিকাশের রূপরেখা
পাওয়া যায়। এই গ্রন্থের তৃতীয় কণ্ডিকায় বলা হয়েছে-
''ষড়্জমধ্যমগান্ধারাস্ত্রয়ী গ্রামাঃ প্রকীতর্তিতা।
ভূলোকজ্জায়তে ষড়্জো ভূবর্লোকচ্চা মধ্যমঃ৬
সর্গান্ননাত্র গান্ধারো নারদস্য মতং যথা।
স্বররাগবিশেষণ গ্রামরাগো ইতি স্মৃতাঃ। ৭
নারদের সময়ে প্রচলিত তিনটি গ্রাম ছিল যড়্জ, গান্ধার ও মধ্যম।
নারদ এই সকল রাগের প্রচলনের স্থান হিসেবে পৌরাণিক ভাবনা থেকে লিখেছিলেন- পৃথিবীতে
ষড়্জগ্রাম, ভুর্বলোকে মধ্যমগ্রাম এবং স্বর্গলোকে গান্ধার গ্রাম প্রচলিত ছিল।
নারদ যদিও
ষড়্জ, মধ্যম ও গান্ধার গ্রামের কথা উল্লেখ করেছেন, কিন্তু সে সময়ে গান্ধার গ্রামের
প্রচলন ছিল না। তবে গান্ধার গ্রাম সম্পর্কে নারদ বিশেষভাবে অবগত ছিলেন।
নারদীয় শিক্ষায় পাওয়া যায় ৭টি গ্রামরাগের কথা। এগুলো হলো- ষড়জগ্রাম, পঞ্চম, কৈশিক,
কৈশিক মধ্যম, মধ্যমগ্রাম, সাধারিত ও ষাড়ব। এগুলোর উদ্ভব হয়েছিল গ্রাম থেকে।
গ্রাম সম্পর্কে প্রথম বিস্তৃত তথ্য পাওয়া যায়-
খ্রিষ্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দীতে ভরতের নাট্যশাস্ত্রে। ভারতের নাট্যশাস্ত্রে দুটি গ্রামের উল্লেখ পাওয়া যায়। এই গ্রাম দুটি হলো- ষড়্জ
গ্রাম ও মধ্যম গ্রাম (দ্বৌগ্রামৌ ষড়্জোমধ্যমশ্চেতি। এই গ্রন্থে
৭টি শুদ্ধ স্বরকে (স র গ ম প ধ ন) স্থাপন করা হয়েছিল ২২টি
শ্রুতিতে। নাট্যশাস্ত্রের ১৮তম অধ্যায়ে উল্লেখ আছে-
ষড়্জ চার শ্রুতি, ঋষভ তিন শ্রুতি, গান্ধার দুই শ্রুতি, মধ্যম চার শ্রুতি, পঞ্চম
চার শ্রুতি ধৈবত ৩ শ্রুতি এবং নিষাদ ২ শ্রুতি। স্বরসপ্তকের প্রথম ষড়্জ স্থাপিত
হয়েছিল প্রথম তিন শ্রুতি বাদ দিয়ে। একইভাবে অন্য ছয়টি স্বর একই ভাবে সূত্রানুসারে
শ্রুতিগুলোতে স্থাপিত হয়েছিল। এই বিচারে ষড়জগ্রামের কাঠামো ছিল নিম্নরূপ।
শ্রুতি সংখ্যা ও নাম |
নাট্যশাস্ত্রে
বর্ণিত ষড়্জগ্রামে শুদ্ধস্বর |
১.
তীব্রা |
|
২.
কুমুদ্বতী |
|
৩.
মন্দা |
|
৪.
ছন্দোবতী |
ষড়্জ
(স) |
৫.
দয়াবতী |
|
৬.
রঞ্জনী |
|
৭. রক্তিকা |
শুদ্ধ
ঋষভ
|
৮.
রৌদ্রী |
|
৯. ক্রোধা |
শুদ্ধ গান্ধার |
১০.
বজ্রিকা |
|
১১.
প্রসারিণী |
|
১২.
প্রীতি |
|
১৩.
মার্জনী |
শুদ্ধ
মধ্যম |
১৪.
ক্ষিতি |
|
১৫.
রক্তা |
|
১৬.
সন্দীপিনী |
|
১৭.
আলাপিনী |
পঞ্চম |
১৮.
মদন্তী |
|
১৯.
রোহিণী |
|
২০.
রম্যা |
শুদ্ধ
ধৈবত |
২১.
উগ্রা |
|
২২.
ক্ষোভিণী |
শুদ্ধ
নিষাদ |
মতঙ্গের মতে- সামবেদ থেকে জাত স্বরসমূহ থেকে ষড়্জ ও মধ্যম
গ্রামের উৎপত্তি হয়েছে। উভয় গ্রামের মধ্যে প্রধান বা মুখ্য গ্রাম হচ্ছে ষড়জ
গ্রাম। গ্রামের এই সাধারণ কাঠামোর উপর ভিত্তি করে আরোহণ ও
অবরোহণের সূত্রে তৈরি হয়েছিল
মূর্চ্ছনা।
প্রাথমিকভাবে গ্রাম
নির্ধারিত হয়েছিল শুদ্ধ স্বরের বিচারে। এই বিচারে মূর্চ্ছনাগুলোও তৈরি হয়েছিল।
গ্রামভেদে এসকল মূর্ছনার প্রত্যেকটির স্বতন্ত্র নাম ছিল। দেখুন:
ষড়্জ গ্রামের মূর্ছনা
ষড়্জ গ্রাম থেকে উৎপন্ন হয়েছিল গ্রামরাগ। আর এই
গ্রামরাগগুলো ব্যবহৃত হতো নাটকের ধ্রুবাগানে। ভরত জাতিগান হিসেবে ষড়্জ গ্রাম থেকে
উৎপন্ন গ্রামরাগগুলোকে যে ভাবে ভাগ করেছিলেন, তা নিচে তুলে ধরা হল-
ষড়জ ও মধ্যম গ্রামের সামগ্রিক শ্রেণিকরণ
- ষড়্জ গ্রামজাত জাতি: মোট ৭টি জাতি। এগুলো হলো-
ষাড়্জী,
আর্যভী,
ধৈবতী,
নৈষাদী,
ষড়্জকৈশিকী,
ষড়্জোদীচ্যবতী এবং
ষড়্জমধ্যমা।
এই রাগগুলো শুদ্ধ ও বিকৃত হিসেবে বিভাজিত ছিল।
- শুদ্ধ জাতি: এই জাতীয় গানে একটি মাত্রা জাতি শুদ্ধভাবে
পরিবেশিত হতো। শুদ্ধ শ্রেণির জাতিগুলো ছিল-
ষাড়্জী,
আর্যভী,
ধৈবতী,
নৈষাদী
(নিষাদবতী)।
- বিকৃত জাতি: একাধিক জাতির সংমিশ্রণে সৃষ্ট জাতিগানে বিকৃত
জাতি হিসেবে বিবেচনা করা হতো। ষড়জ্ গ্রামের বিকৃত জাতিতে একাধিক জাতির
মিশ্রণ থাকলেও ষাড়জী জাতির প্রাধান্য রাখা হতো। যাড়্জী জাতির অন্তর্গত
বিকৃত জাতিগুলো হলো-
ষড়্জগ্রামজাত ভাষারাগসমূহ:
- টক্ক:
বৃহদ্দেশীতে যাষ্টিকের উদ্ধৃতিতে বলা হয়েছে- এই রাগের অধীনে ১৬টি
ভাষারাগ ছিল। এগুলো হলো-
ত্রবণা,
ত্রবোণদ্ভবা,
বেরঞ্জিকা,
ছেবাটী,
মালবেসরী,
গুর্জরী,
সৌরাষ্ট্রিকা,
সৈন্ধবী,
বেসরিকা,
পঞ্চম,
রবিচন্দ্রিকা,
অম্বাহেরী,
ললিতা,
কোলাহলী,
মধ্যমগ্রামিকা,
গান্ধারপঞ্চমী।
শার্ঙ্গদেব তাঁর সঙ্গীতরত্নাকর গ্রন্থের রাগবিবেকাধ্যায়ের প্রথম প্রকরণে ২১
(খ)-৪৭-এ টক্ক রাগের ২১টি ভাষা রাগের নামোল্লেখ করেছেন। এগুলো হলো- শ্রবণা (ত্রবণা),
শ্রবণোদ্ভোবা (ত্রবোণদ্ভবা),
বৈরঞ্জী, মধ্যমগ্রামদেহা (মধ্যমগ্রামিকা),
মালবেসরী,
ছেবাটী,
সৈন্ধবী,
কোলহলা (কোলাহলী),
পঞ্চমলক্ষিতা, সৌরাষ্ট্রী (সৌরাষ্ট্রিকা),
পঞ্চমী (পঞ্চম),
বেগরঞ্জিনী,
গান্ধারপঞ্চমী, মালবী, তানবলিতা,
ললিতা,
রবিচন্দ্রিকা,
ভানা, অম্বাহেরিকা(অম্বাহেরী),
দোহ্যা ও বেসরী (বেসরিকা)
তথ্যসূত্র:
-
নাট্যশাস্ত্র (৪র্থ খণ্ড)। ভরত। বঙ্গানুবাদ: সুরেশচন্দ্র
বন্দ্যোপাধ্যায় এবং ছন্দা চক্রবর্তী। নবপত্র প্রকাশন। ডিসেম্বর ২০১৪।
-
বৃহদ্দেশী। মতঙ্গ। সম্পাদনা।
রাজ্যেশ্বর মিত্র। সংস্কৃত পুস্তক ভাণ্ডার। কলিকাতা ৭০০০০৬। ১৯৮২