ষড়্‌জ
ভারতীয় সঙ্গীত পদ্ধতিতে স্বরসপ্তকের প্রথম স্বর এবং পাশ্চাত্য সঙ্গীত পদ্ধতিতে স্কেলের প্রথম স্বর। ভারতীয় সঙ্গীত পদ্ধতিতে এর ব্যবহারিক নাম 'সা'। প্রাচীন ভারতীয় সঙ্গীতে এর লৌকিক নাম ছিল ষড়্‌‌জ। বর্তমানে এই নামটিকে শাস্ত্রীয় নাম হিসেবে মান্য করা হয়।

ষড়্‌জ শব্দের রূপতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ হলো- ষষ্ (ছয়)+
জন্ (জন্মগ্রহণ করা) + অ (ড)। অর্থাৎ যে স্বর থেকে অপর ছয় স্বরের জন্ম হয়। এর ব্যবহারিক উচ্চারণ সা।

মতঙ্গমুনির প্রণীত বৃহদ্দেশী গ্রন্থে কোহলের মতানুসারে এই স্বরের অর্থ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছ-  ভেক (ব্যাঙ)। বৃহদ্দেশীতে উল্লেখ আছে-
                   ষড়জং বদতি ময়ুর ঋষভং চাতকো বদেৎ             
                   অজা বদতি গান্ধারং ক্রৌঞ্চো বদতি মধ্যমম॥
                   পুষ্পসাধারণে কালে কোকিল: পঞ্চমং বদেৎ।
                   সর্বদা চ তথা দেবি ! নিষাদং বদতি গজ।

অর্থাৎ ময়ূর ষড়জ স্বর, চাতক ঋষভ স্বর, ছাগ গান্ধার স্বর, সারস মধ্যম স্বর, বসন্তকালে কোকিল পঞ্চম স্বর, বর্ষাকালে ভেক ধৈবত স্বর এবং হস্তি নিষাদ স্বর উচ্চারণ করে।
 

সামগানে ব্যবহৃত তিনটি স্বরস্থান (উদাত্ত, স্বরিত, অনুদাত্ত) থেকে এই প্রাথমিকভাবে সাতটি শুদ্ধ স্বর সৃষ্টি হয়েছে। সামগানে এই সাতটি স্বরের নাম ছিল ক্রুষ্ট, প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ, মন্দ্র ও অতিস্বার্য। সেকালের লৌকিক গানে এই স্বরগুলো ভিন্ন ভিন্ন নামে প্রকাশ পেয়েছিল। এই লৌকিক স্বরগুলো হলো ষড়্জ,  ঋষভ, গান্ধার, মধ্যম পঞ্চম, ধৈবত ও নিষাদ। 
যাজ্ঞবল্ক্যের  শিক্ষায় বলা হয়েছে-

ঊচ্চৌ নিষাদগান্ধারৌ নীচবৃষভধৈবতৌ।
শৈষাস্তু স্বরিতা জ্ঞেয়াঃ ষড়্‌জ-মধ্যম-পঞ্চমাঃ॥

ভারতীয় সঙ্গীতে সকল স্বরের জননী হলো ষড়্‌জ। অভিধান মতে- ছয়টি স্থান থেকে উৎপন্ন সঙ্গীতের আদি স্বর। এই স্বরের কোনো বিকৃত স্বর নেই। এই কারণে একে বলা হয় অচলস্বর। এর জাতি হিসেবে উল্লেখ করা হয় 'মধ্যা'।

ভরত তাঁর নাট্যশাস্ত্রে এই স্বরটির ব্যাপ্তী হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে চার শ্রুতি। এই শ্রুতিগুলো হলো-তীব্রা, কুমুদ্বতী, মন্দা ও ছন্দোবতী। ভরত এই চারটি শ্রুতির ভিতর ষড়্‌জ-এর অবস্থান হিসেবে নির্দেশ করেছিলেন ছন্দোবতী। পণ্ডিত অহোবল যখন তারের ৩৬ ইঞ্চির ধ্বনিকে মধ্য সপ্তকের ষড়্‌জ হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন, তখন ওই স্বরকে ছন্দোবতী শ্রুতি হিসেবে বিবেচনা করেছিলেন। পরবর্তী সময়ে শ্রীনিবাসও একই মত প্রকাশ করেছিলেন। এরপর পণ্ডিত ভাতখণ্ডে ষ‌ড়্‌জের এই অবস্থানকে অগ্রাহ্য করে মত দেন যে, ষড়্‌জের অবস্থান হবে তীব্রা শ্রুতিতে। বর্তমানে ষড়্‌জের অপর তিনটি শ্রুতিতে রয়েছে ঋষভের তিনিটি বিকৃত স্বর। এগুলো হলো-
 
শ্রুতি সংখ্যা ও নাম

প্রচলিত স্বর

প্রচলিত আকারমাত্রিক স্বরচিহ্ন

. তীব্রা  

ষড়্‌জ

. কুমুদ্বতী 

অতি কোমল ঋষভ

. মন্দা

কোমল ঋষভ

. ছন্দোবতী  

অনুকোমল ঋষভ

পাশ্চাত্য সঙ্গীত পদ্ধতিতে যে কোনো স্কেলের প্রথম স্বর, এর নাম Do। পাশ্চাত্য রীতিতে এই নামের অর্থ হলো- হরিণী। পাশ্চাত্য স্কেলসমূহের প্রথম স্কেল হল-  A। তাই Doকে অনেক সময় সা হিসেবে মান্য করা হয়। অনেকে  C স্কেল Do বা সা হিসেবে মান্য করে থাকেন। পাশ্চাত্যরীতিতে শ্রুতিকে পৃথকভাবে উল্লেখ করা হয় না। এর পরিবর্তে ফ্ল্যাট ও শার্পের বিচারে Do-এর ব্যাপ্তী বুঝানো হয়। ‌ইংরেজি ও রোমান পদ্ধতিতে Do-এর ব্যাপ্তী হলো-

ইংলিশ প্রতীক

রোমান প্রতীক

প্রচলিত নাম

Cbb

Dobb

-

Cb Dob

-

C Do Do
C# Do#

-

Cx Dox

-


সূত্র:
  • নাট্যশাস্ত্র। অষ্টাবিংশ অধ্যায়। নারদ। বঙ্গানুবাদ: ডঃ সুরেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় ও ডঃ ছন্দা চক্রবর্তী। নবপত্র প্রকাশন। ডিসেম্বর ২০১৪
  • বঙ্গীয় শব্দকোষ (প্রথম খণ্ড)। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়। সাহিত্য অকাদেমী। ২০০১।
  • বৃহদ্দেশী। মতঙ্গ। সম্পাদনা: রাজেশ্বর মিত্র। সংস্কৃত পুস্তক ভাণ্ডার।
  • সঙ্গীতমকরন্দঃ। নারদ। সম্পাদনা ও ভাষান্তর: ডঃ প্রদীপকুমার ঘোষ। রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়ান মিউজিকোলোজি। ১৯৮৮
  • ভারতীয় সঙ্গীতের ইতিহাস । প্রথম খণ্ড। স্বামী প্রজ্ঞানানন্দ। শ্রীরামকৃষ্ণ বেদান্ত মঠ। ১৯৬১
  • সঙ্গীতরত্নাকর। শার্ঙ্গদেব। অনূবাদ: সুরেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। ২২ শ্রাবণ ১৪০৮