স্বর (সঙ্গীত)
note,
musical note
সঙ্গীতোপযোগী শব্দের
ব্যবহারিক উপাদান বিশেষ, যা সুরের মৌলিক উপাদান হিসেবেই বিবেচিত হয়ে থাকে।
শব্দজগতে স্নিগ্ধ মনোমুগ্ধকর ধ্বনি বা
সঙ্গীতোপযোগী শব্দের
সংখ্যা অসংখ্য। এই বিশাল
সঙ্গীতোপযোগী শব্দের
সবগুলোই স্বর হয়ে ওঠে না। বর্তমানে ভারতীয় সঙ্গীত পদ্ধতিতে স্বর দুটি পদ্ধতিতে বিচার করা হয়। এই
পদ্ধতি বা ধারা দুটি হলো-
পাশ্চাত্য স্বরপদ্ধতি এবং
ভারতীয় স্বরপদ্ধতি।
পাশ্চাত্য স্বরপদ্ধতিতে
স্বর বিবেচনা করা হয়-
স্কেলের
বিচার, যা শব্দের কম্পাঙ্ক অনুসারে বিবেচিত হয়। অপর দিকে
ভারতীয় স্বরপদ্ধতিতে
স্বর নির্ধারিত হয়- স্বরাষ্টকের শ্রুতিতে বিশেষভাবে বিন্যস্ত
সঙ্গীতোপযোগী শব্দ
অনুসারে।
স্বরের ক্রমবিকাশ
মূলত শাস্ত্রীয় আদর্শে সঙ্গীতোপযোগী ধ্বনিগুলোর নামকরণের আগেই মানুষ গান গাওয়া
শিখেছিল।
জীবজগতে হোমো স্যাপিয়েন্স
তথা মানুষের আবির্ভাবের আগেই মানুষের নিকটতর প্রজাতি
নিয়ানডার্থাল-রা
বাঁশি আবিষ্কার করেছিল। এর
উৎকৃষ্ট উদাহরণ
ডিভ্জে বাবে বাঁশি। এর অর্থই হলো- সঙ্গীতোপযোগী শব্দের সৌন্দর্য গ্রহণের ক্ষমতা
তাদের ভিতরে জন্মেছিল। মানুষ
নিয়ানডার্থালদের
কাছ থেকে স্বর গ্রহণ করেছিল, না কি মানুষের ক্রমবিবর্তনের ধারায়, এই ক্ষমতা
নিজেরাই অর্জন করেছিল, এ নিয়ে বিতর্ক আছে। যে ভাবেই হোক মানুষ তার আদিম স্তরে
সঙ্গীত এবং ভাষার ব্যবহার শিখেছিল। এই কারণে ভাষা ও সঙ্গীতকে বলা যায়, পরস্পরের
সহোদরা।
আদিম মানুষ প্রথম দিকে
সুখশ্রাব্য ধ্বনিকে ভালোবাসতে শিখেছিল। সেই ধ্বনিই তারা প্রাত্যহিক কথার ভিতরে
ব্যবহার করতো। সেকালের মায়েরা বোধকরি সুখশ্রাব্য ধ্বনি দিয়ে শিশুকে ভোলাতো। মানুষ
শুনতো গায়ক পাখির সুমিষ্ট স্বর। অনুকরণপ্রিয় মানুষ তাকে অনুকরণও করতো। দলের
অন্যান্যদের সাথে কথা বলার সময় ধ্বনির কঠোর-কোমলরূপের চর্চা ছিল। তীর ছুড়ে দেওয়ার পর ধনুকের টানা সুতোয় জেগে
উঠা বোঁ ধ্বনির ভিতরে তারা সুখশ্রাব্য ধ্বনির সন্ধান পেয়েছিল। তীব্র বায়ু প্রবাহের
সূত্রে গাছের পাতার ভিতর দিয়ে সুমিষ্ট শীষ ধ্বনি শোনার অভিজ্ঞতাও হয়েছিল। গাছের পাতা
ঠোঁটের প্রান্তে ধরে তীব্র বায়ু প্রবাহের সৃষ্টি হলে সুখশ্রাব্য ধ্বনির তৈরি হয়ে
সেটাও জেনেছিল। এই সব অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে মানুষের মনোজগতে সুখশ্রাব্য ধ্বনির রূপ
তৈরি করেছিল। এক সময় কেউ না কেউ সে রূপকে পশুর রগে তৈরি একতারা বা পাতার বাঁশিতে
ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছিল। কিম্বা নিজের কণ্ঠস্বরের ভিতর দিয়ে তা প্রকাশ করার
চেষ্টা করেছিল। আবার নলখাগড়ার নলে ফুঁ দিয়ে সসঙ্গীতোপযোগী
ধ্বনির সন্ধান পেয়েছি। কালক্রমে পাতার বাঁশিই হয়ে উঠেছিল রিড। আর নলখাগড়া বা ফাঁপা
পশুর হাড়ে বায়ু-প্রবাহজাত অনুরণাত্মক ধ্বনি-সৃষ্টিকারী উপকরণ হয়ে উঠেছিল বাঁশী।
পশুর রগ, শুকনো নাড়ি, টানটান করা সুতো থেকে উৎপন্ন ধ্বনি থেকে সৃষ্টি হয়েছিল
ততযন্ত্র। এ সবই মানুষ সৃষ্টি করেছিল সুখশ্রাব্য
ধ্বনির ভিতর দিয়ে আনন্দদায়ক অনুভূতি লাভের জন্য।
মানব সভ্যতার উষা লগ্নে মানুষ যখন
সঙ্গীতোপযোগী শব্দের
সন্ধান পেয়েছিল, তখন তার কোনো শাস্ত্রীয় নাম ছিল না। এই ধ্বনিগুলোকে তারা কণ্ঠে বা
যন্ত্রের দ্বারা প্রকাশ করতে সক্ষম হয়েছিল। এই ধ্বনিগুলো প্রাধান্য পেয়েছিল শব্দ-উচ্চতা
(Loudness), শব্দ-তীক্ষ্ণতা
(Pitch)
এবং
শব্দ-রঞ্জকতা (timbre) দ্বারা। এর দ্বারা সূচিত হয়েছিল
সঙ্গীতোপযোগী
ধ্বনি তৈরির
কৌশল।
সঙ্গীতের প্রাথমিক চর্চার ভিতর দিয়ে, আদি
শিল্পীরা বৈচিত্র্যতা আনার জন্য আরও কিছু ধ্বনির সন্ধান করেছিলেন।
বহুদিনের এবং বহু জনের চর্চার ভিতর দিয়ে সঙ্গীতোপযোগী ধ্বনির সংখ্যা বৃদ্ধি
পেয়েছিল। এই ঘটনা শুধু ভারতবর্ষে নয়, সকল মানবগোষ্ঠীর ক্ষেত্রেই ঘটেছিল।
গোড়ার দিকে মানুষ সুরের আনন্দেই বিভোর ছিল। সেকালের সাধারণ মানুষদের ভিতর কেউ
কেউ বিশেষ ভাবে সঙ্গীত পরিবেশন করতে পারতেন সেকালে ভালো গান পারেন বা গান শেখায়
আগ্রহী মানুষের অভাব ছিল না। এঁদের ভিতরে যাঁরা বিশেষ প্রতিভার পরিচয় দিয়েছিলেন,
তাঁদের হাত ধরে গুরু পরম্পরায় সঙ্গীতের উৎকর্ষ সাধিত হয়েছিল। আদিকালের সঙ্গীতের
আদিগুরুদের ছিলেন মূলত লোকসঙ্গীতের সাধক।
এর ফলে
সেকালের সঙ্গীত শিল্পী হয়ে উঠেছিলেন সঙ্গীতগুরু। প্রাচীন সঙ্গীতগুরুরা সঙ্গীতের স্বরের
বিশিষ্টরূপকে মনের মধ্যে ধারণ করার সূত্রে সঙ্গীতোপযোগী ধ্বনিকে চিহ্নিতকরণ এবং তার
নামকরণের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলেন। এই সূত্রে লোকসঙ্গীতের সুর ক্রমে ক্রমে
শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে রূপ লাভ করেছিল। যেমন মানুষ প্রথমে ভাষার ব্যবহার শিখেছিল, পরে
ব্যাকরণ দ্বারা ভাষাকে নিয়মবদ্ধ করে ব্যাকরণশাস্ত্রের সৃষ্টি করেছিল। গানও তেমনি।
মানুষ আগে গান গাইতে শিখেছিল। তারপর গানের শাস্ত্রীয় বিধি তৈরি হয়েছিল।
শাস্ত্রকাররা সঙ্গীতোপযোগী ধ্বনগুলোকে শাস্ত্রীয়
আদর্শে বা সঙ্গীতের ব্যাকরণে বাঁধার জন্য শৃঙ্খলিত করেছিলেন। এঁরা স্কেলের ভিতরে
প্রথাগত গানের বিচারে কিছু কিছু সঙ্গীতোপযোগী ধ্বনিকে শনাক্ত করেছিলেন। ইউরোপ, আরব,
ভারত, চীন ইত্যাদি দেশের সঙ্গীতজ্ঞদের কাছে স্কেল ছিল একটি সুরসীমা মাত্র। এঁরা এই
সুরসীমার ভিতরে নানাভাবে ভাগ করার চেষ্টা করেছিলেন। এই প্রচেষ্টার মাধ্যমে সৃষ্টি
হয়েছিল
১২,
১৯, ২৪, ২২,
৩১ সমবিভাজন। শেষ পর্যন্ত ১২ সমবিভাজনটি আন্তর্জাতিকভাবে গৃহীত হয়েছে।
ভারতীয় পদ্ধতিতে স্বরের পাশাপাশি শ্রুতি হিসেবে আরও একটি বিশেষ ধরনের সঙ্গীতোপযোগী
ধ্বনির কথা বিবেচনা করা হয়। উল্লেখ্য, সাধারণ ভাবে বলা যায় শ্রুতি হলো- একটি
স্বরাষ্টকে ২২ ভাগের, প্রতিটি ভাগ হলো শ্রুতি।
আধুনিককালে, সাধারণভাবে একটি স্কেল বা স্বরসপ্তকের ভিতরে ১২টি স্বরেকে স্বীকার করে নেওয়া হয়। কিন্তু শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যায় পদ্ধতিভেদে স্বরের ক্রমবিন্যাস এবং নির্দিষ্টকরণের বিষয়টি একই রকম নয়। এই বিচারে পদ্ধতির বিচারে স্বরগুলোকে পৃথক পৃথকভাবে চিহ্নিত করা হয়।
দ্রষ্টব্য:
পাশ্চাত্য স্বরপদ্ধতি
ভারতীয় স্বরপদ্ধতি।
তথ্যসূত্র:
- ভারতীয় সঙ্গীতের ইতিহাস । প্রথম খণ্ড। স্বামী প্রজ্ঞানন্দ
- ভারতীয় সঙ্গীতকোষ। শ্রীবিমলাকান্ত রায়চৌধুরী। বৈশাখ ১৩৭২।
- রাগ ও রূপ। স্বামী প্রজ্ঞানন্দ। জুলাই ১৯৯৯।
- সঙ্গীতসমীক্ষা। ড. প্রদীপকুমার ঘোষ