মেল
দক্ষিণ ভারতীয় সঙ্গীতপদ্ধতির একটি পারিভাষিক শব্দ। দক্ষিণ ভারতীয় সঙ্গীত পদ্ধতিতে রাগের বর্গীকরণের জন্য ব্যবহৃত একধরনের স্বর-কাঠামো। পাশ্চাত্য সঙ্গীতে এর সমতুল্য উপাদান হলো স্কেল। উত্তর ভারতীয় সঙ্গীত পদ্ধতিতে একে ঠাট হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
           [দেখুন: মেল বা ঠাটের ইতিহাস।]

বর্তমানে দক্ষিণ ভারতে মেলের সংখ্যা ধরা হয় ৭২টি। ১৭শ খ্রিষ্টাব্দে পণ্ডিত বেঙ্কটমখী ৭২টি মেলরাগের ধারণা প্রবর্তন করেন। এক্ষেত্রে তাঁকে বিশেষভাবে সহয়তা দিয়েছিলেন তাঁর পিতা গোবিন্দ দীক্ষিত। পরবর্তী সময়ে গোবিন্দাচার্য 'সংগ্রহচূড়ামণি' গ্রন্থে মেল-এর একটি চূড়ান্তরূপ দান করার উদ্যোগ নেন। এর ফলে বেঙ্কটমখী এবং গোবিন্দাচার্যের মেলরূপের দুটি ধারা প্রচলিত হয়। অনেকক্ষেত্রেই উভয়ের ধারণার মিল আছে যেমন, আবার অনেকক্ষেত্রে অমিলও আছে।

মেল পদ্ধতিতে স্বরসমূহকে দুটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এর একভাগে রয়েছে শুদ্ধমধ্যম, অপরভাগে রয়েছে প্রতিমধ্যম। মেলের এই বিষয়টি বুঝার জন্য প্রথমে জানতে হবে দক্ষিণ ভারতের স্বরবিন্যাস পদ্ধতি।

দক্ষিণ ভারতীয় সঙ্গীত পদ্ধতিতে মোট স্বরের সংখ্যা ১৬টি। এগুলো হলো−
 
স্বরনাম স্বরসঙ্কেত
ষড়্‌জ
শুদ্ধ ঋষভ
চতুঃশ্রুতি-ঋষভ রি
ষট্‌শ্রুতি-ঋষভ রু
শুদ্ধ-গান্ধার
সাধারণ গান্ধার গি
অন্তর-গান্ধার গু
শুদ্ধ মধ্যম
প্রতি মধ্যম মি
পঞ্চম
শুদ্ধ-ধৈবত
চতুঃশ্রুতি-ধৈবত ধি
ষট্‌শ্রুতি-ধৈবত ধু
শুদ্ধ-নিষাদ
কৈশিক-নিষাদ নি
কাকলি-নিষাদ নু

 


এই স্বরগুলো দুটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে।  ষড়্‌জ থেকে শুদ্ধ মধ্যম পর্যন্ত ভাগকে পূর্বাঙ্গ এবং প্রতি মধ্যম থেকে অষ্টকের শেষ ষড়্‌জ পর্যন্ত একটি ভাগ। একে বলা হয় উত্তরাঙ্গ। এই হিসেবে স্বর বিন্যাস হয়।

পূর্বাঙ্গ:   স র রি রু গ গি গু ম
উত্তরাঙ্গ: মি প ধ ধি ধু ন নি নু র্স

শুদ্ধ ও বিকৃতের বিচারে ১৬টি স্বর পাওয়া যায় বটে, কিন্তু ব্যবহারিক ক্ষেত্রে ১২টি থাকে। এক্ষেত্রে কোনো কোনো ক্ষেত্রে দুটি নামে চিহ্নিত হয়। নিচের এর একটি তুলনামূলক সারণী দেওয়া হলো।
 

পূর্বাঙ্গ উত্তরাঙ্গ
রি রু মি ধি ধু র্স
    গি গু          নি নু  


দক্ষিণ ভারতী সঙ্গীতে পূর্বাঙ্গের স র রি রু গ গি গু ম-এর ভিতর কোনো স্বরের একটি রূপ নিয়ে যদি সাজানো যায়, তাহলে মোট নয়টি রূপ পাওয়া যায়। এগুলো হলো −

র   গ            র   গি            র  গু

রি  গ            রি  গি            রি  গু
রু  গ            রু  গি            রু   গু  

এই নয়টি রূপের ভিতরে কিছু স্বর একই স্থানে অবস্থান করে। পূর্বাঙ্গের বিচারে রি গ এবং রু গি একই স্বর। ফলে এই স্বরদ্বয় কোনো পৃথক ধ্বনি করে না। আবার রু গ বাদ দিতে হয়। কারণ রু গ বক্র ধ্বনি তৈরি করে। ফলে ৯টি সুর-সমন্বয় থেকে ৩টি সুররূপকে বাদ দিলে ৬টি বিন্যাসকে গ্রহণ করা যায়। এই ছয়টি রূপ হলো

র   গ            র   গি            র  গু
রি  গি            রি  গু            রু  গু           

উত্তরাঙ্গের মি প ধ ধি ধু ন নি নু র্স-এর ভিতর এরূপ ৬টি বিন্যাসকে গ্রহণ করা হয়েছে। এগুলো হলো
ধ   ন            ধ  নি            ধ  নু
ধি  নি           ধি  নু             ধু  নু
পূর্বাঙ্গের ঋষভ ও গান্ধারের যে কোন ৬টি রূপ উত্তরাঙ্গের ধৈবত ও নিষাদের যে কোনো ছয়টি বিন্যাসের সাথে মিলিত হয়ে ৩৬টি মেল হতে পারে। আবার শুদ্ধ মধ্যম এবং প্রতি মধ্যমের বিচারে ৩৬+৩৬=৭২টি মেল হতে পারে। এই ৭২ মেলকে সহজে মনে রাখার জন্য ১২টি চক্রে ভাগ করা হয়ে থাকে। এই চক্রগুলোর নাম প্রতীকী। যার ভিতর দিয়ে কোনো সংখ্যামানকে নির্দেশিত করা হয়। নিচে চক্রের নাম ও নামানুসারে সংখ্যা মান তুলে ধরা হলো।
 

চক্র সংখ্যা চক্রের নাম ব্যাখ্যা
ইন্দু ইন্দু অর্থ চাঁদ। পৃথিবীর চাঁদের সংখ্যা ১
নেত্র নেত্র অর্থ চোখ। চোখের সংখ্যা ২
অগ্নি হিন্দু পৌরাণিক কাহিনিতে অগ্নির তিনটি রূপের কথা বলা হয় দেখুন: অগ্নি
বেদ বেদ চার ভাগে বিভাজিত। এই ভাগগুলো হলো ঋক, সাম, যজু, অথর্ব। এই বিচারে বেদের সংখ্যা ৪।
বাণ কামদেবের বাণ সংখ্যা ৫। এই বাণগুলো হলো সম্মোহন, উন্মাদন, শোষণ, তাপন, স্তম্ভন
ঋতু পার্থিব ঋতুর সংখ্যা ৬। গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত ও বসন্ত
ঋষি সপ্তর্ষিকে বুঝানো হয়েছে। উল্লেখ্য এঁরা হলেন মরীচি, অত্রি, অঙ্গিরা, পুলস্ত্য, পুলহ, ক্রতু বশিষ্ঠ
বসু হিন্দু পৌরাণিক কাহিনি মতে বসুর সংখ্যা ৮টি। এই অষ্টবসু হলেন- ধর, ধ্রুব, সোম অনিল, অনল, প্রত্যুষ, প্রভাস ও দ্যু
ব্রহ্মা ব্রহ্মার অপর নাম প্রজাপতি। প্রতিকল্পে ৯ জন প্রজাপতিরূপী সৃষ্টির কাজ করেন
১০ দিক দশ দিক। এই দশ দিক হলো পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর, দক্ষিণ, ঈষাণ, বায়ু অগ্নি, নৈর্‌ঋত, ঊর্ধ্ব, অধঃ
১১ রুদ্র ব্রহ্মার সৃষ্টিকর্মের সময় তাঁর শরীর থেকে ১১টি ক্রন্দনরত সন্তান উৎপন্ন হয়।
১২ আদিত্য ব্রহ্মপুরাণ দক্ষের ঔরসে অদিতির গর্ভে ১২টি পুত্র জন্মে। এঁরা আদিত্য নামে অভিহিত হয়েছে। এই পুত্ররা হলেন- অংশ, অর্যমা, ত্বষ্টা, ধাতা, পূষা, বিধাতা, বিবস্বান, ভগ, বিষ্ণু, শত্রু, সবিতা। [তৃতীয় অধ্যায়। ব্রহ্মপুরাণ]

উপরের এই চক্র, পূর্বাঙ্গ এবং উত্তরাঙ্গের বিচারে মেলসমূহ ১২টি ভাগে বিভাজিত হয়। প্রাথমিকভাবে শুদ্ধ মধ্যম ভিত্তিক যে বিভাগ তৈরি হয়, তার সাথে চক্র যুক্ত হয়ে

২২ শ্রুতি অনুসারে রাগ পাওয়া যায় ১০২৪টি। এর ভিতরে ৭২টি মেলকর্তা রাগ প্রধান। এর ভিতরে বর্তমানে ১৯টি মেলকর্তা রাগ প্রচলিত আছে। সম্পূর্ণ জাতির রাগ ছাড়া ষাড়ব ও ঔড়ব জাতিতে রাগের সংখ্যা দাঁড়ায় অনেক। শুদ্ধ সম্পূর্ণ রাগের সংখ্যা ধরা হয় ৩৪,৮৪৮টি। বক্রগতির রাগের বিচারে এই সংখ্যা দাঁড়ায় ৭,২০০,০১২টি। এর ভিতরে বিশুদ্ধ রাগরূপ পাওয়া যায় ৪০টি।

 

দেখুন: মেল তালিকা  

 


তথ্যসূত্র:

  • ভারতীয় সঙ্গীতের ইতিহাস । প্রথম খণ্ড। স্বামী প্রজ্ঞানন্দ

  • ভারতীয় সঙ্গীতকোষ। শ্রীবিমলাকান্ত রায়চৌধুরী। বৈশাখ ১৩৭২।

  • রাগ ও রূপ। স্বামী প্রজ্ঞানন্দ। জুলাই ১৯৯৯।

  • হিন্দুস্তানী সঙ্গীত পদ্ধতি ক্রমিক পুস্তক মালিকা । বিষ্ণুনারায়ণ ভাতখণ্ডে