বশিষ্ঠ
ব্রহ্মার সপ্তম মানসপুত্র
এবং প্রজাপতি।
আবার
অন্য মতে – কোনো এক যজ্ঞকালে,
অপ্সরী উর্বশী'কে
দেখে যজ্ঞকুম্ভে আদিত্য ও বরুণের বীর্যপাত হয়।
ফলে,
যজ্ঞকুম্ভ থেকে
বশিষ্ট ও অগস্ত্য
–এর জন্ম হয়।
সে হিসাবে উভয়কেই মিত্র (তেজময় সূর্য) ও বরুণের পুত্র বলা হয়।
এর অন্যান্য নাম– অরুন্ধতীজানি,
অরুন্ধতীনাথ,
অরুন্ধতীসহচর, আপব,
উর্বশীয়,
কলসী,
কলসীসূত,
কুম্ভজ,
কুম্ভযোনি,
কুম্ভসম্ভব,
ঘটজ,
ঘটযোনি,
ঘটোৎভব,
মৈত্রাবরুণ,
মৈত্রাবরুণি।
বাল্মীকি রাময়ণের বালখণ্ডের সপ্তম সর্গ মতে- দশরথের রাজসভার সর্বপ্রধান দুই জন ঋত্বিকের একজন। দশরথ পুত্রকামনায় যে পুত্রেষ্টি যজ্ঞ সম্পন্ন করেছিলেন, সে যজ্ঞের প্রধান পুরোহিত হিসাবে যজ্ঞ সম্পন্ন করার জন্য বশিষ্ট দায়িত্ব লাভ করেন। [ত্রয়োদশ সর্গ। বালখণ্ড। রামায়ণ]
ইনি সপ্তর্ষি হিসাবে পরিচিত। ইনি ঋকবেদের সপ্তম মণ্ডলের ও অন্যান্য বেদের ঋষি। এঁর স্ত্রীর নাম অরুন্ধতী। এছাড়া বশিষ্ঠ অক্ষমালা নামক শূদ্রকন্যার প্রতি আসক্ত হয়ে তাঁর সাথে মিলিত হন। বশিষ্ঠের সংস্পর্শে এসে ইনি পরমগুণবতী নারীরূপ লাভ করেছিলেন। এই ঋষির নামে উত্তর-পূর্ব আকাশে একটি তারা আছে।
বশিষ্ঠ সুমেরু পর্বতের কাছে একটি মনোরম স্থানে ধ্যান করতেন। দক্ষের নন্দিনী নামক একটি কন্যা জগতের কল্যাণের জন্য গাভীরূপে কশ্যপের ঔরসে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। পরে ইনি বশিষ্টের হোমধেনু হিসাবে এই আশ্রমে বসবাস করতেন। একবার বসুদেবতারা এই আশ্রমে সস্ত্রীক ভ্রমণ করতে আসেন। এই সময় কোন এক বসুপত্নী নন্দিনীকে দেখে অন্যান্য বসু ও তাঁদের স্ত্রীদের এই গাভী সম্পর্কে অবগত করান। দ্যু নামক বসু এই গাভী দেখে বলেন যে- এর দুধ পান করলে, দশ হাজার বত্সর যৌবন-প্রাপ্ত হয়ে জীবিত থাকবেন। এই কথা শুনে দ্যু-এর স্ত্রী তাঁর সখী জিতবতীর জন্য এই গাভীকে আনার কথা বলেন। এরপর দ্যু ও অন্যান্য বসুরা এই গাভী এবং এর বাছুর অপহরণ করেন। যথাসময়ে বশিষ্ঠ আশ্রমে ফিরে গাভী ও তার বাছুর দেখতে না পেয়ে, জ্ঞানচক্ষু প্রসারিত করেন এবং বসুদের গাভী অপহরণের বিষয়টি জানতে পারেন। এরপর বশিষ্ঠ বসুদেরকে মানুষ হয়ে জন্ম গ্রহণের অভিশাপ দেন। পরে অভিশপ্ত বসুরা মানুষ হিসাবে জন্মগ্রহণের জন্য গঙ্গাকে তাঁর মা হবার অনুরোধ করেন।
একবার বিশ্বামিত্র মৃগয়ায় গিয়ে দারুণ পিপাসার্ত হয়ে বশিষ্ঠ মুনির আশ্রমে উপস্থিত হন। মুনি তাঁর কামধেনুর সাহায্যে রাজাকে এবং তাঁর সৈন্যবাহিনীকে খাবার ও পানীয় দ্বারা পরিতৃপ্ত করেন। বিশ্বামিত্র উক্ত ধেনুর সকল গুণাগুণ অবগত হয়ে- একহাজার গাভীর বিনিময়ে কামধেনু প্রার্থনা করলে, বশিষ্ঠ তা দিতে অস্বীকার করেন। এরপর বিশ্বামিত্র জোর করে কামধেনু হরণ করলে- বশিষ্ঠ কামধেনুকে নিজ শক্তি দ্বারা বিশ্বামিত্রকে পরাস্ত করতে আদেশ দেন। তখন কামধেনু অসংখ্য সৈন্য সৃষ্টি করে বিশ্বামিত্রের বাহিনীকে পরাস্ত করেন। এই যুদ্ধে বিশ্বমিত্রের একশত পুত্র নিহত হয়। একই সাথে বিশ্বামিত্র শর দ্বারা বশিষ্ঠকে আঘাত করার চেষ্টা করলে- বশিষ্ঠ ব্রহ্মদণ্ড দ্বারা তা প্রতিহত করেন। এরপর ক্ষত্রিয় শক্তির চেয়ে ব্রহ্মশক্তি বড় বিবেচনা করে ব্রাহ্মণত্ব লাভের জন্য বিশ্বামিত্র তপস্যা শুরু করেন এবং ব্রাহ্মণত্ব লাভ করেন। কিন্তু বশিষ্ঠ বিশ্বামিত্রের চির শত্রুতে পরিণত হন। কল্মাষপাদকে যজমান হিসাবে পাওয়ার জন্য বশিষ্ঠ ও বিশ্বামিত্রের মধ্যে প্রতিযোগিতা হয়। এই সময় বিশ্বামিত্রের আদেশে কিংকর নামক এক রাক্ষসের আত্মা কল্মাষপাদের শরীরে প্রবেশ করে। এই রাক্ষস বশিষ্ঠের একশত পুত্রের সকলকেই হত্যা করে খেয়ে ফেলে।
সকলপুত্র হারিয়ে বশিষ্ঠ আত্মহত্যা করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। এরপর ইনি বিভিন্ন দেশে ভবঘুরের মত ঘুরে বেড়ান। এইভাবে কিছুদিন কাটিয়ে ইনি দেশের দিকে রওনা দেন। চলার পথে পিছনে বেদ পাঠ শুনতে পেয়ে, পিছন ফিরে তাঁর পুত্রবধূকে (শক্ত্রির স্ত্রী) দেখতে পান। ইনি অবিলম্বে জানতে পারেন যে পুত্রবধূর গর্ভস্থ শিশু এই বেদমন্ত্র উচ্চারণ করছেন। এরপর ইনি খুশি মনে পুত্রবধূকে সাথে নিয়ে আশ্রমের পথে রওনা হন। পরে যথাসময়ে পুত্রবধুর সন্তান হলে, নামকরণ করা হয় পরাশর। বশিষ্ঠ নিজের জীবন 'পরাশু' অর্থাৎ বিসর্জন দিতে কৃতসংকল্প ছিলেন বলে এঁর নাম রাখা হয় পরাশর।
পথিমধ্যে কল্মাষপাদ রাক্ষস তাঁকে আক্রমণ করলে ইনি মন্ত্রপূত জল ছিটিয়ে তাঁকে রাক্ষস অবস্থা থেকে মুক্ত করেন। এরপর ইনি শাপমুক্ত কল্মাষপাদকে রাজ্যে ফিরে গিয়ে রাজ্য চালনা করতে বলেন এবং সেই সাথে ব্রাহ্মণদেরকে সম্মান করার পরামর্শ দেন। এরপর কল্মাষপাদ তাঁর স্ত্রীর গর্ভে একটি পুত্র সন্তান জন্মানোর জন্য বশিষ্ঠকে অনুরোধ করলে– বশিষ্ঠ রাজ-মহিষীর সাথে মিলিত হন। এই মিলনের ফলে কল্মাষপাদের একটি ক্ষেত্রজ পুত্র জন্মে। এঁর নাম রাখা হয়- অশ্মক।
ইনি ঘৃতাচী নামক এক অপ্সরার সাথে মিলিত হলে- কপিলাঞ্জল নামে একটি পুত্র জন্মে। রাজর্ষি নিমি একবার তাঁর যজ্ঞের পুরোহিত হতে বশিষ্ঠকে অনুরোধ করেন। বশিষ্ঠ এই সময় ইন্দ্রের যজ্ঞে পুরোহিত ছিলেন বলে- নিমিকে অপেক্ষা করতে বলে ইন্দ্রের যজ্ঞে যোগ দেন। অনেকদিন পর ইনি ফিরে এসে দেখেন যে নিমি গৌতম ঋষির দ্বারা তাঁর যজ্ঞ সম্পন্ন করেছেন। এতে বশিষ্ঠ ক্ষুব্ধ হয়ে নিমিকে চেতনাবিহীন হওয়ার অভিশাপ দেন। নিমিও একই অভিশাপ বশিষ্ঠকে দিলে- ইনি অশরীরী হয়ে ব্রহ্মার কাছে গিয়ে একটি চেতনাযুক্ত দেহ প্রার্থনা করেন। ব্রহ্মা তখন মিত্রাবরুণের তেজে প্রবেশ করে জন্মগ্রহণ করতে আদেশ করেন। এরপর মিত্রাবরুণ অপ্সরা উর্বশীর সাথে মিলিত হলে- বশিষ্ঠের পুনর্জন্ম হয়। এই কারণে ইনি মৈত্রাবরুণ নামে অভিহিত হন।
অন্য মতে-বশিষ্ঠ চেতনাহীন অবস্থায় ব্রহ্মা ও বিষ্ণুর সাথে দেখা করেন এবং বিষ্ণুর পরামর্শে বশিষ্ঠ অমৃত নামক এক কুণ্ডে স্নান করে শাপমুক্ত হন। এই অমৃত কুণ্ড থেকে প্রবাহিত নদীই ললিতা নামে পরিচিত।
ইনি রাজা হরিষচন্দ্রের কুলপুরোহিত ছিলেন। একবার এই রাজাকে তিনি অতি উত্তম নামে আখ্যায়িত করেন। ফলে বিশ্বামিত্র বশিষ্ঠের এই উক্তি পরীক্ষা করার জন্য হরিষচন্দ্রের কাছে আসেন। বিশ্বামিত্র বিভিন্নভাবে হরিষচন্দ্রকে পরীক্ষা করার পর রাজার প্রতি অত্যন্ত সন্তুষ্ট হয়ে তাঁর সব কিছু ফিরিয়ে দিয়ে আশীর্বাদ করেন। কিন্তু রাজাকে অপরিসীম যন্ত্রণা দেবার কারণে বশিষ্ঠ বিশ্বামিত্রকে অভিশাপ দ্বারা বক-পক্ষীতে পরিণত করেন। একইভাবে বিশ্বামিত্রও বশিষ্ঠকে আড়ি-পাখি হওয়ার অভিশাপ দেন। পরে উভয়ে যুদ্ধ আরম্ভ করলে- পৃথিবী ধ্বংসের উপক্রম হয়। সে কারণে ব্রহ্মার মধ্যস্থতায় এই যুদ্ধ সমাপ্ত হয় এবং উভয়ে উভয়ের বন্ধু হয়।