সঙ্গীতের ক্রমবিকাশের প্রাক্কথন
সঙ্গীত মানুষের সহজাত প্রবৃত্তির অংশ। আদিম মানবগোষ্ঠীর ভিতরে ভাষা এবং সঙ্গীতের
বিকাশ শুরু হয়েছিল একই সময়। পৃথিবীর আদি মানবগোষ্ঠীর উদ্ভব ঘটেছিল
আফ্রিকার
ইথিওপিয়া
এবং তৎসংলগ্ন অঞ্চলে। কালক্রমে এই অঞ্চল থেকে মানুষ পৃথিবীর বিভিন্ন
অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। ধারণ করা হয়, ভারতবর্ষে প্রথম
নেগ্রিট জাতির মানুষ। এরা
খ্রিষ্টপূর্ব ৪০-২০ হাজার বৎসরের মধ্যে এরা
ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিল। এদের দ্বারাই
সূচিত হয়েছিল
ভারতের প্রাচীন প্রস্তরযুগ। ধারণা করা এই সময়
সঙ্গীত এবং ভাষা উভয়ই প্রাথমিক স্তরে ছিল।
এরপর ভারতবর্ষে প্রবেশ করে
প্রোটো-অস্ট্রালয়েডরা। ধারণা করা হয়, এরা ভারতবর্ষের বিভিন্ন
অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিল খ্রিষ্টপূর্ব ২০-৬ হাজার বৎসর পূর্বে। এদের আগমনের ফলে আদি
নেগ্রিটো-রা অপ্রধান হয়ে পড়েছিল। হয়তো
নেগ্রিটোরা আত্মরক্ষায় অপারগ হয়ে ক্রমে ক্রমে উত্তর ভারতে
বিলীন হয়ে গিয়েছিল। কিম্বা এরা দক্ষিণের দিকে সরে গিয়েছিল। কিম্বা এদের সাথে
প্রোটো-অস্ট্রালয়েডদের সংমিশ্রণের ফলে নিজেদের জাতিগত
স্বতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্য হারিয়েছিল। এই বিচারে ভারতের মধ্য-প্রস্তরযুগের সভ্যতা
সৃষ্টি হয়েছিল
নেগ্রিটো আর
প্রোটো-অস্ট্রালয়েডদের সংমিশ্রণে। এদের ভাষা অনেকটাই মনের ভাব প্রকাশের উপযোগী
হয়ে উঠেছিল। এদের দ্বারা ভারতের আদি লোকসঙ্গীতের সূচনা হয়েছিল।
এরপর ভারতবর্ষে প্রবেশ করেছিল
দ্রাবিড় এবং
মোঙ্গলীয়'রা। আর্যদের আসার আগে
নেগ্রিটো,
প্রোটো-অস্ট্রালয়েড,
দ্রাবিড় এবং
মোঙ্গলীয়'রা
ভারতবর্ষে একটি মিশ্র জাতিসত্তার সৃষ্টি করেছিল। এদেরকে মোটা দাগে অনার্য বা
প্রাকৃতজনগোষ্ঠী বলা হয়। ভারতের পূর্বাঞ্চলে বসবাসকারীদের বলা যেতে
পারে পূর্ব-ভারতীয় প্রাকৃত জন। এদের ভিতর
নেগ্রিটো,
প্রোটো-অস্ট্রালয়েড-দের প্রভাব বেশি। ধারণা করা যায়, রক্তের
মিশ্রণের পাশাপাশি এদের ভাষা ও সঙ্গীত নতুন রূপ লাভ করেছিল।
খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০০-২৫০০ অব্দের দিকে বিদ্যমান সিন্ধু সভ্যতায় গড়ে ওঠা
সভ্যতা-সংস্কৃতির কতটা নির্ভেজাল দ্রাবিড়দের নিজস্ব ছিল, আর কতটা মিশ্র জনগোষ্ঠীর
ছিল, তা নিরূপণ করাটা সত্যিই মুশকিল। সাধারণীকরণের বিচারে একে সিন্ধু-সভ্যতা বললে,
দ্বন্দ্ব এড়ানো যায়। সিন্ধু উপত্যাকা খননের সূত্রে আমরা, তৎকালীন মানুষের যে সকল
ব্যবহারিক উপকরণ পাই, তার ভিতরে রয়েছে বেশ কিছু সঙ্গীতের সাথে সম্পর্কিত নমুনা। এর
ভিতরে রয়েছে নৃত্যরতা নারী, দু'তিনটি তন্ত্রীযুক্ত হার্পের মতো বীণা, চামড়া
আচ্ছাদিত মৃদঙ্গ, করতাল ইত্যাদি। এই সকল নমুনা দেখে ধারণা করা যায়, সিন্ধু সভ্যতায়
সঙ্গীতের চর্চা ছিল। সে সময়ে নগরকেন্দ্রিক সঙ্গীত চর্চার ভিতরে হয়তো সাঙ্গীতিক
শৃঙ্খলা কিছু ছিল, কিন্তু এর পাশাপাশি গ্রাম্যজীবনে প্রাকৃতজনদের ভিতরে ছিল
সঙ্গীতের চর্চা। নগরকেন্দ্রিক সিন্ধুসভ্যতায় বিশিষ্ট সঙ্গীত-শিল্পীরা সঙ্গীতের
চর্চা করতেন এবং তাতে রাজা এবং বিশিষ্ট নাগরিকদের পৃষ্ঠপোষকতা ছিল। এর বাইরে
গ্রাম্য সাধারণ মানুষের ভিতরে সঙ্গীতের চর্চা ছিল নিজেদের আনন্দে। এরা নিজেদের
পৃষ্ঠপোষক নিজেরা ছিল। এদেরকে ভারতের প্রাচীন প্রাকৃতজন হিসেবে চিহ্নিত করলে, সে
সকল মানুষের ভাষাকে বলতে হয় প্রাচীন প্রাকৃতজনের ভাষা এবং এদের সঙ্গীতকেও বলা যেতে
পারে প্রাচীন প্রাকৃতজনের লোকসংগীত।
খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০০-২৫০০ অব্দের দিকে
বিদ্যমান সিন্ধু সভ্যতায় সঙ্গীতের যে ধরনের চর্চা ছিল, তা সময়ের সাথে সাথে
পরিবর্তিত হয়েছে। এই পরিবর্তনের ধারা আর্যদেরদের ভারতবর্ষে আগমনের পূর্ব-কাল
পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। এরা ইরান থেকে যে ভাষা ও ধর্মবিশ্বাস
সাথে নিয়ে এসেছিল, পরবর্তী ৩০০ বৎসরের ভিতরে তার পরিবর্তন ঘটলো।
খ্রিষ্ট-পূর্ব ১০০০ বৎসরের ভিতরে ভারতীয় ইন্দো-ইরানিয়ান ভাষার পরিবর্তন
ঘটে, তার নমুনা পাওয়া যায় ঋগ্বেদ। ধারণা করা হয়, ঋগ্বেদের শ্লোকগুলো রচিত হয়েছিল
খ্রিষ্ট-পূর্ব ১২০০-১০০০ বৎসরের ভিতরে। এও ধারণা করা হয়, খ্রিষ্টপূর্ব ৮০০ অব্দের
ভিতরে বেদের সকল শ্লোক রচিত হয়েছিল। খ্রিষ্টপূর্ব ৪০০ অব্দের দিকে কৃষ্ণদ্বৈপায়ন
সকল শ্লোককে চারটিভাগে ভাগ করে নাম দিলেন ঋক্, সাম, যজু, অথর্ব। বেদের এই ভাষাকে
ভাষাবিজ্ঞানীর নাম দিয়েছেন বৈদিক ভাষা।
বৈদিক যুগের গান:
বৈদিকভাষার আচার্যরা জ্ঞানের চর্চা করতেন।
তাঁর ঋক্-মন্ত্রগুলো সুরসহযোগে পরিবেশন করতেন। তাতে সুরগুলো উচ্চারিত হতো বিশেষ
ভঙ্গীতে বা সুরশৈলীতে। একে বলা যায় সুরে সুরে আবৃত্তি। বৈদিক ঋষিরা মন্ত্রপাঠ করতেন
কাব্যের ছন্দে। পরে তাতে সুর যুক্ত করা হয়।তারপরেও ছন্দের চাল রক্ষিত হতো কাব্যের
মাত্রার বিচারে। তাতে সঙ্গীতোপযোগী সুরের কদর ছিল, কিন্তু আলাদা করে সুরের আদর ছিল
না। ঋকবেদের মন্ত্রে ঋষিরা মূলত মানবকণ্ঠের অবিভাজ্য সঙ্গীতোপযোগী ধ্বনি
ব্যবহার করেছিলেন।
বৈদিক যুগের মধ্যপর্বে গ্রামগেয়, অরণ্যগেয়, ঊহ ও ঊহ্য গানের কথা জানা যায়। এই
বিচারে বলা যায়, রাগের শ্রেণিকরণ না হলেও সে সময়ে গানের শ্রেণিকরণ হয়েছিল।
- গ্রামগেয় গান: সেকালের গ্রামীণ
সংস্কৃতিতে যে গান গ্রামের সাধারণ গৃহীরা যাগযজ্ঞে এই গান পরিবেশন করতেন।
- অরণ্যগেয়: এই অরণ্যবাসী ঋষিরা
গাইতেন। বানপ্রস্থকালে অরণ্যজীবনের যাগযজ্ঞে অরণ্যগেয় গান পরিবেশিত হতো।
- ঊহ গান: এই গানও ছিল ঋষিদের
জন্য, অরণ্যবাসী ঋষিরা অরণ্যগেয় গানের পরে ঊহ গান শিখতেন এবং পরিবেশন করতেন।
- ঊহ্য গান: এই গান রহস্যময় গান। এই
গানের অধিকারী ছিলেন দেবতারা।
বৈদিক-কালের এসব গানে বাণীর বিচারে ভাগ করা
হতো। সুরে বিচারে বিশেষ পার্থক্য না থাকায়, ধারণা করা যায়, সেকালে ঋষিদের মন্ত্রের
সুরটা মূখ্য ছিল না। গোড়ার দিকে সেকালের এসব সুরেলা আবৃত্তির সুর ছিল একঘেঁয়ে। সে
সুরকে স্বরের বিচারে বলতে গেলে বলতে হয় এক স্বরস্থানের সুর। যে সকল গানের বাণী
বেদের ঋক্ মন্ত্র থাকতো, সেগুলোকে বলা হতো আর্চিক। ঋকের প্রকৃতি অনুসারে একে দুটি
ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এই ভাগ দুটি হলো–
- পূর্বার্চিক: এই আর্চিকে ঋকগুলো
সাধারণভাবে যেকোনো সময় গাওয়া হতো।
- উত্তরার্চিক: এই আর্চিকে ঋখগুলো
যজ্ঞানুষ্ঠানে পরিবেশিত হতো।
সাধারণত ৩টি পদ নিয়ে গঠিত হতো ত্রিঋচ। অবশ্য
কখনো কখনো দুটি বা তিনের অধিক পদকেও ত্রিঋচ বলা হয়ে থাকে। প্রতিটি ত্রিঋচ-এর প্রথম
পদকে বলা হতো 'যোনি'। এর বাইরে অন্যান্য পদগুলোকে বলা হতো 'উত্তরা'। পূর্বার্চিকে
যোনিমন্ত্রগুলোকে পৃথকভাবে সংগৃহীত বলে, এর অপর নাম যোনিগ্রন্থ।
সুর করে গীত ঋকগুলোর একঘেঁয়েমি দূর করার জন্য কণ্ঠস্বরকে উপর-নিচ করা হতো। স্বরস্থানের
এই পরিবর্তন সাধিত হয়েছিল তিনটি ধাপে। ধাপ তিনটি হলো—
-
উদাত্ত
: স্বাভাবিক কণ্ঠস্বরের চেয়ে নিচু। একালের উদারার মতো।
-
স্বরিত : স্বাভাবিক
কণ্ঠস্বর-উচ্চারণের মতো। একালের মুদারার মতো।
-
উদাত্ত : স্বাভাবিক কণ্ঠস্বরের চেয়ে
উঁচু। একালের তারার মতো।
স্বরস্থানের ভিতরে ধীরে ধীরে একটি একটি করে
সঙ্গীতোপযোগী শব্দ স্থান পেতো থাকলো। এইভাবে একটি সঙ্গীতোপযোগী ধ্বনিকে ভারতীয়
ঋষিরা নাম দিলেন
স্বর। সঙ্গীতরত্নাকরের
মতে―
'শ্রুতিসমূহের অনন্তর অনুরণনাত্মক যে স্নিগ্ধ ধ্বনি উৎপন্ন হয়, যে ধ্বনির অপর কোনও
সহকারী কারণের অপেক্ষা না করিয়া স্বতই শ্রোতার চিত্তরঞ্জন করে তাহাকেই স্বর বলে।'
ঋষিরা
এক্ষেত্রে প্রাথমিকভাবে ষড়্জকে আদর্শমান ধরেছিলেন। এক্ষেত্রে একটি
সুনির্দিষ্ট স্বরসপ্তকের প্রতিটি স্বরের ভিতর ধ্বনিগত ব্যবধান সৃষ্টি হবে এবং ওই
ব্যবধান
শ্রুতির
ব্যবধানকে অনুসরণ করবে। সামবেদে স্বরের অপর নাম 'যম'।
সাম-এর বাণী অংশ ছিলো মন্ত্র বা মন্ত্রের অংশ। একে বলা হতো 'যোনি', এর অর্থ হলো
—
কারণ। ঋকপ্রাতিশাখ্যে শৌণিক সাম-এর স্বরগুলিকে 'যম' উল্লেখ করছেন। মূলত 'যম' দ্বারা
গানের সুর নির্ধারিত হতো। সামবেদের অপর নাম আর্চিক। ৫৮৫টি যোনি নিয়ে আর্চিক গঠিত।
সামগানে ব্যবহৃত তিন
স্বরস্থান থেকে বাকি সাতটি শুদ্ধ স্বর সৃষ্টি হয়েছে। সামগানে এই সাতটি স্বরের নাম
ছিল
―ক্রুষ্ট, প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ,
মন্দ্র ও অতিস্বার্য।
সেকালের লৌকিক গানে এই স্বরগুলো ভিন্ন ভিন্ন নামে প্রকাশ পেয়েছিল। এই লৌকিক
স্বরগুলো হলো―
ষড়্জ, ঋষভ, গান্ধার, মধ্যম পঞ্চম, ধৈবত ও নিষাদ। যাজ্ঞবল্ক্য ও অন্যান্য ঋষিদের
মতে
―
অনুদাত্ত থেকে ঋষভ ও ধৈবত
উদাত্ত থেকে নিষাদ ও গান্ধার
স্বরিত থেকে ষড়্জ, মধ্যম ও পঞ্চমের সৃষ্টি হয়েছিল।
সামগানের স্বরের সাথে লৌকিকগানের স্বর সমন্বয়ের সময়, নারদ এই সাতটি স্বরকে যেভাবে
সাজিয়েছিলেন তা হলো-
সামগানের স্বর ও লৌকিক স্বরের
তুলনামূলক অবস্থান |
সামগানের স্বর |
লৌকিক স্বর |
প্রথম
|
মধ্যম |
দ্বিতীয় |
গান্ধার |
তৃতীয় |
ঋষভ |
চতুর্থ |
ষড়্জ |
মঞ্চম (মন্দ্র) |
ধৈবত |
ষষ্ঠ (অতিস্বার্য) |
নিষাদ |
সপ্তম (ক্রুষ্ট) |
পঞ্চম |
আধুনিককালের স্বরবিন্যাস হলো
‒
ষড়্জ, ঋষভ, গান্ধার, মধ্যম, পঞ্চম, ধৈবত ও নিষাদ। এর সংক্ষেপে এগুলো উচ্চারণ করা
হয়‒
সা, রে, গা, মা, পা, ধা এবং নি। শাস্ত্রমতে এগুলিকে শুদ্ধস্বর বলা হয়। এর ভিতর সা
এবং পা -এর স্থান সুনির্দিষ্ট। এই কারণে এই দুটি স্বরকে
অচলস্বর বলা হয়। বাকি ৫টি শুদ্ধস্বর
মূর্ছনা বা শ্রুতিবিন্যাসের তারতম্যে বিকৃত হয়। এই বিকৃত স্বরগুলি হলো
―
কোমল ঋষভ, কোমল গান্ধার, কড়ি মধ্যম, কোমল ধৈবত, কোমল নিষাদ। ভারতীয় সঙ্গীতশাস্ত্রে
এই স্বরগুলো ২২টি শ্রুতির
উপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে আছে। কোনো বিশেষ স্বরের একটি উপরে বা নিচের অবস্থানে গেলে
এই
শ্রুতি
অনুভব করা যায়। প্রাচীন ভারতের সঙ্গীত তত্ত্বে স্বরগুলোকে শ্রুতি অনুসারে বিভাজিত
করা হয়েছিল, আধুনিককালে তার কিছুটা অবস্থানগত পরিবর্তন ঘটেছে।
বৈদিকভাষার যুগে আর্য ঋষিদের সাথে সাধারণ
আর্যদের যতটা যোগাযোগ ছিল, কালক্রমে তা অনেকটা শিথিল হয়ে পড়েছিল। বৈদিক ভাষা সাধারণ
মানুষের মুখের ভাষা না হয়ে সাহিত্যের ভাষা হয়ে উঠেছিল। এর ফলে বৈদিক ভাষার নানা
ধরনের কথ্যরূপ তৈরি হয়েছিল ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে। খ্রিষ্টপূর্ব ৬০০-৫০০ অব্দের
ভিতরে বৈদিক ভাষা থেকে বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষার সৃষ্টি হয়েছিল। ব্যাকরণ দিয়ে এই ভাষার
রীতি নীতি অনেকে বাঁধার চেষ্টাও করেছিলেন অনেকে। এক্ষেত্রে পাণিনি সফল হয়েছিলেন।
তাঁর সাফল্য সাময়িকভাবে বৈদিক ভাষাকে জীবন্ত করেছিল বটে, দীর্ঘজীবী করতে ব্যর্থ
হয়েছে।
আর্যদের গবেষণার সূত্রে, সঙ্গীত একটি
শাস্ত্রীয় কাঠামো লাভ করেছিল। একথা ভাবার কোনো কারণ নেই যে, আর্যসমাজের সাধারণ
মানুষ তাঁদের সামাজিক জীবনে অন্য কোন গান গাইতেন না। মনুষ্য সমাজের প্রকৃতি অনুসারে
কোনো প্রমাণ ছাড়াই দাবি করা যায় যে, আর্য সমাজের সাধারণ গৃহীদের ভিতরও লোকগান ছিল।
শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের আচার্যরা সে সব সুরের কোনো কোনোটিকে শাস্ত্রীয় বিধিতে বেঁধে
রাগে পরিণত করেছিলেন। কালক্রমে আর্য অনার্যের সংমিশ্রণে ভাষার যেমন পরিবর্তন
ঘটেছিল, সঙ্গীতেও তেমনি অনার্য সুরকেও হয়তো তাঁরা রাগে পরিণত করেছিলেন। শাস্ত্রীয়
বিধি অনুসারে রাগাশ্রয়ী গান সেকালেও তৈরি হতো। বাংলা গানের আদি নমুনা হিসেবে
প্রাপ্ত চর্যাগানই তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায়।
অন্যদিকে ভারতের অনার্য জনগোষ্ঠীর ভিতর
নাচগানের চর্চা ছিল জীবনমুখী। প্রত্যাহিক জীবনযাত্রায় আনন্দ-বেদনার ভিতর দিয়ে
সঙ্গীতকে লালন করেছিল। আর্যঋষিদের মতো শ্রুতি ও স্বরে সূক্ষাতিসূক্ষ্ম বিচার ছিল
না। কিন্তু সুরের যাদু ছিল। যে যাদুতে তাঁর নিজের মোহিত হতেন এবং শ্রোতাকে মুগ্ধ
করতেন। দুর্ভাগ্য সে গান হারিয়ে গেছে। কিন্তু রেশ রয়ে গেছে একালের লোক সঙ্গীতের
ভিতর।
আর্যদের সাথে প্রাকৃতজনের সংমিশ্রণে ভারতীয়
প্রাদেশিক ভাষার জন্ম হয়েছিল। তেমনি সঙ্গীতের আঞ্চলিক লোকগানের বিকাশ ঘটেছিল ভারতের
বিভিন্ন প্রান্তে। এই মেলোমেশায় লোকসঙ্গীতকে আর্যসঙ্গীতের দ্বারস্থ
হতে হয় নি কখনো। ঋষিরা নিজেদেরকে যে উচ্চাসনে বসিয়েছিল, লোকসঙ্গীতকে সে আসনের দিকে
ফিরেও তাকায় নি। বরং ঋষিদেরকে প্রাকৃতজনের কাছে আসতে হয়েছে। লোকসুরকে তাঁরা গ্রহণ
করেছেন। আর স্বভাবগুণে তাঁর সেগুলোক রাগে পরিণত করেছেন। গবেষণালব্ধ স্বর ও মাত্রা
বিন্যাসে ঋষিরা বিজ্ঞানী, কিন্তু রাগের সূতিকার হলো লোকসঙ্গীত।
রাগ -এর
উৎপত্তি ও তার শ্রেণিকরণ
বৈদিক যুগের
শেষে পৌরাণিকযুগে ভারতীয় সঙ্গীতধারায় সঙ্গীতের 'জাতি রাগ'-এর সূচনা হয় । খ্রিষ্টপূর্ব ৪০০ অব্দের দিকে
রচিত রামায়ণ সাতটি শুদ্ধজাতির
রাগের কথা জানা যায়। একালের রাগের জাতি যে অর্থে
মান্য করা হয়, সে অর্থে রামায়ণের জাতি একই কিনা তা জানা যায় না। প্রাথমিকভাবে আমরা
ধরে নিতে পারি খ্রিষ্টপূর্ব ৪০০ অব্দের দিকে জাতি রাগের সূত্রে রাগের বর্গীয়করণের
সূত্রপাত ঘটেছিল। রাগ ও রাগের বর্গীকরণের কালানুক্রমি ধারা নিচে তুলে ধরা হলো।
-
খ্রিষ্টীয় প্রথম শতাব্দী বা তার আগে আদি-নারদ
লিখিত 'শিক্ষা' নামক গ্রন্থ পাওয়া যায়। এই গ্রন্থটি 'নারদীয় শিক্ষা'
নামেই অধিক পরিচিত। এ গ্রন্থে বৈদিক গানের আঙ্গিক বিশ্লেষণ এবং বৈদিক অবরোহী
স্বরের প্রকৃতি বর্ণনা করা হয়েছে। এছাড়া এতে আছে গান্ধর্ব গানের রূপ নিয়ে বিশেষ
আলোচনা, লৌকিক আরোহী সপ্ত স্বরের বৈশিষ্ট্য, সামগানের সুরের সাথে লৌকিক স্বরের
ধ্বনিগত বিচার এবং ষড়্জ ও অন্যান্য স্বরের সৃষ্টি বৃত্তান্ত বর্ণনা করা হয়েছে।
এই গ্রন্থে প্রথম শ্রুতির উল্লেখ পাওয়া যায়। নারদ শ্রুতি সম্পর্কে বলেছেন–
দীপ্তায়তা করুণানাং মৃদুমধ্যময়োস্তথা
শ্রুতিনাং যোহবিশেষজ্ঞো ন স আচার্য উচ্যতে।
[দীপ্তা, আয়তা, করুণা ইত্যাদি পঞ্চশ্রুতি বিষয়ে যিনি বিশেষজ্ঞ নন, তাঁকে
আচার্য বলা যায় না।]
নারদের এই শ্রুতি মূলত স্বরের নামান্তর।
৫টি শ্রুতি ছিল মূলত স্বরের জাতি। তাই একে বলা হয় জাতি শ্রুতি।
এই গ্রন্থে রাগের শ্রেণিকরণে গ্রামের উল্লেখ পাওয়া যায়। এই গ্রামগুলোর নাম পাওয়া
ষড়্জ, গান্ধার ও মধ্যম (ষড়্জ-মধ্যম-গান্ধারা ত্রয়ো গ্রামঃ প্রকীর্তিতঃ)। এই তিনটি
গ্রামের আদ্যস্বরের নামকরণ করেছেন 'রাগস্বর'। গ্রামের অধীনস্থ মূর্চ্ছনা রাগের
অনুরূপ। তাই মূর্চ্ছনাকে রাগের আদ্যরূপ ধরলে, গ্রামকে ঠাট হিসেবে বিবেচনা করা যেতে
পারে। এই গ্রামের অধীনে ছিল
গ্রামরাগ। নারদীয় শিক্ষায় গ্রামরাগের তালিকা পাওয়া যায়। এগুলো হলো ষড়্জগ্রাম,
পঞ্চম, কৈশিক, কৈশিকগ্রাম, মধ্যমগ্রাম, সাধারিত, ষাড়ব ইত্যাদি। উল্লেখ্য গ্রামের
মূর্চ্ছনা থেকে এই গ্রামরাগের উৎপত্তি হয়েছিল।
-
খ্রিষ্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দীর দিকে ভরত রচনা
করেন 'নাট্যশাস্ত্র'। এই গ্রন্থে গ্রামের সংখ্যা কমে দাঁড়ায় দুটি। এই গ্রাম
দুটি হলো- ষড়্জ গ্রাম ও মধ্যম গ্রাম (দ্বৌগ্রামৌ ষড়্জোমধ্যমশ্চেতি)। এই
গ্রন্থে শ্রুতি, স্বর, মূর্চ্ছনা, নৃত্য, নাট্য ইত্যাদি বিষয়ে বিশদ বিবরণ
পাওয়া যায়। তাঁর বইতে দুটো বিকৃত স্বর পাওয়া যায়। এই স্বরদুটি হলো–অন্তর
গান্ধার ও কাকলী নিষাদ। এই গ্রন্থে নারদের ৫টি শ্রুতি ২২টি শ্রুতিতে পরিণত হয়।
এর অর্থ স্বরসমূহের সুক্ষ্ম ব্যবধানের ভিত্তিতে ভরত ২২টি শ্রুতিকে প্রতিষ্ঠিত
করেছিলেন। যেহেতু স্বরের ধারণা তখন প্রতিষ্ঠিত ছিল। তাই কোনো শ্রুতিতে কোন স্বর
স্থাপিত হবে, তার নির্দেশনা এই গ্রন্থে ছিল।
-
খ্রিষ্টীয় ৫ম-৬ষ্ঠ শতাব্দী মতঙ্গমুনি রচনা
করেন 'বৃহদ্দেশী' নামক গ্রন্থ। এই গ্রন্থটি ভরতে নাট্যশাস্ত্রের পরে রচিত
হলেও গান্ধার গ্রামের উল্লেখ পাওয়া যায়। তিনি তিনটি গ্রাম এবং মূর্চ্ছনা নিয়ে
বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। এই গ্রন্থে টকী, সাবীরা, মালবপঞ্চম, ষাড়ব, বট্টরাগ,
হিন্দোলক ও টক্ককৌশিক নামক সাতটি জাতির উল্লেখ করেছেন।
-
খ্রিষ্টীয় ৭ম শতাব্দীতে
লিখিত কুড়ুমিয়ামালাই প্রস্তর লিপিতে ৭টি স্বর, ৩টি গ্রাম, ২১টি মূর্চ্ছনা এবং
তান ৫১টি। আর এর সমবেত রূপের নাম দেওয়া হয়েছে 'স্বরমণ্ডল'।
সপ্ত স্বরাস্ত্রয়ো গ্রামা মূর্চ্ছনাস্ত্বেকবিংশতি।
তানা একোনপঞ্চাশদিত্যেতৎ স্বরমণ্ডলম্॥
-
খ্রিষ্টীয় অষ্টম শতাব্দী থেকে পঞ্চদশ
শতাব্দীর ভিতরে গ্রাম, শ্রুতি, স্বর ইত্যাদি নিয়ে নানারূপ গ্রন্থ রচিত হয়। এর
পাশাপাশি রাগের শ্রেণিকরণে রাগ-রাগিণীর ধারণা প্রচলিত হয়। ফলে গ্রামরাগ ও
রাগ-রাগিণীর দুটি বর্গীয়করণ রীতি পাশাপাশি চালু হয়ে যায়।
লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো এই দুটি ধারার ভিতরে
ধারাবাহিকতা বা আন্তঃসম্পর্ক ছিল না।
রাগ-রাগিণীর
ধারণা জন্মলাভ করেছিল, অনেকটা লেখকদের স্বচ্ছাচারিতায়। এ বিষয়ে কৃষ্ণধন বন্দ্যোপাধ্যায়
তাঁর 'গীতসূত্রসার' গ্রন্থে রাগের এরূপ শ্রেণি-বিন্যাসের ত্রুটিকে এই ভাবে উল্লেখ
করেছন–
'"কোন একটি স্থায়ী নিয়ম
অবলম্বন করিয়া রাগ-রাগিণীগুলি শ্রেণীবদ্ধ হয় নাই। উহা গ্রন্থাকারগণের
স্বেচ্ছাধীন কল্পনা মাত্র। তাঁহারা সুরের মধ্যে প্রবেশ না করিয়া যাহা পাইয়াছেন
সমস্ত ষড়ে-সাপ্টায় সংগ্রহ করিয়া গ্রন্থীকৃত করিয়াছেন। স্বরবিন্যাসের প্রকৃতিগত
সাদৃশ্যানুসারে রাগ-রাগিনী শ্রেণীবদ্ধ করিয়া যাইলে হিন্দুসঙ্গীতের আরো গৌরব
হইত, তাহাতে সন্দেহ নাই।'
রাগ-রাগিণীর শ্রেণি-বিভাজনে নানা মতও ছিল।
তবে সকল মতেই রাগের শ্রেণীকরণ করা হয়েছিল পরিবারের আদলে। এত রাগ ছিল গৃহস্বামীর মতো। এর সংখ্যা ছিল
ছয়টি। প্রতিটি রাগের ছয়টি করে স্ত্রী ছিল। এদেরকে বলা হতো রাগিণী। সব মিলিয়ে ছয়
রাগের স্ত্রী (রাগিণী) সংখ্যা ছিল ৩৬টি। হনুমন্ত মতে অবশ্য রাগের সংখ্যা ছিল ৫টি। এছাড়াও কেউ কেউ এই রাগ-রাগিণীদের পুত্র ও
পুত্রবধুদের নিয়ে বিশাল সংসার কল্পনা করেছেন। এই সব রাগ এবং এর পরিবারের সদস্যদের
নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন মত ছিল। এর ভিতরে চারটি মত অধিক প্রচলিত। এই মতগুলো হলো−
-
ব্রহ্মা মত: এই মতে রাগের সংখ্যা
৬টি। আর প্রত্যেকটি রাগের অধীনে ছিল ৬টি করে রাগিণী। এই মতানুসারে রাগ-রাগিণীর
তালিকা দেওয়া হলো।
-
১. রাগ: ভৈরব
-
রাগিণী :
ভৈরবী, গুর্জ্জরী,
রামকলী, গুণকলি, সৈন্ধবী, বাঙ্গালী
-
২.
রাগ: শ্রী
-
রাগিণী:
মালশ্রী, ত্রিবেণী, গৌরী, কেদারী,
মধুমাধবী, পাহাড়ী
-
৩. রাগ: মেঘ
-
রাগিণী:
মল্লারী, সৌরাটি, সাবেরী, কৌশিকি,
গান্ধারী, হরশৃঙ্গারী
-
৪. রাগ: বসন্ত
-
রাগিণী: দেশী, দেবগিরী,
বরাটী, তোড়ি, ললিতা, হিন্দোলী
-
৫.রাগ: পঞ্চম
-
রাগিণী: বিভাষ, ভূপালী,
কর্নাটী, বড়হংসিকা, মালবী, পটমঞ্জরী
-
৬. রাগ: নট
-
রাগিণী: কামোদী, কল্যাণী,
আভিরী, নাটিকা, সারঙ্গী, হাম্বির
-
কল্পিনাথ
মত: এই মতে রাগের সংখ্যা ৬টি। আর প্রত্যেকটি রাগের অধীনে ছিল ৬টি করে
রাগিণী। এই মতানুসারে রাগ-রাগিণীর তালিকা দেওয়া হলো।
- রাগ: শ্রী
- রাগিণী:
গৌরী, কোলাহল, ধবল, বরোরাজী বা রদারঙ্গী,
মালকোষ, দেবগান্ধার
- রাগ: পঞ্চম
- রাগিণী:
ত্রিবেণী, হস্তান্তরিহতা বা
স্তম্ভতীর্থীকা-খমাইচী, আভিরা বা আহিরী, কোকভ, বরারী, আশাবরী
- রাগ: ভৈরব
- রাগিণী:
ভৈরবী, গুর্জ্জরী, বেলাবেলী,
বিহাগ বা বাদহংসী, কর্ণাট, কানাড়া বা ভাষা
- রাগ মেঘ
- রাগিণী:
বাঙ্গালী, মধুরা বা মুদ্রা, কামোদী, ধানশ্রী,
দেবতীর্থী, দেবলী বা তীর্থকী
- রাগ: নটনারায়ণ
- রাগিণী:
তরবঙ্কী বা দেবলী, তিলঙ্গী বা তিলকি, পুর্ব্বী,
গান্ধারী, রাম বা বিরাম, সিন্ধুমল্লারী বা শুদ্ধমল্লারী
- রাগ: বসন্ত
- রাগিণী:
আন্ধালী, গমকী, পটমঞ্জরী, গৌড়গিরি, ধামকী বা
টঙ্কা, দেবশাখ
- হনুমন্ত
মত: এই মতে রাগের সংখ্যা ৬টি। আর প্রত্যেকটি রাগের অধীনে ছিল ৫টি করে
রাগিণী। এই মতানুসারে রাগ-রাগিণীর তালিকা দেওয়া হলো।
-
রাগ: ভৈরব
-
রাগিণী:
মধ্যমাদি, ভৈরবী, বাঙ্গালী, বরাটিকা, সৈন্ধবী
-
রাগ: কৌশিক
-
রাগিণী:
তোড়ি, খাম্বাবতী, গৌরী, গুণকিরি, ককুভা
-
রাগ: হিন্দোল
-
রাগিণী:
বেলাবেলী, রামকিরি, দেশাখ্য, পটমঞ্জরী, ললিতা
-
রাগ: দীপক
-
রাগিণী:
কেদারী, কানাড়া, দেশী, কামোদী, নাটিকা
-
রাগ: শ্রী
-
রাগিণী:
বাসন্তী, মালবী, মালশ্রী, ধন্যাসীকা, আশাবরী
-
রাগ: মেঘ
-
রাগিণী:
মল্লারী, দেশকারী, ভূপালী, গুর্জ্জরী, টঙ্ক
-
ভরত মত: এই ভরত নাট্যশাস্ত্রের
রচয়িতা ভরত নন। এই মতে মোট রাগের
সংখ্যা ৬টি রাগ। প্রতিটি রাগের রয়েছে ৫টি রাগিণী ৫টি পুত্র এবং ৫টি পুত্রবধু
হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এই ভাগের তালিকা নিচে দেওয়া হলো।
-
রাগ: ভৈরব
-
রাগিণী:
মধুমাধবী, ভৈরবী, বাঙ্গালী, বরারী, সৈন্ধবী
-
পুত্র:
বিলাবল, পঞ্চম, দেসাখ্য, দেবগান্ধার, বিভাষ
-
পুত্রবধূ: রামকলী,
সুহাই, সুঘরাই, পটমঞ্জরী, তোড়ি
-
রাগ: মালকোষ
-
রাগিণী:
গুণকলী, খাম্বাবতী, গুর্জ্জরী, ভূপালী, গৌরী
-
পুত্র: সোম, পরাশন,
বড়হংস, ককুভ, বাঙ্গাল
-
পুত্রবধূ: সুরঠী,
ত্রিবেণী, কর্ণাটি, আশাবরী, গোড়গিরি
- রাগ: হিন্দোল
-
রাগিণী: বেলাবলী, দেশাখী, ললিতা, ভীমপলাশী, মালবী
- পুত্র: রেখবহংস,
বসন্ত, লোকহাস, গান্ধর্ব্ব, ললিত
- পুত্রবধূ: কেদারা, কামোদী, বেহাগরা, কাফি, পরজ
- রাগ: দীপক
-
রাগিণী: নট, মল্লারী, কেদারী, কানাড়া, ভারেকা
- পুত্র: শুদ্ধকল্যাণ, সোরাঠ, দেশকার, হাম্বির, মারু
- পুত্রবধূ: বড়হংসী, দেশবরাটি, বৈরাটি, দেবগিরি, সিন্ধুরা
- রাগ: শ্রী
-
রাগিণী: বাসন্তী, মালবী, মালশ্রী, সাহানা, ধনাশ্রী
- পুত্র: নট, ছায়ানট,
কানাড়া, ইমন, শঙ্করাভরণ
- পুত্রবধূ: শ্যাম, পুরিয়া,
গুর্জ্জরী, হাম্বিরী, আড়ানা
- রাগ: মেঘ
-
রাগিণী: সারঙ্গ, বঙ্গা, গান্ধর্ব্ব, মল্লারী, মূলতানী
- পুত্র: বাহাদুরী,
নটনারায়ণ, মালব, জয়তি, কামোদ
- পুত্রবধূ: পাহাড়ী, জয়ন্তী, গান্ধারী, পুরবী, জয়জয়ন্তী
- খ্রিষ্টীয় ত্রয়োদশ শতাব্দীতে
শার্ঙ্গদেব রচনা করেন 'সঙ্গীত রত্নাকর'। এই গ্রন্থে গ্রামের ভিত্তিতে রাগের
বর্গীয়করণের বিষয়টই প্রাধান্য পেয়েছে।
-
আমির খসরু (১২৫৩-৫৪-
১৩২৫ খ্রিষ্টাব্দ) ভারতীয় সঙ্গীতের
প্রাচীন ভারতের মূর্চ্ছনা সূত্রে প্রাপ্ত ৭টি শুদ্ধ স্বর ও ৫টি বিকৃত স্বরের
বিন্যাসিত করে ১২ স্বরের কাঠামোকে সুনির্দিষ্ট করেছিলেন।
এই কাঠামোর সাথে দাক্ষিণাত্যের স্বরসমূহের সমন্বয় করে
বিজয়নগর রাজ্যের মন্ত্রী বিদ্যারণ্য (প্রকৃতনাম মাধবাচর্য)
রাগের বরগীকরণে মেল পদ্ধতি তৈরি করেন। উল্লেখ্য তিনি বিজয়নগর রাজ্যের মন্ত্রীর
পদ পেয়েছিলেন ১৩৪৩ খ্রিষ্টাব্দে। বিদ্যারণ্যের রচিত 'সঙ্গীতসার' গ্রন্থে ১৫টি মেল
এবং ৫০টি জন্যরাগের পরিচয় দিয়েছেন। এই ১৫টি মেল হলো-
নট্টা, গুর্জরী, বরাটী, শ্রী, ভৈরবী, শঙ্করাভরণ, আহীরী, বসন্তভৈরবী, সামন্ত,
কাম্বোজী, মুখারী, শুদ্ধরামক্রিয়া, কেদারগৌড়, হিজ্জুজী ও দেশাক্ষী।
এর ভিতরে মুখারীকে তিনি শুদ্ধ মেলরূপে চিহ্নিত করেছিলেন।
- ১৫৫০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে পণ্ডিত
রামামাত্য রচনা করেন 'স্বরমেল কলানিধি' গ্রন্থ। এই গ্রন্থটিতে তিনি ২০টি মেলের
উল্লেখ পাওয়া যায়। এর ভিতরে মুখারীকে তিনি শুদ্ধ মেলরূপে
চিহ্নিত করেছিলেন। একই সাথে ৬৪টি জন্যরাগের ধারণা পাওয়া যায় এই গ্রন্থ
থেকে। রামাদিত্য এই গ্রন্থে আদি ও শুদ্ধ মেল হিসেবে উল্লেখ করেছেন 'মুখারী'।
তিনি এই গ্রন্থে গ্রামের কথা স্বীকার করেছেন। তাঁর মতে, এই গ্রামের মূর্চ্ছনা
মধ্যশ্রুতি থেকে শুরু। বীণা প্রকরণ, মেল প্রকরণ বর্ণনা করে রাগ প্রকরণে গ্রন্থ
শেষ করেছেন। তিনি রাগের পুরুষ-স্ত্রী বিভাগ অগ্রাহয্ করেছেন।
- ১৫৯০ খ্রিষ্টাব্দের পুণ্ডরীক বিট্ঠল্
তাঁর রচিত 'সদ্রাগচন্দ্রোদয়' গ্রন্থে ১৯টি মেলের উল্লেখ করেছেন। পরে তিনি তাঁর
'রাগমঞ্জরী' গ্রন্থে মেল বা মেলরাগ হিসেবে রামামাত্য-এর মত মেনে নিয়ে ২০টি
মেলের ধারণা দেন। মুণ্ডরীকও রামাদিত্যের মতানুসারে এই গ্রন্থে আদি ও শুদ্ধ মেল
হিসেবে উল্লেখ করেছেন 'মুখারী'।
- ১৬০৯-১০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে পণ্ডিত সোমনাথ
রচনা করেন 'রাগবিরোধ' নামক একটি গ্রন্থে মেল নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন। এই
গ্রন্থে ২২টি শ্রুতিকে স্বীকার করেছেন। এই গ্রন্থে মেলের সংখ্যা নির্ধারণ করেন
২৩টি এবং ৭৭টি জন্যরাগের ধারণা দেন। এর ভিতরে মুখারীকে তিনি
শুদ্ধ মেলরূপে চিহ্নিত করেছিলেন। এই গ্রন্থে তিনি মেলের সমার্থক শব্দ হিসেবে
ঠাট শব্দও ব্যবহার করেছেন। তিনি রাগ-রাগিণীর শ্রেণিবিভাজন না মানলেও আলোচনার
ক্ষেত্রে এই শব্দ দুটি ব্যবহার করেছেন।
- ১৬৩০-৪০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে পণ্ডিত
ব্যাঙ্কটমখী তাঁর 'চতুর্দণ্ডিপ্রকাশিকা' গ্রন্থে মেলের সংখ্যা ৭২টি উল্লেখ
করেন। তবে কাজের সুবিধার জন্য ১৯টি মেলের কথা উল্লেখ করেছেন।
তাঁর মেলসমূহের ভিতরে শুদ্ধ মেলের নামকরণ করেছিলেন কণকাম্বরী।
'চতুর্দণ্ডিপ্রকাশিকা' গ্রন্থটি ১০টি অধ্যায়ে
বিন্যস্ত। ভাগগুলো হলো- বীণা প্রকরণম্, শ্রুতি প্রকরণম্, স্বর প্রকরণম্, মেল
প্রকরণম্, রাগ প্রকরণম্, আলাপ প্রকরণম্, স্থায় প্রকরণম্, গীত প্রকরণম্, গীত
প্রকর্ণম্, প্রবন্ধাদি প্রকরণম্ ও তাল প্রকরণম্।
-
পণ্ডিত অহোবল, ১৬৫০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে 'সঙ্গীত পারিজাত' নামক একটি
গ্রন্থ রচনা করেন। এই গ্রন্থে মেলের সংখ্যা উল্লেখ করেছেন ২১৩৪০টি। এই গ্রন্থ মতে-
'যে-কোন প্রকার স্বরের সমূহকে (সংঘ বা একত্রিত)
মেল (ঠাট) বলা হয়।' মেলের স্বর বিন্যাস হয়ে সরল। এই কারণে
মেলের স্বরবিন্যাসকে বলা হয় উদার।
অহোবলের মতে মেল গঠনে ষাড়ব বা ঔড়বে ষড়্জকে বাদ দেওয়া যাবে না।
মেল গঠনে অন্যান্য স্বর বর্জন করা যেতে পারে। ফলে স্বরের সংখ্যার উপর ভিত্তি করে মেল তিন প্রকার হতে পারে। এগুলো হলো-
- সম্পূর্ণ: সাতটি
স্বর নিয়ে গঠিত
- ষাড়ব: ছয়টি স্বর
নিয়ে গঠিত
- ঔড়ব:
পাচটি স্বর নিয়ে
গঠিত
মেলের স্বর গ্রহণে শুদ্ধ বা বিকৃত স্বর গ্রহণ করা যেতে পারে।
এই বিচারে মেলের
পণ্ডিত অহোবল, তাঁর সঙ্গীত পারিজাত গ্রন্থে মেলের সংখ্যা উল্লেখ করেছেন
২১৩৪০টি। এই গ্রন্থ মতে থেকে অধিক প্রচলিত প্রসিদ্ধ মেলের উল্লেখ
পাওয়া যায়। এগুলো হলো- শুদ্ধা, ভিন্না,
গৌরী, বেসরা ও সাধারণী।
- খ্রিষ্টীয় ১৭শ শতাব্দীর সঙ্গীতজ্ঞ লোচন
পণ্ডিত (জন্ম আনুমানিক ১৬৫০ খ্রিষ্টাব্দ) তাঁর 'রাগ তরঙ্গিনী'
গ্রন্থে ১২টি মেলের বিচারে রাগের শ্রেণিকরণকে নির্দেশিত করেছেন।
- খ্রিষ্টীয় ১৮শ
শতাব্দীতে রাজা তুলাজীরাও ভোঁশলে 'রাগলক্ষণম' একটি গ্রন্থ রচনা করেন। এই
গ্রন্থে ব্যাঙ্কটমখীর ৭২ মেল বা ঠাট মেনে নিয়ে যে তালিকা তৈরি করেন, তাতে কিছু
ঠাটের নামগত পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়।
- ১৮১৩ খ্রিষ্টাব্দে পাটনার রইস মুহম্মদ
রজা সাহেব 'নগমাতে আসফী' নামক একটি গ্রন্থ রচনা করেন। তিনি এ গ্রন্থে সর্বপ্রথম
বিলাবলকে শুদ্ধ ঠাট বলে প্রচার করেন। রাগ বর্গীকরণে তিনি পুরানো রাগ-রাগিণী
পদ্ধতির সংস্কার সাধন করে নতুন ভাবে ছয় রাগ ও ছত্রিশ রাগিণী নির্ধারিত করেছেন।
উত্তর ভারত ও দক্ষিণ ভারত মিলে ঠাট বা রাগের
যে তালিকা পাওয়া যায়, তার তালিকা দেখুন।
[দক্ষিণ ভারতীয়:
মেল
তালিকা (সঙ্গীতকোষ)]
[ভাতখণ্ডে প্রণীত উত্তরভারতীয় ঠাট:
ঠাট (সঙ্গীত কোষ)]
তথ্যসূত্র:
- ভারতীয় সঙ্গীতের
ইতিহাস । প্রথম খণ্ড। স্বামী প্রজ্ঞানন্দ
- ভারতীয় সঙ্গীতকোষ। শ্রীবিমলাকান্ত রায়চৌধুরী। বৈশাখ ১৩৭২।
- রাগ ও রূপ। স্বামী প্রজ্ঞানন্দ। জুলাই ১৯৯৯।
- সঙ্গীত পারিজাত। অহোবল
- সরল বাংলা অভিধান। সুবলচন্দ্র মিত্র
- বঙ্গীয় শব্দকোষ। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়
- সঙ্গীত কথা। অপূর্বসুন্দর মৈত্র।
পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যপুস্তক পর্ষদ। এপ্রিল ১৯৮৬।
- হিন্দুস্তানী
সঙ্গীত পদ্ধতি ক্রমিক পুস্তক মালিকা । বিষ্ণুনারায়ণ ভাতখণ্ডে