সঙ্গীতোপযোগী ধ্বনির ধ্বনিরঞ্জকতা:
আগেই বলা হয়েছে-
সঙ্গীতোপযোগী ধ্বনি হলো বহুবিধ ধ্বনির সমন্বিত রূপ। এর উপধ্বনিগুলোর
কম্পাঙ্ক অনুযায়ী সঙ্গীতোপযোগী ধ্বনির রঞ্জকতাগুণ পাল্টে যায়। যেমন হারমোনিয়ামের
রিড হয় ধাতুর। এর একটি সুনির্দিষ্ট রিডের মৌলিক ধ্বনি যদি ৪৪০ কম্পাঙ্কের হয়। তাহলে
ওই রিড থেকে একটি বিশেষ ধ্বনি পাওয়া যাবে। এই রিড যদি মাত্র ওই একটি
মৌলিক ধ্বনি উৎপন্ন
করে, তাহলে উপসুর না থাকায় ওই ধ্বনিটি রঞ্জকগুণ পাবে না। তখন ওই ধ্বনিকে বলা হবে
সুরেলা ধ্বনি। বাস্তবে হারমোনিয়ামের রিড তৈরি করা হয় এমনভাবে
যাতে এটি মৌলিক ধ্বনির সাথে সাথে আরও বহু ধ্বনি তৈরি করে। সদ্য কারখানা থেকে আসা
রিডের মৌলিক ধ্বনি এবং উপধ্বনিগুলোর ভিতরে সুসমন্বয় থাকে না। তাই একে ঘষে-মেজে সঙ্গীতোপযোগী
করার চেষ্টা করা হয়। সঙ্গীতজগতে সাধারণভাবে একে বলা হয় সুরে আনা। এই সুরে আনার
প্রক্রিয়ার ভিতর দিয়ে মূলত শব্দরঞ্জকতা সৃষ্টি করার কাজটি করা হয়। আবার বেহালার তারকে যখন সুরে
বাঁধা হয়, তখন মৌলিক কোনো একক কম্পাঙ্কে বাঁধা হয়। এরপর যখন এই তারের উপর ছড় টানা
হয়, তখন তারে ঘর্ষণজাত নানা ধরনের ধ্বনি তৈরি হয়। মূলত এই ধ্বনিগুলোর সুসমন্বিত
রূপ যৌগিক শব্দ মান তৈরি করে এবং এই মান শব্দরঞ্জকগুণ ধারণ করে। এরূপ দুটি বাদ্যযন্ত্র থেকে উৎপন্ন একটি বিশেষ ধ্বনির মূল ধ্বনি ৪৪০ হয়, তাহলে উভয়
যন্ত্রের ধ্বনি এক হয়েছে বলা যাবে। কিন্তু বাস্তবে দুটি পৃথক ধ্বনিরূপ পাওয়া যাবে।
এই পৃথক ধ্বনিরূপ তৈরি হবে উপসুরের পার্থক্যের জন্য। একই
স্কেলের স্বরগুলো হারমোনিয়াম ও বেহালাতে ভিন্নতর
শোনাবে এই কারণে। এখানে একই ধ্বনিভিত্তি
হওয়া সত্বেও উভয়ের ধ্বনিরঞ্জকতা পাল্টে দেবে উপসুরগুলো। একই কারণে নারী-পুরুষের কণ্ঠস্বর আলাদা হয়,
বা দুটি পুরুষের স্বরও আলাদা হয়। এতসব বাদ্যযন্ত্রের ধ্বনিরূপ পৃথক পৃথক হয়েও স্বরের
বিচারে একই হয়ে থাকে, ভিত্তিধ্বনি ও শব্দরঞ্জকতার গুণে।
সুরেলা ধ্বনি ও তার নান্দনিক বিশ্লেষণ
শ্রাব্যসীমার মধ্যে যে কোনো একক কম্পাঙ্কের ধ্বনিকে বলা হয় সুরেলা ধ্বনি।
যেমন ৪০০, ৫০০, ৬০০ ইত্যাদি একক কম্পাঙ্কের ধ্বনি হবে সুরেলা। একটি নির্দিষ্ট প্রকৃতির শব্দতরঙ্গ যখন একইভাবে শ্রোতার শ্রবণেন্দ্রিয়ে
পৌঁছায়, তখন ওই শব্দতরঙ্গ মস্তিষ্ককে একটি সুষম অনুভূতির জন্ম দেয়। ফলে ওই শব্দ মানুষের কাছে
স্বস্তিদায়ক অনুভূতি জাগায়। ফলে প্রতিদিনের অসংখ্য শোনার অভিজ্ঞতার ভিতরে একক
কম্পাঙ্কের ধ্বনি সুখশ্রাব্য হয়ে উঠে। ক্রমাগত এই ধ্বনি
শ্রবণের অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে- শ্রোতার মনে স্বাভাবিক স্বস্তিদায়ক অনুভূতির চেয়ে
একটু বেশি স্বস্তিদায়ক স্তরে পৌঁছে দেয়। এর ফলে মনোজগতে এক ধরনের সুখশ্রাব্যের
অনুভূতির জন্ম দেয়। এই সুখশ্রাব্য ধ্বনি মনকে মোহিত করে। মনের এই দশাকে আনন্দের
দশা হিসেবে বিবেচিত হয়।
ধরা যাক, কোনো একজন শ্রোতা স্বাভাবিক শব্দদশার মধ্যে রয়েছেন। তাঁর আটপৌরে জীবনে ঘরের ভিতরে থাকার সময় তিনি নানা ধরনের স্বাভাবিক শব্দ শুনে থাকেন। এর ভিতরে কিছু স্বাভাবিক মাত্রার অস্বস্তিকর বা স্বস্তিকর শব্দ থাকতে পারে। উভয় মিলে ওই শ্রোতার কাছে একটি স্বস্তি-অস্বস্তির গড় মান তৈরি হবে। এর ভিতরে হঠাৎ যদি একটি বিশেষ সুরেলা ধ্বনি (একক কম্পাঙ্কের কোনো ধ্বনি) শ্রবণেন্দ্রিয়কে স্পর্শ করে, তাহলে মনের ভিতরে কিছুক্ষণের জন্য একটি বিশেষ সুখদায়ক অনুভূতির সৃষ্টি করবে। আর যদি ধ্বনিরঞ্জকতা আছে, এমন ধ্বনি বাদিত হয়, তাহলে তা আরও স্নিগ্ধ, মনোমুগ্ধকর হয়ে উঠবে। শ্রুত-ধ্বনির মনোরঞ্জনকারী এই অনুভূতির সাধারণ নামই হলো- শ্রবণ-আনন্দ। ধরা যাক পাশের রেখা চিত্রে স্বস্তিদায়ক ও অস্বস্তিদায়ক সীমাকে ১ এবং -১ -এর মধ্যে রয়েছে। তাহলে, সুখশ্রাব্যতার বিচারে এই সীমা অতিক্রমকারী শব্দ আনন্দদায়ক সুরেলা ধ্বনির জন্ম দেবে। আবার অনেক সময় সুরেলা ধ্বনিও অস্বস্তিকর হতে পারে। যেমন একক উচ্চ কম্পাঙ্কের ধ্বনি শ্রবেণন্দ্রিয়কে তীব্রভাবে আঘাত করার কারণে তীব্র অস্বস্তির জন্ম দিতে পারে।
সঙ্গীতোপযোগী ধ্বনির নান্দনিক বিশ্লেষণ
আগেই
বলেছি- সকল একক কম্পাঙ্কের ধ্বনিই মৌলিক এবং তা সুরেলা। আর
মৌলিক ধ্বনির সাথে অন্যান্য আরও কিছু ধ্বনি মিশ্রিত হলে, তা হয়ে উঠবে যৌগিক
ধ্বনি। সুখশ্রাব্যতার বিচারে যৌগিক
ধ্বনি হতে পারে সুশ্রাব্য বা কুশ্রাব্য। একটি যৌগিক ধ্বনি সুশ্রাব্য বা
কুশ্রাব্য হবে, তার অনেকটাই নির্ভর করবে, শ্রোতার তাৎক্ষণিক মানসিক দশার উপর।
পরম বেদনার মুহুর্তে অতি প্রিয় গান হয়ে উঠতে পারে কুশ্রাব্য। আবার পরম আনন্দ-ঘন
মূহুর্তে তীব্র কোলাহলও হয়ে উঠতে পারে পরম রমণীয়।
এতসব শর্তকে এড়িয়ে আমরা যদি নির্ভেজালভাবে শুধুই সুশ্রাব্য ধ্বনির স্বাভাবিক
আকর্ষণের কথা ভাবি, তাহলে প্রথমে সারিতে উঠে আসে
সঙ্গীতোপযোগী ধ্বনিসমূহ।
সাধারণভাবে এই জাতীয় ধ্বনি মানুষের
শ্রবণেন্দ্রিয়ে শুধু সুখবোধ জাগায় তাই নয়, মনকে আবেশিত করে এবং মোহিত করে। বহুবিধ
ধ্বনির সংমিশ্রণে মৌলিক ধ্বনি যখন মোহিত করার গুণ লাভ করে তখন, মৌলিক ধ্বনিটি
রঞ্জকগুণের অধিকারী হয়ে উঠে। এই গুণকেই বলা হবে শব্দরঞ্জকতা। তাই সাদামাটাভাবে বলা
যায়, রঞ্জকগুণে গুণান্বিত যে কোনো যৌগিক ধ্বনিই হলো সঙ্গীতোপযোগী শব্দ। যেমন লাটিমের দ্রুত
ঘোরার সময়ে উৎপন্ন বোঁ জাতীয় শব্দ বা ধনুকের গুণ টেনে ছেড়ে দেওয়ার পর উৎপন্ন শব্দকে
কেউ বাদ্যযন্ত্রের পর্যায়ে ফেলবেন না। কিন্তু এই জাতীয় শব্দ যদি সমতরঙ্গ তৈরি করে
শ্রবণেন্দ্রিয়ে সুখানুভূতির সৃষ্টি করে, তবে তা সঙ্গীতোপযোগী ধ্বনি সৃষ্টি করবে, এমন
কথা ভাবাই যায়। কিন্তু বাস্তবে আমরা সঙ্গীতোপযোগী ধ্বনিকে আরও একটু উচ্চাসনে বসিয়ে
থাকি। এই বিবেচনাটা করা হয় গানের বিচারে।
সঙ্গীতোপযোগী ধ্বনির প্রধান বৈশিষ্ট্য
হিসেবে যদি ধ্বনি রঞ্জকতাকে বিবেচনা করা তাহলে দেখা যায়, মৌলিক ধ্বনির ধ্বনিরঞ্জকতা
কম। মৌলিক ধ্বনি অন্যান্য ধ্বনি-শ্রবণের বিড়ম্বনা থেকে মুক্ত থাকে, ফলে শুনতে খারাপ
লাগে না। কিন্তু অন্য কোনো ধ্বনির সমন্বয় থাকে না বলে ধ্বনি রঞ্জকতার মান পায় না।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায় চিনি মিষ্টি, কিন্তু স্বাদের বিচারে তার
স্বাদন-রঞ্জকতা কম। আবার
পায়েস মিষ্টি, কিন্তু এর স্বাদন-রঞ্জকতা
বেশি। মৌলিক ধ্বনি হলো- হলো শ্রবণেন্দ্রিয়ের
বিচারে চিনির মতো মিষ্টি কিন্তু ধ্বনিরঞ্জকতার অভাবে তা সঙ্গীতোপযোগী ধ্বনি হয়ে উঠে
না।
শুধু ধ্বনিরঞ্জকতাই সঙ্গীতোপযোগী ধ্বনি পূর্ণাঙ্গ সুখশ্রাব্য রূপ পায় না। এর
সাথে আরও কিছু বিষয়কে বিবেচনায় রাখতেই হয়।
যেমন, শব্দ-উচ্চতা