রাগ

ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের একটি পারভাষিক শব্দ। শব্দউৎসের বিচারে এটি সংস্কৃত শব্দ। এর রূপতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ হলো- রন্‌জ্ (রঞ্জিত করা) + অ (ঘঞ্), ভাববাচ্য। অভিধানের বিচারে রাগ শব্দটির নানা অর্থ পাওয়া যায়। যেমন-

১. কোনো কিছুকে রঙিন করা
সমার্থক শব্দাবলি: রঞ্জন, রঞ্জিত করা, রাগ।
২. রঞ্জিত রূপের প্রকাশিত দশা
সমার্থক শব্দাবলি: রং, বর্ণ, রঞ্জনদ্রব্য। অঙ্গরাগ, রক্তরাগ]
. চিত্তের বিক্ষুব্ধ দশায় উৎপন্ন ভাব
সমার্থক শব্দাবলি: কোপ, ক্রোধ, গোসা, রাগ, রোষ।
. প্রেমপূর্ণ আবেগজাত ভাব- যা আসক্তি, মোহ, স্নেহ ইত্যদির প্রকাশ ঘটায়
সমার্থক শব্দাবলি: আসক্তি, প্রণয়, প্রেম, মমতা, স্নেহ
. ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের একটি রূপ কাঠামো, যা সঙ্গীতোপযোগী ধ্বনি সুনির্দিষ্ট ধ্বনি বিন্যাসে সৃষ্ট হয় এবং শ্রোতার মনকে রঞ্জিত করে।
সমার্থক শব্দাবলি: রাগ, রাগিণী। যেমন-ভৈরব, ভৈরবী, কাফি ইত্যাদি

ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের রাগ একটি পারভাষিক শব্দ। খ্রিষ্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীতে রচিত মতঙ্গের রচিত বৃহদ্দেশী 'রাগ' নামক অধ্যায়ে রাগের সংজ্ঞা হিসেবে বলা হয়েছে- স্বরবর্ণবিশেষের প্রয়োগে অথবা ধ্বনিভেদে যা রঞ্জন করে থাকে, সজ্জনসমূহের মতানুসারে তাকেই রাগ আখ্যা দেওয়া হয়। [পৃষ্ঠা: ১৩২]

রাগ শব্দের আক্ষরিক অর্থ হলো- যার উপস্থিতিতে মন রঞ্জিত হয়। রাগের মনোরঞ্জনের প্রাথমিক রূপ সৃষ্টি হয় মনে। এর মৌলিক উপাদান অনাহত নাদ। ভৌত জগতে আহত নাদের দ্বারা প্রকাশিত হয়। এই অনাহত সঙ্গীত অনাহত ছন্দ নিবদ্ধ হলে, রাগের প্রাথমিক অরূপ মূর্তি তৈরি হয়। এর সাথে রসের আবির্ভাব হলে, রাগ পূর্ণতা পায়।

নানা ধরনের স্বরবিন্যাসে রাগের নানা ধরণ তৈরি হয়। তার সবই অরূপমূর্তি রূপে অনাহতের নাদের আশ্রয়ে মনের গভীরে ধ্বনিত হয়। সুনির্দিষ্ট কোনো রাগ হলো- বহুবিধ সঙ্গীতোপযোগী শব্দ বা ধ্বনি-শৈলির অরূপমূর্তির একটি মিশ্ররূপ।

ভারতীয় সঙ্গীতশাস্ত্রের আদি ধ্বনিরূপকে নাদ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এর দুটি রূপ হলো- অনাহত নাদ (অশ্রুত শব্দব্রহ্ম) ও আহত নাদ। আহত নাদ সৃষ্টির হয় আঘাতজনিত কারণে বস্তুর কম্পনের সূত্রে। সঙ্গীতোপযোগী ধ্বনিকম্পাঙ্কের দ্বিগুণাত্মক সূত্রে সৃষ্টি হয় স্কেল। এই স্কেলের সমগুণান্বিত দ্বাদশ ভাগের প্রতিটি ভাগ হলো স্বর। আর একাধিক স্বর মিলিত হয়ে তৈরি হয় সুর। সুর নানা ভাবে তৈরি হতে পারে। সঙ্গীতের রূপের বিচারে একে বলা যায় সুরের মৌলিক রূপ। দুটি স্বর মিলে যত ধরনের সুর তৈরি হবে, তার সবগুলোই হবে মৌলিক রূপ। দুইয়ের বেশি স্বর মিলে তৈরি হবে যৌগিক ক্ষুদ্ররূপ। এই রূপগুলো হতে পারে বিচ্ছিন্ন ধারায়, অবিচ্ছন্ন ধারায়। অবিচ্ছিন্ন ধারার সুর হতে পারে সরল, বক্র বা মীড়যুক্ত। আর অবিচ্ছিন্ন ধারার সুরে রয়েছে সরল ও বক্র।

ক্ষুদ্রসুর যখন কোনো নান্দনিক  হয়ে উঠে এবং একটি ক্ষুদ্র সুরকাঠামো তৈরির উপযোগী হয়ে উঠে, তখন তাকে  বলা হয় সাঙ্গীতিক স্বরগুচ্ছ (
phrase, musical phrase)। এরূপ নানা জাতীয় সুর ও স্বর মিলিত হয়ে তৈরি হয়, নানা ধরনের সুরশৈলী। এক বা একাধিক সুরশৈলীর সমন্বয়ে সৃষ্ট স্বরবিন্যাস যখন একটি বিশেষ শৈলীকে উপস্থাপন করে, তখন সুরাঙ্গের ( musical style) সৃষ্টি হয়। ভারতীয় সঙ্গীতে সাধারণভাবে একে বলা হয় 'অঙ্গ'। যেমন-ভৈরব অঙ্গ, কাফি অঙ্গ, কানাড়া অঙ্গ। এই সকল অঙ্গের সাথে আরও কিছু সুরশৈলী বা ক্ষুদ্রসুর যুক্ত হয়ে যে সুরকাঠামো গড়ে উঠে, তাতে রাগাঙ্গের রূপ ফুটে উঠে। একে রাগ হিসেবে বিশেষভাবে চিহ্নিত করা ক্ষেত্রে কতকগুলো বিধিকে অনুসরণ করা হয়। এই বিধির দ্বারা রাগের লক্ষণ সৃষ্টি হয়।

রাগের গাঠনিক ভিত্তি হিসেবে প্রাথমিকভাবে একটি স্বরসপ্তক থেকে নির্বাচিত কিছু স্বরকে গ্রহণ করা হয়। একে বলা যায় রাগের ব্যবহারিক স্বরতালিকা। যেমন ইমন রাগে ব্যবহৃত স্বরসপ্তক হলো- স র গ হ্ম প ধ ন। স্কেলের বা স্বরাষ্টকের বিচারে এর রূপ স র গ হ্ম প ধ ন র্স। এখানে কোনো স্বরকে দুইবার গ্রহণ করা হয় নি। ইট, কাঠ, লোহা ইত্যাদি যেমন বাড়ি নয়, তেমনি 'স র গ হ্ম প ধ ন র' ইমন রাগ নয়। যে কোন রাগের নির্ধারিত রূপ ফুটে, ওই রাগের জন্য নির্বাচিত স্বরের বিন্যাসের ভিতর দিয়ে। এক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রাখে কিছু নির্বাচিত সুরশৈলী এবং অন্যান্য কিছু স্বরের বিধিবদ্ধ সমন্বিত প্রয়োগ। একটি রাগকে বিশেষভাবে চিহ্নিত করা জন্য বিশেষ কিছু শর্ত বা বিধি মান্য করা হয়। প্রাথমিকভাবে রাগ-পরিচিতিতে দুটি বিষয়কে মান্য করা হয়। এর একটি হলো আরোহণ-অবরোহণ, দ্বিতীয়টি জাতি।
১. আরোহণ-অবরোহণ: প্রতিটি রাগের রয়েছে সুনির্দিষ্ট আরোহণ/অবরোহণের স্বরসমষ্টি। যেমন-
রাগ ভূপালী: স র গ প ধ র্স/র্স ধ প গ র স
রাগ মালকোষ: স জ্ঞ ম দ ণ র্স/র্স ণ দ ম জ্ঞ স
রাগ ভৈরবী: স ঋ জ্ঞ ম প দ ণ র্স/র্স ণ দ প ম জ্ঞ ঋ স।

২. জাতি: রাগের আরোহণ/অবরোহণে ব্যবহৃত স্বরের সংখ্যানুসারে রাগের জাতি নির্ধারিত হয়। সাধারণভাবে রাগে ৫, ৬ বা ৭টি স্বর ব্যবহৃত হয়। পাঁচ স্বরে রাগকে বলা হয় ঔড়ব, ছয় স্বরের রাগকে বলা হয় ষাড়ব আর সাত স্বরের রাগকে বলা হয় সম্পূর্ণ। রাগের জাতি নির্ণয়ের ক্ষেত্রে এটি সাধারণ হিসাব। কিন্তু একটু বিশেষভাবে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, অনেক রাগের আরোহণ এবং অবরোহণের স্বরসংখ্যা একই রকমের হয় না। যেমন খাম্বাজ রাগের আরোহণে ব্যবহৃত হয় ৬টি স্বর (স গ ম প ধ ন র্স), অবরোহণে ব্যবহৃত হয় ৭টি স্বর (র্স ণ ধ প ম গ র স)। এই বিচারে জাতি হবে ষাড়ব সম্পূর্ণ। এই বিচারে রাগের জাতি হবে-
সম্পূর্ণ-সম্পূর্ণ, সম্পূর্ণ-ষাড়ব, সম্পূর্ণ-ঔড়ব
ষাড়ব-সম্পূর্ণ, ষাড়ব-ষাড়ব, ষাড়ব-ঔড়ব
ঔড়ব-সম্পূর্ণ, ঔড়ব-ষাড়ব, ঔড়ব-ঔড়ব
এছাড়া চার স্বরের কিছু রাগ আছে যাদের স্বর সংখ্যা চারটি। এই জাতীয় রাগকে বলা হয় স্বরান্তর।
উপরের দুটি শর্তকে প্রাথমিক বিধি বলা হয়, রাগের স্বর-উপাদানের বিচারে। এই বিচার করা হয় একটি স্বরসপ্তকের বিচারে। রাগরূপ সৃষ্টি হয় এই দুটি বিধিকে ভিত্তি করে বিশেষ স্বরবিন্যাসের মাধ্যমে। রাগের রূপ নির্ণয়ে এই স্বরবিন্যাসকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা হয়।
সুর: সঙ্গীততত্ত্বের বিচারে 'সুর' শব্দটি একটি বিশেষ অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। এটি নিতান্তই সঙ্গীতের পারিভাষিক শব্দ। তাই ভিন্ন অর্থে সুর যাই হোক এখানে তা গ্রহণ করা হবে না। এক্ষেত্রে সুর হলো- দুই বা ততোধিক স্বরের বিন্যাস, যা স্বরগুলোর শ্রবণ-রেশের ভিতর ধ্বনিত হবে এবং ধ্বনি মাধুর্য তৈরি করবে। একটি স্বরকে দীর্ঘক্ষণ ধরে টানা বাজতে থাকলে তা হবে স্বর। কিন্তু একটি স্বরের শ্রবণ-রেশের ভিতরে ধ্বনিত হলে তা সুরে পরিণত হবে। এই বিচারে সুরকে প্রাথমিকভাবে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন-
১. বিচ্ছিন্ন সুর: যখন প্রতিটি স্বরের ভিতরে শ্রবণ বিরাম পাওয়া যায়। কিন্তু এই বিরাম সামান্য সময়ের জন্য ঘটে, ফলে শ্রোতা স্বরগুলোকে বিচ্ছিন্নভাবে শুনলেও শ্রবণ অনুভবের ভিতরে অবচ্ছিন্নভাবেই পায়। এই সুর হতে পারে তিন প্রকার। প্রকার তিনটি হলো- আরোহ, অবরোহ ও বক্র। ২. অবচ্ছিন্ন সুর: কোনো ধ্বনি মানুষের শ্রবণেন্দ্রিয়কে যখন উজ্জীবিত করে, তখন তার রেশ ১/১০ সেকেন্ড পর্যন্ত থেকে যায়। এই সময়ের মধ্যে দুটি ধ্বনি মানুষের কাছে অবচ্ছিন্ন মনে হয়। এই জাতীয় সুর হতে পারে- চার প্রকার। প্রকার চারটি হলো আরোহ, অবরোহ, বক্র ও মীড়।
সুরের প্রকৃতি বিচারে যে কোনো রাগ হলো- সুরের প্রবহমানতা। যেহেতু প্রতিটি রাগের নিজস্ব স্বর-সেট রয়েছে। তাই এক্ষেত্রে প্রতিটি রাগের নিজস্ব সুরের রূপ তৈরির একটি ধাপ সম্পন্ন হবে। এর দ্বারা চূড়ান্ত রূপ পাওয়া যাবে না অন্তত একটি কারণে, তা হলো একই স্বর ও স্বরসংখ্যা একাধিক রাগে থাকতে পারে। একাধিক রাগের যখন একই স্বর ও স্বরসংখ্যা থাকে, তখন ওই রাগগুলো সমপ্রকৃতির রাগের ইঙ্গিতও দেয়। কিন্তু পরিপূর্ণভাবে সমপ্রকৃতির রাগ হয়ে উঠে না। এক্ষেত্রে বিশেষ নিয়ামক হয়ে হয়ে উঠে এর স্বরগুচ্ছ ও সুরশৈলী।
স্বরগুচ্ছ ও সুরশৈলী: কিছু স্বর একত্রিত হয়ে বিশেষ ধরনের সুর তৈরি করে। এই বিশেষ সুরগুলো ব্লক হিসেবে নিজস্ব ধ্বনিরূপ পায়। এই অবস্থায় এগুলোকে স্বরগুচ্ছ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। যেমন- সরগ, রগম, গমপ।  অনেক সময়ই এদেরকে কোনো টানা সুরের ভিতরে আলাদা করে চেনা যায়। যেমন-
              স স স। স র গ। র গ ম। গ মপ। প ম গ। র স স।
এখানে, প্রথম 'সসস'  একটি পৃথক স্বরগুচ্ছ। এর পরে রয়েছে স র গ। র গ ম। গ ম প- তিনটি স্বরগুচ্ছ। কিন্তু বক্ররীতিতে একটি সুররূপ তৈরি করেছে। এই সুররূপগুলো যেন পরস্পরের অনুষঙ্গী হয়ে চলছে। কবিতার অনুপ্রাসের মতই এই তিনটি স্বরগুচ্ছ যেন এক ধরনের সুর-প্রতিধ্বনির সৃষ্টি করে এগিয়ে চলে। আরে শেষের প ম গ। র স স হলো অবরোহী স্বরগুচ্ছ।

প্রতিটি রাগের রয়েছে কিছু নিজস্ব স্বরগুচ্ছ। এগুলো ছোটো ছোটো সুরের নকশা তৈরি করে, একটি সুরশৈলীকে প্রকাশ করে। মূলত এই স্বরগুচ্ছ রাগের মৌলিক রূপকে ধারণ করে। তাই রাগের ক্ষেত্রে এই স্বরগুচ্ছকে সাঙ্গীতিক স্বরগুচ্ছ (
phrase, musical phrase )। অবশ্যই সাধারণ স্বরগুচ্ছ থেকে সাঙ্গীতিক স্বরগুচ্ছ স্বতন্ত্র। সাধারণ সাঙ্গীতিক স্বরগুচ্ছ সাধারণভাবে সুরের প্রয়োজনে যেকোনো ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যায়। কিন্তু বিশেষ রাগের ক্ষেত্রের জন্য বিশেষ সাঙ্গীতিক স্বরগুচ্ছ ব্যবহার করতেই হয়, তা না হলে রাগ-রূপ নষ্ট হয়ে যায়।
শুধু সাঙ্গীতিক স্বরগুচ্ছ দিয়ে রাগরূপ ফুটে উঠে না। এর জন্য রাগে ব্যবহৃত অন্যান্য স্বরগুলোরও  প্রয়োজন হয়। মূলত রাগের মূল সাঙ্গীতিক স্বরগুচ্ছের সাথে অন্যান্য স্বরের সুসমন্বয়ে রাগরূপ ফুটে উঠে। এক্ষেত্রে অন্যান্য স্বরগুলোর প্রয়োগের ক্ষেত্রে বিবেচনা করতে হয়, প্রতিটি স্বরের স্থিতিকাল। একটি স্বর থেকে পরের স্বরের যাওয়ার সময়টা কতটুকু হবে, সেখানে মীড়ের ব্যবহার হবে কিনা, কোনো বিশেষ প্রয়োগের সময় অন্য স্বরের স্পর্শ লাগবে কিনা, অবরোহণের রীতিতে স্বরের চলন হবে না কি উলম্ফন হবে- এই জাতীয় বিষয়গুলো বিশেষ বিবেচনায় রাখতেই হবে। এছাড়া আছে রাগের শুরুতে কোন স্বর ব্যবহার করতে হয় (গ্রহস্বর) এবং রাগের চলনের সময় কোনো কোন স্বরে থামতে হয় (ন্যাসস্বর) ইত্যাদিও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এছাড়াও রয়েছে রাগের জন্য বাদীস্বর, সম্বাদী স্বর, বিবাদীস্বর, বর্জিত স্বর ইত্যাদি। আরও রয়েছে রাগরূপায়ণে নানা ধরনের অলঙ্কার। পরিবেশনের অঙ্গ হিসেবে অলঙ্কারে প্রকৃতিতেও রয়েছে বিভিন্নতা। যেমন- খেয়াল, ধ্রুপদ, টপ্পা, গজল, ঠুমরি, ভজন ইত্যাদির রয়েছে কিছু সাধারণ সুরালঙ্কার, আবার কিছু রয়েছে বিশেষিত অলঙ্কার। সব মিলিয়ে প্রতিটি রাগ যে বিশেষ ধ্বনি সৌন্দর্য তৈরি করে, তাই হলো ওই রাগের রূপ। রাগরূপে উল্লেখিত বৈশিষ্ট্যের বিচারে প্রতিটি রাগের তৈরি হয় নিজস্ব ধ্বনিসৌর্ভ ও ধ্বনি-আভিজাত্য। যা দিয়ে সৃষ্টি হয় প্রতিটি রাগের স্বতন্ত্র রূপ, বলা যায় রাগ-ব্যক্তিত্ব। এর উদাহরণ হিসেবে ইমন রাগের রূপ যৎকিঞ্চিৎ আলোচনা করবো।

ইমনের রাগরূপ:
ইমন রাগের আরোহণ-অবরোহণের স্বরগুলো হলো-  স র গ হ্ম প ধ ন র্স/র্স ন ধ প হ্ম গ র স। একে বলা যায়, ইমন রাগের স্বরাষ্টক। স্বরের সংখ্যার বিচারে সম্পূর্ণ-সম্পূর্ণ। এই স্বরাষ্টক আর ইমন রাগ এক নয়। মূলত ইমন পরিবেশন করতে গেলে স্বরাষ্টকের কোন কোন স্বর ব্যবহার করা হবে, তার একটি সাধারণ উল্লেখ মাত্র। তাই পরিবেশেনের সময় স্বরাষ্টককের সরল কাঠামো ভেঙে বক্র কাঠামো তৈরি করতে হয়।

প্রথাগতভাবে এর শুরু হওয়া উচিৎ ষড়্‌জ থেকে। কিন্তু এই রাগের শুরুটা প্রায়ই দেখা যায় স্কেলের এক স্বর নিচ থেকে অর্থাৎ উদারার শুদ্ধ নিষাদ থেকে। সঙ্গীত শাস্ত্রে বলা হয় এর প্রধান সুরশৈলী হলো ন্ র গ। এই সুরশৈলীকে কেন্দ্র করে অন্যান্য স্বরগুলো আবর্তিত হয়, এবং এর ন্যাস স্বর হিসেবে স্থিতি লাভ করে ষড়্‌জতে।
ন ধ্ ন্ র স।
ন্ র গ
ন্ র গ হ্ম প-- র গ
ন্ র স
শাস্ত্রী এই বিধি অনুসরণ করলেও ইমন রূপ পাওয়া যাবে না, যতক্ষণ না অন্যান্য স্বরগুলোর প্রয়োগ যথাযথভাবে না হবে। যেমন ন্‌ র স-এর র- স্বর কিছুটা মীড়ের মতো হয়ে প্রলম্বিত হবে। এখানে র স্বরের উপরে কতটুকু সময় থাকবে হবে সেটাও বিবেচনা করতে হবে। ন্ র গ-কে মূল সুরশৈলী বলা হয়, এককভাবে এই স্বর তিনটি পরিবেশন করে বিশ্রাম নেওয়া যায়। কিন্তু এর সাথে হ্ম প যোগ করে এগিয়েও যাওয়া যায়। এরপর প-থেকে র-তে ফিরে আসলে রাগের রূপ বজায় থাকে, তবে প থেকে র-তে আসতে হয় মীড় দিয়ে। তাতে যুক্ত করতে হয়, কোমল ধ্বনিপ্রক্ষেপণ।

এরপর এই রাগরূপকে এগিয়ে নিতে গেলে পঞ্চমকে অতিক্রম করতেই হয়। কিন্তু এখানেই ঘটে স্বরের উলম্ফন। এই উলম্ফন ঘটে কড়ি মধ্যম থেকে শুদ্ধ ধৈবতে। এখানে প্রয়োগ হয় ইমনের দ্বিতীয় সুরশৈলী। এই সুরশৈলী হলো হ্ম ধ ন। অবশ্য এর যুক্ত থাকে ন্ র গ। সব মিলিয়ে এর আরোহ রূপ দাঁড়ায়-
ন্ র গ হ্ম ধ ন র্‌র র্স
যদিও এই রাগের আরোহণে পঞ্চম বর্জন করা হয়। তারপরেও  গান্ধার ও নিষাদের পরে প্রবল উপস্থিতি রয়েছে পঞ্চমের। বিশেষ করে প-স  এবং প র গ -এর প্রয়োগে এই রাগে ফুটে ওঠে কল্যাণ অঙ্গ। এতকিছু বলার পরও ইমন রাগ বই থেকে থেকে শিখে পরিবেশন করতে পারবেন না। রাগ প্রশিক্ষণের এই প্রক্রিয়ায় একমাত্র প্রকৃষ্ট মাধ্যম হলো গুরু।

রাগের প্রধান পরিচয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত। কারণ রাগ মাত্রেই কিছু অত্যাবশ্যকীয় বিধির দ্বারা নির্ধারিত হয়ে থাকে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রথাগত বিধি মেনেই সামান্য পরিবর্তন করা হয়। তবে এই পরিবর্তনেরও বিধি আছে।

রাগের সাধারণ বিধিসমূহ

১. রাগ নাম: শাস্ত্রমতে একটি রাগের সুনির্দিষ্ট নাম থাকতে হবে। বাস্তবে রাগ-নামের নানা হেরফের লক্ষ্য করা যায়। যেমন-

২. আরোহণঅবরোহণ: একটি রাগে ব্যবহৃত স্বরের ক্রমো-ঊর্ধবমুখী রূপ ও ক্রম-নিম্নমুখী রূপ হলো- আরহণ ও অবরোহণ। বাস্তবে রাগের আরোহণ-অবরোহণ রূপ অনেক সময় সরল হয় না। রাগের প্রাথমিক রূপের বিচারে অনেক সময় বক্র সুর ব্যবহার করা হয়।

৩.ঠাট: ঠাট হলো রাগের শ্রেণিকরণের নাম বিশেষ। দক্ষিণ ভারতীয় পদ্ধতিতে এর সমতূল্য নাম মেল। দক্ষিণ ভারতে মেলের সংখ্যা ৭২টি। বেঙ্কটমখী এবং গোবিন্দাচার্যের মেল বিভাজনে নামের পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। উত্তর ভারতে ভাতখণ্ডেজির প্রণীত ১০ ঠাট মান্য করা হয়।

ভাতখণ্ডেজির প্রণীত ১০ ঠাট
 

  ১. বিলাবল : স র গ ম প ধ ন র্স

২.
খাম্বাজ : স র গ ম প ধ ণ র্স
৩.
কাফি : স র জ্ঞ ম প ধ ণ র্স
৪.
শাবরী : স র জ্ঞ ম প দ ণ র্স
৫.
ভৈরবী : স ঋ জ্ঞ ম প দ  ণ র্স
৬.
ভৈরব : স ঋ গ ম প দ ন র্স
৭.
কল্যাণ : স র গ হ্ম প ধ ন র্স
৮.
মারবা : স ঋ গ হ্ম প ধ ন র্স
৯.
পূরবী : স ঋ গ হ্ম প দ ন র্স
১০.
টোড়ি : স ঋ জ্ঞ হ্ম প দ ন র্স


৪.জাতি: একটি রাগ কয়টি স্বর নিয়ে রচিত হয়, তার উপর ভিত্তি করে রাগের জাতি নির্ধরণ করা হয়। সাধারণ বিধিতে ৭ স্বরের রাগকে সমপূর্ণ, ৬ স্বরের রাগকে ষাড়ব এবং ৫ স্বরের রাগকে ঔড়ব বলা হয়।

আরোহণ-অবরোহণের  বিচারে জাতি হতে প্রকার হতে পারে। যেমন

আরোহণে স্বর-সংখ্যা অবরোহণে স্বর-সংখ্যা জাতি
















ঔড়ব-ঔড়ব
ঔড়ব-ষাড়ব
ঔড়ব-সম্পূর্ণ
ষাড়ব-ঔড়ব
ষাড়ব-ষাড়ব
ষাড়ব-সম্পূর্ণ
সম্পূর্ণ-ঔড়ব
সম্পূর্ণ-ষাড়ব
সম্পূর্ণ-সম্পূর্ণ

প্রাচীন গ্রন্থাদিতে ৪ স্বরের রাগের উল্লেখ পাওয়া যায়। এই জাতীয় রাগকে বলা হয় স্বরান্তর। ৪ স্বরের কম রাগ না হলেও, সুরের চলনের বিচারে এদের নাম রয়েছে। যেমন ৩ স্বরের সুর সামিক, ২ স্বরের সুর, গাথিক। এক স্বরে কোনো সুর হয় না। তারপরেও এর নাম পাওয়া আর্চিক।

৫. বাদী ও সমবাদী: রাগের সবেচেয়ে প্রাধান্য পায় এমন স্বর বাদী এবং বাদী স্বর থেকে কম কিন্তু অন্যান্য স্বর থেকে বেশি ব্যবহৃত হয়, এমন স্বর সমবাদী। বাদী স্বরের বিচারে সমবাদী স্বর নির্ধারণে দুটি শর্ত অনুসরণ করা হয়।

১. বাদী স্বর থেকে নবম বা ত্রয়োদশ শ্রুতিতে অধিষ্ঠিত স্বরকে সমবাদী বলা হয়।
২. সমশ্রুতি-বিশিষ্ট স্বরদ্বয় পরস্পরের বাদী ও সম্বাদী হবে।
প্রথম শ্রুতি অনুসারে দেখা যায় বাদী স্বরের বিচারে নবম বা ত্রয়োদশ শ্রুতিতে সমবাদী হয়। তা হলে ষড়্‌জ বাদী হলে মধ্যম বা পঞ্চম সম্বাদী হতে পারে। লক্ষ্য করা যায় মধ্যসপ্তকের ষড়্‌জ থেকে মন্দ্রসপ্তকের মধ্যম ত্রয়োদশ শ্রুতিতে পাওয়া যায়। এবং মন্দ্রমধ্যমের দ্বিগুণ স্বর হয় বলে মধ্যসপ্তকের মধ্যম, ষড়্‌জ থেকে নবম শ্রুতিতে সম্বাদীর মর্যাদা পায়। অনেকে বাদী-সমবাদীকে 'ষড়্‌জ-পঞ্চম ভাব' হিসাবে আখ্যায়িত করে থাকেন।

নবম শ্রুতিতে সমবাদী নির্ধারণ করে বাদী-সমবাদী হলে, মধ্যম বাদী ও কোমল নিষাদ সমবাদী হবে। কিন্তু এই দুটি স্বর সমশ্রুতি সম্পন্ন নয়। তাই দ্বিতীয় সূত্রের বিচারে এই স্বরদ্বয় বাদী সমবাদী হবে না। উপরের দুটি শর্তের বিচারে বাদী-সমবাদী হিসাবে যে স্বরদ্বয় হিসাবে বিবেচিত হবে, তার তালিকা নিচে দেওয়া হলো।
 
অধস্তন সমবাদী     মধ্যসপ্তক-স্থিত বাদী  ঊর্ধ্তন সমবাদী
ম্
হ্ম্
প্
দ্
ধ্
ণ্
ন্



জ্ঞ




জ্ঞ


হ্ম





র্স





র্স


জ্ঞ

র্ম
র্হ্ম
র্প


৬. অঙ্গ: স্বরাষ্টকের আটটি স্বরকে (স র গ ম প ধ ন র্স) দুটি ভাগে করলে, তার প্রত্যেকটি ভাগকে অঙ্গ বলা হয়। যেমন : স র গ ম ও  প ধ ন র্স। এর পূর্বভাগকে (স র গ ম) বলা হয় পূর্বাঙ্গ, এবং উত্তরভাগকে (প ধ ন র্স) বলা হয় উত্তরাঙ্গ। কোনো কানো মতে এই বিভাজন হয় তিন প্রকার। এই মতে পূর্বাঙ্গ (স র গ), মধ্যাঙ্গ (ম প) ও উত্তরাঙ্গ (ধ ন র্স)। স্বরাষ্টকের  দুই ভাগে যারা বিশ্বাসী- তাদের কেউ কেউ প-কে পূর্বাঙ্গ ধরে থাকেন। 

রাগের চলন যে অঙ্গকে অবলম্বন করে রচিত তার বিচারে- রাগকে সেই অঙ্গের বিচার করা হয়। তা ছাড়া রাগের বাদী স্বরকে কেন্দ্র করে রাগরূপায়ণ ঘটে থাকে। তাই বাদী স্বরের বিচারে রাগকে পূর্বাঙ্গ বা উত্তরাঙ্গ প্রধান হিসেবেও বিবেচনা করা হয়।

কোনো কোনো রাগের স্বরবিন্যাস কখনো কখনো এমন কোনো বিশিষ্ট্ রূপ ধারণ করে, যা অন্যত্র ওই বিশেষ রূপেই নিজেকে প্রকাশ করে থাকে। এই বিশেষ রূপকে অঙ্গ বলা হয়। রাগের ক্ষেত্রে এরূপ অঙ্গ কোনো বিশেষ নামে চিহ্নিত হয়ে থাকে। যেমন- কানাড়া অঙ্গ।

. পকড়: হিন্দি পকড় শব্দের অর্থ 'ধরা'। বাংলাতে হিন্দির মতো তীর্যক অ-এর উচ্চারণ হয় না। তাই বাংলাতে এর উচ্চারণ হবে 'পকোড়্'। সঙ্গীত শাস্ত্রের অত্যল্প স্বরের দ্বারা রাগের রূপ প্রকাশ করার প্রক্রিয়াই হলো পকড়। যেমন ইমন রাগের পকড় হতে পারে, পহ্মগরগহ্মপ। কোনো বিশেষ রাগের পকড়ের স্বরগুলো এমনভাবে নির্ধারণ করা হয়, যাতে অন্য কোনো রাগের থেকে ওই বিশেষ রাগকে পৃথকভাবে নির্দেশিত করা যায়।

. সময়:  ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে রাগ পরিবেশনের সময়কে অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিশেষভাবে মান্য করা হয়। এই সময়কে যেভাবে।

. লয়: ভারতীয় সঙ্গীতে তালের গতিকে লয় বলা হয়। মূলতঃ তালের অন্তর্গত প্রতি দুটি মাত্রার মধ্যবর্তী সময়কেই কাল বলে। এই মাত্রাদ্বয়ের মধ্যবর্তী কালের স্থিতিকালের উপর নির্ভর করে লয়ের শ্রেণি-বিভাগ করা হয়েছে। ধরা যাক দুটি মাত্রার মধ্যবর্তীকাল যদি ৪ সেকেণ্ড হয়- তবে লয় বিভাজন নিম্নরূপ হবে

   ৪ সেকেণ্ড   বিলম্বিত লয়

   ২ সেকেণ্ড   ঈষ বিলম্বিত লয়

   ১ সেকেণ্ড  মধ্য লয়

   ১/২সেকেণ্ড  ঈষ দ্রুত লয়

   ১/৪সেকেণ্ড  দ্রুত লয়

   ১/৮সেকেণ্ড  অতি দ্রুত লয়।


এছাড়া কোন নির্দিষ্ট লয়ের মধ্যে থেকেও পরিবেশনের ক্ষেত্রে লয়ের গতিকে হ্রাস-বৃদ্ধি করা সম্ভব। ধরা যাক, ১ সেকেণ্ড পরিমিত একটি লয় গ্রহণ করা হলো। অ
র্থ প্রতি ১ সেকেণ্ড পর পর একটি করে মাত্রা যাবে। এইক্ষেত্রে পরিবেশনকারী নিম্নরূপ সূত্রে অগ্রসর হবে

 

   ১  ২  ৩  ৪   ৫  ৬  ৭  ৮

   সা রা গা  মা পা  ধা  না  র্সা

 

কিন্তু পরিবেশনকারী যদি উক্ত মাত্রাকালের মধ্যে দুটি করে স্বর উচ্চারণ করে, তবে তা দ্বিগুণ লয়ের পরিবেশনা হিসাবে বিবেচিত হবে। আর এর রূপটি হবে নিম্নরূপ-

 

   ১     ২     ৩      ৪     ৫   ৬       ৭     ৮

  সরা  গমা  পধা  নর্সা  সরা  গমা   পধা  নর্সা

 

এইরূপ লয়ের নামও ভিন্ন। যেমন :

১। লয়ের সমান সময়ে পরিবেশিত হলে তাকে বলে বরাবর লয় বলে।

২। লয়ের সমান সময়ের মধ্যে সোয়া বার পরিবেশিত হলে তাকে কু-আড় লয় বলে।

৩। লয়ের সমান সময়ের মধ্যে দেড় বার পরিবেশিত হলে তাকে আড় লয় বলে।

৪। লয়ের সমান সময়ের মধ্যে দুই বার পরিবেশিত হলে তাকে দ্বিগুণ লয় বলে।

৫। লয়ের সমান সময়ের মধ্যে তিন বার পরিবেশিত হলে তাকে ত্রিগুণ লয় বলে।

৬। লয়ের সমান সময়ের মধ্যে চার বার পরিবেশিত হলে তাকে চৌগুণ লয় বলে।
 

পাশ্চাত্য সঙ্গীতে লয়কে বলে টেম্পো

এছাড়া রাগের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে মান্য করা হয়- গ্রহস্বর, ন্যাস স্বর, স্থান (মন্দ্র, মধ্য, তারের বিচারে), শ্রেণি (শুদ্ধ, ছায়ালগ, সঙ্কীর্ণ)।

রাগের প্রকাশরূপ:
রাগের প্রাথমিক প্রকাশরূপ তৈরি অনাহত নাদ, আহত নাদ ও ছন্দের সুসমন্বয়ে। রাগের প্রাথমিক দশায় আহত নাদ ও ছন্দ বা তাল রাগের যান্ত্রিক রূপ প্রদান করে। কারণ এক্ষেত্রে প্রতিটি রাগের শাস্ত্রীবিধি অনুসারে কিছু রাগভিত্তিক সুরশৈলী উপস্থাপন করা হয়। আহতনাদের চর্চার ভিতর দিয়ে মনের ভিতরে রাগের অরূপ মূর্তির কাঠামোটা তৈরি হয়। এই কাঠামো অনাহত নাদ হয়ে নৈশব্দে মনের ভিতরে বাজে। তাই রাগের শাস্ত্রীবিধিতে বাঁধা রাগ, শুধু রাগের গায়ক তৈরি করে, শিল্পী তৈরি করে না।
 
রাগ শৈল্পিক হয়ে ওঠে, স্বরবিন্যাসের সাথে রস যুক্ত হয়। এটা যতটা না গুরুমুখী, তার চেয়ে বেশি আত্মমুখী। আহত নাদের জগতের স্বর প্রয়োগের কৌশল গুরুমুখী। সেখানে গুরু -শিষ্যের স্বরধ্যান একই। কিন্তু রসের জগত গুরু-শিষ্যের একই হয় না। রসভেদের স্বরের প্রয়োগ সম্পর্কে গুরু শিষ্যকে যান্ত্রিক পরামর্শ দিতে পারেন। কিন্তু রসের অনুভূতিকে শিষ্যের মনে আরোপ করতে পারেন না। তাই রসের সাগরে ডুব দিতে হলে, শিষ্যকই রসিক হয়ে উঠতে হয়। নইলে চিরকাল গুরুর কার্বনকপি হয়ে থাকতে হয়।

রাগের প্রাথমিক কাঠামো ফুটে উঠে পকড়ের মাধ্যমে। কণ্ঠে পরিবেশিত বন্দিশ এবং বাদ্যযন্ত্রে পরিবেশিত গতের মাধ্যমে রাগের একটি বিশেষ ধরনের রূপ তৈরি হয়ে। খেয়ালের বিস্তার বা ধ্রুপদের আলাপের ভিতরে রাগের পূর্ণ বিকাশ ঘটে। মূলত আলাপ বা বিস্তারে রাগের সুরশৈলীর সাথে রসের অবতারণা করা হয়। এর ভিতর দিয়ে উপস্থাপিত হয় রাগের পূর্ণাবয়ব। এক্ষেত্রে রাগের রূপবৈচিত্র্য এতটাই বিস্তৃত হয় যে, এক আসরে বসে এর সকল রূপ উপস্থাপন করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। নন্দনতত্ত্বের বিচারে রাগের রূপ অসীম। তাই এক জীবনে একজন শিল্পীর হয়তো একটি রাগের রূপবৈচিত্র্যের সন্ধান পাওয়া সম্ভব হয়ে ওঠে না। নন্দনতত্ত্বের বিচারে রাগের সৌন্দর্যের পরম দশায় রয়েছে রাগের প্রকৃত রূপ, যা রাগের জন্য পরম সত্য।

দেখুন: রাগের ক্রমবিবর্তনের ইতিহাস