রাগের ক্রমবিবর্তনের ইতিহাস
রাগের কালানুক্রমিক তালিকা
রাগ
ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের একটি পারভাষিক শব্দ। শব্দউৎসের বিচারে এটি সংস্কৃত শব্দ। এর রূপতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ হলো- রন্‌জ্ (রঞ্জিত করা) + অ (ঘঞ্), ভাববাচ্য। অভিধানের বিচারে রাগ শব্দটির নানা অর্থ পাওয়া যায়। যেমন-
১. কোনো কিছুকে রঙিন করা
সমার্থক শব্দাবলি: রঞ্জন, রঞ্জিত করা, রাগ।
২. রঞ্জিত রূপের প্রকাশিত দশা
সমার্থক শব্দাবলি: রং, বর্ণ, রঞ্জনদ্রব্য। অঙ্গরাগ, রক্তরাগ]
৩. চিত্তের বিক্ষুব্ধ দশায় উৎপন্ন ভাব
সমার্থক শব্দাবলি: কোপ, ক্রোধ, গোসা, রাগ, রোষ।
৪. প্রেমপূর্ণ আবেগজাত ভাব- যা আসক্তি, মোহ, স্নেহ ইত্যদির প্রকাশ ঘটায়
সমার্থক শব্দাবলি: আসক্তি, প্রণয়, প্রেম, মমতা, স্নেহ
৫. ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের একটি রূপ কাঠামো, যা সঙ্গীতোপযোগী ধ্বনি সুনির্দিষ্ট ধ্বনি বিন্যাসে সৃষ্ট হয় এবং শ্রোতার মনকে রঞ্জিত করে।
সমার্থক শব্দাবলি: রাগ, রাগিণী। যেমন-ভৈরব, ভৈরবী, কাফি ইত্যাদি
রাগ শব্দের সাধারণ অর্থের বিচারে বলা যায়- ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের একটি বিশেষ ধরনের সঙ্গীতশৈলী, যা মানুষের শ্রবণেন্দ্রিয় দ্বারা অনুভূত হয় এবং  মনকে রঞ্জিত করে। কিন্তু শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের বিচারে এই সংজ্ঞা যথেষ্ঠ নয়। কারণ শ্রবণেন্দ্রিয় দ্বারা অনুভূত যে কোন মনোরঞ্জনকারী স্বর বা সুরকে রাগ বলা হয় না। শাস্ত্রীয় বিধির বিশেষ নিয়মে বাঁধা সুর হয়ে ওঠে রাগ।
খ্রিষ্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীতে রচিত মতঙ্গের রচিত বৃহদ্দেশীর 'রাগ' নামক অধ্যায়ে রাগের সংজ্ঞা হিসেবে বলা হয়েছে- স্বরবর্ণ  বিশেষের প্রয়োগে অথবা ধ্বনিভেদে যা রঞ্জন করে থাকে, সজ্জনসমূহের মতানুসারে তাকেই রাগ আখ্যা দেওয়া হয়। [পৃষ্ঠা: ১৩২]

রাগের সত্তা বৈশিষ্ট্য:   মূর্ত ও বিমূর্ত জগতের অসংখ্যা সত্তার ভিতরে রাগকে বিশেষভাবে শনাক্ত করা যায়। তাই শব্দের বিচারে বা সুরশৈলীর বিচার রাগ হলো- একটি স্বতন্ত্র সত্ত্বা। ত্রিমাত্রিক বস্তু জগতে এই সত্তার কোনো দৃশ্যত আকার নেই তাই রাগকে বলা হয় বিমূর্ত সত্তা। রাগ পরিবেশনের মধ্য দিয়ে বিমূর্তন রূপ প্রকাশ পায়। রাগ পরিবেশনের মধ্য দিয়ে শ্রোতার সাথে শিল্পীর একটি 'শ্রবণ যোগাযোগ' গড়ে ওঠে।

মানুষ  তার শ্রবণেন্দ্রিয়ের মাধ্যমে নানা ধরনের শব্দের পরিচিত। এসকল শব্দের মধ্য অসংখ্য শব্দকে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে থাকে। সঙ্গীতে ব্যবহৃত শব্দ এর ভিতরে একটি। সঙ্গীতে ব্যবহৃত বিশেষ ধরনের শব্দের শাস্ত্রীয় নাম সঙ্গীতোপযোগী ধ্বনি। এই ধ্বনির প্রাথমিক ধারণা হিসেবে বলা যায়- যে ধ্বনি মানুষের মনকে স্নিগ্ধ ও মোহিত করে, তাকেই সঙ্গীতোপযোগী ধ্বনি বা সুরেলা ধ্বনি। এই বিচারে সঙ্গীতোপযোগী ধ্বনি অসংখ্য। প্রকৃতিতে এরূপ ধ্বনি পাওয়া যায়, গান গাওয়া পাখির ডাকে, জলধারার শব্দে, মেঘমন্দ্রিত গম্ভীর ধ্বনি। আদিম কালের মানুষের মধ্যে সাঙ্গীতিক বোধের বিকাশ ঘটেছিল, প্রাকৃতিক এই সকল সঙ্গীতোপযোগী ধ্বনি শ্রবণের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে।

আদিম মানুষ সঙ্গীতের শাস্ত্রীয় জ্ঞান ছিল না। তারা সঙ্গীতোপযোগী ধ্বনি ব্যবহার করতো তাদের মনোরঞ্জনের জন্য।  কালক্রমে মানুষ এসকল ধ্বনিকে সুনির্দিষ্ট শ্রবণ নমুনা হিসেবে শনাক্ত করার জন্য সাঙ্গীতিক স্কেল (সাঙ্গীতিক পরিমাপ) তৈরি করেছিল। ধ্বনির উচ্চতা সামান্যতার বিচারে  তৈরি করেছিল উদারা-মুদারা তারা নামক স্কেল। এই স্কেলের ভিতরের সঙ্গীতোপযোগী ধ্বনিগুলোকে ব্যবহারিক সুবিধার জন্য নাম দিয়েছিল স্বর। ভারতীয় বৈদিক সঙ্গীতের ধারায় এগুলোর নামকরাণ করা হয়েছিল- প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ, মন্দ্র, ক্রুষ্ট, আতিশার্য। এই প্রাথমিক সাতটি স্বরের বিন্যাসে গান্ধর্ব সঙ্গীতশিল্পীরা তিনটি নবতর স্কেল তৈরি করেছিল। এর নাম দেওয়া হয়েছিল গ্রাম।

খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম শতাব্দীর দিকে তিনটি গ্রামের প্রচলন ছিল। এদের নাম ছিল ষড়্‌জগ্রাম, মধ্যম গ্রাম এবং গান্ধার গ্রাম। খ্রিষ্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দীর দিকে গান্ধার গ্রাম বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। এই গ্রামগুলোর স্বরের অনুক্রমিক বিন্যাসে সৃষ্টি হয়েছিল মূর্চ্ছনা। আর মূর্চ্ছনার নানারূপ বিন্যাসে সৃষ্টি হয়েছিল স্বরবিন্যাস। এর সাথে নানা ধরনের সুরশৈলী যুক্ত হয়ে সৃষ্টি হয়েছিল গ্রামরাগ। এই গ্রাম রাগের ব্যবহার ছিল ধ্রুব গানে। খ্রিষ্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দীতে নাটকে গ্রামরাগের বিশেষভাবে ব্যবহার করা হয়েছিল ধ্রুবা গ্রান। ভরতে নাট্যশাস্ত্রের এই গানগুলোকে উপস্থাপন করা হয়েছিল জাতি গান হিসেবে। ভরতের পরে তাঁর পুত্র ও শিষ্যরা স্বতন্ত্রভাবে গ্রামরাগগুলোকে সাজিয়েছিল। খ্রিষ্টীয় পঞ্চম শতাব্দীর ভিতরে শাস্ত্রীয় গ্রামরাগ এবং ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের সুরগুলোকে শাস্ত্রীয় বিধিতে বেঁধে রাগ নামে অভিহিত করা হয়েছিল। এই সময় আঞ্চলিক সুরবালম্বনে রচিত রাগগুলোর নাম দেওয়া হয়েছিল দেশাখ্য রাগ।

গ্রামরাগ এবং দেশাখ্য রাগের সাধারণ সুরশৈলী অনুসারে সৃষ্টি হয়েছিল সুরাঙ্গ। এই সুরাঙ্গের অধীনে রাগগুলো বিন্যস্ত হয়েছিল। রাগের কালনুক্রমিক ক্রমবিবর্তনের ধারা অনুসরণে এবং শুধু শাস্ত্রীয় বিধির অনুসরণে রাগের সত্তাতত্ত্বকে সাজালে যে রূপটি পাওয়া যায়, তা হলো-
সত্তা | বিমূর্ত সত্তা | বিমূর্তন | যোগাযোগ | শ্রবণ যোগাযোগ | সঙ্গীতোপযোগী ধ্বনি | সাঙ্গীতিক স্কেল | স্বরস্বরবিন্যাস | | সুরশৈলী | সুরাঙ্গ | রাগ}
প্রাচীন গ্রামের ভিতর এক সময় মধ্যম গ্রাম বিলুপ্ত হয়ে যায়। পরে ষড়্‌জগ্রামের কাঠামো অনুসারে প্রচলতি হয় মেল ও ঠাট ভিত্তিক স্বরবিন্যাস। রাগ-রাগিণী ভাবনায় পুষ্ট হয়ে রাগের শ্রেণিকরণে বেশ কিছু মত প্রকাশিত হয়েছিল। এগুলো হলো- ব্রহ্মামত (৬ রাগ ৩৬ রাগিনী), কল্পিনাথ মত (৬ রাগ, ৩৬ রাগিণী), হনুমন্ত মত (৬ রাগ, ৩০ রাগিণী), ভরত মত (৬টি রাগ, ৩০ রাগিণী, ৩০ পুত্র ও ৩০ পুত্রবধূ)।

খ্রিষ্টীয় ত্রয়োদশ-চতুর্দশ শতাব্দীর ভিতরে রাগের শ্রেণী বিন্যাসে মেল ও ঠাটের ভাবনা সঞ্চালিত হয়। এই ধারণার ক্রমবির্তনে সৃষ্টি হয়েছে দক্ষিণ ভারতীয় সঙ্গীত পদ্ধতির ৭২ মেল, এবং উত্তর ভারতে ভাতখণ্ডেজির প্রস্তাবিত ১০টি ঠাট। এই বিচারে   সত্তাতত্ত্বকে সাজালে যে রূপটি পাওয়া যায়, তা হলো-
সত্তা | বিমূর্ত সত্তা | বিমূর্তন | যোগাযোগ | শ্রবণ যোগাযোগ | সঙ্গীতোপযোগী ধ্বনি | সাঙ্গীতিক স্কেল | স্বরস্বরবিন্যাস | মেল/ঠাট। রাগ}
রাগাঙ্গ ও মেল বা ঠাট
প্রাচীন ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে রাগের উৎপত্তি ঘটেছিল- মনোরঞ্জনের সূত্রে। রাগাঙ্গে তার আভাস থাকলেও ঠটা বিন্যাসে তার সন্ধান পাওয়া যায় না। শব্দবিশ্লেষণের বিচারে রাগ ও অঙ্গ মিলে হয় রাগাঙ্গ। এখানে যা মনকে রঞ্জিত করে, তাই রাগ। আর অঙ্গ হলো- রাগের আঙ্গিক বিন্যাসের রূপরেখা। উভয় মিলে রাগাঙ্গের ভিতরে পাওয়া যায় মনোরঞ্জনকারী বিশেষ স্বরগুচ্ছ বা সুরশৈলী একটি সাধারণ রূপ। যখন একাধিক রাগে একই ধরনের মনোরঞ্জকারী সুরশৈলী  পাওয়া যায়, তখন ওই সকল রাগের দলগত নাম হয় রাগাঙ্গ। যেমন ভৈরব অঙ্গ, টোড়ি অঙ্গ, কানাড়া অঙ্গ, মল্লার অঙ্গ ইত্যাদি। কোনো সুনির্দিষ্ট রাগের আসল মেজাজ এবং রূপ এই রাগাঙ্গের মাধ্যমেই প্রকাশিত হয়। রাগ পরিবেশনের সময় রাগাঙ্গ অনুসরণেই শ্রোতার বিশেষ রাগকে বিশেষভাবে উপস্থাপন করা হয়।

মেল বা ঠাট নিছক স্কেল ভিত্তিক স্বরবিন্যাস। এর সাথে মনোরঞ্জনের কোন বিষয় যুক্ত থাকে না। রাগাঙ্গকে বর্জন করে রাগরূপকে প্রতিষ্টা করা যায় না। পক্ষান্তরে ঠাটের বিচরণ শুধুই আরোহণ/অবরোহণের মধ্যে আবদ্ধ। তাছাড়া ঠাটের মূল কাঠামোকে অগ্রাহ করে, ওই ঠাটের রাগে অন্যস্বর ব্যবহৃত হয়।

রাগের কাঠামোগত বিন্যাস
রাগের গাঠনিক ভিত্তি হিসেবে প্রাথমিকভাবে একটি স্বরসপ্তক থেকে নির্বাচিত কিছু স্বরকে গ্রহণ করা হয়। একে বলা যায় রাগের ব্যবহারিক স্বরতালিকা। যেমন ইমন রাগে ব্যবহৃত স্বরসপ্তক হলো- স র গ হ্ম প ধ ন। স্কেলের বা স্বরাষ্টকের বিচারে এর রূপ স র গ হ্ম প ধ ন র্স। এখানে কোনো স্বরকে দুইবার গ্রহণ করা হয় নি। ইট, কাঠ, লোহা ইত্যাদি যেমন বাড়ি নয়, তেমনি 'স র গ হ্ম প ধ ন র' ইমন রাগ নয়। যে কোন রাগের নির্ধারিত রূপ ফুটে, ওই রাগের জন্য নির্বাচিত স্বরের বিন্যাসের ভিতর দিয়ে। এক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রাখে কিছু নির্বাচিত সুরশৈলী এবং অন্যান্য কিছু স্বরের বিধিবদ্ধ সমন্বিত প্রয়োগ। একটি রাগকে বিশেষভাবে চিহ্নিত করা জন্য বিশেষ কিছু শর্ত বা বিধি মান্য করা হয়।রাগরূপ সৃষ্টি হয় এই ৩টি বিধিকে ভিত্তি করে বিশেষ স্বরবিন্যাসের মাধ্যমে। বিধি দুটি হলো সুর, স্বরগুচ্ছ, ও সুরশৈলী।
সুর: সঙ্গীততত্ত্বের বিচারে 'সুর' শব্দটি একটি বিশেষ অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। এটি নিতান্তই সঙ্গীতের পারিভাষিক শব্দ। তাই ভিন্ন অর্থে সুর যাই হোক এখানে তা গ্রহণ করা হবে না। এক্ষেত্রে সুর হলো- দুই বা ততোধিক স্বরের বিন্যাস, যা স্বরগুলোর শ্রবণ-রেশের ভিতর ধ্বনিত হবে এবং ধ্বনি মাধুর্য তৈরি করবে। একটি স্বরকে দীর্ঘক্ষণ ধরে টানা বাজতে থাকলে তা হবে স্বর। কিন্তু একটি স্বরের শ্রবণ-রেশের ভিতরে অন্য স্বর ধ্বনিত হলে তা সুরে পরিণত হবে। এই বিচারে সুরকে প্রাথমিকভাবে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন-
১. বিচ্ছিন্ন সুর: যখন প্রতিটি স্বরের ভিতরে শ্রবণ বিরাম পাওয়া যায়। কিন্তু এই বিরাম সামান্য সময়ের জন্য ঘটে, ফলে শ্রোতা স্বরগুলোকে বিচ্ছিন্নভাবে শুনলেও শ্রবণ অনুভবের ভিতরে অবচ্ছিন্নভাবেই পায়। এই সুর হতে পারে তিন প্রকার। প্রকার তিনটি হলো- আরোহ, অবরোহ ও বক্র।
২. অবচ্ছিন্ন সুর: কোনো ধ্বনি মানুষের শ্রবণেন্দ্রিয়কে যখন উজ্জীবিত করে, তখন তার রেশ ১/১০ সেকেন্ড পর্যন্ত থেকে যায়। এই সময়ের মধ্যে দুটি ধ্বনি মানুষের কাছে অবচ্ছিন্ন মনে হয়। এই জাতীয় সুর হতে পারে- চার প্রকার। প্রকার চারটি হলো আরোহ, অবরোহ, বক্র ও মীড়।
সুরের প্রকৃতি বিচারে যে কোনো রাগ হলো- সুরের প্রবহমানতা। যেহেতু প্রতিটি রাগের নিজস্ব স্বর-সেট রয়েছে। তাই এক্ষেত্রে প্রতিটি রাগের নিজস্ব সুরের রূপ তৈরির একটি ধাপ সম্পন্ন হবে। এর দ্বারা চূড়ান্ত রূপ পাওয়া যাবে না অন্তত একটি কারণে, তা হলো একই স্বর ও স্বরসংখ্যা একাধিক রাগে থাকতে পারে। একাধিক রাগের যখন একই স্বর ও স্বরসংখ্যা থাকে, তখন ওই রাগগুলো সমপ্রকৃতির রাগের ইঙ্গিতও দেয়। কিন্তু পরিপূর্ণভাবে সমপ্রকৃতির রাগ হয়ে উঠে না। এক্ষেত্রে বিশেষ নিয়ামক হয়ে হয়ে উঠে এর স্বরগুচ্ছ ও সুরশৈলী।
স্বরগুচ্ছ ও সুরশৈলী: কিছু স্বর একত্রিত হয়ে বিশেষ ধরনের সুর তৈরি করে। এই বিশেষ সুরগুলো ব্লক হিসেবে নিজস্ব ধ্বনিরূপ পায়। এই অবস্থায় এগুলোকে স্বরগুচ্ছ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। যেমন- সরগ, রগম, গমপ।  অনেক সময়ই এদেরকে কোনো টানা সুরের ভিতরে আলাদা করে চেনা যায়। যেমন-
              স স স। স র গ। র গ ম। গ ম প। প ম গ। র স স।

এখানে, প্রথম 'সসস'  একটি পৃথক স্বরগুচ্ছ। এর পরে রয়েছে স র গ। র গ ম। গ ম প- তিনটি স্বরগুচ্ছ। কিন্তু বক্ররীতিতে একটি সুররূপ তৈরি করেছে। এই সুররূপগুলো যেন পরস্পরের অনুষঙ্গী হয়ে চলছে। কবিতার অনুপ্রাসের মতই এই তিনটি স্বরগুচ্ছ যেন এক ধরনের সুর-প্রতিধ্বনির সৃষ্টি করে এগিয়ে চলে। আরে শেষের প ম গ। র স স হলো অবরোহী স্বরগুচ্ছ।

প্রতিটি রাগের রয়েছে কিছু নিজস্ব স্বরগুচ্ছ। এগুলো ছোটো ছোটো সুরের নকশা তৈরি করে, একটি সুরশৈলীকে প্রকাশ করে। মূলত এই স্বরগুচ্ছ রাগের মৌলিক রূপকে ধারণ করে। তাই রাগের ক্ষেত্রে এই স্বরগুচ্ছকে সাঙ্গীতিক স্বরগুচ্ছ (
phrase, musical phrase )। অবশ্যই সাধারণ স্বরগুচ্ছ থেকে সাঙ্গীতিক স্বরগুচ্ছ স্বতন্ত্র। সাধারণ সাঙ্গীতিক স্বরগুচ্ছ সাধারণভাবে সুরের প্রয়োজনে যেকোনো ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যায়। কিন্তু বিশেষ রাগের ক্ষেত্রের জন্য বিশেষ সাঙ্গীতিক স্বরগুচ্ছ ব্যবহার করতেই হয়, তা না হলে রাগ-রূপ নষ্ট হয়ে যায়।
শুধু সাঙ্গীতিক স্বরগুচ্ছ দিয়ে রাগরূপ ফুটে উঠে না। এর জন্য রাগে ব্যবহৃত অন্যান্য স্বরগুলোরও  প্রয়োজন হয়। মূলত রাগের মূল সাঙ্গীতিক স্বরগুচ্ছের সাথে অন্যান্য স্বরের সুসমন্বয়ে রাগরূপ ফুটে উঠে। এক্ষেত্রে অন্যান্য স্বরগুলোর প্রয়োগের ক্ষেত্রে বিবেচনা করতে হয়, প্রতিটি স্বরের স্থিতিকাল। একটি স্বর থেকে পরের স্বরের যাওয়ার সময়টা কতটুকু হবে, সেখানে মীড়ের ব্যবহার হবে কিনা, কোনো বিশেষ প্রয়োগের সময় অন্য স্বরের স্পর্শ লাগবে কিনা, অবরোহণের রীতিতে স্বরের চলন হবে না কি উলম্ফন হবে- এই জাতীয় বিষয়গুলো বিশেষ বিবেচনায় রাখতেই হবে। এছাড়া আছে রাগের শুরুতে কোন স্বর ব্যবহার করতে হয় (গ্রহস্বর) এবং রাগের চলনের সময় কোনো কোন স্বরে থামতে হয় (ন্যাসস্বর) ইত্যাদিও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এছাড়াও রয়েছে রাগের জন্য বাদীস্বর, সম্বাদী স্বর, বিবাদীস্বর, বর্জিত স্বর ইত্যাদি। আরও রয়েছে রাগরূপায়ণে নানা ধরনের অলঙ্কার। পরিবেশনের অঙ্গ হিসেবে অলঙ্কারে প্রকৃতিতেও রয়েছে বিভিন্নতা। যেমন- খেয়াল, ধ্রুপদ, টপ্পা, গজল, ঠুমরি, ভজন ইত্যাদির রয়েছে কিছু সাধারণ সুরালঙ্কার, আবার কিছু রয়েছে বিশেষিত অলঙ্কার। সব মিলিয়ে প্রতিটি রাগ যে বিশেষ ধ্বনি সৌন্দর্য তৈরি করে, তাই হলো ওই রাগের রূপ। রাগরূপে উল্লেখিত বৈশিষ্ট্যের বিচারে প্রতিটি রাগের তৈরি হয় নিজস্ব ধ্বনিসৌর্ভ ও ধ্বনি-আভিজাত্য। যা দিয়ে সৃষ্টি হয় প্রতিটি রাগের স্বতন্ত্র রূপ, বলা যায় রাগ-ব্যক্তিত্ব। এর উদাহরণ হিসেবে ইমন রাগের রূপ যৎকিঞ্চিৎ আলোচনা করবো।

ইমনের রাগরূপ:
ইমন রাগের আরোহণ-অবরোহণের স্বরগুলো হলো-  স র গ হ্ম প ধ ন র্স/র্স ন ধ প হ্ম গ র স। একে বলা যায়, ইমন রাগের স্বরাষ্টক। স্বরের সংখ্যার বিচারে সম্পূর্ণ-সম্পূর্ণ। এই স্বরাষ্টক আর ইমন রাগ এক নয়। মূলত ইমন পরিবেশন করতে গেলে স্বরাষ্টকের কোন কোন স্বর ব্যবহার করা হবে, তার একটি সাধারণ উল্লেখ মাত্র। তাই পরিবেশেনের সময় স্বরাষ্টককের সরল কাঠামো ভেঙে বক্র কাঠামো তৈরি করতে হয়।

প্রথাগতভাবে এর শুরু হওয়া উচিৎ ষড়্‌জ থেকে। কিন্তু এই রাগের শুরুটা প্রায়ই দেখা যায় স্কেলের এক স্বর নিচ থেকে অর্থাৎ উদারার শুদ্ধ নিষাদ থেকে। সঙ্গীত শাস্ত্রে বলা হয় এর প্রধান সুরশৈলী হলো ন্ র গ। এই সুরশৈলীকে কেন্দ্র করে অন্যান্য স্বরগুলো আবর্তিত হয়, এবং এর ন্যাস স্বর হিসেবে স্থিতি লাভ করে ষড়্‌জতে।
ন ধ্ ন্ র স।
ন্ র গ
ন্ র গ হ্ম প-- র গ
ন্ র স
শাস্ত্রী এই বিধি অনুসরণ করলেও ইমন রূপ পাওয়া যাবে না, যতক্ষণ না অন্যান্য স্বরগুলোর প্রয়োগ যথাযথভাবে না হবে। যেমন ন্‌ র স-এর র- স্বর কিছুটা মীড়ের মতো হয়ে প্রলম্বিত হবে। এখানে র স্বরের উপরে কতটুকু সময় থাকবে হবে সেটাও বিবেচনা করতে হবে। ন্ র গ-কে মূল সুরশৈলী বলা হয়, এককভাবে এই স্বর তিনটি পরিবেশন করে বিশ্রাম নেওয়া যায়। কিন্তু এর সাথে হ্ম প যোগ করে এগিয়েও যাওয়া যায়। এরপর প-থেকে র-তে ফিরে আসলে রাগের রূপ বজায় থাকে, তবে প থেকে র-তে আসতে হয় মীড় দিয়ে। তাতে যুক্ত করতে হয়, কোমল ধ্বনিপ্রক্ষেপণ।

এরপর এই রাগরূপকে এগিয়ে নিতে গেলে পঞ্চমকে অতিক্রম করতেই হয়। কিন্তু এখানেই ঘটে স্বরের উলম্ফন। এই উলম্ফন ঘটে কড়ি মধ্যম থেকে শুদ্ধ ধৈবতে। এখানে প্রয়োগ হয় ইমনের দ্বিতীয় সুরশৈলী। এই সুরশৈলী হলো হ্ম ধ ন। অবশ্য এর যুক্ত থাকে ন্ র গ। সব মিলিয়ে এর আরোহ রূপ দাঁড়ায়-
ন্ র গ হ্ম ধ ন র্‌র র্স
যদিও এই রাগের আরোহণে পঞ্চম বর্জন করা হয়। তারপরেও  গান্ধার ও নিষাদের পরে প্রবল উপস্থিতি রয়েছে পঞ্চমের। বিশেষ করে প-স  এবং প র গ -এর প্রয়োগে এই রাগে ফুটে ওঠে কল্যাণ অঙ্গ। এতকিছু বলার পরও ইমন রাগ বই থেকে থেকে শিখে পরিবেশন করতে পারবেন না। রাগ প্রশিক্ষণের এই প্রক্রিয়ায় একমাত্র প্রকৃষ্ট মাধ্যম হলো গুরু।

রাগের প্রধান পরিচয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত। কারণ রাগ মাত্রেই কিছু অত্যাবশ্যকীয় বিধির দ্বারা নির্ধারিত হয়ে থাকে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রথাগত বিধি মেনেই সামান্য পরিবর্তন করা হয়। তবে এই পরিবর্তনেরও বিধি আছে।

রাগের প্রথাগত সাধারণ বিধিসমূহ
১. রাগ নাম: শাস্ত্রমতে একটি রাগের সুনির্দিষ্ট নাম থাকতে হবে। বাস্তবে রাগ-নামের নানা হেরফের লক্ষ্য করা যায়। যেমন-  প্রাথমিকভাবে রাগ-পরিচিতিতে দুটি বিষয়কে মান্য করা হয়। এর একটি হলো আরোহণ-অবরোহণ, দ্বিতীয়টি জাতি।২. আরোহণ-অবরোহণ: প্রতিটি রাগের রয়েছে সুনির্দিষ্ট আরোহণ/অবরোহণের স্বরসমষ্টি। যেমন-
রাগ ভূপালী: স র গ প ধ র্স/র্স ধ প গ র স
রাগ মালকোষ: স জ্ঞ ম দ ণ র্স/র্স ণ দ ম জ্ঞ স
রাগ ভৈরবী: স ঋ জ্ঞ ম প দ ণ র্স/র্স ণ দ প ম জ্ঞ ঋ স।

৩. জাতি: রাগের আরোহণ/অবরোহণে ব্যবহৃত স্বরের সংখ্যানুসারে রাগের জাতি নির্ধারিত হয়। সাধারণভাবে রাগে ৫, ৬ বা ৭টি স্বর ব্যবহৃত হয়। পাঁচ স্বরে রাগকে বলা হয় ঔড়ব, ছয় স্বরের রাগকে বলা হয় ষাড়ব আর সাত স্বরের রাগকে বলা হয় সম্পূর্ণ। রাগের জাতি নির্ণয়ের ক্ষেত্রে এটি সাধারণ হিসাব। কিন্তু একটু বিশেষভাবে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, অনেক রাগের আরোহণ এবং অবরোহণের স্বরসংখ্যা একই রকমের হয় না। যেমন খাম্বাজ রাগের আরোহণে ব্যবহৃত হয় ৬টি স্বর (স গ ম প ধ ন র্স), অবরোহণে ব্যবহৃত হয় ৭টি স্বর (র্স ণ ধ প ম গ র স)। এই বিচারে জাতি হবে ষাড়ব সম্পূর্ণ। এই বিচারে রাগের জাতি হবে-
সম্পূর্ণ-সম্পূর্ণ, সম্পূর্ণ-ষাড়ব, সম্পূর্ণ-ঔড়ব
ষাড়ব-সম্পূর্ণ, ষাড়ব-ষাড়ব, ষাড়ব-ঔড়ব
ঔড়ব-সম্পূর্ণ, ঔড়ব-ষাড়ব, ঔড়ব-ঔড়ব
অনেকে চার স্বরের রাগের কথা বলেন। কিন্তু শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে পাঁচ স্বরে কম কোনো রাগ হবে নে, এমন নির্দেশ পাওয়া যায়।
৪. ঠাট বা মেল: ঠাট হলো রাগের শ্রেণিকরণের নাম বিশেষ। দক্ষিণ ভারতীয় পদ্ধতিতে এর সমতূল্য নাম মেল। দক্ষিণ ভারতে মেলের সংখ্যা ৭২টি। বেঙ্কটমখী এবং গোবিন্দাচার্যের মেল বিভাজনে নামের পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। উত্তর ভারতে ভাতখণ্ডেজির প্রণীত ১০ ঠাট মান্য করা হয়।

৫. বাদী ও সমবাদী: রাগের সবেচেয়ে প্রাধান্য পায় এমন স্বর বাদী এবং বাদী স্বর থেকে কম কিন্তু অন্যান্য স্বর থেকে বেশি ব্যবহৃত হয়, এমন স্বর সমবাদী। বাদী স্বরের বিচারে সমবাদী স্বর নির্ধারণে দুটি শর্ত অনুসরণ করা হয়।
১. বাদী স্বর থেকে নবম বা ত্রয়োদশ শ্রুতিতে অধিষ্ঠিত স্বরকে সমবাদী বলা হয়।
২. সমশ্রুতি-বিশিষ্ট স্বরদ্বয় পরস্পরের বাদী ও সম্বাদী হবে।
প্রথম শ্রুতি অনুসারে দেখা যায় বাদী স্বরের বিচারে নবম বা ত্রয়োদশ শ্রুতিতে সমবাদী হয়। তা হলে ষড়্‌জ বাদী হলে মধ্যম বা পঞ্চম সম্বাদী হতে পারে। লক্ষ্য করা যায় মধ্যসপ্তকের ষড়্‌জ থেকে মন্দ্রসপ্তকের মধ্যম ত্রয়োদশ শ্রুতিতে পাওয়া যায়। এবং মন্দ্রমধ্যমের দ্বিগুণ স্বর হয় বলে মধ্যসপ্তকের মধ্যম, ষড়্‌জ থেকে নবম শ্রুতিতে সম্বাদীর মর্যাদা পায়। অনেকে বাদী-সমবাদীকে 'ষড়্‌জ-পঞ্চম ভাব' হিসাবে আখ্যায়িত করে থাকেন।

নবম শ্রুতিতে সমবাদী নির্ধারণ করে বাদী-সমবাদী হলে, মধ্যম বাদী ও কোমল নিষাদ সমবাদী হবে। কিন্তু এই দুটি স্বর সমশ্রুতি সম্পন্ন নয়। তাই দ্বিতীয় সূত্রের বিচারে এই স্বরদ্বয় বাদী সমবাদী হবে না। উপরের দুটি শর্তের বিচারে বাদী-সমবাদী হিসাবে যে স্বরদ্বয় হিসাবে বিবেচিত হবে, তার তালিকা নিচে দেওয়া হলো।
 
অধস্তন সমবাদী     মধ্যসপ্তক-স্থিত বাদী  ঊর্ধ্তন সমবাদী
ম্
হ্ম্
প্
দ্
ধ্
ণ্
ন্



জ্ঞ




জ্ঞ


হ্ম





র্স





র্স


জ্ঞ

র্ম
র্হ্ম
র্প

৬. অঙ্গ: স্বরাষ্টকের আটটি স্বরকে (স র গ ম প ধ ন র্স) দুটি ভাগে করলে, তার প্রত্যেকটি ভাগকে অঙ্গ বলা হয়। যেমন : স র গ ম ও  প ধ ন র্স। এর পূর্বভাগকে (স র গ ম) বলা হয় পূর্বাঙ্গ, এবং উত্তরভাগকে (প ধ ন র্স) বলা হয় উত্তরাঙ্গ। কোনো কানো মতে এই বিভাজন হয় তিন প্রকার। এই মতে পূর্বাঙ্গ (স র গ), মধ্যাঙ্গ (ম প) ও উত্তরাঙ্গ (ধ ন র্স)। স্বরাষ্টকের  দুই ভাগে যারা বিশ্বাসী- তাদের কেউ কেউ প-কে পূর্বাঙ্গ ধরে থাকেন। 

রাগের চলন যে অঙ্গকে অবলম্বন করে রচিত তার বিচারে- রাগকে সেই অঙ্গের বিচার করা হয়। তা ছাড়া রাগের বাদী স্বরকে কেন্দ্র করে রাগরূপায়ণ ঘটে থাকে। তাই বাদী স্বরের বিচারে রাগকে পূর্বাঙ্গ বা উত্তরাঙ্গ প্রধান হিসেবেও বিবেচনা করা হয়।

কোনো কোনো রাগের স্বরবিন্যাস কখনো কখনো এমন কোনো বিশিষ্ট্ রূপ ধারণ করে, যা অন্যত্র ওই বিশেষ রূপেই নিজেকে প্রকাশ করে থাকে। এই বিশেষ রূপকে অঙ্গ বলা হয়। রাগের ক্ষেত্রে এরূপ অঙ্গ কোনো বিশেষ নামে চিহ্নিত হয়ে থাকে। যেমন- কানাড়া অঙ্গ।

৭. পকড়: হিন্দি পকড় শব্দের অর্থ 'ধরা'। বাংলাতে হিন্দির মতো তীর্যক অ-এর উচ্চারণ হয় না। তাই বাংলাতে এর উচ্চারণ হবে 'পকোড়্'। সঙ্গীত শাস্ত্রের অত্যল্প স্বরের দ্বারা রাগের রূপ প্রকাশ করার প্রক্রিয়াই হলো- পকড়। যেমন ইমন রাগের পকড় হতে পারে, পহ্মগরগহ্মপ। কোনো বিশেষ রাগের পকড়ের স্বরগুলো এমনভাবে নির্ধারণ করা হয়, যাতে অন্য কোনো রাগের থেকে ওই বিশেষ রাগকে পৃথকভাবে নির্দেশিত করা যায়।

৮. সময়:  ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে রাগ পরিবেশনের সময়কে অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিশেষভাবে মান্য করা হয়। এই সময়কে যেভাবে।
ভারতীয় মতে দিবসের একটি অর্থ হলো- যতক্ষণ সূর্যের আলো পৃথিবীকে আলোকিত করে। এই অর্থে দিবস হলো সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সময়। সূর্যোদয়ের মুহূর্তকে বলা হয় ব্রাহ্মমুহূর্ত। এই ব্রাহ্মমুহূর্তকে দিনের শুরু হিসেবে বিবেচনা করা হয়। উল্লেখ্য দিবারাত্রির ৩০ ভাগের এক ভাগ হলো মূহূর্ত। এই বিচারে ৪৮ মিনিটে এক মুহূর্ত হয়। কোনো স্থানে সূর্য দৃশ্যমান হওয়া থেকে পরবর্তী ৪৮ মিনিট হলো ব্রাহ্মমুহূর্ত। অন্যভাবে বলা যায়, সূর্যোদয়ের প্রথম ৪৮ মিনিট হলো ব্রাহ্মমুহূর্ত।   ভারতবর্ষ নামক বিশাল ভূখণ্ডের সকল স্থানে একই সময় ব্রাহ্মমুহূর্ত সংঘটিত হয় না। আবার ঋতু পরিবর্তনে কারণে প্রতিদিন একই সময়ে ব্রাহ্মমুহূর্ত হয় না। কিন্তু লক্ষ্য করা যায়, সূর্য যখন বিষুবরেখা অতিক্রম করে, তখ, এই রেখার নিকটবর্তী অঞ্চলে দিবারাত্রি সমান হয়। এই কারণে, সূর্যোদয়ের একটি আদর্শমান হিসেবে বিবেচনা করা হয় ৬.০০। এই সূত্রে দিবা প্রথম প্রহর শুরু হয় সকাল ৬টা থেকে। ঋতু পরিবর্তনে এই সময়ের হেরফেল হলেও এই মানকেই অনুসরণ করা হয়।

রাজবাড়িতে যামের শেষে ঢাক বা ধাতব ঘণ্টায় আঘাত করে সময়ের ঘোষণা দেওয়া হতো। এই ঘোষণাকে বলা হতো প্রহর ঘোষণা। এই ঘোষণা হতো প্রহরের শেষে। এর অর্থ হলো সকাল ৬টায় যে প্রহর ঘোষণা করা হতো, তাকে বলা হতো রাত্রি শেষ প্রহরের ঘণ্টা। এই কারণে বেলা দ্বিপ্রহর হলো বেলা ১২টার ঘণ্টা। উল্লিখিত এই সময় পরিমাপের বিচারে।

দিবা প্রথম প্রহর : ভোর ৬টা থেকে সকাল ৯টা [ঘণ্টা পড়বে ৯টায়]
দিবা দ্বিতীয় প্রহর : সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১২টা [ঘণ্টা পড়বে ১২টায়]
দিবা তৃতীয় প্রহর : দুপুর ১২টা থেকে বিকাল ৩টা [ঘণ্টা পড়বে ৩টায়]
দিবা চতুর্থ বা শেষ প্রহর : বিকাল ৩টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা [ঘণ্টা পড়বে ৬টায়]।
রাত্রি প্রথম প্রহর : সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ৯টা [ঘণ্টা পড়বে ৯টায়]
রাত্রি দ্বিতীয় প্রহর : রাত ৯টা থেকে রাত ১২টা [ঘণ্টা পড়বে ১২টায়]
রাত্রি তৃতীয় প্রহর : রাত ১২টা রাত ৩টা [ঘণ্টা পড়বে ৩টায়]
রাত্রি চতুর্থ বা শেষ প্রহর : রাত ৩টা থেকে ভোর ৬ট [ঘণ্টা পড়বে ৬টায়, রাত্রি শেষ প্রহরের ঘণ্টা]

বর্তমানে প্রাত্যহিক কাজ কর্মে প্রহরের ব্যবহার না থাকলেও ভারতীয় রাগসঙ্গীতে এবং জ্যোতিষশাস্ত্রে 'প্রহর' ব্যবহার আছে। অবশ্য ভারতীয় সঙ্গীতশাস্ত্রে প্রহর নির্ধারণে মতভেদ আছে। পশ্চিম ভারতে রাগসঙ্গীতে দিবসের প্রথম প্রহর ধরা হয় ভোর ৪টা থেকে। কিন্তু একে সরসময় মান্য করা যায় না। ভাতখণ্ডেজী তাঁর 'ক্রমিক পুস্তক মালিকা (দুসরী পুস্তক)' গ্রন্থে ইমন রাগের লক্ষণগীতিতে এই রাগের গায়নকাল উল্লেখ করেছেন, 'রাত প্রথম প্রহর'। এই বিচারে দিবসের প্রথম প্রহর ভোর ৪টা থেকে ধরলে, ইমন গাওয়ার সময় হয় বিকেল ৪টা। কিন্তু রাত্রি প্রথম প্রহরকে সন্ধ্যা ৬টা ধরলে, ঋতু পরিবর্তনের সময়ের হেরফের হলেও তা বিকেল হয় না। প্রাতঃসন্ধি ও সায়ংসন্ধি রাগে সময়ের হেরফের সকল সন্ধ্যার বিচারে মান্য করা যায়। কিন্তু সন্ধি রাগের আগে পরের রাগে প্রহরের শুরু ৪টা ধরলে বিপত্তি ঘটে।

৮. লয়: ভারতীয় সঙ্গীতে তালের গতিকে লয় বলা হয়। মূলতঃ তালের অন্তর্গত প্রতি দুটি মাত্রার মধ্যবর্তী সময়কেই কাল বলে। এই মাত্রাদ্বয়ের মধ্যবর্তী কালের স্থিতিকালের উপর নির্ভর করে লয়ের শ্রেণি-বিভাগ করা হয়েছে। ধরা যাক দুটি মাত্রার মধ্যবর্তীকাল যদি ৪ সেকেণ্ড হয়- তবে লয় বিভাজন নিম্নরূপ হবে-

৪ সেকেণ্ডে   বিলম্বিত লয়   
২ সেকেণ্ডে- ঈষৎ বিলম্বিত লয়   
১ সেকেণ্ডে   মধ্য লয়   
১/২ সেকেণ্ডে ঈষৎ দ্রুত লয়   
১/৪ সেকেণ্ডে দ্রুত লয়
১/৮ সেকেণ্ড অতি দ্রুত লয়।

এছাড়া কোন নির্দিষ্ট লয়ের মধ্যে থেকেও পরিবেশনের ক্ষেত্রে লয়ের গতিকে হ্রাস-বৃদ্ধি করা সম্ভব। ধরা যাক, ১ সেকেণ্ড পরিমিত একটি লয় গ্রহণ করা হলো। অর্থাৎ প্রতি ১ সেকেণ্ড পর পর একটি করে মাত্রা যাবে। এইক্ষেত্রে পরিবেশনকারী নিম্নরূপ সূত্রে অগ্রসর হবে-
১  ২  ৩  ৪   ৫  ৬  ৭  ৮    সা রা গা  মা পা  ধা  না  র্সা
কিন্তু পরিবেশনকারী যদি উক্ত মাত্রাকালের মধ্যে দুটি করে স্বর উচ্চারণ করে, তবে তা দ্বিগুণ লয়ের পরিবেশনা হিসাবে বিবেচিত হবে। আর এর রূপটি হবে নিম্নরূপ-
   ১     ২     ৩      ৪     ৫   ৬     ৭     ৮  
  সরা  গমা  পধা  নর্সা  সরা  গমা   পধা  নর্সা
এইরূপ লয়ের নামও ভিন্ন। যেমন :
১। লয়ের সমান সময়ে পরিবেশিত হলে তাকে বলে বরাবর লয় বলে।
২। লয়ের সমান সময়ের মধ্যে সোয়া বার পরিবেশিত হলে তাকে কু-আড় লয় বলে।
৩। লয়ের সমান সময়ের মধ্যে দেড় বার পরিবেশিত হলে তাকে আড় লয় বলে।
৪। লয়ের সমান সময়ের মধ্যে দুই বার পরিবেশিত হলে তাকে দ্বিগুণ লয় বলে।
৫। লয়ের সমান সময়ের মধ্যে তিন বার পরিবেশিত হলে তাকে ত্রিগুণ লয় বলে।
৬। লয়ের সমান সময়ের মধ্যে চার বার পরিবেশিত হলে তাকে চৌগুণ লয় বলে।
পাশ্চাত্য সঙ্গীতে লয়কে বলে টেম্পো। এছাড়া রাগের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে মান্য করা হয়- গ্রহস্বর, ন্যাস স্বর, স্থান (মন্দ্র, মধ্য, তারের বিচারে), শ্রেণি (শুদ্ধ, ছায়ালগ, সঙ্কীর্ণ)।

রাগ শ্রেণিকরণের সামগ্রিক রূপ

রাগের প্রকাশরূপ:
রাগের প্রাথমিক প্রকাশরূপ তৈরি অনাহত নাদ, আহত নাদ ও ছন্দের সুসমন্বয়ে। রাগের প্রাথমিক দশায় আহত নাদ ও ছন্দ বা তাল রাগের যান্ত্রিক রূপ প্রদান করে। কারণ এক্ষেত্রে প্রতিটি রাগের শাস্ত্রীবিধি অনুসারে কিছু রাগভিত্তিক সুরশৈলী উপস্থাপন করা হয়। আহতনাদের চর্চার ভিতর দিয়ে মনের ভিতরে রাগের অরূপ মূর্তির কাঠামোটা তৈরি হয়। এই কাঠামো অনাহত নাদ হয়ে নৈশব্দে মনের ভিতরে বাজে। তাই রাগের শাস্ত্রীবিধিতে বাঁধা রাগ, শুধু রাগের গায়ক তৈরি করে, শিল্পী তৈরি করে না।
 
রাগ শৈল্পিক হয়ে ওঠে, স্বরবিন্যাসের সাথে রস যুক্ত হয়। এটা যতটা না গুরুমুখী, তার চেয়ে বেশি আত্মমুখী। আহত নাদের জগতের স্বর প্রয়োগের কৌশল গুরুমুখী। সেখানে গুরু -শিষ্যের স্বরধ্যান একই। কিন্তু রসের জগত গুরু-শিষ্যের একই হয় না। রসভেদের স্বরের প্রয়োগ সম্পর্কে গুরু শিষ্যকে যান্ত্রিক পরামর্শ দিতে পারেন। কিন্তু রসের অনুভূতিকে শিষ্যের মনে আরোপ করতে পারেন না। তাই রসের সাগরে ডুব দিতে হলে, শিষ্যকই রসিক হয়ে উঠতে হয়। নইলে চিরকাল গুরুর কার্বনকপি হয়ে থাকতে হয়।

রাগের প্রাথমিক কাঠামো ফুটে উঠে পকড়ের মাধ্যমে। কণ্ঠে পরিবেশিত বন্দিশ এবং বাদ্যযন্ত্রে পরিবেশিত গতের মাধ্যমে রাগের একটি বিশেষ ধরনের রূপ তৈরি হয়ে। খেয়ালের বিস্তার বা ধ্রুপদের আলাপের ভিতরে রাগের পূর্ণ বিকাশ ঘটে। মূলত আলাপ বা বিস্তারে রাগের সুরশৈলীর সাথে রসের অবতারণা করা হয়। এর ভিতর দিয়ে উপস্থাপিত হয় রাগের পূর্ণাবয়ব। এক্ষেত্রে রাগের রূপবৈচিত্র্য এতটাই বিস্তৃত হয় যে, এক আসরে বসে এর সকল রূপ উপস্থাপন করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। নন্দনতত্ত্বের বিচারে রাগের রূপ অসীম। তাই এক জীবনে একজন শিল্পীর হয়তো একটি রাগের রূপবৈচিত্র্যের সন্ধান পাওয়া সম্ভব হয়ে ওঠে না। নন্দনতত্ত্বের বিচারে রাগের সৌন্দর্যের পরম দশায় রয়েছে রাগের প্রকৃত রূপ, যা রাগের জন্য পরম সত্য।