√ সো (অবসান করা)+ মন্ (মনিন্), কর্তৃবাচ্য
...যজ্ঞসম্পাদনার্থ যে সকল ঋক গীত হয়'।
উল্লেখিত শব্দের বিশ্লেষণে 'সাম' শব্দের উৎকৃষ্ট ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না। মূলত ভক্তিমূলক গান হিসেবে সেমেটিক ভাষায় এই জাতীয় গানের অস্তিত্ব ছিল। দাউদের রচিত এরূপ বহুগান হিব্রু বাইবেলে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। সংকলিত এই গ্রন্থের হিব্রু নাম ছিল সেফের তেহিল্লিম (sefer tehillim) । এর অর্থ ছিল প্রশস্তি-গ্রন্থ। ধারণা করা হয় এই সঙ্গীত-সংকলনটি খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীর আগেই রচিত হয়েছিল। এতে ছিল দাউদের ৭৩টি গান, আসাফের ১২টি গান এবং কোরাহ-বংশীয় বাদক দলের ১১টি গান। হিব্রু থেকে গ্রিক ভাষার বাইবেল রচনার সময় এর নাম দেওয়া হয়েছিল প্সাল্মই (Psalmoi) পরে এই শব্দ থেকে গ্রিক শব্দ। psalmos শব্দের উৎপত্তি ঘটেছিল। এই গানের সাথে সংঙ্কলনের এর অর্থ গ্রহণ করা হয়েছিল- 'এমন ধর্মসঙ্গীত যা তারযন্ত্রের সাথে গীত হয়ৱ। এই সময় সেমেটিক ভাষা থেকে ইন্দো-ইউরোপিয়ান ভাষায় কৃতঋণ শব্দ হিসেবে যুক্ত হয়েছিল psalmos শব্দ। ল্যাটিন ভাষায় এর নাম হয়েছিল psalmus । আর প্রাচীন ইংরেজি ভাষায় শব্দটি প্রবেশ করেছিল psealm হিসেবে।
এই সময়ের বৈদিক সামগান তথা বৈদিক গানের
পাশাপাশি ছিল আর্যপল্লীর লৌকিক গান। এই সময় বৈদিক গানের সূত্রে আধ্যাত্মিক ওম ধ্বনি
সঙ্গীতের ওম ধ্বনিতে পরিণত হয়েছিল। এই ধ্বনি থেকে উৎপন্ন হয়েছিল বৈদিক গানের তিনটি ধ্বনি-
উদাত্ত, অনুদাত্ত স্বরিত নামক সঙ্গীতোপযোগী ধ্বনি। পরে আদ্য এই তিনটি ধ্বনি থেকে
উৎপন্ন হয়েছিল ৭টি শুদ্ধ স্বর। এই সকল বৈদিক স্বরগুলোর নাম পরিবর্তন করে গন্ধর্ব সঙ্গীতজ্ঞরা লৌকিক গানের
স্বর (ষড়্জ ঋষভ, গান্ধার, মধ্যম, পঞ্চম ও ধৈবত) গ্রহণ করেছিল।
বৈদিক যুগের রাজা-মহারাজার পূণ্যসঞ্চয়, সুনাম অজর্ন বা বড় ধরণের বিপদ থেকে মুক্তি
পাওয়ার আশায় পুরোহিতদের শরণাপন্ন হতেন। পুরোহিতরা বিষয়ের গুরুত্ব অনুসারে রাজাদেরকে
যজ্ঞের পরামর্শ দিতেন। যজ্ঞানুষ্ঠান যাঁর জন্য করা হতো, তাঁদের বলা হত যজমান। আর যে
সকল ঋষিরা এই যথাবিহিত নিয়ম অনুসরণ করে যজ্ঞানুষ্ঠান সম্পন্ন করতেন, তাঁদেরকে বলা
হতো ঋত্বিক। যজ্ঞানুষ্ঠান হতো সাড়ম্বরে, তাতে থাকতো বিপুল আয়োজন। ফলে এককভাবে কোনো
ঋষির পক্ষে যজ্ঞানুষ্ঠান পরিচালনা সম্ভব ছিল না। তাই অন্যান্য ঋত্বিকরা একজন প্রধান
ঋত্বিকের অধীনে অন্যান্য ঋত্বিকদের কর্মক্ষমতা বা পারদর্শিতার বিচারে যজ্ঞের
বিভিন্ন অংশ পরিচালনা করতেন। এই অনুষ্ঠানের প্রশস্তি পাঠকারীর ঋত্বিকদের বলা হতো -
হোতা। এই যজ্ঞানুষ্ঠানে কিছু ঋষি গান পরিবেশন করতেন। এঁদের বলা হত- উদ্গাতা।
সঙ্গীতোপযোগী এই পাঠের সংকলনের নাম ছিল সাম-সংহিতা।
বৈদিকযুগে যজ্ঞানুষ্ঠানে বেদের কিছু মন্ত্র পাঠ করা হতো। আর কিছু অংশ সুরে গাওয়া
হতো। গান হিসেবে ব্যবহৃত এই মন্ত্রগুলোকেই তাকে সাম বলা হয়। আর এ সকল গানের সংকলনই
হলো- সামবেদ সংহিতা। এই সূত্রে বেদের সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল চারটি। সামবেদের তাণ্ড্যা
শাখার অন্তর্গত একটি গ্রন্থের নাম ছান্দ্যোগ্য ব্রাহ্মণ। এই ব্রাহ্মণ্যের শেষ আটটি
অধ্যায়- ছান্দ্যগো উপনিষদ নামে পরিচিত। এই গ্রন্থে ওম ধ্বনির সাঙ্গীতিক তাৎপর্য
পাওয়া যায়। এই গ্রন্থের প্রথম খণ্ডের (উদ্গীথোপাসনা) শুরুতেই বলা হয়েছে- 'ওম' '
উচ্চারণ করিয়া পরে 'উদগীথ' গান করা নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সামগনের বাক্য হলো ঋক্
আর এর প্রাণ হলো সাম। এই দুইয়ের মিলনে পরস্পরের কামনা পূর্ণ হয়। এই কারণে বৈদিক
যুগে- ঋক ও সাম - মিথুন হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। মূলত ওম ধ্বনির মধ্য দিয়ে
সামগানের শুরুতে 'উদগীথ' গানের প্রাণ প্রতিষ্ঠা করা হতো। এই সময় ওম্ ধ্বনি ছিল
পরমব্রহ্ম জ্ঞাপক ধ্বনি। একই সাথে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের আদি ধ্বনি হলো ওম
ধ্বনি বা সঙ্গীতোপযোগী ধ্বনি।
এই গানের বিস্তরিত রূপ পাওয়া যায় ছান্দ্যোগ্য উপনিষদে। সামগানের আনুষ্ঠানিক
পরিবেশনস্থল ছিল যজ্ঞস্থান। এখানে মূলত ভক্তিগীতি পরিবেশিত হতো। এই গানগুলোর নাম
ছিল প্রস্ত্বা, উদগীথ, প্রতিহার, উপদ্রব ও নিধান। সকল পুরোহিতরা একই ভক্তিগীতি
পরিবেশন করতেন না। যাঁরা প্রোস্ত্ব গান করতেন তাঁদেরকে বলা হতো প্রস্তোত্রী। এরূপ
উদ্গাত্রীরা উদ্গান, প্রতিহারীরা প্রতিহার, উদ্গাত্রীরা উপদ্রব এবং অন্যান্য
যাজ্ঞিক ঋষিরা নিধান ভক্তিগান করতেন।
ছান্দোগ্য উপনিষদের প্রথম খণ্ডে ওম্ ধ্বনিকে আদি বা প্রারম্ভিক ধ্বনি হিসেব
বিবেচনা করা হয়েছে। এর বাক হলো ঋক্ আর প্রাণ হলো সাম। এর এই দুইয়ের সমন্বয়ে
সৃষ্টি হয়েছে ওম্। একে বলা হয়েছে হিংকার। এই উপনিষদের প্রথম অধ্যায়ে ওম, ঋক্, সাম
উদ্গীথ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। এই উপনিষদ শুরু হয়েছে আদি ধ্বনি ওম্
নিয়ে। এই উপনিষদের মতে সামগানের সূত্রপাত হয় ওম্ ধ্বনি থেকে। এই উপনিষদের প্রথম
খণ্ডের প্রথম সূক্তে বলা হয়েছে- 'ওম্' অক্ষরকে উদ্গীথ রূপে উপাসনা করিবে। কারণ,
প্রথমে 'ওম্' ধ্বনি উচ্চারণ করিয়া, পরে উদ্গীথ গান করা হয়। আবার পঞ্চম সূক্তে বলা
হয়েছে- বাক্যই ঋক্, সামই 'ওম'। এখানে ওম হলো ক্ষয়হীন আদিধ্বনি, তাই এর নাম অক্ষর।
এই অক্ষরের সাধনায় শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করা যায়। এই অক্ষর দিয়েই যজ্ঞের মন্ত্রপাঠ,
দেবস্তুতি সম্পন্ন হতো।
উদ্গীথ গানের শুরুতে ওম্ ধ্বনিটি ছিল বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।
১. উদ্গীথ গানের শিল্পীরা এই ধ্বনির মধ্য দিয়ে গানের আদ্যধ্বনি গৃহস্বর নির্ধারণ করে নিতেন। এটা ছিল বর্তমান কালের স্কেলের মতো। যার ফলে মূল উদ্গীথ গানের শিল্পীরা একটি বিশেষ ধ্বনিকে আদ্যধ্বনি হিসেবে গ্রহণ করেই একই স্বরস্থান থেকে সমবেত সঙ্গীত শুরু করতে পারেন।।
২. ওম্ ধ্বনির মধ্য দিয়ে- উদ্গীথ গানের শিল্পীরা তাঁদের কণ্ঠকে সুস্থির আনার সুযোগ লাভ করতেন।
৩. ওম্ ধ্বনিকে শিল্পীরা আধ্যত্মিক দর্শনে দেখতেন। ওঙ্কার ধ্বনি সমার্থ ধ্বনি হিসেব এই ধ্বনির মাধ্যমে ঋষিরা পরমব্রহ্মের বন্দনা করতেন। ছন্দোগ্য উপনিষদের নির্দেশও ছিল- 'ওম্' অক্ষরকে উদ্গীথ রূপে উপাসনা করিবে। সব মিলিয়ে ওম ধ্বনি ছিল একসাথে সাঙ্গীতিক এবং আধ্যত্মিক চেতনার বাহক।
৪. যজ্ঞানুষ্ঠানের কোলাহলকে স্তব্ধ করে দিয়ে সাঙ্গীতিক পরিবেশ সৃষ্টির জন্য ওম্ ধ্বনি অপরিহার্য ধ্বনি হিসেবে বিবেচনা করা হতো।
ধারণা করা হয়, মূলধারার বেদ রচিত হয়েছিল খ্রিষ্টপূর্ব
১২০০ থেকে ৬০০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে। বেদের ঋক্ বা শ্লোকগুলোতে সুর দিয়ে পরিবেশনের
বিষয়টি এসেছিল বৈদিকযুগের মাঝামাঝি সময়ে। বৈদিক যুগের গোড়ার দিকে আর্য
পল্লীতে গান বলতে ছিল সাধারণ মানুষের আনন্দ-বেদনার গান।
আর্যাবর্তের বিভিন্ন অংশে এসকল গানের নানারূপ গড়ে উঠছিল। সাধারণভাবে এগানগুলোকে বলা
হয় লৌকিক গান।
গন্ধর্ব জাতির সঙ্গীতগুরুরা লৌকিক গান এবং বৈদিক গানের সমন্বয়ে একটি আদর্শিক
বিধিবদ্ধ গানের সূচনা করেছিলেন। তাঁরা নিয়েছিলেন
লোক শিল্পীদের কাছ থেকে সুরের কাঠামো আর, ঋষি পল্লী থেকে নিয়েছিলেন সুর ও
স্বর-বিষয়ক গবেষণালব্ধ পাঠ। এই দুয়ের সম্মিলনে সৃষ্টি হয়েছিল সুরের চলনের বিধিবদ্ধ
রূপ। তাঁরা দেখেছিলেন কিছু কিছু গানের সুরে একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য পাওয়া যায়। তখন
তাঁরা এই সাধারণ বৈশিষ্ট্যের বিচারে এ সকল সুরশৈলীর পৃথক পৃথক নামে চিহ্নিত
করেছিলেন। কালক্রমে এগুলোই ভিন্ন ভিন্ন রাগ নামে
প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ক্রমবিবর্তনের
ধারায় খ্রিষ্টীয় প্রথম শতাব্দীর
ভিতরে গন্ধর্বার সেকালের সঙ্গীতকে বিধিবদ্ধ কাঠামোর মধ্যে আনার জন্য সৃষ্টি
করেছিলেন গ্রাম। এই পর্যায়ের প্রথমে সৃষ্টি হয়েছিল ষড়্জ গ্রাম। এই বিস্তার ছিল
মূলত মন্দ্র সপ্তকে। এরপর মধ্য ও তার সপ্তকে জন্য সৃষ্টি করেছিলেন মধ্যম ও
গান্ধার গ্রাম।
গ্রাম থেকে উৎপন্ন হয়েছিল
মূর্ছনা।
পরবর্তীয় পর্যায়ে মূর্ছনা থেকে তৈরি হয়েছিল
গ্রামরাগ।
সে সময়ের লৌকিক গানের নানা প্রকরণ প্রচলিত ছিল। দশটি রাগলক্ষণের দ্বারা অন্যান্য
গান থেকে গ্রামরাগ
পৃথক হয়ে গিয়েছিল। রাগের আদি রূপ তথা গ্রামরাগ সৃষ্টি করেছিলেন গন্ধর্বরা।
খ্রিষ্টপূর্ব ৬০০-৫০০ অব্দের ভিতরে রচিত বাল্মীকি রামায়ণে পাওয়া যায় মূর্ছনার কথা।
এই গ্রন্থের আদিকাণ্ডের চতুর্থ সর্গে উল্লেখ আছে, বাল্মীকি
রামের দুই পুত্র কুশী ও লবকে রাম-সীতার চরিত্রসহ রাবণ-বধ নামক কাব্য শেখান। কুশীলব
এই কাব্য পাঠ করা ও গান হিসেবে পরিবেশন করার প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। এ বিষয়ে রামায়ণের
এই অধ্যায়ে বলা হয়েছে-
'এই পাঠ ও গান মধুর, দ্রুত, মধ্য ও বিলম্বিতরূপে ত্রিবিধ-প্রমাণ-সংযুক্ত ষড়্জ ও মধ্যম প্রভৃতি সপ্তস্বর-সংযুক্ত, বীণালয় বিশুদ্ধ এবং শৃঙ্গার, করুণ, হাস্য, রৌদ্র, ভয়ানক ও বীর প্রভৃতি সমুদয়-রসসংযুক্ত। স্থান ও মূর্চ্ছনাভিজ্ঞ, গান্ধর্ব্ববিদ্যাভিজ্ঞ কুশী ও লব তাহা গাহিতে লাগিলেন। সুন্দরকাণ্ডের প্রথম সর্গে ১৭০তম অধ্যায়ে রয়েছে- হনুমান সীতাকে রাবণের নিকট থেকে এনে রামের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য আকাশপথে যাত্রা করেন। এই যাত্রাপথের বর্ণনায় পাওয়া যায় -'গীতনিপুণ গন্ধর্বগণে সমাবৃত..'।
স্থান ও মূর্চ্ছনাভিজ্ঞ,
গান্ধর্ব্ববিদ্যাভিজ্ঞ কুশী ও লবের গান ছিল-
গান্ধর্বসঙ্গীতজ্ঞদের গবেষণালব্ধ গান, যাতে মূর্ছনার ব্যবহার ছিল। এই বিচারে বলা
যায়- এই সময়ে গ্রাম এবং মূর্ছনালবদ্ধ জাতি গানের আদিরূপ তৈরি হয়েছিল। তবে তখনো
বিধিবদ্ধরূপে রাগের উৎপত্তি ঘটেনি। গৌতমবুদ্ধের (জন্ম:
৫৬৭-৫৬৩ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ, মৃত্যু ৪৮৭-৪৮৩ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ) ধর্মীয় দর্শনের উপর
ভিত্তি করে গড়ে উঠা ধর্মীয় মতবাদ, সনাতন ধর্মেকে ভিন্নতর দর্শনের সন্ধান দিয়েছিল।
সেই সূত্রে ভারতীয় সঙ্গীতের ভাবগত বিষয়ের নতুনত্বের সৃষ্টি হয়েছিল। গৌতমবুদ্ধের
পূর্বজীবনের কাহিনিগুলো রচিত হয়েছিল খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীতে। প্রায় ৫০০টি
জাতকের মধ্যে ১৫টি জাতকে গান সম্পর্কে উল্লেখ পাওয়া যায়। এই জাতকগুলো হলো- নৃত্য,
ভেরীবাদক, বিশ্বম্ভর, কুশ, অসদৃশ্য, সর্বদ্রষ্ট, গুপ্তিল, ভদ্রঘট, বীণাস্থূণা,
চুল্লু-প্রলোভন, ক্ষান্তিবাদি, কাকবতী, শঙ্খ, মৎস, বিদুরপণ্ডিত। এসকল জাতকে সঙ্গীতে
বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায় না। গুপ্তিল জাতকে উত্তম ও মধ্যম মূর্ছনার নাম পাওয়া
যায়। এ সকল গ্রন্থে কোনো রাগের নাম পাওয়া যায় না।
মূলত বৌদ্ধ ধর্মের দ্রুত বিকাশে, সনাতন ধর্মাবলম্বীরা কোণঠাসা
হয়ে পড়েছিল। গান্ধর্বরা ছিল মূলত বৈদিক ধর্মে দীক্ষিত। এঁরা সঙ্গীতকে গ্রহণ করেছিল
ধর্মাচরণের অনুষঙ্গ হিসেবে। বৌদ্ধ ধর্ম সঙ্গীত-চর্চা নিষিদ্ধ ছিল না। এঁদের
ধর্মগুরুরা গানের মধ্য দিয়ে ভক্তি প্রকাশের চেয়ে ধ্যন ও জ্ঞানের চর্চার মধ্য দিয়ে
নির্বাণ লাভের চেষ্টায় নিমগ্ন হয়ে পড়েছিল।
বহিরাগতদের আক্রমণে গান্ধর রাজ্যের স্বাভাবিক পরিস্থিতি বার বার বিঘ্নিত হয়েছে।
খ্রিষ্টপূর্ব ৫৫০ থেকে ১০০
অব্দের ভিতরে গান্ধার রাজ্যের জনজীবনের স্বাভাবিক ছন্দ হারিয়ে গিয়েছিল। তবে এই
অস্থির পরিবেশের ভিতরে গান্ধর্ব ঋষিরা তাঁদের ভাষা ও
সঙ্গীতের গবেষণা বজায় রেখেছিলেন। সেকালের সঙ্গীতবিষয়ক ধারণা
পাওয়া যায় কতিপয় 'শিক্ষা' নামক
গ্রন্থাদিতে থেকে। এই ধারার গ্রন্থাদির মধ্যে বিশেষ
স্থান দখল করে আছে- পাণিনীর (খ্রিষ্টপূর্ব ৫০০-৪০০) রচিত
অষ্টাধ্যায় এবং পাণিনীয় শিক্ষা।
পাণিনীয় শিক্ষায় বলা হয়েছে 'স্বরস্ত্রয়' থেকে সাত স্বরের উৎপত্তি ঘটেছিল। বৈদিক শাস্ত্রীয় স্বরের নামের পরিবর্তে লৌকিক নাম ব্যবহার করেছেন। এই গ্রন্থ মতে-
উদাত্তে নিষাদগান্ধারাবানুদাত্তঋষভধৈবতৌ
স্বরিতঃ প্রভবা হোতো ষড়্জমধ্যমপঞ্চমাঃ॥উদাত্ত থেকে - নিষাদ ও গান্ধার, অনুদাত্ত থেকে ঋষভ ও ধৈবত এবং স্বরিত থেকে ষড়্জ, মধ্যম ও পঞ্চমের উৎপত্তি হয়েছে। স্বরের উৎপত্তি স্থান হিসেবে ৮টি অধিষ্ঠানের উল্লেখ করা হয়েছে। এগুলো হলো- উরঃ, কণ্ঠ, শির, জিহ্বামূল, দন্ত, নাসিকা, ওষ্ঠ ও তালু। এছাড়া স্বরে উৎস হিসেবে পশুপাখির কণ্ঠস্বরের উল্লেখ করেছেন।
পাণিনীয় শিক্ষার পরে
যাজ্ঞবল্ক্য শিক্ষা এবং মাণ্ডুকী শিক্ষা গ্রন্থাদিতে
মূলত স্বরের উৎপত্তি, নামকরণ ইত্যাদি নিয়ে আলোচিত হয়েছে। মূলত আদর্শিক সঙ্গীতবিষয়ক
পাঠ পাওয়া যায়, খ্রিষ্টীয় প্রথম শতাব্দীতে রচিত নারদীয় শিক্ষায়।
নারদীয় শিক্ষায় কাশ্যপ নামে একজন সঙ্গীজ্ঞের নাম পাওয়া যায়, যিনি মধ্যমগ্রাম থেকে
কৌশিক রাগ উৎপন্নের কথা বলেছেন। কাশ্যপের কোনো গ্রন্থের কথা জানা যায় না।
খ্রিষ্টীয় প্রথম শতাব্দীতে রচিত
নারদের রচিত 'নারদীয় শিক্ষা'
গ্রন্থের প্রথম প্রপাঠকের
দ্বিতীয় কণ্ডিকার দ্বিতীয় শ্লোকে পাওয়া যায় রাগ শব্দটি। এই শ্লোকে বলা হয়েছে-
তান-রাগ-স্বর-গ্রাম-মুর্চ্ছনানাং তু লক্ষণম্।
পবিত্রং পাবনং পুণ্যং নারদেন প্রকীর্তিতম্ ॥২॥
তান, রাগ, স্বর, গ্রাম এবং মূর্ছনা-এর লক্ষণ বা বৈশিষ্ট্য নারদ কর্তৃক পবিত্র, পাবন এবং পুণ্যদায়ক রূপে ব্যাখ্যাত হয়েছে।
এই শ্লোকটি 'নারদীয় শিক্ষা' গ্রন্থের নিজস্ব গুরুত্ব প্রতিষ্ঠা করছে। বলা হচ্ছে— সঙ্গীতের যে মৌলিক উপাদানগুলি, যেমন—তান (বিস্তার), রাগ (সুর-বিন্যাস), স্বর (সুর), গ্রাম (স্বরস্থান) এবং মূর্ছনা (আরোহণ-অবরোহণ), সেগুলির সঠিক সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট্য নারদ মুনি এখানে বর্ণনা করেছেন। এই জ্ঞানকে কেবল জাগতিক জ্ঞান হিসেবে দেখা হচ্ছে না, বরং পবিত্রতা দানকারী, শুদ্ধকারী এবং ধর্মীয় ফলদায়ক (পুণ্য) হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। এর দ্বারা বোঝানো হচ্ছে যে সঙ্গীতের এই বিদ্যা সাধারণ নয়, এটি আধ্যাত্মিক উন্নতির মাধ্যম।
চতুর্থ কণ্ডিকা'র ৮-১১ শ্লোকে পাওয়া যায় ৭টি গ্রামরাগের কথা। এগুলো হলো- ষড়জগ্রাম, পঞ্চম, কৈশিক, কৈশিকমধ্যম, মধ্যমগ্রাম, সাধারিত ও ষাড়ব। নারদ যে তিনটি গ্রামের (ষড়্জ, মধ্যম ও গান্ধার) উল্লেখ করেছিলেন- সেগুলো ছিল মূলত স্বরবিন্যাসের কাঠামো মাত্র। একালের ঠাটের মতো, যা শুধু স্বরবিন্যাসের কাঠনিক ধারণা মাত্র, সঙ্গীত হিসেবে পরিবেশনযোগ্য নয়। গ্রাম থেকে উৎপন্ন মূর্চ্ছনাও তেমনি। কিন্তু নারদ যে ৭টি গ্রামরাগের নাম উল্লেখ করেছেন- তার সবগুলোর সাথে স্বরের নামের সম্পর্ক নেই। এগুলোর সংক্ষিপ্ত বর্ণানায় সুরবিন্যাসই পাওয়া যায়। যেমন-
"ঈষৎ স্পষ্টো নিষাদস্তু গান্ধারশ্চাধিকো ভবেৎ।
ধবৈতঃ কম্পিতো যত্র ষড়্জগ্রামং তু নির্দিশেৎ॥৮॥"
সরলার্থ: যে স্বরবিন্যাসে নিষাদ স্বর সামান্য সুস্পষ্ট (বা প্রধান), গান্ধার স্বর অপেক্ষাকৃত অধিক (গুরুত্বপূর্ণ), এবং ধৈবত স্বর কম্পিত হয়, সেই স্বরবিন্যাসকে 'ষড়্জ গ্রাম' বলে চিহ্নিত করা উচিত।
ব্যাখ্যা: এই গ্রামরাগে- নিষাদ স্বর সামান্য স্পষ্ট বা কিঞ্চিৎ প্রধান স্বর হিসেবে ব্যবহৃত হতো। এর অর্থ, এটি পুরোপুরি গৌণ না হলেও, গ্রামের মূল ভিত্তি ছিল না। গান্ধার স্বর এখানে অধিক বা গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত হতো। এটি স্বর বিন্যাসে বিশেষ গুরুত্ব লাভ করত। ধবৈত স্বর কম্পিত হতো। 'কম্পিত' বলতে বোঝায় স্বরটিকে সামান্য আন্দোলন বা মীড়ের (কম্পনের মাধ্যমে স্বরের ব্যবহার) সাথে ব্যবহার করা হতো, যা আধুনিক সঙ্গীতের 'আন্দোলিত' বা 'কম্পনযুক্ত' স্বরের ব্যবহারের সঙ্গে তুলনীয়।
অন্তরস্বরসংযুক্তা কাকলির্যত্র দৃশ্যতে।
তন্তু সাধারিতং বিদ্যাৎ পঞ্চমস্থং তু কৌশিকম্ ॥৯॥
সরলার্থ: যেখানে অন্তরের স্বরের সাথে যুক্ত এক বিশেষ মৃদু বা কোমল স্বর (কাকলি) শুনতে পাওয়া যায়, সেই তার (তন্ত্রী) দ্বারা উৎপন্ন ধ্বনিকে সাধারিত স্বরস্থান বলে গণ্য করা উচিত। আর সেই ধ্বনিটি যখন পঞ্চম স্বরস্থানে অবস্থান করে, তখন তাকে কৌশিক বলে জানতে হবে।
কৌশিক সম্পর্কে- ১১ সংখ্যক শ্লোকে বলা হয়েছে-
কাকলির্যত্র দৃশ্যতে প্রাধান্যং পঞ্চমস্য তু।
কাশ্যপঃ কৌশিকং প্রাহ মধ্যমগ্রামসংভবম্ ॥১১॥
যেখানে কাকলি স্বরটি শোনা যায় এবং পঞ্চম স্বরের প্রাধান্য থাকে, মুনি কাশ্যপ সেই কৌশিক রাগটিকে মধ্যমগ্রাম থেকে উৎপন্ন বলে বর্ণনা করেছেন।
- সঙ্গীতশাস্ত্রে কাকলি বলতে একটি সূক্ষ্ম এবং মৃদু স্বর বোঝানো হয়, যা মূল স্বরের চাইতে সামান্য উঁচু বা নিচু হতে পারে। শ্লোকটি বলছে, যখন কোনো ধ্বনি অভ্যন্তরীণ সুরের সাথে মিশে এই সূক্ষ্ম কাকলি স্বর সৃষ্টি করে।
- এই কাকলিযুক্ত ধ্বনিটি যখন তারযুক্ত বাদ্যযন্ত্র (তন্তু) থেকে উৎপন্ন হয়, তখন সেই স্বরস্থানকে 'সাধারিত' নামক একটি বিশেষ স্বর হিসেবে গণ্য করার কথা বলা হচ্ছে। 'সাধারিত' একটি বিকৃত স্বরের নাম।
- শ্লোকের শেষ অংশ পঞ্চমস্থং তু কৌশিকম্ -এর রাগরূপে পরিচয় প্রদান করছে। যখন এই 'সাধারিত' স্বরটি সঙ্গীতের 'পঞ্চম' স্থানে (যেমন: 'সা-রে-গা-মা-পা') অবস্থান করে, তখন একে 'কৌশিক' বলে চিহ্নিত করা হচ্ছে। কৌশিক হলো একটি প্রাচীন রাগের নাম বা রাগের বিশেষ স্বর। এর দ্বারা বোঝানো হচ্ছে যে, এই স্বরের বিশেষ প্রয়োগ বা অবস্থানই কৌশিক রাগের জন্ম দেয়।
- কৌশিক রাগে পঞ্চম স্বরের প্রাধান্য থাকে। এই রাগটি মধ্যমগ্রাম থেকে উৎপন্ন হয়েছে।
কৌশিকং ভাবয়িত্বাতু স্বরৈঃ সর্বৈঃ সমন্ততঃ।
যস্মাৎ মধ্যমে ন্যাসস্তস্মাৎকৌশিকমধ্যমঃ॥১০॥
সরলার্থ: যেহেতু সমস্ত স্বর দ্বারা কৌশিক (রাগ) কে সম্পূর্ণরূপে প্রকাশ করা হয়, এবং যেহেতু মধ্যম স্বরটিতেই এর ন্যাস (স্থায়িত্ব) ঘটে। সেই কারণেই এই রাগটিকে কৌশিকমধ্যম বলা হয়।ব্যাখ্যা:
- শ্লোকের প্রথম অংশ (কৌশিকং ভাবয়িত্বাতু স্বরৈঃ সর্বৈঃ সমন্ততঃ) দ্বারা বোঝানো হচ্ছে যে এই রাগটি সৃষ্টি বা পরিবেশনের সময় সমস্ত স্বর ব্যবহার করে কৌশিক রাগের মূল ভাবটিকে যেন চারদিক থেকে বা পূর্ণভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়। এটি রাগের সম্পূর্ণ স্বর-সমষ্টির ব্যবহারের ইঙ্গিত দেয়।
- সঙ্গীতের পরিভাষায় ন্যাস হলো সেই স্বর, যেখানে রাগের বিশ্রাম হয়। শ্লোকের দ্বিতীয় অংশ (যস্মাৎ মধ্যে ন্যাসঃ) নিশ্চিত করছে যে এই রাগটির বিশ্রামের স্বর হলো মধ্যম।
- যেহেতু এটি কৌশিক রাগের ভাবকে প্রতিষ্ঠা করে এবং এর ন্যাস স্বরটি হলো মধ্যম, তাই এই দুইয়ের সংমিশ্রণে রাগটির নামকরণ করা হয়েছে কৌশিকমধ্যম (তস্মাৎ কৌশিকমধ্যমঃ)।
উল্লেখিত সথত্রে ধারণা করা যায়- নারদের আমলে
রাগের আদি ধারণা সৃষ্টি হয়েছিল। এই সময়ে গ্রামরাগের ধারণাও ষ্পষ্ট হয়ে ওঠে।
খ্রিষ্টীয় দ্বিতীয়
শতাব্দীর ভিতরে গ্রামরাগভিত্তিক জাতি গানের উদ্ভব হয়েছিল। এর প্রভাব ছড়িয়ে
পড়েছিল অন্যান্য দেশী গীতসমূহে। তবে শাস্ত্রীয় বিধিতে এই গ্রামরাগগুলো সবচেয়ে বেশি এবং
গুরুত্বের সাথে ব্যবহৃত হতো- নাটকের
ধ্রুবাগান হিসেবে।
জাতিগানের সুর গ্রামরাগ ভিত্তিক হলেও এই গানগুলো ব্যবহারের সুনির্দিষ্ট রীতি
ছিল। যেমন- এই জাতিগানগুলো নাটকের কোথায় ব্যবহৃত হবে, এর তাল এবং রস কি হবে তা
সুনির্দিষ্ট করা ছিল। ফলে জাতি গানে গ্রামরাগগুলো অনেকটাই বদ্ধ দশায় পতিত
হয়েছিল।
নাট্যশাস্ত্রের অষ্টাবিংশ অধ্যায়ের ৪০ থেকে ৪৩ সংখ্যাক
শ্লোকে ১৮ প্রকার জাতির নাম পাওয়া যায়। এই জাতিগানগুলো ষড়্জ ও মধ্যম গ্রাম অনুসারে
সাজানো হয়েছিল। এর ভিতরে ষড়্জ গ্রামে ছিল ৭টি জাতিগান। এর ভিতরে ৪টি ছিল শুদ্ধজাতি
এবং ৩টি ছিল বিকৃত জাতি। পক্ষান্তরে মধ্যম জাতির গান ছিল ১১টি। এর ভিতরে
৩টি ছিল
শুদ্ধজাতির এবং ৮টি ছিল বিকৃত জাতির।
নিচে এই জাতিগানগুলোর শ্রেণিকরণ দেখানো হলো।
জাতিগানের সুরের কাঠামো ছিল গ্রামরাগ। এই গ্রন্থে গ্রামরাগের দশটি লক্ষণ আর জাতিগানের লক্ষণ একই ছিল। এই কারণে অনেক সময় জাতিগানকে জাতিরাগ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। নাট্যশাস্ত্রের অষ্টাবিংশ অধ্যায়ের ৭৬ -৭৭ সংখ্যক শ্লোকে সরাসরি 'রাগ' শব্দটি দিয়ে রাগের বৈশিষ্ট্য সন্পর্কে বলা হয়েছে-
জাতিগানের দশটি লক্ষণ'গানের সেই স্বর দশলক্ষণযুক্ত অংশ, যার উপরে রাগ নির্ভর করে; পঞ্চস্বরের উপরে নির্ভর্শীল মন্দ্র ও তারের পরিবর্তনের এটি মূল। অনেক স্বরের মিলনে এটি স্পষ্টতমরূপে অনুভূত হয়; অন্যান্য স্বর প্রবল স্বর এবং সঙ্গে সংবাদী বা অনুবাদী রূপে সম্বন্ধ হয় এবং এটি গ্রহ, অপন্যাস, বিন্যাস, সংন্যাস ও ন্যাস (স্বরের) সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত থাকে।'
১. গ্রহ: যে স্বর থেকে গান শুরু হয়। একে বলা হয়েছে অংশের বিকল্প। দুই গ্রামে গ্রহস্বরের সংখ্যা ছিল ৬৩টি। [২৮।৭৫]
দুই গ্রামে অংশস্বরের সংখ্যা ৬৩টি। [২৮।৭৯]
২. অংশ: এই স্বরের উপর রাগ নির্ভর করে। গ্রহ, অপন্যাস, বিন্যাস, সংন্যাস ও ন্যাস -এর সাথে সম্বন্ধযুক্ত থাকে। এটি গানের সর্বত্র ছড়ানো থাকে। দুই গ্রামে অংশস্বরের সংখ্যা ৬৩টি। [২৮।৭৬-৭৯]
নাট্যশাস্ত্রের অষ্টাবিংশ অধ্যায়ের ৮০-৯৪ শ্লোকে জাতিতে ব্যবহৃত গ্রহ ও অংশ স্বরের কথা বলা হয়েছে। যেমন-
- পঞ্চম: গান্ধারপঞ্চমী জাতি
- পঞ্চম: নন্দয়ন্তী জাতি
- পঞ্চম মধ্যমোদীচ্যবা জাতি
- ধৈবত ও ঋষভ: ধৈবতী জাতি
- ঋষভ ও পঞ্চম: পঞ্চমী জাতি
- ষড়্জ ও মধ্যম: গান্ধারোদীচ্যবা জাতি
- ঋষভ, ধৈবত ও নিষাদ: আর্যভী জাতি
- ঋষভ, গান্ধার ও নিষাদ: নৈষাদী জাতি
- ষড়্জ, গান্ধার ও পঞ্চম: ষড়্জকৈশিকী জাতি
- ষড়্জ, মধ্যম. ধৈবত ও নিষাদ: ষড়্জোদীচ্যবতী জাতি
- ঋষভ, পঞ্চম, ধৈবত ও নিষাদ: কর্মারবী
- ঋষভ, গান্ধার, পঞ্চম ও নিষাদ: আন্ধ্রী
- ষড়্জ, ঋষভ, মধ্যম, পঞ্চম ও ধৈবত: মধ্যমা জাতি
- ষড়্জ, গান্ধার, মধ্যম, পঞ্চম ও ধৈবত: ষাড়্জী জাতি
- ষড়্জ, গান্ধার, মধ্যম, পঞ্চম ও নিষাদ: গান্ধারী জাতি
- ষড়্জ, গান্ধার, মধ্যম, পঞ্চম ও নিষাদ: রক্তগান্ধারী জাতি
- ষড়্জ, গান্ধার, মধ্যম, পঞ্চম, ধৈবত ও নিষাদ: কৈশিকী জাতি
- ষড়্জ, ঋষভ গান্ধার, মধ্যম, পঞ্চম, ধৈবত ও নিষাদ: ষড়্জমধ্যমা জাতি
৩. তার: এটি মূলত রাগের গতি। এর প্রয়োগ হয় রাগের প্রথম পাঁচ স্বরের উপর। মূলত অংশ স্বর থেকে চতুর্থ স্বর পর্যন্ত অথবা পঞ্চম স্বর পর্যন্ত তারগতি হবে। অংশ স্বর পঞ্চম বা সপ্তম পর্যন্ত হতে পারে। [২৮।৯৪]
৪. মন্দ্র: মন্দ্র গতি তিন প্রকার।১. নিম্নগ্রামের অংশের উপর নির্ভরশীল।
২. ন্যাসের উপর নির্ভরশীল
৩. অপন্যাসের উপর নির্ভরশীল। [২৮।৯৪-৯৫]৫. ন্যাস: এই অংশে রাগের আলাপ বা বিকাশ ঘটে। এবং রাগের অংশবিশেষের বা সম্পূর্ণ অংশের পূর্ণতা লাভের পর যে স্বরে সমাপ্তি ঘটে। এর সংখ্যা ২১ প্রকার। [২৮।৯৪-৯৫] [২৮।১০০]
৬. অপন্যাস: গানের মধ্যবর্তী সমাপ্তি হয় যে স্বরে। এর সংখ্যা ৫৬টি [২৮।৯৪-৯৫] [২৮।১০০]
নাট্যশাস্ত্রের অষ্টাবিংশ অধ্যায়ের ১০১- শ্লোকে জাতিতে ন্যাস ও অপন্যাসের বিষয় বলা হয়েছে। যেমন-৭. অল্পত্ব: যে স্বর রাগে অল্প ব্যবহৃত হয়। জাতিরাগে অল্পত্ব ছিল দুই ধরনের। এই ধরণ দুটি হলো- অনভ্যাস ও লঙ্ঘন। যে স্বরের প্রায় ব্যবহৃত হয় না বা যে স্বর বর্জন করা হয়। তাকে বলে অনভ্যাস। পক্ষান্তরে যে স্বর সামান্য ব্যবহার করা হয়, তাকে বলা হয় লঙ্ঘন। [২৮।৯৬-৯৭]
৮.বহুত্ব: যে স্বর অধিক ব্যবহার করা হয়।
৯. ষাড়বত্ব: যে রাগে ৬টি স্বর ব্যবহৃত হয়। এর সংখ্যা ১৪ প্রকার। এর বিভাগ ৪৭টি। [২৮।৯৮]
১০ ঔড়বত্ব: যে রাগে ৫টি স্বর ব্যবহৃত হয়। উল্লিখিত লক্ষণের বিচারে জাতি রাগ হতে গেলে কমপক্ষে ৫টি স্বর থাকতেই হতো। অর্থাৎ আর্চিক, গাথিক, সামিক এবং স্বরান্তরের সুরবিন্যাসকে জাতি রাগ হিসেবে গ্রহণ করা হতো না। [২৮।৯৯]
ভরতের সময় ১৮টি গ্রামরাগের ব্যবহার ছিল ধ্রুবাগানে। এর বাইরে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে বিকশিত রাগগুলোর নাম ভরত উল্লেখ করেন নি। ভরতের সময়ে কণ্ঠসঙ্গীতের সাধারণ নাম ছিল গীত। তিনি গীতকে ৪টি ভাগে ভাগ করেছিলেন। এই ভাগগুলো হলো- মাগধী, অর্ধ-মাগধী, সম্ভাবিতা ও পৃথুলা। ভরতের এই ভাগটি ছিল মূলত সুরের প্রায়োগিক দিক। যেমন-
এর দ্বারা গীতে রাগ প্রয়োগের বিধিকে নির্দেশিত করা হয়েছে বটে, কিন্তু রাগের শ্রেণিকরণে কোনো বিশেষ ভূমিকা রাখে নি।
ভরত-উত্তর সঙ্গীতভাবনায় গুরুত্ব পেতে শুরু করেছিল- ধ্রুবাগানের বাইরের রাগগুলো।
ভরতের পুত্র এবং শিষ্যরা এই রাগগুলোর গুরুত্ব
অনুধাবন করে, রাগের অন্তর্ভুক্ত করতে চেয়েছিলেন।
খ্রিষ্টীয় তৃতীয় শতাব্দীতে ভরতের শতপুত্র এবং শিষ্যদের মাধ্যমে গীতের নতুন শ্রেণিগত বিভাজনের একটি রূপরেখা
স্পষ্ট হয়েছিল। খ্রিষ্টীয় দ্বিতীয়-তৃতীয় শতাব্দীতে
ভরতের পুত্র শার্দুল
বলেছিলেন- গীত এক প্রকার, তা হলো- ভাষাগীতি। [বৃহদ্দেশী। রাগ। পৃষ্ঠা: ১৩৪]
শার্দুল
গ্রামরাগ-ভিত্তিক জাতিগানকে মেনে নিয়ে- শাস্ত্রীয় গান হিসেবে ভাষাগানকে গীত হিসেবে
স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। সম্ভবত শার্দুলের অন্যান্য গীতের মধ্যে ভাষাগীতকে মুখ্য হিসেবে
স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। এবং সম্ভবত তাঁর সময়ে ভাষাগীতের পাশাপাশি অন্যান্য গীতের যথার্থ
বিকাশ ঘটেনি। তারপরেও তিনি বিভাষা গীতির অন্তর্গত কয়েকটি রাগের উল্লেখ করেছিলেন।
খ্রিষ্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীতে মতঙ্গের রচিত বৃহদ্দেশী গ্রন্থে- শর্দুলের উদ্ধৃতিতে
খ্রিষ্টীয় চতুর্থ শতাব্দীতে দুর্গাশক্তি, পাঁচ প্রকার গীতের কথা উল্লেখ করেছিলেন।
এগুলো হলো- শুদ্ধা, ভিন্না, বেসরা, গৌড়ী এবং সাধারিতা। লক্ষণীয় বিষয় এই তালিকায়
ভাষাগীতের উল্লেখ্য নেই। কিন্তু তার সমসাময়িক সঙ্গীতজ্ঞ যাষ্টিক গীতের তিনটি
প্রকরণের গীতের কথা বলেছিলেন। এগুলো হলো- ভাষা, বিভাষা ও অন্তরভাষা। [বৃহদ্দেশী। রাগ।
পৃষ্ঠা: ১৩৩-১৩৪]
বৃহদ্দেশীর রাগ পরিচয়
খ্রিষ্টীয় ষষ্ঠশতাব্দী পর্যন্ত রাগ-ভিত্তিক সঙ্গীতের ধারায় গ্রামরাগের আদিরূপের সাথে
যুক্ত হয়েছিল আরও বহু দেশী রাগ। এর ভিতরে
শার্দুলের উল্লেখিত রাগগুলোও ছিল। এই সময়ের ভিতরে গ্রামরাগের পরিবর্তে শুধু রাগ
শব্দটিই প্রাধান্য পেতে শুরু করেছিলে। এই সময়ে মতঙ্গ তাঁর রচিত বৃহদ্দেশী গ্রন্থে-
সেকালের প্রচলিত রাগের কাঠামোগত পরিচয়ের পাশাপাশি রাগের শ্রেণিকরণের উদ্যোগ
নিয়েছিলেন। তাঁর মতে গীত ছিল ৭ প্রকার। এগুলো হলো-
চোক্ষ,
ভিন্নকা,
গৌড়িকা,
রাগগীতি, সাধারণী, ভাষা
ও বিভাষা।
মোট কথা
ভরত থেকে মতঙ্গের আমল পর্যন্ত গীতের প্রকরণ করা হয়েছিল, গ্রামরাগ এবং অন্যান্য দেশী
রাগের ভিত্তিতে। তাই গীতের শ্রেণিকরণের সূচনা হয়েছিল গ্রামভিত্তিক। তখন এর সাধারণ
নাম ছিল গ্রামরাগ। ভরতের আমলে জাতিগানের আড়ালে গ্রামরাগ চাপা পড়ে গিয়েছিল। কিন্তু
জাতিগানের শ্রেণিকরণ করা হয়েছিল গ্রামরাগের ভিত্তিতে। পরবর্তী সময়ে রাগের শ্রেণিকরণে বিশেষ স্থান দখল করে নিয়েছিল গীত। গীত ও রাগের মধ্যে
পার্থক্য নির্ণয়ের একটি সূত্র পাওয়া যায় বৃহদ্দেশীতে। বৃহদ্দেশীতে উল্লিখিত সূত্রটি
হলো- 'গীতে স্বরাদির বিন্যাসে যে দশলক্ষণ লক্ষিত হয়, সেটিই রাগ। তাদের কোথাও অংশ,
গ্রহ, অপন্যাস, ন্যাস ও স্বরাদির আরোপ হয়; এইগুলি মন্দ্রত্ব এবং তারত্ব,- এই দুটির
পরিপ্রেক্ষিতে যোজিত হয় এবং কোথাও অল্পত্ব, কোথাও বহুত্ব পরিলক্ষিত হয়। এতদ্ব্যতীত
আক্ষেপ, নিষ্কাম, প্রসাদিক এবং অন্তরা,- এই পাঁচপ্রকার ধ্রুবাগানেও (নাট্যসঙ্গীতে)
গ্রামসমূহ সংযোজিত হয়।[পৃষ্ঠা: ১৮৭-১৮৮]
মতঙ্গ
তাঁর সময়ের প্রচলিত রাগগুলোর প্রকৃতি অনুসারে
গ্রামরাগ এবং অন্যান্য দেশী রাগগুলোকে শ্রেণিকরণে 'গীত' শব্দটিকে
শব্দ-ঊর্ধ্বক্রমবাচকতার সোপানে বিন্যস্ত করেছিলেন। এই শ্রেণি বিভাজনের উচ্চধাপে ছিল
গ্রাম। এরপর নিম্নক্রমিক ধারাটি ছিল- গ্রামরাগ> জাতিরাগ।
এই ধারায় গ্রামরাগ, গ্রামরাগজাত রাগ ও দেশী রাগের একটি সাধারণ পরিচয় হিসেবে পরিচয়
লাভ করেছিল। বৃহদ্দেশীতে গীতের বিভাজন করা হয়েছিল গ্রামরাগ এবং দেশী রাগের ভিত্তিতে।
এই সূত্রে গীতের বাইরে এসে অতিরিক্ত আরো কয়েকটি রাগপ্রকৃতিকে রাগবর্গীকরণের
অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। এগুলো ছিল- ভাষারাগ, বিভাষারাগ, অন্তরভাষারাগ, উপরাগ। প্রতিটি ভাগে কতগুলো রাগ
ছিল, তার সংখ্যা নির্দেশ করা হয়েছে।
সঙ্গীতরত্নকরের রাগবিবেকাধ্যায়ের ২-৩ শ্লোকে বলা হয়েছে- পাঁচটি গীতির আশ্রয়হেতু
গ্রামরাগ পাঁচ প্রকার। যথা- শুদ্ধা, ভিন্না, গৌড়ী, বেসরা ও সাধারণী।
বৃহদ্দেশীতে বর্ণিত গীতিপ্রকরণের তালিকা
বৃহদ্দেশীতে বলা হয়েছে ভাষা ভেদের গানের বিচারে- ভাষা হলো প্রকরণ। মূলত রাগ হিসেবে ভাষা হলো গ্রাম রাগের প্রকারভেদ। এই শ্রেণির রাগগুলোকে চারটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এগুলো হলো- মূল, সঙ্কীর্ণ, দেশজ ও ছায়ামাত্রাশ্রবা। খ্রিষ্টীয় ত্রয়োদশ শতাব্দীতে শার্ঙ্গদেবের রচিত সঙ্গীতরত্নাকরে একে ভিন্ন নামে উপস্থাপিত হয়েছে।
সঙ্গীতরত্নাকরে বর্ণিত বিভাষা রাগের তালিকা
রাগের শ্রেণিকরণের ধারায় আরও কিছু রাগের পরিচয় পাওয়া যায়। এগুলো হলো- অন্তরভাষা রাগ ও উপরাগ।
বৃহদ্দেশীতে উল্লেখিত রাগের বর্ণানুক্রমিক তালিকা
অম্বাহেরী,
আদ্যবেসরিকা,
আন্ধ্রী,
আভীরী,
আর্যভী,
কুকুভ,
কর্মারবী,
কৈশিকী,
কোলাহলী,
খঞ্জরী,গান্ধারপঞ্চমী,
গান্ধারী,
গুর্জরী,
মূলত খ্রিষ্টীয় ত্রয়োদশ শতাব্দীর ভিতরে আরও বহুবিধ রাগের
উৎপত্তি হয়েছিল। খ্রিষ্টীয় ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষ ভাগে সুলতান
আলাউদ্দীন খিলজির সভাকবি-
আমির খসরু,
দেশী রাগের চর্চার পাশাপাশি আরব-পারশ্যের রাগের
সংমিশ্রণে নতুন কিছু রাগ তৈরি করেছিলেন।
খ্রিষ্টীয় সপ্তদশ শতাব্দীর ভিতরে ভারতীয় রাগসঙ্গীতের ধারায় বহু প্রচীন রাগ বিলুপ্ত
হয়ে গিয়েছিল। আবার দেশীর সুরাবলম্বনে নতুন নতুন রাগের উদ্ভব হয়েছিল।
খ্রিষ্টীয় সপ্তদশ শতাব্দীর শেষার্ধে থেকে অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে লোচন শর্মার
রচিত 'রাগতরঙ্গিনী' গ্রন্থে এরূপ রাগের নাম পাওয়া যায়। এই গ্রন্থে ৬টি রাগকে আদি
রাগ হিসেবে চিহিত করা হয়েছিল। এগুলো হলো-
ভৈরব,
কৌশিক,
হিন্দোল,
দীপক ও শ্রী।
তিনি পারশ্যের রাগকে ভারতীয় শাস্ত্রীয় কাঠামোতে তৈরি করেছিলেন
ইমন রাগ। পরে এই রাগের সাথে অন্যান্য রাগের মিশ্রণ ঘটিয়ে তৈরি করেছিলেন
ইমন-পুরিয়া, ইমন-ভূপালী, ইমন-বিলাবল, ইমন
বেহাগ, ইমন কল্যাণ।
ফকিরুল্লা'র রাগ দর্পণ গ্রন্থ থেকে ১২টি এরূপ ১২টি রাগের তালিকা পাওয়া যায়। এর
বাইরে পাওয়া যায়-