রাগের ক্রমবিবর্তনের ইতিহাস
[মূল প্রবন্ধ: রাগ]

ভারতীয় আর্য ভাষাগোষ্ঠীর সঙ্গীতজ্ঞদের মাধ্যমে ভারতীয় রাগ সঙ্গীতের বিকাশ ঘটেছিল। কিন্তু এর যাত্রা শুরু হয়েছিল দূর অতীত থেকে। ধারণা করা হয়, একদল মানুষ ১ লক্ষ ২৫ হাজার বৎসর আগে আফ্রিকা থেকে বের হয়ে ইউরোপ, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও এশিয়ায় ছড়িয়ে পড়া শুরু করে। ৭৫ হাজার বৎসর আগে এদের একটি দল আরব উপদ্বীপে পৌঁছায়। আর ৬০ হাজার বৎসরের ভিতরে এরা এশিয়া সংলগ্ন ইউরোপে বসতি স্থাপন করে। পরবর্তী ৪০ হাজার বৎসরে ভিতরে ইউরোপের রাইন নদী থেকে তুরস্ক পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিল। খ্রিষ্টপূর্ব ৩৫ হাজার বৎসরের দিকে এদের একটি শাখা দানিয়ুব নদীর তীরবর্তী বিশাল তৃণাঞ্চলে বসবাস করা শুরু করে। সে সময়ে বসবাস এদের মূল পেশা ছিল পশুপালন। জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং আন্তঃগোষ্ঠীর দ্বন্দ্বের সূত্রে এদের একটি দল এই অঞ্চল ত্যাগ করে দার্দেনেলিশ প্রণালী হয়ে এশিয়া মাইনরে প্রবেশ করে। খ্রিষ্টপূর্ব ২৫ হাজার বৎসরের দিকে এরা ইউফ্রেটিস-টাইগ্রিস নদী পার হয়ে মধ্য এশিয়ার বিস্তৃর্ণ অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। পরে এদের একটি দল চলে যায় ইউরোপের দিকে, অপর দলটি চলে আসে ইরানের দিকে। আর খ্রিষ্টপূর্ব ১৮০০ অব্দের দিকে ইরানের পশ্চিমাঞ্চলের অধিবাসীরা ভারতে প্রবেশ করা। ইরানে যারা থেকে গিয়েছিল তাদেরকে বলা হয় ইন্দো-ইরানীয়। ভারতে প্রবেশ করা জাতি গোষ্ঠীকে বলা হয় ভারতীয় আর্য ভাষাভাষী বা ভারতীয় আর্য

বহিরাগত এই নৃগোষ্ঠীর ছিল নিজের ভাষা ও সঙ্গীত। খ্রিষ্টপূর্ব ১৮০০ থেকে ১৫০০ অব্দের ভিতরে এদের ভাষার পরিবর্তন ঘটেছিল। তাদের এই নব্যভাষায় রচিত হয়েছিল বেদ। নবতর এই বেদের ভাষাকে ভাষাবিজ্ঞানীরা বলে থাকে বৈদিক ভাষা। ভাষাগত পরিবর্তনের পাশাপাশা এদের ধর্ম-দর্শনে এবং সঙ্গীতের পরিবর্তন এসেছিল।

খ্রিষ্টপূর্ব ১২০০-৬০০ অব্দ
এই সময়ের ভিতরে রচিত হয়েছিল বৈদিক সামগান তথা বৈদিক গান। এর পাশাপাশি ছিল আর্যপল্লীর লৌকিক গান। এই সময় বৈদিক গানের সূত্রে আধ্যাত্মিক ওম ধ্বনি সঙ্গীতের ওম ধ্বনিতে পরিণত হয়। এই ধ্বনি থেকে উৎপন্ন হয়েছিল বৈদিক গানের তিনটি ধ্বনি- উদাত্ত, অনুদাত্ত স্বরিত নামক সঙ্গীতোপযোগী ধ্বনি। আদ্য এই তিনটি ধ্বনি থেকে ৭টি ুদ্ধ স্বর। এই সকল বৈদিক স্বরগুলোর নাম পরিবর্তন করে গন্ধর্ব সঙ্গীতজ্ঞরা লৌকিক গানের স্বর গ্রহণ করেছিল।

খ্রিষ্টপূর্ব ১২০০-৬০০ অব্দের ভিতরে ভারতীয়  আর্যরা রচনা করেছিলেন- ঋগ্বেদ, যজুর্বেদ ও অথর্ববেদ। বৈদিকযুগে যজ্ঞানুষ্ঠানে বেদের কিছু মন্ত্র পাঠ করা হতো। আর কিছু অংশ সুরে গাওয়া হতো। গান হিসেবে ব্যবহৃত এই মন্ত্রগুলোকেই তাকে সাম বলা হয়। আর এ সকল  গানের সংকলনই হলো- সামবেদ সংহিতা। এই সূত্রে বেদের সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল চারটি।

বৈদিক যুগের রাজা-মহারাজার পূণ্যসঞ্চয়, সুনাম অজর্ন বা বড় ধরণের বিপদ থেকে মুক্তি পাওয়ার আশায় পুরোহিতদের শরণাপন্ন হতেন। পুরোহিতরা বিষয়ের গুরুত্ব অনুসারে রাজাদেরকে যজ্ঞের পরামর্শ দিতেন। যজ্ঞানুষ্ঠান যাঁর জন্য করা হতো, তাঁদের বলা হত যজমান। আর যে সকল ঋষিরা এই যথাবিহিত নিয়ম অনুসরণ করে যজ্ঞানুষ্ঠান সম্পন্ন করতেন, তাঁদেরকে বলা হতো ঋত্বিক। যজ্ঞানুষ্ঠান হতো সাড়ম্বরে, তাতে থাকতো বিপুল আয়োজন। ফলে এককভাবে কোনো ঋষির পক্ষে যজ্ঞানুষ্ঠান পরিচালনা সম্ভব ছিল না। তাই অন্যান্য ঋত্বিকরা একজন প্রধান ঋত্বিকের অধীনে অন্যান্য ঋত্বিকদের কর্মক্ষমতা বা পারদর্শিতার বিচারে যজ্ঞের বিভিন্ন অংশ পরিচালনা করতেন। এই অনুষ্ঠানের প্রশস্তি পাঠকারীর ঋত্বিকদের বলা হতো - হোতা। এই যজ্ঞানুষ্ঠানে কিছু ঋষি গান পরিবেশন করতেন। এঁদের বলা হত- উদ্গাতা। সঙ্গীতোপযোগী এই পাঠের সংকলনের নাম ছিল সাম-সংহিতা।

বৈদিকযুগে যজ্ঞানুষ্ঠানে বেদের কিছু মন্ত্র পাঠ করা হতো। আর কিছু অংশ সুরে গাওয়া হতো। গান হিসেবে ব্যবহৃত এই মন্ত্রগুলোকেই তাকে সাম বলা হয়। আর এ সকল  গানের সংকলনই হলো- সামবেদ সংহিতা। এই সূত্রে বেদের সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল চারটি। সামবেদের তাণ্ড্যা শাখার অন্তর্গত একটি গ্রন্থের নাম ছান্দ্যোগ্য ব্রাহ্মণ। এই ব্রাহ্মণ্যের  শেষ আটটি অধ্যায়- ছান্দ্যগো উপনিষদ নামে পরিচিত। এই গ্রন্থে ওম ধ্বনির সাঙ্গীতিক তাৎপর্য পাওয়া যায়। এই গ্রন্থের প্রথম খণ্ডের (উদ্গীথোপাসনা) শুরুতেই বলা হয়েছে- 'ওম'  ' উচ্চারণ করিয়া পরে 'উদ‌গীথ' গান করা নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সামাগনের বাক্য হলো ঋক্ আর এর প্রাণ হলো সাম। এই দুইয়ের মিলনে পরস্পরের কামনা পূর্ণ হয়। এই কারণে বৈদিক যুগে- ঋক ও সাম - মিথুন হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। মূলত ওম ধ্বনির মধ্য দিয়ে সামগানের শুরুতে  'উদ‌গীথ' গানের প্রাণ প্রতিষ্ঠা করা  হতো। এই সময় ওম্ ধ্বনি ছিল পরমব্রহ্ম জ্ঞাপক ধ্বনি। একই সাথে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের আদি ধ্বনি হলো ওম ধ্বনি বা সঙ্গীতোপযোগী ধ্বনি।

এই গানের বিস্তরিত রূপ পাওয়া যায় ছান্দ্যোগ্য উপনিষদে। সামগানের আনুষ্ঠানিক পরিবেশনস্থল ছিল যজ্ঞস্থান। এখানে মূলত ভক্তিগীতি পরিবেশিত হতো। এই গানগুলোর নাম ছিল প্রস্ত্বা, উদগীথ, প্রতিহার, উপদ্রব ও নিধান। সকল পুরোহিতরা একই ভক্তিগীতি পরিবেশন করতেন না। যাঁরা প্রোস্ত্ব গান করতেন তাঁদেরকে বলা হতো প্রস্তোত্রী। এরূপ উদ্‌গাত্রীরা উদ্‌গান, প্রতিহারীরা প্রতিহার, উদ্‌গাত্রীরা উপদ্রব এবং অন্যান্য যাজ্ঞিক ঋষিরা নিধান ভক্তিগান করতেন।

ছান্দোগ্য উপনিষদের প্রথম খণ্ডে ওম্ ধ্বনিকে আদি বা প্রারম্ভিক ধ্বনি হিসেব বিবেচনা করা হয়েছে। এর বাক হলো ঋক্ আর প্রাণ হলো সাম। এর এই দুইয়ের সমন্বয়ে সৃষ্টি হয়েছে ওম্। একে বলা হয়েছে হিংকার। এই উপনিষদের প্রথম অধ্যায়ে ওম, ঋক্, সাম উদ্‌গীথ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। এই উপনিষদ শুরু হয়েছে আদি ধ্বনি ওম্ নিয়ে। এই উপনিষদের মতে সামগানের সূত্রপাত হয় ওম্ ধ্বনি থেকে। এই উপনিষদের প্রথম খণ্ডের প্রথম সূক্তে বলা হয়েছে-  'ওম্' অক্ষরকে উদ্‌গীথ রূপে উপাসনা করিবে। কারণ, প্রথমে 'ওম্' ধ্বনি উচ্চারণ করিয়া, পরে উদ্‌গীথ গান করা হয়। আবার পঞ্চম সূক্তে বলা হয়েছে- বাক্যই ঋক্, সামই 'ওম'। এখানে ওম হলো ক্ষয়হীন আদিধ্বনি, তাই এর নাম অক্ষর। এই অক্ষরের সাধনায় শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করা যায়। এই অক্ষর দিয়েই যজ্ঞের মন্ত্রপাঠ, দেবস্তুতি সম্পন্ন হতো।

উদ্‌গীথ গানের শুরুতে ওম্ ধ্বনিটি ছিল বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।
১. উদ্‌গীথ গানের শিল্পীরা এই ধ্বনির মধ্য দিয়ে গানের আদ্যধ্বনি গৃহস্বর নির্ধারণ করে নিতেন। এটা ছিল বর্তমান কালের স্কেলের মতো। যার ফলে মূল উদ্‌গীথ গানের শিল্পীরা একটি বিশেষ ধ্বনিকে আদ্যধ্বনি হিসেবে গ্রহণ করেই একই স্বরস্থান থেকে সমবেত সঙ্গীত শুরু করতে পারেন।।
২. ওম্ ধ্বনির মধ্য দিয়ে- উদ্‌গীথ গানের শিল্পীরা তাঁদের কণ্ঠকে সুস্থির আনার সুযোগ লাভ করতেন।
৩. ওম্ ধ্বনিকে শিল্পীরা আধ্যত্মিক দর্শনে দেখতেন। ওঙ্কার ধ্বনি সমার্থ ধ্বনি হিসেব এই ধ্বনির মাধ্যমে ঋষিরা পরমব্রহ্মের বন্দনা করতেন। ছন্দোগ্য উপনিষদের নির্দেশও ছিল-  'ওম্' অক্ষরকে উদ্‌গীথ রূপে উপাসনা করিবে। সব মিলিয়ে ওম ধ্বনি ছিল একসাথে সাঙ্গীতিক এবং আধ্যত্মিক চেতনার বাহক।
৪. যজ্ঞানুষ্ঠানের কোলাহলকে স্তব্ধ করে দিয়ে সাঙ্গীতিক পরিবেশ সৃষ্টির জন্য ওম্ ধ্বনি অপরিহার্য ধ্বনি হিসেবে বিবেচনা করা হতো।

ধারণা করা হয়, মূলধারার বেদ রচিত হয়েছিল খ্রিষ্টপূর্ব ১২০০ থেকে ৬০০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে। বেদের ঋক্ বা শ্লোকগুলোতে সুর দিয়ে পরিবেশনের বিষয়টি এসেছিল বৈদিকযুগের মাঝামাঝি সময়ে। বৈদিক যুগের গোড়ার দিকে আর্য পল্লীতে গান বলতে ছিল সাধারণ মানুষের আনন্দ-বেদনার গান। আর্যাবর্তের বিভিন্ন অংশে এসকল গানের নানারূপ গড়ে উঠছিল। সাধারণভাবে এগানগুলোকে বলা হয় লৌকিক গান।

গন্ধর্ব জাতির সঙ্গীতগুরুরা লৌকিক গান এবং বৈদিক গানের সমন্বয়ে একটি আদর্শিক বিধিবদ্ধ গানের সূচনা করেছিলেন। তাঁরা নিয়েছিলেন লোক শিল্পীদের কাছ থেকে সুরের কাঠামো আর, ঋষি পল্লী থেকে নিয়েছিলেন সুর ও স্বর-বিষয়ক গবেষণালব্ধ পাঠ। এই দুয়ের সম্মিলনে সৃষ্টি হয়েছিল সুরের চলনের বিধিবদ্ধ রূপ। তাঁরা দেখেছিলেন কিছু কিছু গানের সুরে একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য পাওয়া যায়। তখন তাঁরা এই সাধারণ বৈশিষ্ট্যের বিচারে এ সকল সুরশৈলীর পৃথক পৃথক নামে চিহ্নিত করেছিলেন। কালক্রমে এগুলোই ভিন্ন ভিন্ন রাগ নামে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।

বৈদিক গান
আদিতে ঋষিরা ধর্মীয় উপলব্ধিতে থেকে নানা ধরনের শ্লোক তৈরি করেছিল।  বৈদিক যজ্ঞানুষ্ঠানে এ সকল শ্লোকের পাঠ করা হতো। এ শ্লোক ধর্মীয় বিশ্বাসে এঁরা মুখস্ত রাখতো। ঋষিদের সৃষ্ট এ সকল নিষ্ঠার সাথে শুনে শুনে মনে রাখতো। এই প্রক্রিয়া সৃষ্ট বাণীকে সাধারণভাবে বলা হতো শ্রুতি।  এই শ্রুতিসমূহের কিছু অংশ সুরে গাওয়া হতো। গান হিসেবে ব্যবহৃত এই শ্লোকগুলোকেই পরে সামবেদ নামে সংকলিত হয়েছিলএই বিচারে সামবেদ পৃথক কোনো বেদ নয়। এটি অন্যান্য বেদের সুরসম্বলিত অংশের সংকলন মাত্র।

সাম শব্দটি বৈদিক ভাষায় সেমেটিক বা ইন্দো-ইউরোপিয়ান শব্দ থেকে কৃতঋণ শব্দ হিসেবে গৃহীত হয়েছিল। অবশ্য নিরুক্তিকার যাস্কের মতে- ঋকের দ্বারা যার পরিমাপ করা হয়েছে, তাই সাম। বঙ্গীয় শব্দকোষে সাম শব্দের রূপতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ ও অর্থগত ব্যাখ্যায় উল্লেখ করা হয়েছে- 

সো (অবসান করা)+ মন্ (মনিন্), কর্তৃবাচ্য
...যজ্ঞসম্পাদনার্থ যে সকল ঋক গীত হয়'।

উল্লেখিত শব্দের বিশ্লেষণে 'সাম' শব্দের উৎকৃষ্ট ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না। মূলত ভক্তিমূলক গান হিসেবে সেমেটিক ভাষায় এই জাতীয় গানের অস্তিত্ব ছিল। দাউদের রচিত এরূপ বহুগান হিব্রু বাইবেলে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। সংকলিত এই গ্রন্থের হিব্রু নাম ছিল সেফের তেহিল্লিম (sefer tehillim) । এর অর্থ ছিল প্রশস্তি-গ্রন্থ। ধারণা করা হয় এই সঙ্গীত-সংকলনটি খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীর আগেই রচিত হয়েছিল। এতে ছিল দাউদের ৭৩টি গান, আসাফের ১২টি গান এবং কোরাহ-বংশীয় বাদক দলের ১১টি গান। হিব্রু থেকে গ্রিক ভাষার বাইবেল রচনার সময় এর নাম দেওয়া হয়েছিল প্সাল্মই (Psalmoi) পরে এই শব্দ থেকে গ্রিক শব্দ psalmos শব্দের উৎপত্তি ঘটেছিল। এই গানের সাথে সংঙ্কলনের এর অর্থ গ্রহণ করা হয়েছিল- 'এমন ধর্মসঙ্গীত যা তারযন্ত্রের সাথে গীত হয়'। এই সময় সেমেটিক ভাষা থেকে ইন্দো-ইউরোপিয়ান ভাষায় কৃতঋণ শব্দ হিসেবে যুক্ত হয়েছিল psalmos শব্দ। ল্যাটিন ভাষায় এর নাম হয়েছিল psalmus । আর প্রাচীন ইংরেজি ভাষায় শব্দটি প্রবেশ করেছিল psealm হিসেবে।

খ্রিষ্টপূর্ব ১৮০০ থেকে ১৫০০ অব্দের ভিতরে ইন্দো-ইউরোপিয়ান ভাষাগোষ্ঠী যখন ভারতে আর্য ভাষা-ভাষী হিসেবে প্রবেশ করেছিল, তখন প্রাক্-বৈদিক ধর্মদর্শন এবং ধর্মানুষ্ঠানের নির্ধরিত গানের ব্যবহার তাদের জানা ছিল। বৈদিক যুগে ভাষার বিবর্তনে psealm হয়ে গিয়েছিল সাম গান। বাংলায় বাইবেল অনুবাদের সময় এই গানকে সামসঙ্গীত নামে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।


ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ক্রমবিবর্তনের ধারায় খ্রিষ্টীয় প্রথম শতাব্দীর ভিতরে গন্ধর্বার সেকালের সঙ্গীতকে বিধিবদ্ধ কাঠামোর মধ্যে আনার জন্য সৃষ্টি করেছিলেন গ্রাম। এই পর্যায়ের প্রথমে সৃষ্টি হয়েছিল ষড়্‌জ গ্রাম। এই বিস্তার ছিল মূলত মন্দ্র সপ্তকে। এরপর মধ্য ও তার সপ্তকে জন্য সৃষ্টি করেছিলেন মধ্যম  ও গান্ধার গ্রাম। 

গ্রাম থেকে উৎপন্ন হয়েছিল মূর্ছনা। পরবর্তীয় পর্যায়ে মূর্ছনা থেকে তৈরি হয়েছিল গ্রামরাগ। সে সময়ের লৌকিক গানের নানা প্রকরণ প্রচলিত ছিল। দশটি রাগলক্ষণের দ্বারা অন্যান্য গান থেকে
গ্রামরাগ পৃথক হয়ে গিয়েছিল। রাগের আদি রূপ তথা গ্রামরাগ সৃষ্টি করেছিলেন গন্ধর্বরা।

খ্রিষ্টপূর্ব ৬০০-৫০০ অব্দের ভিতরে রচিত বাল্মীকি রামায়ণে পাওয়া যায় মূর্ছনার কথা। এই গ্রন্থের
আদিকাণ্ডের চতুর্থ সর্গে উল্লেখ আছে, বাল্মীকি রামের দুই পুত্র কুশী ও লবকে রাম-সীতার চরিত্রসহ রাবণ-বধ নামক কাব্য শেখান। কুশীলব এই কাব্য পাঠ করা ও গান হিসেবে পরিবেশন করার প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। এ বিষয়ে রামায়ণের এই অধ্যায়ে বলা হয়েছে-

'এই পাঠ ও গান মধুর, দ্রুত, মধ্য ও বিলম্বিতরূপে ত্রিবিধ-প্রমাণ-সংযুক্ত ষড়্‌জ ও মধ্যম প্রভৃতি সপ্তস্বর-সংযুক্ত, বীণালয় বিশুদ্ধ এবং শৃঙ্গার, করুণ, হাস্য, রৌদ্র, ভয়ানক ও বীর প্রভৃতি সমুদয়-রসসংযুক্ত। স্থান ও মূর্চ্ছনাভিজ্ঞ, গান্ধর্ব্ববিদ্যাভিজ্ঞ কুশী ও লব তাহা গাহিতে লাগিলেন। সুন্দরকাণ্ডের প্রথম সর্গে ১৭০তম অধ্যায়ে রয়েছে- হনুমান সীতাকে রাবণের নিকট থেকে এনে রামের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য আকাশপথে যাত্রা করেন। এই যাত্রাপথের বর্ণনায় পাওয়া যায় -'গীতনিপুণ গন্ধর্বগণে সমাবৃত..'।

স্থান ও মূর্চ্ছনাভিজ্ঞ, গান্ধর্ব্ববিদ্যাভিজ্ঞ কুশী ও লবের গান ছিল- গান্ধর্বসঙ্গীতজ্ঞদের গবেষণালব্ধ গান, যাতে মূর্ছনার ব্যবহার ছিল। এই বিচারে বলা যায়- এই সময়ে গ্রাম এবং মূর্ছনালবদ্ধ জাতি গানের আদিরূপ তৈরি হয়েছিল। তবে তখনো বিধিবদ্ধরূপে রাগের উৎপত্তি ঘটেনি। গৌতমবুদ্ধের (জন্ম: ৫৬৭-৫৬৩ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ, মৃত্যু ৪৮৭-৪৮৩ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ) ধর্মীয় দর্শনের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠা ধর্মীয় মতবাদ, সনাতন ধর্মেকে ভিন্নতর দর্শনের সন্ধান দিয়েছিল। সেই সূত্রে ভারতীয় সঙ্গীতের ভাবগত বিষয়ের নতুনত্বের সৃষ্টি হয়েছিল। গৌতমবুদ্ধের পূর্বজীবনের কাহিনিগুলো রচিত হয়েছিল খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীতে। প্রায় ৫০০টি জাতকের মধ্যে ১৫টি জাতকে গান সম্পর্কে উল্লেখ পাওয়া যায়। এই জাতকগুলো হলো- নৃত্য, ভেরীবাদক, বিশ্বম্ভর, কুশ, অসদৃশ্য, সর্বদ্রষ্ট, গুপ্তিল, ভদ্রঘট, বীণাস্থূণা, চুল্লু-প্রলোভন, ক্ষান্তিবাদি, কাকবতী, শঙ্খ, মৎস, বিদুরপণ্ডিত। এসকল জাতকে সঙ্গীতে বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায় না। গুপ্তিল জাতকে উত্তম ও মধ্যম মূর্ছনার নাম পাওয়া যায়। এ সকল গ্রন্থে কোনো রাগের নাম পাওয়া যায় না।

মূলত বৌদ্ধ ধর্মের দ্রুত বিকাশে, সনাতন ধর্মাবলম্বীরা কোঠাসা হয়ে পড়েছিল। গান্ধর্বরা ছিল মূলত বৈদিক ধর্মে দীক্ষিত। এঁরা সঙ্গীতকে গ্রহণ করেছিল ধর্মাচরণের অনুষঙ্গ হিসেবে। বৌদ্ধ ধর্ম সঙ্গীত-চর্চা নিষিদ্ধ ছিল না। এঁদের ধর্মগুরুরা গানের মধ্য দিয়ে ভক্তি প্রকাশের চেয়ে ধ্যন ও জ্ঞানের  চর্চার মধ্য দিয়ে নির্বাণ লাভের চেষ্টায় নিমগ্ন হয়ে পড়েছিল।

বহিরাগতদের আক্রমণে গান্ধর রাজ্যের স্বাভাবিক পরিস্থিতি বার বার বিঘ্নিত হয়েছে।
খ্রিষ্টপূর্ব ৫৫০ থেকে ১০০ অব্দের ভিতরে গান্ধার রাজ্যের জনজীবনের স্বাভাবিক ছন্দ হারিয়ে গিয়েছিল। তবে এই অস্থির পরিবেশের ভিতরে গান্ধর্ব ঋষিরা তাঁদের ভাষা ও সঙ্গীতের গবেষণা বজায় রেখেছিলেন। সেকালের সঙ্গীতবিষয়ক ধারণ পাওয়া যায় কতিপয় 'শিক্ষা' নামক গ্রন্থাদিতে থেকে। এই রাধার গ্রন্থাদির মধ্যে বিশেষ স্থান দখল করে আছে- পাণিনীর (খ্রিষ্টপূর্ব ৫০০-৪০০) রচিত অষ্টাধ্যায় এবং পাণিনীয় শিক্ষা।

পাণিনীয় শিক্ষায় বলা হয়েছে 'স্বরস্ত্রয়' থেকে সাত স্বরের উৎপত্তি ঘটেছিল। বৈদিক শাস্ত্রীয় স্বরের নামের পরিবর্তে লৌকিক নাম ব্যবহার করেছেন। এই গ্রন্থ মতে-

উদাত্তে নিষাদগান্ধারাবানুদাত্তঋষভধৈবতৌ
স্বরিতঃ প্রভবা হোতো ষড়্‌জমধ্যমপঞ্চমাঃ॥

উদাত্ত থেকে - নিষাদ ও গান্ধার, অনুদাত্ত থেকে ঋষভ ও ধৈবত এবং স্বরিত থেকে ষড়্‌জ, মধ্যম ও পঞ্চমের উৎপত্তি হয়েছে। স্বরের উৎপত্তি স্থান হিসেবে ৮টি অধিষ্ঠানের উল্লেখ করা হয়েছে। এগুলো হলো- উরঃ, কণ্ঠ, শির, জিহ্বামূল, দন্ত, নাসিকা, ওষ্ঠ ও তালু। এছাড়া স্বরে উৎস হিসেবে পশুপাখির কণ্ঠস্বরের উল্লেখ করেছেন।

পাণিনীয় শিক্ষার পরে যাজ্ঞবল্ক্য শিক্ষা এবং মাণ্ডুকী শিক্ষা গ্রন্থাদিতে মূলত স্বরের উৎপত্তি, নামকরণ ইত্যাদি নিয়ে আলোচিত হয়েছে। মূলত আদর্শিক সঙ্গীতবিষয়ক পাঠ পাওয়া যায়, খ্রিষ্টীয় প্রথম শতাব্দীতে রচিত নারদীয় শিক্ষায়। 

খ্রিষ্টীয় প্রথম শতাব্দীতে রচিত
নারদের রচিত 'নারদীয় শিক্ষা' গ্রন্থের প্রথম প্রপাঠকের চতুর্থ কণ্ডিকার ৮-১১ শ্লোকে পাওয়া যায় ৭টি গ্রামরাগের কথা। এগুলো হলো- ষড়জগ্রাম, পঞ্চম, কৈশিক, কৈশিকমধ্যম, মধ্যমগ্রাম, সাধারিত ও ষাড়ব। এই গ্রামরাগুলোর নাম ছাড়া প্রাসঙ্গিক কোনো বিষয়ে নারদীয় শিক্ষা থেকে জানা যায় না।

খ্রিষ্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দীর ভিতরে গ্রামরাগভিত্তিক জাতি গানের উদ্ভব হয়েছিল। এর প্রভাব ছড়িয়ে পড়েছিল অন্যান্য দেশী গীতসমূহে। তবে শাস্ত্রীয় বিধিতে এই গ্রামরাগগুলো সবচেয়ে বেশি এবং গুরুত্বের সাথে ব্যবহৃত হতো- নাটকের ধ্রুবাগান হিসেবে। জাতিগানের সুর গ্রামরাগ ভিত্তিক হলেও এই গানগুলো ব্যবহারের সুনির্দিষ্ট রীতি ছিল। যেমন- এই জাতিগানগুলো নাটকের কোথায় ব্যবহৃত হবে, এর তাল এবং রস কি হবে তা সুনির্দিষ্ট করা ছিল। ফলে জাতি গানে গ্রামরাগগুলো অনেকটাই বদ্ধ দশায় পতিত হয়েছিল।

নাট্যশাস্ত্রের অষ্টাবিংশ অধ্যায়ের ৪০ থেকে ৪৩ সংখ্যাক শ্লোকে ১৮ প্রকার জাতির নাম পাওয়া যায়। এই জাতিগানগুলো ষড়্‌জ ও মধ্যম গ্রাম অনুসারে সাজানো হয়েছিল। এর ভিতরে ষড়্জ গ্রামে ছিল ৭টি জাতিগান। এর ভিতরে ৪টি ছিল শুদ্ধজাতি এবং ৩টি ছিল বিকৃত জাতি। পক্ষান্তরে মধ্যম জাতির গান ছিল ১১টি। এর ভিতরে ৩টি ছিক শুদ্ধজাতির এবং ৮টি ছিল বিকৃত জাতির।

নিচে এই জাতিগানগুলোর শ্রেণিকরণ দেখানো হলো।

জাতিগানের সুরের কাঠামো ছিল গ্রামরাগ। এই গ্রন্থে গ্রামরাগের দশটি লক্ষণ আর জাতিগানের লক্ষণ একই ছিল। এই কারণে অনেক সময় জাতিগানকে জাতিরাগ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। নাট্যশাস্ত্রের অষ্টাবিংশ অধ্যায়ের ৭৬ -৭৭ সংখ্যক শ্লোকে সরাসরি 'রাগ' শব্দটি দিয়ে রাগের বৈশিষ্ট্য সন্পর্কে বলা হয়েছে-

'গানের সেই স্বর দশলক্ষণযুক্ত অংশ, যার উপরে রাগ নির্ভর করে; পঞ্চস্বরের উপরে নির্ভর্শীল মন্দ্র ও তারের পরিবর্তনের এটি মূল। অনেক স্বরের মিলনে এট স্পষ্টতমরূপে অনুভূত হয়; অন্যান্য স্বর প্রবল স্বর এবং সঙ্গে সংবাদী বা অনুবাদী রূপে সম্বন্ধ হয় এবং এটি গ্রহ, অপন্যাস, বিন্যাস, সংন্যাস ও ন্যাস (স্বরের) সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত থাকে।'

জাতিগানের দশটি লক্ষণ
নাট্যশাস্ত্রের অষ্টাবিংশ অধ্যায়ের ৭৪ সংখ্যক শ্লোকে জাতিগানের দশটি লক্ষণের উল্লেখ করা হয়েছে। এগুলো হলো- গ্রহ, অংশ, তার, মন্দ্র, ন্যাস, অপন্যাস, অল্পত্ব, বহুত্ব, ষাড়বত্ব ও ঔড়বত্ব।

১. গ্রহ: যে স্বর থেকে গান শুরু হয়। একে বলা হয়েছে অংশের বিকল্প। দুই গ্রামে গ্রহস্বরের সংখ্যা ছিল ৬৩টি। [২৮।৭৫]
দুই গ্রামে অংশস্বরের সংখ্যা ৬৩টি। [২৮।৭৯]

২. অংশ:
এই স্বরের উপর রাগ নির্ভর করে।  গ্রহ, অপন্যাস, বিন্যাস, সংন্যাস ও ন্যাস -এর সাথে সম্বন্ধযুক্ত থাকে। এটি গানের সর্বত্র ছড়ানো থাকে। দুই গ্রামে অংশস্বরের সংখ্যা ৬৩টি। [২৮।৭৬-৭৯]
 
নাট্যশাস্ত্রের অষ্টাবিংশ অধ্যায়ের ৮০-৯৪ শ্লোকে জাতিতে ব্যবহৃত গ্রহ ও অংশ স্বরের কথা বলা হয়েছে। যেমন-

৩. তার: এটি মূলত রাগের গতি। এর প্রয়োগ হয় রাগের প্রথম পাঁচ স্বরের উপর। মূলত অংশ স্বর থেকে চতুর্থ স্বর পর্যন্ত অথবা পঞ্চম স্বর পর্যন্ত তারগতি হবে। অংশ স্বর পঞ্চম বা সপ্তম পর্যন্ত হতে পারে। [২৮।৯৪]
৪. মন্দ্র: মন্দ্র গতি তিন প্রকার।

১. নিম্নগ্রামের অংশের উপর নির্ভরশীল।
২. ন্যাসের উপর নির্ভরশীল
৩. অপন্যাসের উপর নির্ভরশীল।   [২৮।৯৪-৯৫]

৫. ন্যাস: এই অংশে রাগের আলাপ বা বিকাশ ঘটে। এবং রাগের অংশবিশেষের বা সম্পূর্ণ অংশের পূর্ণতা লাভের পর যে স্বরে সমাপ্তি ঘটে। এর সংখ্যা ২১ প্রকার।  [২৮।৯৪-৯৫]  [২৮।১০০]
৬. অপন্যাস: গানের মধ্যবর্তী সমাপ্তি হয় যে স্বরে। এর সংখ্যা ৫৬টি [২৮।৯৪-৯৫]  [২৮।১০০]

নাট্যশাস্ত্রের অষ্টাবিংশ অধ্যায়ের ১০১- শ্লোকে জাতিতে ন্যাস ও অপন্যাসের বিষয় বলা হয়েছে। যেমন-

৭. অল্পত্ব: যে স্বর রাগে অল্প ব্যবহৃত হয়। জাতিরাগে অল্পত্ব ছিল দুই ধরনের। এই ধরণ দুটি হলো- অনভ্যাস ও লঙ্ঘন। যে স্বরের প্রায় ব্যবহৃত হয় না বা যে স্বর বর্জন করা হয়। তাকে বলে অনভ্যাস। পক্ষান্তরে যে স্বর সামান্য ব্যবহার করা হয়, তাকে বলা হয় লঙ্ঘন।  [২৮।৯৬-৯৭]
৮.বহুত্ব: যে স্বর অধিক ব্যবহার করা হয়।
৯. ষাড়বত্ব: যে রাগে ৬টি স্বর ব্যবহৃত হয়। এর সংখ্যা ১৪ প্রকার। এর বিভাগ ৪৭টি।  [২৮।৯৮]
১০ ঔড়বত্ব: যে রাগে ৫টি স্বর ব্যবহৃত হয়। উল্লিখিত লক্ষণের বিচারে জাতি রাগ হতে গেলে কমপক্ষে ৫টি স্বর থাকতেই হতো। অর্থাৎ আর্চিক, গাথিক, সামিক এবং স্বরান্তরের সুরবিন্যাসকে জাতি রাগ হিসেবে গ্রহণ করা হতো না।  [২৮।৯৯]

ভরতের সময়ে কণ্ঠসঙ্গীতের সাধারণ নাম ছিলমগীত। তিনি গীতকে ৪টি ভাগে ভাগ করেছিলেন। এই ভাগগুলো হলো- মাগধী, অর্ধ-মাগধী, সম্ভাবিতা ও পৃথুলা। ভরতের এই ভাগটি ছিল মূলত সুরের প্রায়োগিক দিক। যেমন-

  • মাগধী (এই গান তিনবার আবৃত্তির পর সমাপ্ত হতো)
  • অর্ধমাগধী (এই গান মাগধীর অর্ধকালে সমাপ্ত হতো)
  • সম্ভাবিতা (গুরু অক্ষরের সমন্বয়ে এই গান তৈরি হতো)
  • পৃথুলা (লঘু অক্ষরের সমন্বয়ে তৈরি হতো)

এর দ্বারা গীতে রাগ প্রয়োগের বিধিকে নির্দেশিত করা হয়েছে বটে, কিন্তু রাগের শ্রেণিকরণে কোনো বিশেষ ভূমিকা রাখে নি।

ভরতের সময় গ্রামরাগ ভিত্তিক জাতি গানের বাইরে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে গ্রামরাগের উদ্ভব হয়েছিল। সম্ভবত তিনি এই রাগগুলোকে গ্রামরাগের পদমর্যাদা দিতে চান নি। তবে তাঁর পুত্র এবং শিষ্যরা এই রাগগুলোর গুরুত্ব অনুধাবন করে, রাগের অন্তর্ভুক্ত করতে চেয়েছিলেন।

খ্রিষ্টীয় তৃতীয় শতাব্দীতে ভরতের শতপুত্র এবং শিষ্যদের মাধ্যমে গীতের নতুন শ্রেণিগত বিভাজনের একটি রূপরেখা স্পষ্ট হয়েছিল। খ্রিষ্টীয় দ্বিতীয়-তৃতীয় শতাব্দীতে
ভরতের পুত্র শার্দুল বলেছিলেন- গীত এক প্রকার, তা হলো- ভাষাগীতি। [বৃহদ্দেশী। রাগ। পৃষ্ঠা: ১৩৪]

শার্দুল গ্রামরাগ-ভিত্তিক জাতিগানকে মেনে নিয়ে- শাস্ত্রীয় গান হিসেবে ভাষাগানকে গীত হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। সম্ভবত শার্দুলের অন্যান্য গীতের মধ্যে ভাষাগীতকে মুখ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। এবং সম্ভবত তাঁর সময়ে ভাষাগীতের পাশাপাশি অন্যান্যা গীতের যথার্থ বিকাশ ঘটেনি। তিনি ভাষা গীতির অন্তর্গত কয়েকটি রাগের উল্লেখ করেছিলেন।
াঁর মতে এই সকল ভাষা রাগ এবং এর অন্তর্গত বিভাষা রাগগুলো ছিলো

খ্রিষ্টীয় চতুর্থ শতাব্দীতে দুর্গাশক্তি, পাঁচ প্রকার গীতের কথা উল্লেখ করেছিলেন। এগুলো হলো- শুদ্ধা, ভিন্না, বেসরা, গৌড়ী এবং সাধারিতা। লক্ষণীয় বিষায় এই তালিকায় ভাষাগীতের উল্লেখ্য নেই। কিন্তু তার সমসাময়িক সঙ্গীতজ্ঞ যাষ্টিক গীতের তিনটি প্রকরণের কথা বলেছিলেন। এগুলো হলো- ভাষা, বিভাষা ও অন্তরভাষা। [বৃহদ্দেশী। রাগ। পৃষ্ঠা: ১৩৩-১৩৪]

খ্রিষ্টীয় চতুর্থ শতাব্দীতে যাষ্টিক সেকালের প্রচলিত রাগগুলোকে একটি আদর্শিক শ্রেণিকরণের চেষ্টা করেছিলেন।  তাঁর মতে মূলরাগগুলোকে ভিন্নভাবে উপস্থাপনের সূত্রে ভাষারাগের উদ্ভব হয়েছিল। তাঁর মতে মূলরাগ বা গ্রামরাগ ছিল ১৬টি। এই রাগগুলো থেকে উৎপন্ন হয়েছিল ভাষারাগগুলো। নিচে গ্রামতাগ এবং এর অন্তর্গত ভাষারাগগুলোর তালিকা দেওয়া হলো ।

রাগের ক্রমবিকাশে বৃহদ্দেশীর অবদান
খ্রিষ্টীয় ষষ্ঠশতাব্দী পর্যন্ত রাগ-ভিত্তিক সঙ্গীতের ধারায় গ্রামরাগের আদিরূপের সাথে যুক্ত হয়েছিল আরও বহু দেশী রাগ। এই সময়ের ভিতরে গ্রামরাগের পরিবর্তে শুধু রাগ শব্দটিই প্রাধান্য পেতে শুরু করেছিলে। এই সময়ে মতঙ্গ তাঁর রচিত বৃহদ্দেশী গ্রন্থে- সেকালের প্রচলিত রাগের কাঠামোগত পরিচয়ের পাশাপাশি রাগের শ্রেণিকরণের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তাঁর মতে গীত ছিল ৭ প্রকার। এগুলো হলো- চোক্ষ, ভিন্নকা, গৌড়িকা, রাগগীতি, সাধারণী, ভাষা ও বিভাষা।

মোট কথা ভরত থেকে মতঙ্গের আমল পর্যন্ত গীতের প্রকরণ করা হয়েছিল, গ্রামরাগ এবং অন্যান্য দেশী রাগের ভিত্তিতে। তাই গীতের শ্রেণিকরণের সূচনা হয়েছিল গ্রামভিত্তিক। তখন এর সাধারণ নাম ছিল গ্রামরাগ। ভরতের আমলে জাতিগানের আড়ালে গ্রামরাগ চাপা পড়ে গিয়েছিল। কিন্তু জাতিগানের শ্রেণিকরণ করা হয়েছিল গ্রামরাগের ভিত্তিতে। পরবর্তী সময়ে রাগের শ্রেণিকরণে  শ্রেণিকরণে বিশেষ স্থান দখল করে নিয়েছিল গীত। গীত ও রাগের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয়ের একটি সূত্র পাওয়া যায় বৃহদ্দেশীতে। বৃহদ্দেশীতে উল্লিখিত সূত্রটি হলো- 'গীতে স্বরাদির বিন্যাসে যে দশলক্ষণ লক্ষিত হয়, সেটিই রাগ। তাদের কোথাও অংশ, গ্রহ, অপন্যাস, ন্যাস ও স্বরাদির আরোপ হয়; এইগুলি মন্দ্রত্ব এবং তারত্ব,- এই দুটির পরিপ্রেক্ষিতে যোজিত হয় এবং কোথাও অল্পত্ব, কোথাও বহুত্ব পরিলক্ষিত হয়। এতদ্ব্যতীত আক্ষেপ, নিষ্কাম, প্রসাদিক এবং অন্তরা,- এই পাঁচপ্রকার ধ্রুবাগানেও (নাট্যসঙ্গীতে) গ্রামসমূহ সংযোজিত হয়।[পৃষ্ঠা: ১৮৭-১৮৮]

মতঙ্গ তাঁর সময়ের প্রচলিত রাগগুলোর প্রকৃতি অনুসারে গ্রামরাগ এবং অন্যান্য দেশী রাগগুলোকে শ্রেণিকরণে 'গীত' শব্দটিকে শব্দ-ঊর্ধ্বক্রমবাচকতার সোপানে বিন্যস্ত করেছিলেন। এই শ্রেণি বিভাজনের উচ্চধাপে ছিল গ্রাম। এরপর নিম্নক্রমিক ধারাটি ছিল- গ্রামরাগ> জাতিরাগ> গীত> গ্রামরাগ ভিত্তিক গীত> রাগ।

গীত ও রাগের নির্দেশনার পরেও এই সময়ে গীত হয়ে উঠেছিল গ্রামরাগ বা রাগের সমার্থক। সঙ্গীতরত্নকরের রাগবিবেকাধ্যায়ের ২-৩ শ্লোকে বলা হয়েছে- পাঁচটি গীতির আশ্রয়হেতু গ্রামরাগ পাঁচ প্রকার। যথা- শুদ্ধা, ভিন্না, গৌড়ী, বেসরা ও সাধারণী। এর আগে বৃহদ্দেশীতে গীতের বিভাজন করা হয়েছিল গ্রামরাগ এবং দেশী রাগের ভিত্তিতে। এই কারণে- গীতের বাইরে এসে অতিরিক্ত আরো কয়েকটি রাগপ্রকৃতিকে রাগবর্গীকরণের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। এগুলো ছিল- ভাষারাগ, বিভাষারাগ, অন্তরভাষারাগ, উপরাগ। প্রতিটি ভাগে কতগুলো রাগ ছিল, তার সংখ্যা নির্দেশ করা হয়েছে।

খ্রিষ্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীর ভিতরে প্রচলিত রাগ
খ্রিষ্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীর ভিতরে রাগ হিসেবে পাওয়া যায়- ১৮টি গ্রাম এবং এবং গীতির প্রকরণের বিষয়টিকে শ্রেণি হিসেব উল্লেখের বাইরে পাওয়া যায়- দেবলবধনী, পৌরালী, ত্রাবণী, তানলতিকা, দেহ্যা, শার্দূলী, ভিন্নলতিকা, রবিচন্দ্র, ভিন্নপৌবালী, দ্রাবিড়ী, পিঞ্জরীম পার্বতী, টঙ্ক
রাগগুলোর নাম।

বৃহদ্দেশীতে বর্ণিত গীতিপ্রকরণের তালিকা

রাগের শ্রেণিকরণের ধারায় আরও কিছু রাগের পরিচয় পাওয়া যায়। এগুলো হলো- অন্তরভাষ রাগ ও উপরাগ।

মূলত খ্রিষ্টীয় ত্রয়োদশ শতাব্দীর ভিতরে আরও বহুবিধ রাগের উৎপত্তি হয়েছিল। খ্রিষ্টীয় ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষ ভাগে সুলতান আলাউদ্দীন খিলজির সভাকবি- আমির খসরু, দেশী রাগের চর্চার পাশাপাশি আরব-পারশ্যের রাগের সংমিশ্রণে নতুন কিছু রাগ তৈরি করেছিলেন।

খ্রিষ্টীয় সপ্তদশ শতাব্দীর ভিতরে ভারতীয় রাগসঙ্গীতের ধারায় বহু প্রচীন রাগ বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। আবার দেশীর সুরাবলম্বনে নতুন নতুন রাগের উদ্ভব হয়েছিল।  খ্রিষ্টীয় সপ্তদশ শতাব্দীর শেষার্ধে থেকে অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে লোচন শর্মার রচিত 'রাগতরঙ্গিনী' গ্রন্থে এরূপ রাগের নাম পাওয়া যায়। এই গ্রন্থে ৬টি রাগকে আদি রাগ হিসেবে চিহিত করা হয়েছিল। এগুলো হলো- ভৈরব, কৌশিক, হিন্দোল, দীপক ও শ্রী

তিনি পারশ্যের রাগকে ভারতীয় শাস্ত্রীয় কাঠামোতে তৈরি করেছিলেন ইমন রাগ। পরে এই রাগের সাথে অন্যান্য রাগের মিশ্রণ ঘটিয়ে তৈরি করেছিলেন ইমন-পুরিয়া, ইমন-ভূপালী, ইমন-বিলাবল, ইমন বেহাগ, ইমন কল্যাণ। ফকিরুল্লা'র রাগ দর্পণ গ্রন্থ থেকে ১২টি এরূপ ১২টি রাগের তালিকা পাওয়া যায়। এর বাইরে পাওয়া যায়-

এছাড়া তিনি প্রণয়ন করেছিলেন- ঝিঁঝিট, যমনী, তুরস্ক-গৌড়, তুরস্ক টোড়ি, বাহার, আলাইয়া বিলাবল, সাহানা, অাড়ানা, মোহনী. সুহ. সুখরাই, রুলীক, মারু, পিলু, বারওয়া, লুম ইত্যাদি।
 

তথ্যসূত্র:
  • নাট্যশাস্ত্র (চতুর্থ খণ্ড)। ভরত। বঙ্গানুবাদ সুরেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। নবপত্র প্রকাশন। পঞ্চম মুদ্রণ ডিসেম্বর ২০১৪।
  • বঙ্গীয় শব্দকোষ। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়
  • বৃহদ্দেশী। মতঙ্গ। রাজ্যেশ্বর মিত্র সম্পাদিত। সংস্কৃত পুস্তক ভাণ্ডার। কলকাতা। ১৯৯২।
  • ভারতীয় সঙ্গীতের ইতিহাস । প্রথম খণ্ড। স্বামী প্রজ্ঞানন্দ
  • ভারতীয় সঙ্গীতকোষ। শ্রীবিমলাকান্ত রায়চৌধুরী। বৈশাখ ১৩৭২।
  • সঙ্গীতরত্নাকর। সুরেশচন্দ্র অনূদিত।  রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়। কলকাতা। ২২ শ্রাবণ ১৪০৮।